অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫৯
কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত সত্য হুটহাট করে দমকা হাওয়ার মতো এসে অনুভূতিগুলোকে সব এলোমেলো করে দিয়ে যায়। যেন সত্যিটা না জানলেই বোধ হয় ভালো হতো। তবুও সত্যিটা তো আর কখনো চাপা থাকে না। ঘটনাক্রমে না চাইতেও সামনে চলে আসে। ঠিক তেমনি হয়েছে অনির সাথে। একটু আগেও হৈ হুল্লোড় করে বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিল।কাজের চাপে তার দম নেয়ার ফুসরত টুকুও ছিল না। কিছু সময়ের ব্যবধানে তার হাসিমুখটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। বিষাদছায়ারা সব উপচে পড়েছে হৃদয় জুড়ে। মনের মাঝে কিছু অজানা অনুভূতিগুলো থেকে থেকে আর্তনাদ করে উঠছে।চাপা আর্তনাদগুলো বেরিয়ে আসার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। নীরব অনি রেহানা বেগমের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে তার জীবনের অসমাধিত সমীকরণ গুলো মেলাতে ব্যস্ত। আর কি কি সত্যি তার অজানা আছে?আর কতবার এভাবে তাকে অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের সম্মুখীন হতে হবে? নিজের জীবনের উপর এক অযাচিত অবসাদগ্রস্ততা চলে এসেছে। এত জটিলতার মাঝে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। সুখের রাস্তাটা কোনদিনই তার জন্য মসৃণ ছিল না। কখনো কখনো অমসৃণ এতটাই গভীর হয় যে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে হয়।
অতীত
হরেক রকমের আলোকবাতিতে আলোকিত বাড়িটাকেও যেন আজ নতুন কনের সদৃশ মনে হচ্ছ। আত্মীয় স্বজনদের আনাগোনাও বেড়েই গেছে। বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করতে করতে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। অনি রিশাদের দম ফেলবার ফুসরত নেই। বাড়ির বড়রা তাদের উপর সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এটা ওটার তদারকি করছে। অনি গৃহকর্ত্রী হয়ে আজ সকল দায়িত্ব পালন করছে। তার কাজের পারদর্শিতাও চোখে পড়ার মতো। আজ প্রকৃতরূপেই যেন বাঙালি এক গৃহবধূ হয়ে উঠেছে। সে যে জীবনের দীর্ঘ সময় যাবত দেশের সংস্কৃতি থেকে দূরে ছিল তা বোঝার যেন কোন উপায় নেই। যেটা পারছে না সেটা নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে সম্পন্ন করছে তো আবার কখনো শায়লা বেগমের কাছ থেকে শিখে নিচ্ছে। অন্যদিকে তার সহায়ক হিসেবে সর্বক্ষণের জন্য তার মাথার উপর ছায়া হয়ে রয়েছে রিশাদ।
ব্যস্ত অনি এক ডালি ফুল নিয়ে যাচ্ছিল উপরের দিকে। পার্লারের লোকজন এসে সাজাচ্ছে মিথিলা আর রিশাকে।সংগীত ও মেহেন্দির সকল প্রিপারেশন নেয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু বরপক্ষের আগমনের অপেক্ষা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই একজোড়া হাত এসে অনিকে বন্ধ দরজার আড়ালে নিয়ে যায়। আচমকা এরকম একটা ঘটনায় অনি কিছুটা আঁতকে ওঠে। তবে অনির সেই কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা দৃশ্যমান হওয়াত আতঙ্কিত সেই মুখটায় হাসি ফুটে ওঠে।
–উমম রিশাদ!এখন না প্লিজ আমার অনেক কাজ আছে। (অনি)
–হুশশ।সারাদিন তো তুমি আমাকে পাত্তাই দাও না।(রিশাদ)
–বাব্বাহ!তুমি মনে হয় আমাকে খুব পাত্তা দাও।তোমার তো দেখাই পাওয়া যায় না।(অনি)
–আমি তো তোমার আশেপাশেই থাকি। তুমিই তো দেখতে পাও না। (রিশাদ)
–হ্যা জানি জানি যাও তো। আমার এখন অনেক কাজ আছে। রেডিও হতে হবে আমার আবার। (অনি)
বলেই অনি রিশাদকে সরিয়ে দিয়ে চলে যায়। রিশাদ কিছুটা হতাশ হয়ে বিড় বিড় করে বলে;
–ধুর আসল জিনিসটাই দেখানো হলো না। এরপর সে নিজেও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনি ফুলের ডালি নিয়ে রিশাদের রুমে যায়। রুমে রিশার কাজিনরা সব মিথিলা আর রিশাকে ঘিরে রেখেছে। দুজন পার্লারের মেয়ে এসে তাদের সাজিয়ে দিচ্ছে। অনি ফুলের ডালিটা নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। মিথিলা আর রিশা দুজনকেই গোলাপি ও সাদা রং এর মিক্স কম্বিনেশনের একটা শাড়ি পরানো হয়েছে। মাথায় বিশাল খোঁপা ফুল দিয়ে ঢাকা।নাকে নথ আর গলায় সিম্পল ডিজাইনের হার। আটপৌরে করে শাড়ি পরানো হয়েছে। দুজনকেই বেশ দারুণ মানিয়েছে।
মিথিলা আর রিশার কাছে গিয়ে বলে; মাশ আল্লাহ দুজনকেই তো খুব সুন্দর লাগছে।
রিশা মুচকি হেসে বলে;ভাবী তুমি তো এখনো রেডিই হওনি। আরো কখন রেডি হবে তুমি?
–এইতো যাচ্ছি। তোমাদের ফুলগুলো দিতে এসেছিলাম। (অনি)
কিছুক্ষণ বসে থেকে অনি রিশা আর মিথিলাকে সাজানো দেখে। এরপর রিশা তাকে জোর করে রুমে পাঠিয়ে দেয় রেডি হওয়ার জন্য।
অনি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। আলমারি থেকে শপিং ব্যাগ গুলো বের করে রিশাদের কিনে দেয়া একটা শাড়ি বের করে। শাড়িটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখছে অনি। লাইট পার্পল কালারের শাড়ি। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।
অনির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। শাড়িটা পরবে কিভাবে?এতদিন মিথিলা আর রিশা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। এখন সে কাকে বলবে?পার্লারের মেয়েগুলোর কাছে যাবে?ভাবতে থাকে অনি। অবশেষে সে পার্লারের মেয়েগুলোর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাইরের দিকে যেতে উদ্যত হয়। তখনই রিশাদ রুমে প্রবেশ করে। রিশাদ রুমে এসে অনিকে দেখে বলে;
–এখনো রেডি হও নি?আরো কখন রেডি হবে?(রিশাদ)
–হ্যা যাচ্ছি। কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বলে অনি। রিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
–কি হয়েছে?এরকম ব্যাঙ এর মতো কেন মুখ করে আছো?(রিশাদ)
–কিছুনা। শাড়িটা পরতে পাচ্ছিলাম না। রিশা আর মিথিলাই তো আগে পরিয়ে দিত। (অনি)
–ওহ আচ্ছা। এই ব্যাপার।তুমি একটু বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। (রিশাদ)
মিনিট দশেক পর রিশাদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আছে। রিশাদ বিছানায় রাখা পাঞ্জাবিটা পরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা একটু ঠিক করে নেয়।
অতঃপর রিশাদ অনির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অনি মুখটা গোমড়া করে রেখেছে।
–তুমি নিজে রেডি হয়ে গেছো আর আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে রেখেছো।আমার কি রেডি হওয়া লাগবে না?এক্ষুণি মামনি এসে ডাকাডাকি শুরু করবে। কিছুটা রাগ নিয়ে কথাগুলো বলে অনি।
–আরে বাবা রাগ করছো কেন?আমি আছি তো।আমি নিজে তোমাকে আজ শাড়ি পরিয়ে দেব।বলেই রিশাদ একটা হাসি দেয়।
অনি চোখ বড় বড় করে রিশাদের দিকে তাকায়। রিশাদ শাড়ি পরিয়ে দেবে কথাটা সে ঠিক হজম করতে পারছে না অনি।
–তুমি শাড়ি পরাতে পারো?কিভাবে শিখলে?(অনি)
–না পারিনা। তবে দেখেছি। আশা করি চেষ্টা করলে পারবো। (রিশাদ)
–আল্লাহ সিরিয়াসলি তুমি পরাবে?কিভাবে না জানি পরাবে যদি খুলে যায় তখন কি হবে?(অনি)
–আরে ধুর খুলবে না। আমি পরিয়ে দিচ্ছি দেখো। (রিশাদ)
বলেই রিশাদ অনির হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে কোমড়ে শাড়ির এক পাশটা গুঁজে দেয়। রিশা মিথিলাকে যেভাবে শাড়ি পড়ানো হয়েছে ঠিক সে ভাবেই রিশাদ অনিকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। বেশ কয়েকটা সেফটি পিন লাগিয়ে দিয়ে অনিকে শক্ত করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। তারপর সে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় অনিকে।
অনি আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। খুব সুন্দর করে রিশাদ তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে যেন একেবারে দক্ষ একটুও এদিক ওদিক হয়নি। অনি তো পুরোপুরি অবাক হয়ে যায়। মুচকি হেসে রিশাদের দিকে তাকায়। রিশাদ অনির কোমড়ের উপর দিয়ে দুহাত রেখে থুঁতনিটা অনির কাঁধে রাখে।
–কি ম্যাম দেখলেন তো আমি কত সুন্দর করে শাড়ি পরাতে পারি। (রিশাদ)
–হ্যা আসলেই তো। দেখতে হবে না বরটা কার। বলেই অনি শব্দ করে হাসে। অনির সাথে সাথে রিশাদও হাসিতে মেতে ওঠে।
মিনিট দশেক সময় নিয়ে সাজগোজ শেষ করে অনি। শাড়ির সাথে ম্যাচিং হিজাবটা পরে নিয়ে বড় লকেটযুক্ত একটা মোটা চেইন পরে অনি। লকেটটা বেশ সুন্দর ডিজাইন করা। হিজাবের নিচে দিয়ে শাড়ির উপর খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। হাতে রিশাদের দেয়া ডায়মন্ডের আংটিটা পরে আরেকটা সোনার আংটি পরে নেয়। চোখে কাজল দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়।তবে লিপস্টিকটা ঠোঁটের কালারের সাথে মিলে যাওয়ায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। খুব সুন্দর একটা ন্যাচারাল কালার এসেছে। সাজগোজ শেষ করে অনি নিজেকে আয়নায় দেখে নেয়। রিশাদ এতক্ষণ সোফায় বসে বসে তার প্রিয়তমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিল। মাঝে মাঝে অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল।
নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে অনি রিশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।রিশাদ পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার অনিকে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। কিছু একটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে।
–উম সব ঠিক আছে। শুধু একটা জিনিস মিসিং আছে। (রিশাদ)
অনি একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় কিছু মিস করেছে কিনা। না সে তো সব ঠিক ঠাক মতোই পরেছে। তবে রিশাদ কিসের কথা বলছে?
–সব তো পরেছি। কি মিসিং আছে বলো তো। (অনি)
–এক মিনিটা দাঁড়াও দেখাচ্ছি। বলেই রিশাদ আগের খুলে রাখা প্যান্টটার পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে অনির সামনে এসে দাঁড়ায়। প্যাকেটটা খুলে একটা কোমড়বন্ধনী বের করে অনির কোমড়ে পরিয়ে দেয়। শাড়ির উপর কোমড়বন্ধনীটা বেশ ফুটে উঠেছে। অনিকে এবার পরিপূর্ণ দেখাচ্ছে।
অনি আয়নার সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় সত্যিই এখন পরিপূর্ণ লাগছে সাজটাকে। রিশাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে। রিশাদ তার প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে যেন প্রশান্তি অনুভব করছে।
কিছুক্ষণ পর রিশাদকে ছেড়ে দিয়ে অনি বলে; এটা কখন কিনলে তুমি?
–এটা দেখানোর জন্যই তো তখন তোমাকে আটকাচ্ছিলাম। তুমি না দেখেই চলে যাচ্ছিলে। (রিশাদ)
–ওহ আচ্ছা। আমি কি জানতাম নাকি বলো। কিছুটা ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বলে অনি।
–হয়েছে এখন থাক। চলুন নিচে চলুন। অনেক কাজ বাকি আছে।(রিশাদ)
বলেই রিশাদ অনিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রিশাদ নিচের দিকে যায় আর অনি যায় মিথিলা রিশাকে যেখানে সাজানো হচ্ছিল সেখানে।
অনি রুমে প্রবেশ করতেই সবার নজর পরে অনির উপর। অনিকে বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে যেন কোন বিদেশিনী বাঙালি সাজে সজ্জিত হয়েছে। সবার প্রশংসা শুনে অনি বেশ লজ্জা পাচ্ছিল।
শায়লা বেগমের নির্দেশে মিথিলা আর রিশাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। আত্মীয় স্বজনরা সবাই এসে পড়েছে।জাহানারা বেগম আর অনামিকাও এসেছে। তবে অদ্রি আসেনি। অদ্রিকে হাজার বলেও কোন কাজ হয়নি। তবে অনি অদ্রিকে আসার জন্য অনেক জোর করে। সে আজ আসেনি তবে বলেছে বিয়ের দিন অবশ্যই আসবে। তাই অনিও আর জোরাজুরি করেনি।
সেটেজের বিপরীতে ফ্লোরে বড় বিছানা করে মিথিলা আর রিশাকে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়। ফুল দিয়ে সাজানো ও লাইটিং করা। বেশ সুন্দর ও সুসজ্জিত বিছানা করা যেন মেহেদি লাগাতে সুবিধা হয়। রিশার কাজিন ও তাদের ফ্রেন্ডরা সবাই মিথিলা ও রিশাকে ঘিরে বসে।
একটু পরেই ইভান ও রাফির পরিবারের সদস্যরা এসে হাজির হয়। পরিবারের সবাই মিলে তাদের আপ্যায়ন করে। তাদের বসার জায়গা আলাদা করে করা হয়েছে। রিশা মিথিলার মুখোমুখিই ইভান আর রাফিকে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রিশাদ ইভান আর রাফিকে বসিয়ে দেয়।
অনি দুই পরিবারের সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। এরপর তাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয়। ওয়েটারকে দিকে কোল্ড ড্রিংকস সার্ভ করানোর ব্যবস্থা করে। অনি রিশাদের আতিথেয়তায় সবাই বেশ মুগ্ধ। তাদের মাঝের আন্ডারস্ট্যান্ডিং কতটা তা কাজের পারস্পারিক সংযোগ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
রাফি ইভান তাদের প্রেয়সীর দিক থেকে নজর সরাতে পারছে না। মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। তবে বন্ধুদের জ্বালায় দেখেও শান্তি নেই। কথায় কথায় তারা এত মানুষদের মধ্যে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। মিথিলা রিশা হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ।
অতিথি আপ্যায়ন শেষে শুরু হয় মেহেন্দির অনুষ্ঠান। পার্লার থেকে হায়ার করা মেহেদি আর্টিস্ট দুজন রিশা আর মিথিলাকে মেহেদি পরানো শুরু করে। পাশাপাশি যারা একটু ভালো ডিজাইন করতে পারে তারাও একে অপরকে মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে।
রিশাদ তার ক্যামেরা নিয়ে টুক টাক ছবি তুলছিল। যদিও ছবি তোলার জন্য আলাদা ক্যামেরা ম্যান হায়ার করা আছে তবুও সে তার শখ মেটানোর জন্যই আরকি ছবি তুলছিল। তবে তার ক্যামেরা যেন বার বার অনির উপর এসেই আটকে যাচ্ছিল। অনির অজান্তেই বেশ কতগুলো ক্যান্ডিড উঠায় রিশাদ। ছবিগুলো দেখছিল আর মুচকি হাসছিল রিশাদ।
অনি বসে বসে মেহেদি পরানো দেখছিল। সে আগে কখনো হাতে মেহেদি দেয়নি। বেশ ভালোই লাগছে তার মেহেদি দেয়া দেখতে। রিশাদ বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনিকে পর্যবেক্ষণ করছে মেহেদির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে অনি।
একটা চেয়ার টেনে এনে অনির পাশে এসে বসে পড়ে রিশাদ। অনির মনোযগ ভঙ্গ হয়।
–কি করছো এখানে? সবাই মেহেদি দিচ্ছে তুমি বসে বসে দেখছো যে?তুমিও দাও। (রিশাদ)
–আমি?আমি তো আগে কখনো মেহেদি দেইনি। (অনি)
অনির কথায় রিশাদ কিছুটা অবাক হয়ে যায়।মেহেদি মেয়েদের প্রধান আকর্ষণের একটা জিনিস। আর সেখানে অনি কখনো মেহেদিই লাগায়নি। রিশাদ বেশিক্ষণ অবাক থাকে না। তার মনে পড়ে যায় অনন্যময়ীর জীবনযাপর আর পাচঁটা সাধারণ মানুষের মতো নয়।
রিশাদ পাশেই রাখা ট্রে থেকে একটা মেহেদির কোণ নিয়ে অনির হাতটা টেনে নেয়। অনি কিছুটা অবাক হয়ে বলে;
–এই কি করছো আমি মেহেদি দিবো না। (অনি)
–আমি দিয়ে দিচ্ছি।একবার দাও খুব ভালো লাগবে আই প্রমিস। (রিশাদ)
অনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রিশাদ অনির উত্তরের অপেক্ষা না করে অনির হাতে মেহেদি দিতে শুরু করে। রিশাদের আঁকা আঁকি করার শখ আগে থেকেই ছিল। প্রায় বিশ মিনিট ধরে রিশাদ অনির হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেয়।
–এই নাও মেহেদি লাগানো হয়ে গেছে। দেখো তো কেমন হয়েছে?(রিশাদ)
অনি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রিশাদ সত্যিই অনেক সুন্দর ডিজাইন করেছে।এতটা ভালো হবে সে আশা করেনি। রিশাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে; ওয়াও রিশাদ তুমি তো অনেক সুন্দর মেহেদি দিতে পারো। ইউ আর গ্রেট।
–ইয়েস ম্যাম।দেখতে হবে না বরটা কার!বলেই রিশাদ শব্দ করে হেসে দেয়। আশেপাশের সবার নজর পরে অনি রিশাদের উপর।অনি কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় সবার এভাবে তাকিয়ে থাকায়।
মেহেদি লাগিয়ে হাত দিয়ে বার বার ফুঁ দিয়ে দিচ্ছিল রিশাদ যেন তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। অনি রিশাদের দিকে গভীর ভাবনায় মগ্ন। রিশাদের ওই ছোট ছোট কেয়ারিংস গুলো অনিকে কি পরিমাণ সুখী অনুভব করায় তা অব্যক্ত,অবর্ণনীয়।
অনিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিশাদ অনির নাকটা টিপে দিয়ে বলে; এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি আর আপনার পেট ভরবে ম্যাম?থাকুন আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। সারাদিন তো কিছু খাওয়া হয়নি।
বলেই রিশাদ অনিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খাবার আনতে চলে যায়। দুমিনিটের মধ্যেই রিশাদ খাবার নিয়ে হাজির হয়। একটা চামচ দিয়ে রিশাদ অনিকে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে টিস্যু দিয়ে তার মুখে লেগে থাকা খাবারগুলো মুছে দিচ্ছিল। তাদের কার্যকলাপে তাদের মাঝের ভালোবাসা ও বন্ধনটা যে কারোরই নজর কেড়ে নিতে সক্ষম।
একজোড়া চোখ পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অনি রিশাদ দম্পতিকে দেখছিল। তার মুখের ভাব দেখে বোঝা মুশকিল এই দম্পতিকে নিয়ে সে কি ভাবছে। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো সাথে দেখার মতো কষ্টকর বিষয় আর কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। বাহ্যিকভাবে ভালো আছি,স্ট্রং আছি দেখালেই ভেতরকার নীরব হাহাকার কেউই শ্রবণ করতে পারে না। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া অন্তরটা সবার অগোচরেই থেকে যায়।
অনিকে খাওয়া শেষ করিয়ে দিয়ে রিশাদ প্লেটটা রেখে আসে। একগ্লাস পানি এনে অনিকে খাইয়ে দিয়ে মুখটা মুছে দেয়। রিশাদ অনির হাতের মেহেদিটা ভালো করে দেখে বলে;
–মেহেদিটা শুকিয়ে গেছে।চলো ধুয়ে নেবে।(রিশাদ)
–হুম যাচ্ছি। তুমি থাকো আমি একাই পারবো।(অনি)
বলেই অনি ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। আর রিশাদ রাফি আর ইভানের খাওয়ার তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অনি কমন ওয়াশরুমে গিয়ে হাতটা ধুয়ে নেয়। এই প্রথম সে মেহেদি দিয়েছে তাই কিভাবে মেহেদিটা ধুয়ে ফেলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কিছুটা সময় নিয়ে সে মেহেদিটা ধুয়ে নেয়। একটা টিস্যু দিয়ে হাতটা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। অনির ফরসা হাতে মেহেদি টা খুব মানাচ্ছে। হাতের দিকে তাকিয়ে রিশাদের কথা মনে হতেই কিছুটা লজ্জা পায় অনি।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সে ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক অচেনা পুরুষালি কণ্ঠে অনি নিজের নামটা উচ্চারিত হতে শোনে।
–অনন্যময়ী!!
অনি পেছনে ফিরে তাকায়। কণ্ঠটা অচেনা হলেও এই মানুষটা অচেনা নয়। দু একবার সাক্ষাত হলেও কথা কম হয়েছে বিধায় সে ভুলে গেছে। কিছুটা মলিন দৃষ্টি নিয়ে রাফি অনির দিকে তাকিয়ে আছে। হিমাদ্রীর সাথে চোখাচোখি হতেই অনি তার নজর সরিয়ে নেয়। হিমাদ্রীর এমন চাহনির ভাবার্থ সে বুঝতে চায়না।অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করছে। সে যাই হোক।
–অনন্যময়ী আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?বেশি সময় নেবনা জাস্ট দুমিনিট। (হিমাদ্রী)
অনি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। বুঝতে পারছে না হিমাদ্রী তাকে কি বলবে?এমনিতেই হিমাদ্রীর সাথে তার বেশ বাজে অভিজ্ঞতা আছে এর আগে। যদিও সে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে তবে কিছুটা অস্বস্তি থাকা স্বাভাবিক।
–আমার সাথে কি কথা আপনার?(অনি)
–তেমন কিছুনা। আসলে আপনাকে সরি বলার ছিল।(হিমাদ্রী)
–সরি কেন?(অনি)
–আসলে আমি ওই দিনের ঘটনার জন্যই সরি বলতে চাচ্ছি। আপনি বিবাহিত এই বিষয়টা আমরা কেউই জানতাম না। আমার জন্য আপনাকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হয়েছে। তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করবেন। আসলে আপনাকে প্রথম যখন আমি দেখেছিলাম তখন আপনি বিবাহিত ছিলেন না। আপনাদের হোটেলেই আপনাকে প্রথম আমি দেখেছিলাম।পরিস্থিতি তখন একেবারেই অন্যরকম ছিল। আপনার বোন এবং আপনার হাসবেন্ড এর সাথে ছিলেন। তবে নিয়তি আমাকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।অনির দিকে না তাকিয়েই কথা গুলো বলে হিমাদ্রী।
–না না ইটস ওকে ভাইয়া। আপনি মন খারাপ করবেন না। এটা তো একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আসলে কার ভাগ্যে কি থাকে সেটা বলা যায়না। আমরা চাইলেই কাউকে পাইনা আবার না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে যাই। হয়তো আপনার নিয়তি অন্যকারো সাথে বিধায় আপনাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমাকেও ক্ষমা করবেন আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আপনারা ধোঁয়াশায় ছিলেন এতে আমাদেরও ভুল ছিল। শুধু শুধু কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেছে।(অনি)
অনির আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে রিশাদ অনির খোঁজে ওয়াশরুমের দিকে আসে। দূরে দাঁড়িয়ে রিশাদ হিমাদ্রী আর অনিকে কথা বলতে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। রিশাদের মাঝে রাগের অনুভূতি জাগলেও সে নিজেকে সংযত রাখে। কেননা অনন্যময়ীর উপর তার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে। সে কোন রূপ খারাপ মনোভাব আনতে চায়না। রিশাদ সেখানে দাঁড়িয়ে অনি আর হিমাদ্রীর কথা না শুনে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর অনি হিমাদ্রীর সাথে কথা বলে শেষ করে ড্রইং রুমে চলে আসে। হিমাদ্রীর সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগে অনির।হিমাদ্রীকে তার বেশ ভালো একজন মানুষ হিসেবে মনে হয়।
অনি এসে রিশাদের পাশে দাঁড়ায়। রিশাদ অনির দিকে একবার তাকায়। তারপর সে বলে;
— কি করছিলে?এত সময় লাগছিল যে?(রিশাদ)
–নাহ তেমন কিছুনা। (অনি)
অনি রিশাদের প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। কেননা সে ভাবছিল এখন হিমাদ্রীর কথাটা বলা হয়তো ঠিক না। আশে পাশে এত মানুষজন।
অনির এড়িয়ে যাওয়াটা রিশাদের বুঝতে কষ্ট হয়নি। তবে অনির এই কথাটা লুকানো রিশাদ ঠিক হজম করতে পারেনি। বার বার এই এক কথায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রিশাদ সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছে কোন বিরূপ ধারণা না করতে। অনন্যময়ীকে সে নিজের চেয়েও ভরসা করে বেশি।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে রেখে রাতে ঘুমোতে যেতে যেতে প্রায় বারোটা বেজে যায়। অনি রিশাদ দুজনেই বেশ ক্লান্ত। অনি রুমে যেয়ে দেখতে পায় রিশাদ শুইয়ে পড়েছে। লাইটটা অফ করে দিয়ে অনি রিশাদের পাশে শুইয়ে পড়ে।
রিশাদকে জড়িয়ে ধরে অনি। রিশাদকে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে অনির। টুকটাক কথা বলছিল রিশাদের সাথে।রিশাদ তেমন রেসপন্স করছিল না।হু হা করেই উত্তর দিচ্ছিল।
–একটা কথা বলবো রিশাদ!প্রমিস করো রাগ করবে না।(অনি)
–হুম বলো।(রিশাদ)
রিশাদের সম্মতি পেয়ে অনি রিশাদকে সবটা জানিয়ে দেয় হিমাদ্রীর সাথে তার কি কি কথা হয়েছে। রিশাদ কোনরূপ রাগ দেখায় না। অন্ধকারে অনির অগোচরে মুচকি হেসে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অনি ঠিক বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কি হলো?
–আমি জানি তুমি ভুল কিছু করবে না। তাই রাগ করার কোন প্রশ্নই আসে না। এখন ঘুমিয়ে পড়ো অনেক রাত হয়ে গেছে। (রিশাদ)
অনিও আর কোন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ে। রিশাদ জানতো অনি সবটা নিজে থেকেই তাকে বলবে। কেন জানে না অদ্ভুত এক ভালো লাগা কা করছে তার মাঝে।
সকাল বেলা থেকেই গায়ে হলুদের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। দুই বাড়িতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব পাঠাতে হবে আবার এখানেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে। বেশ ব্যস্ততার মধ্যে আছে সবাই। ভোরবেলা থেকেই রিশাদের কাজিনরা ও মিথিলা রিশার ফ্রেন্ডরা তত্ত্ব সাজাচ্ছে। প্রায় দশটা বেজে যায় সবটা সাজাতে। সবাই মিলে ঠিক করে অনি,রিশাদ আর তার কাজিনেরা যাবে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে।
তিনটে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক গাড়ি বোঝাই করা জিনিস পত্র আবার সবার হাতে হাতেও। প্রথমে তারা ইভানদের বাসায় যায়। সেখানে ইভানের পরিবারের সবাই খুব ভালো ভাবে আপ্যায়ন করে তাদের। ইভানের বাবা আর তার মায়ের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয় অনি। মা ডাক ছাড়া কোন কথাই বলেন না তিনি। খুব কাছের মানুষের মতো ব্যবহার করেন। ইভানদের বাড়ির পালা চুকিয়ে তারা যায় রাফিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
দুপুর বেলার দিকে রাফিদের বাসায় পৌঁছায় অনিরা। সেখানে রাফির বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের পাশাপাশি রয়েছে হিমাদ্রীদের পরিবারের সবাই।মূলতা তারাই সবকিছুর তদারকি করছে।হিমাদ্রী আর রাফি সবাইকে আপ্যায়ন করে। রাফি আর হিমাদ্রীদের বাড়িটাও পাশাপাশি তাই আর কোন সমস্যা হয় নি তাদের।
দুপুরে সবাই রাফিদের বাসায় লাঞ্চ করে। গুনগুন ও নিরার সাথে গল্প করছিল অনি। সবার এখনো লাঞ্চ করা শেষ হয়নি। রিশাদকে বলে গুনগুনকে নিয়ে বাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে ফিরে দেখছিল অনি। রাফিদের বাড়ি আর হিমাদ্রীদের বাড়িটার মধ্যে অনেকটা মিল আছে। মাঝেখানে প্রাচীর দিয়ে আলাদা করা। এ বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়ালে ও বাড়ির বাগানটাও স্পষ্ট দেখা যায়।
গুনগুনের সাথে ঘুরে ঘুরে বাগানটা দেখছিল অনি। গুনগুনেরও ফুল খুব পছন্দের বস্তু। অনিকে সে জোর করে তাদের বাড়ির বাগানে নিয়ে যায় একটা ফুলের গাছ দেখানোর জন্য। অনিও গুনগুনের সাথে না পেরে যেতে বাধ্য হয়।
গুনগুন তাকে তাদের বাগানে নিয়ে গিয়ে ব্ল্যাক রোজের গাছটা দেখায়। ব্ল্যাক রোজের গাছ দেখে অবাক হয়না। বাংলাদেশ এর প্রচলন কম থাকলেও ইংল্যান্ডে হরহামেশাই দেখা যায়।
তবুও অনি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে গুনগুনের মন রাখার জন্য। ফুলগুলো দেখতে দেখতে বাগানের প্রান্তের দিকে চোখ যায় অনির। চারকোণা প্রাচীর দেয়া আনুমানিক কোমড় অবধি। অনি বুঝতে পারছে না এটা। কৌতূহলী অনি গুনগুনের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
–এটা কার কবরগুনগুন?(অনি)
–এটা তো ছোট দাদুর কবর।(গুনগুন)
অনি কবরটার সামনে গিয়ে নেমপ্লেটে থাকা নামটা পড়ার চেষ্টা করে। বাংলা পড়ায় সে একে বারেই কাঁচা। তাই সে গুনগুনকে জিজ্ঞাসা করে;
–দেখ তো গুনগুন এখানে কার নাম লেখা আছে?(অনি)
–পরী আন্টি তুমি পড়তে পারো না?এখানে তো আমার ছোট দাদুর নাম লেখা “রাহাত চৌধুরী”বলেই গুনগুন হেসে ওঠে অনি পড়তে পারেনা বলে।
গুনগুনের মুখে রাহাত চৌধুরী নামটা শুনে অনির বুকের মাঝে ছ্যাত করে ওঠে। এটা তো তার জন্মদাতা পিতার নাম। যাকে কখনোই দেখার সৌভাগ্য হয়নি।ছবিতেও দেখার ভাগ্য হয়নি অনির। তবে এই রাহাত চৌধুরীই তার পিতা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় অনি।
গুনগুনকে খুঁজতে খুঁজতে নিরা বাগানে চলে আসে।
–তোমরা এখানে আমি খুঁজছিলাম তো?কি করছো এখানে?(নিরা)
অনি নিরাকে কবরটা দেখিয়ে বলে;এটা কার কবর আপু?(অনি)
–ও এটা?এটা তো আমার চাচা শ্বশুরে কবর।(নিরা)
–কিভাবে মারা গেছেন?(অনি)
–একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল।তারপর বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন তো আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি মা, কাব্য,হিমাদ্রী সবাই বিদেশে থাকতো।বাবা ওখানকার ব্যবসা সামলাতো আর কাব্য হিমাদ্রী ছোট ছিল। দেশে আমার দাদা শ্বশুড় আর দাদী শ্বাশুড়ি থাকতেন আর তাদের ছোট ছেলে রাহাত চৌধুরী। এক্সিডেন্টের পর ওনাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হন তবে তবে একা চলাফেরা করতে পারতেন না আর মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পরেছিলেন। কাব্যর দাদা দাদী মারা যাবার পর আরো ভেঙে পরেন। এরপর সবাই দেশে আসে। দেশে আসার পর ওনার স্বাস্থ্যে অবনতি ঘটতে থাকে। কিছুদিন পরেই মারা যান। (নিরা)
–ওহ আচ্ছা। ওনার পরিবারে আর কেউ নেই?আই মিন ওনার ওয়াইফ বা ওনার ছেলে মেয়ে?(অনি)
–আসলে এই ব্যাপারে আমরা কিছু জানিনা। ওনার ওয়াইফ আর সন্তানের জন্যই আজ এই অবস্থা। আমরা কেউই জানিনা কোথায় আছে তারা।আদৌও বেঁচে আছে কিনা জানিনা।আর উনিও কিছু বলতে পারতেন না। আমার চাচা শ্বশুড় আর কাব্যর দাদা দাদী ছাড়া কেউই জানে না ওনার ওয়াইফ আর সন্তানের খবর। বাকি সবাই তো দেশের বাইরে ছিল। আর ওনার বিয়েটাও একটু অস্বাভাবিকভাবে হয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন খবর মেলেনি। (নিরা)
নিরার প্রতিটি কথায় অনির কেমন ভয় ভয় করছে। সত্যিই কি এটা তার সেই জন্মদাতা পিতা?জানতেই হবে আজ তাকে।
–অস্বাভাবিক কেন আপু?(অনি)
–পুরো ঘটনাটা আমি জানিনা। তবে শুনেছিলাম সে সময় কোন এক মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছিলেন। কিছুদিন সংসার করার পর মেয়েটা চলে যায়। চাচা অনেক চেষ্টা করেছিল ফিরিয়ে আনার কেননা ওনার ওয়াইফ সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিন্তু ওনার ওয়াইফ ওনাকে ক্ষমা করে না আর ফিরেও আসে না। (নিরা)
অনির কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সবকিছু মিলে যাচ্ছে এই রাহাত চৌধুরীর সাথে। নাহ সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।এই সময় যে মানুষটাকে তার প্রয়োজন তা হলো তার দিদা। ফোনটা নিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে সে তার দিদাক্ব ফোন করে।
গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বের হচ্ছে না। জাহানারা বেগম ফোন রিসিভ করতেই সে তাকে হিমাদ্রীদের বাড়ির ঠিকানাটা বলে সেখানে আসতে বলে।জাহানারা বেগম কিছু বুঝতে পারছেন না। অনিকে তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাই তিনি সময় ব্যয় না করে রওনা দেন হিমাদ্রীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অনির এমন আচরণ ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না নিরার। সে বার বার অনিকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে তার কিন্তু অনি কোন কথা বলছে না। সে কাঁদছে চোখ দিয়ে অনবরত তার পানি বের হচ্ছে হাত পা কাঁপছে। নিরা ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসে।
রিশাদ খাবার প্লেট ফেলে কোন রকমে হাতটা ধুয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসে। অনিকে সে জড়িয়ে ধরে। অনি এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। রিশাদ কিছু বুঝতে পারছে না। বার বার সে ইশারা করে কবরটা দেখাচ্ছিল তবে রিশাদ কিছু বুঝতে পারছে না।
উত্তেজনায় অনির গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহানারা বেগম উপস্থিত হন। অনির এমন অবস্থাত ঘাবড়ে যান তিনি। অনির দু গালে হা রেখে বলেন;
–কি হয়েছে দিদি ভাই তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার?আমাকে বলো। (জাহানারা)
অনি তার দিদার চোখের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে কবরের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে; বা….বা!
অনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কবরের দিকে তাকিয়ে জাহানারা বেগম নামটা পরে ফেলেন। “রাহাত চৌধুরী”
অনির অসুস্থতার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হয়।অনিকে রিশাদ কোলে করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার আংকেল এর কাছে ফোন দিয়ে আসতে বলে। তবে জাহানারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রেহানা ও নিহাল চৌধুরীর সাথে কথা বলেন।
সবটা শুনে উপস্থিত সবাই খুব বড়সড় ধাক্কা খায়।অনির মানসিক অবস্থাটা বিন্দুমাত্র হলেও সবাই অনুধাবন করতে পারছে। তবে আরো বেশি ধাক্কা খায় অনির এত বছরের জীবনযাপনের কথাটা জেনে। নিহাল চৌধুরী ও রেহানা কান্না থামাতে পারেন না। উপস্থিত সবার চোখেই অশ্রুর ছোঁয়া দেখা যায়। একজন পিতা যেমন মরার আগ পর্যন্ত তার সন্তানকে একবার দেখা আকুতি নিয়ে ছিল তেমনি সন্তানও প্রতিনিয়ত মা বাবার ছায়া বিহীন এক অসহনীয় জীবন যাপন করেছে। বাবার অনুপস্থিতি আর মায়ের অবহেলা সব মিলিয়ে জীবনটা যে কতটা কষ্টের ছিল তা সবাই ধারণা করতে পারছে।
অনি জ্ঞান ফিরতেই রেহানা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরেন। নিহাল চৌধুরী শিয়রে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রেহানা বেগমের বুকে মুখ লুকিয়ে অনি ভাবছে তার জীবন কতটা স্বাভাবিক হতে পারতো।কিন্তু না সবকিছু থেকেও যেন তার কিচ্ছু নেই। নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঙাল মনে হচ্ছে। কতটা হতভাগ্য হলে সন্তান কখনো পিতাকে না দেখে তার কবর দেখতে পায়। সত্যিই ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস দেখে অনি আজ বড্ড অবাক হচ্ছে। নিষ্ঠুরতা যেন আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই সুন্দর ও সুখী পরিবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য কে দায়ী? তার বাবা নাকি তার মা? নাকি তার নিষ্ঠুর ভাগ্য?
চলবে…..
আসসালামু আলাইকুম ?
আর তিনটে পর্বের মধ্যে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে।আজকের পর্বের কন্সেপ্টটা ঠিক মতো সাজাতে পারছিলাম না। দুদিন ধরে একটা লাইনও লিখতে পারিনি। তাই দেরি হয়ে গেলো। জানি না কতটা ভালো লিখতে পারছি। কমেন্টে আপনাদের মতামত জানালে কোন ভুল ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নিতে পারতাম। ধন্যবাদ?