অপরিচিত পর্বঃ ০৫

0
978

অপরিচিত পর্বঃ ০৫
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা

মিমির থাপ্পড় খেয়ে অবাক হয়ে তাকায় আরফা মিমির দিকে । গাল ব্যাথায় টনটন করছে কিন্তু আরফার সেদিকে খেয়াল নেই।

মিমি রেগে বললো, কেনো এমন করছিস বলতে পারিস আমাকে ? কার জন্য নিজের মায়ের চোখের পানি ঝাড়াচ্ছিস আর বাবার স্বপ্ন দাফন করছিস বলবি একটু ?

আরফা বললো, মিমি আমি,,,,

আরফার মুখের কথা শেষ করতে দিলো না মিমি। তার আগেই মিমি আবার বলে উঠলো, আমি জানি তোর লাইফে যা ঘটে গেছে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। তোর পাশে তো নিজের মা আছে আমি আছি তাও কেনো একটা প্রতারকের জন্য কষ্ট পেয়ে এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করছিস বলবি আমায়। সবার চোখের আড়াল করতে পারলেও আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবি না আরফা। তোর এই রেজাল্টের কারণ যতটা না তোর বাবার মৃত্যু তার থেকে অনেক বেশি দায়ী রুমানের ধোঁকা। এখনো সময় আছে আরফা এভাবে সব ধ্বংস করিস না। ভুলে যা সব আর নতুন করে পথ চলতে শুরু কর। জীবনের অনেকটা পথ সামনে পরে আছে এখন যদি নিজেকে শুধরে ফেলতে না পারিস তাহলে একদিন রুমান তোকে দেখে আফসোস করবে না বরং তুই নিজেকে দেখে আফসোস করবি।

আরফা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে তার বলার মতো কিছু নেই।

মিমি আবার বললো, আরফা অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব। কী ছিলি, কী হয়েছিস আর কী হতে চলেছিস ? অতীত ধরে বসে থেকে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এভাবে নষ্ট করিস না। তোর বাবা হয়তো কবরেও শান্তি পাবে না তোকে দেখে। তোর জন্যই তো এতো কিছু করেছে তোর বাবা ? ভাব আরফা ভাব কার জন্য নিজের বাবা-মাকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই।

মিমি আর কিছু না বলে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো আর আরফা ধীর পায়ে চলে গেলো আলতাফের কবরের পাশে। থপ করে বসে পড়লো কবরের পাশে। চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে লাগলো। সত্যি তো কার জন্য কষ্ট দিচ্ছে নিজের বাবা-মাকে। কার জন্য দাফন করছে নিজের বাবার স্বপ্ন, তার ত্যাগ।

মিমির কথাগুলো মেডিসিনের মতো কাজ করেছিলো আরফাকে সঠিক পথে আনার। তাইয়েবা আরফাকে রেজাল্ট নিয়ে কিছুই বলেনি পরদিন সকালে এমন ব্যবহার করেছিলো যেনো গতকাল কিছুই হয়নি। সেটা দেখে আরফা নিজেকে আরো অপরাধী ভাবতে থাকে। পরদিন আরফা গিয়ে মিমিকে সরি বললে মিমি আরফাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। সরি বলে থাপ্পড় মারার জন্য। স্কুল থেকে এসে আরফা আলতাফের কবরের কাছে গিয়ে কিছু করছে দেখে তাইয়েবা দৌড়ে যায় সেখানে।

তাইয়েবা ব্যস্ত হয়ে বলে, আরফা তুই এখানে কী করছিস ? মেয়েদের কবরের কাছে যেতে নেই জানিস না ?

আরফা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু করছি না আমি। একটা বকুলের চারা লাগালাম কবরের সামনে।

তাইয়েবা খেয়াল করে দেখলো আলতাফের করবের মাথার সামনে একটা ছোট বকুল চারা লাগিয়েই আরফা। সেটা দেখে জিজ্ঞেস করলো, এটা এখানে কেনো লাগিয়েছিস ?

আরফা কবরের দিকে তাকিয়ে বললো, এই গাছটা যখন বড় হয়ে ফুলে ফুলে ভড়ে উঠবে তখন আমি একজন সফল ডাক্তার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করে দাঁড়াবো বাবার করবের সামনে। ডাক্তার হয়ে প্রথম ফুলের শুভেচ্ছা আমি আমার বাবার থেকেই নিতে চাই। বাবা তো আর দিতে পারবে না এই গাছ থেকে ফুল ঝরে যখন আমার উপর পড়বে আমি মনে করে নিবো বাবাই আমাকে ফুলের শুভেচ্ছা দিচ্ছে।

একথা বলে আরফা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তাইয়েবা মেয়ের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন আর বললেন, আল্লাহ যেনো তোর মানের আশা পূরণ করে মা।

আরফা চেঞ্জ হয়ে যেতে লাগলো। নিজের যত্ন না নিলেও বুকল চারাটার যত্ন নিতে ভুলে না সে। আর ঠিক তেমনি ভুলে না নিজের পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতে। বছরের অর্ধেকটা নষ্ট করে ফেলেছে সে তাই অনেক বেশি কষ্ট করছে সেটা পূরণ করতে। একবছরের পড়া তাকে ছয়মাসে শেষ করতে হবে। মেয়েকে আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হতে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস নেন তাইয়েবা।

চার ঋতুর দেশ কানাডা—ডিসেম্বর, জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস শীতকাল কানাডায়। শীতের শেষে আসে বসন্তকাল। মার্চ, এপ্রিল আর মে মাস হলো কানাডার বসন্তকাল। জুন, জুলাই আর আগস্ট এই তিন মাস হলো কানাডার গ্রীষ্মকাল। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এই বাকি তিন মাস হলো শরৎকাল। এখন মে মাস মানে বসন্তকাল চলছে কানাডায়। গাছে গাছে শুধু ফুল আর ফুল। নানান জাতের গাছ রয়েছে, যেগুলোতে কোনো পাতাই দেখা যাচ্ছে না, আছে বিভিন্ন রঙের ফুল। যেন এক সাজানো বাসরসজ্জা। মানুষজন বাড়ির আঙিনায় নানা জাতের ফুলের গাছ লাগিয়েছে। এখনো কিন্তু বেশ শীত পড়ে। সবাই গ্রীষ্মকালের জন্য অপেক্ষা করছে। শুরুও হয়ে গেছে গ্রীষ্মকালের পোশাকের কেনাকাটা। ফুলগুলো যেন তাড়াতাড়ি ঝরে যাচ্ছে কানাডিয়ানদের গ্রীষ্মের আনন্দ দেওয়ার জন্য। সুন্দরী মেয়েদের পোশাকই বলে দিচ্ছে আবার চলে এসেছে কানাডার সুদিন, মানে গ্রীষ্মকাল। গাড়িতে বসে সুন্দর প্রকৃতি দেখছে সিনথিয়া। গ্রাজুয়েশন শেষ করে মেহরাব মেডিকেল পড়া শুরু করেছে। প্রথমে ভর্তি হতে না চাইলেও পরে রাজি হয়ে যায় মমের কথায়। আর প্রথমে মেহরাব এই পেশাকে ঘৃণা করতো কারণ তার ধারণা ছিলো এই পেশার জন্যই তার মম তাকে সময় দেয় না। সেই ভুল ভাঙার পর মেডিকেল পড়া নিয়ে তার আর আপত্তি ছিলো না তেমন। তাই শেষ পর্যন্ত পড়া শুরু করে দেয়। মেডিকেল পড়ার পাশাপাশি মেডিসিন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাও করতে শুরু করেছে সে। সিনথিয়া একই কলেজে পিএইচডি শুরু করেছে। সাথে দুজনের প্রেমও চলছে সমান তালে। সিনথিয়া মাঝে মাঝে মেহরাবকে দেখে অবাক হয়। আগে মনে হতো সিনথিয়া মেহরাবকে বেশি ভালোবাসে কিন্তু এখন মনে হয় সিনথিয়া যতোই ভালোবাসুক মেহরাবের ভালোবাসার সামনে কম পরে যাবে। মেহরাব সিনথিয়াকে গাড়িতে বসতে বলে কোথায় যেনো গেছে। সিনথিয়া গাড়িতে বসে এসব চিন্তা করছিলো তখনই মেহরাব একটা আইসক্রিম নিয়ে এসে সিনথিয়ার হাতে দিয়ে গাড়ি স্ট্রার্ট দিলো।

আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে সিনথিয়া বললো, এখন আইসক্রিম ?

মেহরাব বললো, কেনো কী সমস্যা ?

সিনথিয়া বললো, না সমস্যা নেই কিন্তু একটা কেনো, তুমি খাবে না ?

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, হ্যাঁ খাবো তো, খাবো না কেনো ?

সিনথিয়া মেহরাবের দিয়ে তাকিয়ে বললো, তাহলে তোমারটা কোথায় ?

মেহরাব সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, সব সময় তোমার আমার করো কেনো ? যা তোমার তাই আমার আর যা আমার তাই তোমার । শেয়ার করে খাবো, জানো তো শেয়ার করলে ভালোবাসা বাড়ে।

সিনথিয়া মাঝে মাঝে মেহরাবের পাগলামি দেখে অবাক হয়ে যায়। সেও কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেঁসে আইসক্রিম খোলে মেহরাবের দিকে এগিয়ে দিলো।

তা দেখে মেহরাব বললো, উহু আগে তুমি খাও তারপর আমি।

সিনথিয়া মনে মনে বললো, পাগল একটা।

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, আমার কী দোষ ? আমি তো ভালোই ছিলাম তুমি তো পাগল বানিয়ছো ভালোবাসতে শিখিয়ে।

মেহরাবের কথা শুনে সিনথিয়া কিছু না বলে মুচকি হাঁসলো। ছেলেটার জন্য মনে মনে কথা বলেও শান্তি নেই তার। মুখ দেখেই মনের কথা বুঝে যায়। সিনথিয়া কথা না বাড়িয়ে আইসক্রিম একটু খেয়ে মেহরাবের দিকে দিলো। সিনথিয়া যেখানে খেয়েছে তার উল্টো দিক মেহরাবের দিকে দিলে মেহরাব সিনথিয়ার হাত ধরে ঘুরিয়ে সেখানেই কামড় বসালো যেখানে সিনথিয়া খেয়েছে।

মেহরাব মুচকি হেঁসে বললো, বিয়ের আগে তো নাকি ঠোঁটের ছোঁয়া নিতে দেবে না। সরাসরি না পাই একটু অন্যভাবেই নাহয় তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া নিলাম।

মেহরাবের কথা শুনে সিনথিয়া একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মেহরাব তা দেখে মুচকি হেঁসে গাড়ি চালানোতে মন দিলো। দু’জনে শেয়ার করে আইসক্রিম শেষ করলো।

হঠাৎ সিনথিয়া বললো, আমার ইন্ডিয়া যেতে হবে একটু।

সিনথিয়ার কথা শুনে মেহরাব গাড়ি ব্রেক করে ফেললো। একটু ঝাঁকুনি খেয়ে সিনথিয়া মেহরাবের দিকে তাকালো।

মেহরাব জিজ্ঞেস করলো, ইন্ডিয়া কেনো যাবে ?

সিনথিয়া বললো; মেহরাব, ইন্ডিয়া আমার নিজের দেশ, আমার জন্মভূমি, আমার মাতৃভূমি। সেখানে আমার সব প্রিয়জন আছে। আজ চার বছর হতে চললো আমি কানাডায় আছি একবারও দেশে যাওয়া হয়নি। বাবার শরীররা ভালো যাচ্ছে না সে আমাকে দেখতে চাইছে।

মেহরাব আবার গাড়ি স্ট্রার্ট দিয়ে বললো, তোমার সব প্রিয়জন ইন্ডিয়াতে আছে। এখানে তোমার কোনো প্রিয়জন নেই ?

সিনথিয়া মুখ গোমড়া করে বললো, এভাবে কেনো বলছো ? আমি তো চিরদিনের জন্য যাচ্ছি না। বাবার সাথে দেখা করে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার চলে আসবো।

মেহরাব মলিন মুখে বললো, আমি তো তোমাকে না দেখে একটা বেলাও থাকতে পারি না সেখানে কয়েকটা দিন কীভাবে থাকবো ?

সিনথিয়া হাতের ফোনটা মেহরাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এটা আছে কী করতে ?

মেহরাব আগের মতো গুমরা মুখে বললো, এটাতে কথা বলে আমার পোষাবে না।

সিনথিয়া মেহরাবের গালে কিস করলো দুম করে আর মেহরাব গাড়ি ব্রেক করে সিনথিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।

সিনথিয়া ইনোসেন্ট ফেস করে বললো, এমন বাচ্চাদের মতো জেদ কেনো করছো ? আমি তো বাবার কাছে গিয়ে তোমার কথাও বলবো।

মেহরাব দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো, ঠিক আছে যেতে দেবো একটা শর্তে।

সিনথিয়া জিজ্ঞেস করলো, কী শর্ত ?

মেহরাব নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বললো, এখনই যেটা গালে দিলে সেটা এখানে দিতে হবে তাও যতক্ষণ না আমার মন ভরছে।

সিনথিয়া মেহরাবের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। প্রথমে মাথা দিয়ে না না ইশারা করলেও পরে দেওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে কিস করে বুঝতে পারলো সে ঠোঁটে নয় গালেই করেছে। তাই চোখ খোলে তাকালো।

মেহরাব বললো, এটা তো তখনই নিবো যখন তুমি নিজের ইচ্ছেতে দিবা। এখন গালেই ঠিক আছে। তবে শর্ত পূরণ করতে হবে অন্য একটা তারপর তুমি যাওয়ার অনুমতি পাবে।

সিনথিয়া জিজ্ঞেস করলো, কী শর্ত ?

মেহরাব আবার গাড়ি চালাতে লাগলো আর বললো, আগে এনগেজমেন্ট করে তারপর ইন্ডিয়া যেতে পারবে তার আগে না।

সিনথিয়া চিন্তিত হয়ে বললো, কিন্তু বাবা-মাকে না জানিয়ে এভাবে,,,,,

মেহরাব বললো, ভেবে দেখো তুমি ইন্ডিয়া যেতে চাও কিনা।

সিনথিয়া অনেক ভেবে রাজি হয়ে গেলো এনগেজমেন্ট করতে। মেহরাব খুশি হয়ে সিনথিয়াকে নিয়ে প্যালেসের দিকে যেতে লাগলো মমকে খুশির খবরটা সিনথিয়াকে সাথে নিয়েই দিতে চায় মেহরাব। সিনথিয়ার ইন্ডিয়া জার্নি বদলে দিতে চলছে ওদের জীবন সেটা দুজনের কেউই কল্পনায়ও আনতে পারছে না।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here