অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
বোনাস_পার্ট
হিমাদ্রীদের বাসার কিছুদূর সামনে থেকে রিশাদ ডাক্তার আংকেলকে এগিয়ে নিয়ে আসে। এতক্ষণে গুনগুনকে উপরে তার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পার্টিতে আসা লোকজনের ভিড়ও কিছুটা কমে গেছে। সবাই গুনগুনের রুমে বসে আছে অধীর আগ্রহে। এখনো গুনগুনের জ্ঞান ফেরেনি। সেই অপেক্ষাতেই বসে আছে সবাই। সবার মুখেই উত্তেজনা,চিন্তা আর ভয়। কেউ কেউ তো একাধারে অশ্রুপাত করছে।
নিরা গুনগুনের পাশেই বসে আছে। তার মুখে কোন কথা নেই। একটু পর পর শুধু চোখের জল মুছতে আর গুনগুনের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছে। নিরার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রেহানা বেগম, আয়শা বেগম আর নিধি। তারাও নীরবে অশ্রুপাত করছে। চারপাশ থেকে সবাই। গুনগুনকে ঘিরে ধরে বসে আছে। একটু তার ভুবন ভোলানো হাসির অপেক্ষায়;এই বুঝি সে চোখ মেলে তাকিয়ে মাম্মাম বলে ডেকে উঠবে হয়তো।
গুনগুনের পাশে বসে আছে এরিক। গুনগুন তার অবচেতন মনেও এরিকের হাত চেপে ধরে আছে। কেউ আর সেই হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি। এরিক নিজেও যেন মনে মনে এমন কিছুই চাইছিল। গুনগুনকে ছেড়ে যেতে তার মন চাইছে না। মনে হচ্ছে যেন গুনগুনকেই আকড়ে ধরে থাকে। গুনগুনকে এই অবস্থায় দেখে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মানুষ হিসেবে তার কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে গুনগুনের জন্য এরিক যে কষ্টটা অনুভব করতে পারছে তা শুধুই নিজের আপনজনের জন্যই অনুভব করা যায়। খুব অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে এরিকের। এক অসমাধানকৃত
গোলকধাঁধায় ক্রমাগত ঘিরে যাচ্ছে সে।
ডাক্তার আংকেলকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে রিশাদ। সবাই সাইডে সরে যায়। ডাক্তার এসে গুনগুনের চেকাপ করে।
সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে ডাক্তার কি বলে তা শোনার জন্য। তাদের হাসিখুশি মেয়েটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে।চোখের পাপড়িগুলো এখনো ভেজা।
চেকাপ শেষ করেন ডাক্তার আংকেল। চিন্তার ভাজ পড়ে কপাল কুঞ্চিত হয়ে যায়। কিছুটা গম্ভীর ভাবে বলতে শুরু করে;
–আপনাদের আমি বার বার বলেছিলাম আর কটা দিন গুনগুনকে হসপিটালে রাখুন। আপনারা আমার কথাটা শুনলেন না। দেখুন মেয়েটার কি অবস্থা হয়ে গেছে। এতোটা স্ট্রেস গুনগুনের শরীরের জন্য মোটেও ঠিক নয়। সবেমাত্র একটা সিরিয়াস অপারেশন হয়েছে মেয়েটার। এখনক ব্যান্ডেজটাও খুলে দেয়া হয়নি। এই অপারেশনে এডাল্টরাই সারভাইভ করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তার রহমতে এই বাচ্চা মেয়েটা বেঁচে গেছে। আপনাদের আরো কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিল। আজ গুনগুনের মারাত্মক কিছু হতে পারতো। প্লিজ ওকে একদম কোন স্ট্রেস দেবেন। অন্তত কিছুদিন ওকে নিয়ে একটু বেশি কেয়ারফুল থাকতে হবে যতদিন না পুরোপুরিভাবে সুস্থ হচ্ছে। আদারওয়াইজ উই হ্যাভ টু লস হার। (ডাক্তার আংকেল)
হিমাদ্রী ডাক্তার আংকেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে; এক্সট্রিমলি সরি আংকেল। আমরা গুনগুনের ভালো ভাবেই খেয়াল রাখছিলাম। একটা ইন্সিডেন্টের জন্য ওর উপর দিয়ে কিছুটা স্ট্রেস গেছে। প্লিজ আংকেল আপনি একটু দেখুন। অনেকক্ষণ ধরে গুনগুনের সেন্স ফিরছে না। ওর কিছু হবে না তো? প্লিজ আংকেল গুনগুনকে ঠিক করে দিন। অসহায়ভাবে কথাগুলো বলে হিমাদ্রী।
–প্লিজ রিল্যাক্স হিমাদ্রী। ঘাবড়ানোর মতো খুব বেশি কিছু হয়নি। মনে হয় কোন কারণে মেন্টাল প্রেশার পড়েছে। (ডাক্তার আংকেল)
–ওকে আংকেল। গুনগুনকে কি হসপিটালে নিতে হবে??(হিমাদ্রী)
–এই মূহুর্তে হসপিটালে নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। নেক্সট দিন ওকে একবার হসপিটালে নিয়ে এসে চেকাপ করিয়ে নিয়ে যেয়ো। আমি একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি ওর একটু রেস্টের প্রয়োজন। আর হ্যা কোন রকম স্ট্রেস উত্তেজনা মানসিক চাপ যেন গুনগুনের উপর না পড়ে খেয়াল রাখবে। মেডিসিনগুলো টাইমলি দিতে হবে। এর মধ্যে যদি বেশি কোন সমস্যা হয় তবে আমাকে কল করে জানাবে। আমি এখন আসছি। টেক কেয়ার অফ হার। বলেই ডাক্তার আংকেল বেরিয়ে যান। রিশাদ ডাক্তার আংকেলের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায়।
ডাক্তারের কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেন কিছুটা স্বস্তি পায়। সবাই সাময়িক ভাবে চিন্তামুক্ত হলেও একজনের চিন্তা ক্রমেই বেরিয়ে চলেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এনির এমন অস্বাভাবিক চাহনির দিকে তাকিয়ে আছে অনি। এনিকে শুরু থেকেই তার অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তবে বিষয়টাকে সে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছে না। গুনগুন সুস্থ আছে ভেবেই সে স্বস্তি পায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গুনগুন অনির মন কাড়ে। তাই গুনগুনের এই অবস্থায় বেশ অস্থির অস্থির লাগছিল অনির।
যা এখন কেটে গেছে। দূর থেকেই গুনগুনকে দেখে সে পুরো রুমে চোখ বুলায়। কোথাও রিশাদকে দেখতে পাচ্ছে না। এর মধ্যেই দুবার শায়লা বেগম কল দিয়েছে। এত কিছুর মাঝে রিসিভ করার সময় হয়নি। একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রুম থেকে বেরিয়ে রিশাদকে খুঁজতে থাকে অনি।
রিশাদ ডাক্তার আংকেলকে এগিয়ে দিয়ে উপরের দিকেই আসছিল। অনিকে তার দিকেই আসতে দেখে রিশাদ।
অনি রিশাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে; কোথায় ছিলেন আপনি? অনেকক্ষণ ধরেই আপনাকে খুঁজছিলাম আমি। মামনি বার বার ফোন দিচ্ছে। বাড়ি ফিরতে হবে তো।
–হ্যা আমিও সেটাই ভাবছিলাম। গুনগুন তো এখন ভালো আছে। চলুন তাহলে বাড়ি ফেরা যাক। (রিশাদ)
–হ্যা চলুন। (অনি)
অনি রিশাদ হিমাদ্রীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। শায়লা বেগমকে কল করে জানিয়ে দেয় তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসছে । অনিকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় রিশাদ। গাড়িতে অন্যমনস্কভাবে বসে আছে অনি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। অনির উদাসীনতার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন চারপাশটা আঁধার হয়ে আসছে। ব্যস্ততার মাঝে যেন কেমন একটা গুমোট ভাব। বিষণ্ণতা ভরা চাহনি নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খারাপ হয়ে আছে অনির। মুখটা মলিন হয়ে আছে। দু চোখ জুড়ে তার সীমাহীন উদাসীনতা। দেশে ফেরার পর বার বার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে অনি।
রিশাদ মাঝে মাঝে অনির দিকে তাকাচ্ছে। অনির বিষণ্ণতা তার নজর এড়ায়নি। তার মলিন চেহারা রিশাদকে কিঞ্চিত বিচলিত করে তুলেছে। অনির ছোট ছোট বিষয়গুলোও আজকাল রিশাদকে ভাবায়। সে যদি পারত অনির সকল মন খারাপ গুলো দূর করে নিজের ভাগে নিয়ে নিত। তার কল্পনার এক্লটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনি নামক ভাবনা। রিশাদ বারে বারে অনিকে নিয়ে আজগুবি ভাবনা গুলো যতই ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে ততই যেন নিত্য নতুন ভাবনা এসে ভিড় জমায়। বেশ অস্বস্তি হয় রিশাদের। বড্ড বিরক্ত হয় নিজের উপর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায় অনি, রিশাদ। ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে কিছু একটা ভাবছিল অনি। রিশাদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে অনিকে এক ধ্যানে বসে থাকতে দেখে বার দুয়েক অনির নাম ধরে ডাকে। কোন সাড়াশব্দ পায় না। তোয়ালেটা যথাস্থানে রেখে অনির কানের কাছে গিয়ে কিছুটা জোরে শব্দ করে রিশাদ।
আচমকা এতো জোরে শব্দ হওয়ায় অনি কিছুটা ভয় পেয়ে আতকে ওঠে। রিশাদের এমন কান্ডে অনির মন চাচ্ছে রিশাদকে এক্ষুণি কিছু একটা করতে। ক্রোধ সামলাতে না পেরে রিশাদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনি।
অনির এই চাহনির সাথে রিশাদ বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। তাদের প্রথম সাক্ষাতেই অনির ক্রোধের সাথে পরিচিত হয় রিশাদ। অপরিচিত অনন্যময়ীর এমন চাহনি দেখে প্রথমবার কিছুটা ভড়কে যায় রিশাদ। তবে অপরিচিত অনন্যময়ী থেকে এবার কিছুটা পরিচিত হয়ে গেছে। বিধায় এবার সে আর ভয় পায় না বরং অনির এমন চাহনি দেখে বেশ মজা পাচ্ছে রিশাদ।
–আপনি এমন করলেন কেন? এতো জোরে করে শব্দ করলেন কেন? আমার কানের পর্দাটা যদি ফেটে যেত? আমি যদি কানে শুনতে না পেতাম আর? কি হতো আমার? (অনি)
অনির কথায় রিশাদের কিছুটা হাসি পাচ্ছে। হাসি চেপে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে দেয় রিশাদ। রিশাদের হাসির শব্দে আরো বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে অনির। যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হচ্ছে।
–সরি সরি। আমি জানি আপনার রাগ হচ্ছে। কিন্তু কি করবো বলুন আপনার কথা শুনে হাসি আটকাতে পারছি না। এতটুকু শব্দে কারো কানের পর্দা ফেটে যায়! হা হা হা! এই প্রথম শুনলাম মনে হচ্ছে। (রিশাদ)
রিশাদের কথা রাগে ফুঁসছে অনি। অনির নাকটা কাঁপছে। চোখ দুটো বড় বড় করে রিশাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনির এই মারাত্মক চাহনির দিকে লক্ষ্য করে রিশাদ হাসি থামিয়ে দেয়। অনিকে আজ পুরোপুরি অন্যরকম লাগছে। সম্পূর্ণ আলাদা। তার চেনা পরিচিত অনন্যময়ীর নতুন এক রূপ দেখছে সে। হয়ত রিশাদের কাছে নতুন মনে হচ্ছে। কেননা অনিকে সে সবেমাত্র চিনতে শুরু করেছে,বুঝতে শুরু করেছে, গভীরভাবে লক্ষ্য করতে শুরু করেছে। তাই বোধ হয় অনির এই মারাত্মক চাহনি রিশাদের নজরে আগে ধরা পড়েনি।
রিশাদকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনি রিশাদকে বলে; কি হলো? কোন ভাবনার দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন আপনি?
–না কিছু না। একটা কথা মনে পড়ে গেল। জানেন কি কথা?(রিশাদ)
–কি কথা?(অনি)
–আপনার মনে আছে যেদিন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আমি ভুল করে পিছন থেকে আপনার চোখ চেপে ধরেছিলাম বাব্বাহ সে কি রাগ আপনার!আমার তো ভাবলেই গলা শুকিয়ে যায়। (রিশাদ)
–হ্যা মনে আছে আমার। দোষটা আপনার ছিল বিধায় আপনার উপরেই রাগ দেখিয়েছি। হুট হাট করে এভাবে অচেনা কারো চোখ চেপে ধরলে তো এমনই হবে আপনার সাথে। (অনি)
–হ্যা তা ঠিক। আমিই ভুল করে আপনার চোখ চেপে ধরেছিলাম ঠিকি কিন্তু আপনি যে একটা কথা বলেছিলেন মনে আছে আপনার? (রিশাদ)
–কোন কথা বলুন তো?(অনি)
— এ মা আপনি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন কিভাবে বলুন তো? (রিশাদ)
–এতো ভনিতা না করে বলুন না কোন কথাটা। তাহলেই তো হয়ে গেল।(অনি)
–হ্যা বলছি শুনুন। আপনার মনে আছে আপনি বলেছিলেন আমার মতো কাউকে কে বিয়ে করবে। তার নাকি কপাল পুড়বে।(রিশাদ)
অনি রিশাদের কথায় অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়;হ্যা তো কি হয়েছে। যা সত্যি তাই বলেছিলাম আমি।
অনির কথায় রিশাদ মুখ টিপে হাসছে। রিশাদের এমন শয়তানি মার্কা হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে রিশাদের কথার মানে বুঝতে।
–আপনি কি কথাগুলো আমাকে বলছেন নাকি? (অনি)
–এ মা ছি ছি! আপনাকে কেন বলবো? আমার কি সেই সাধ্য আছে নাকি বলুন? আপনার রাগেই তো আমি ভস্ম হয়ে যাব। আমি তো শুধু এটাই বলছিলাম যে আমাকে যে বিয়ে করেছে তার কপালটা পুড়েছে । বেশি কিছু হয়নি। আহারে বেচারি। কার কপালটা পুড়ল বলুন তো? আপনি কি পোড়া পোড়া কোন গন্ধ পাচ্ছেন? আমি তো পাচ্ছি। (রিশাদ)
বলেই রিশাদ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে। অনি রিশাদের কথায় প্রচণ্ড রেগে যায়।অনি রিশাদের দিকে তেড়ে যেতে নিলে রিশাদ দৌঁড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অনি দরজা অবধি রিশাদের পিছু নিয়ে থেমে যায়।
রিশাদের কথাগুলো মনে হতেই অনি একা একা হাসতে থাকে। কি এক অবস্থা। সেদিন সে নিজেই রিশাদকে বলেছিল রিশাদকে যে মেয়ে বিয়ে করবে তার কপাল পুড়বে। আর আজ সে নিজেই রিশাদকে বিয়ে করেছে। ভাবতেই হাসি পাচ্ছে অনির।
এই হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি অনির মুখে। তার মনে পড়ে যায় এইসব কিছুই হয়তো তার সীমিত সময়ের জন্য পাওয়া। হয়ত তারও মন চায় সবকিছু দিয়ে আকড়ে ধরতে। দুহাতে সুখ কুঁড়োতে মন চায়। সবাইকে আপন করে নিতে মন চায়। পরিবারের সবাইকে আপন করে নিতে মন চায়। যার জন্য এই পরিবারকে পেয়েছে তাকে কি আপন করে নিতে পারবে? হয়তো পারবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তো সবটা ঠিকও হতে পারতো।
কিছু অদৃশ্য পিছুটান গুলোর জন্য এসকল চিন্তাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেয় অনি। ভালোই তো ছিল সে তার আগের জীবনে। প্রতিদিনের ব্যস্ততা, ভার্সিটি, এসাইনমেন্ট,ল্যাব টেস্ট সব কিছু মিলিয়ে খুব যে খারাপ ছিল তা তো নয়। ছিল হয়তো কিছু অপূরণীয় শূন্যতা। তবুও নিত্য নতুন ভাবে তাকে কোন তিক্ত বিষাদময় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি। রোজ রোজ ভালো মন্দ মেশানো কিছু নতুন নতুন অদ্ভুত অনুভূতি জাগে নি।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অদ্ভুত লাগে তার। নিজের উপর বড্ড হাসি পায়। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড ঘটে তার জীবনে। তার জীবনের সূচনা লগ্ন থেকেই তার সবকিছু এলোমেলো। একটা সুন্দর পরিবার থাকা সত্ত্বেও তেইশ বছরের জীবনে সে কখনোই তার পরিবারের সান্নিধ্য পায়নি। পেয়েছে শুধু শুন্যতা আর অবহেলা। পৃথিবীতে হয়ত সেই সন্তানেরই সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্য যার মা থাকা সত্ত্বেও তাকে মা বলে ডাকার অনুমতি নেই। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে মুচকি হাসে অনি।
পুরো শহরটা ঘুমিয়ে গেছে। জেগে রয়েছে রিশাদ। যে করেই হোক তাকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। সব সোর্স কাজে লাগিয়ে সে শুধু মাত্র একটা কোন উপায় খুঁজছে। হাতে মাত্র আর দুদিন সময় বাকি আছে। রিশাদ ল্যাপটপে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা পড়ছে। স্ক্রল করতে করতে এক জায়গায় এসে রিশাদের চোখ আটকে যায়। পুরোটা পড়ার পর রিশাদ উত্তেজনায় টেবিলে বারি দিয়ে বলে ওঠে;
–“ইয়েস! আই হ্যাভ গট ইট।”
এরপর রিশাদ ফোন বের করে কললিস্ট থেকে জয়ের নাম্বারটা বের করে ডায়াল করে। দু তিন বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে।
–হ্যালো জয়, লিসেন টু মি। আমি একটা উপায় পেয়ে গেছি। তোকে এই মূহুর্তে আমি সবকিছু ডিটেইলস পাঠাচ্ছি ইমেইলে। (রিশাদ)
এতো রাতে ফোন বাজতে দেখে জয় কিছুটা বিরক্ত হয়। ঘুম ঘুম চোখে রিশাদের নামটা দেখে কল রিসিভ করে। রিশাদের কথা শুনে তার ঘুম উড়ে যায়। বিগত কয়েকদিন যাবত রিশাদ তাকে ঠিকমতো খেতে দেয় না ঘুমোতে দেয় না। দিন রাত খুঁজেও কোন উপায় না দেখে যেন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিল। আজ রিশাদের কথায় লাফিয়ে ওঠে জয়।
–কি বলছিস তুই? পেয়ে গেছিস? আমাকে এক্ষুণি ইমেইল করে পাঠা আমি বাকিটা দেখে নেব। তুই আর কিছু ভাবিস না। (জয়)
রিশাদ জয়ের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়। আরো কিছুক্ষণ কাজ করে সে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুটা রিল্যাক্স ফিল হচ্ছে আজ তার। তবে পুরোপুরিভাবে টেনশন ফ্রি হতে পারছে না। তবুও রিশাদ আশার আলো দেখছে। এতো দূর অবধি যখন সে আসতে পেরেছে বাকিটাও সব ঠিক ভাবেই সম্পন্ন হবে।
রুমে এসে অনির পাশে শুয়ে পড়ে রিশাদ।কপালের উপর এক হাত রেখে ঘুমাচ্ছে অনি। চেহারায় স্পষ্ট বিষাদছায়া। এই বিষাদ ছায়াকে প্রশান্তিতে রূপান্তর করতেই এত কিছুর আয়োজন করছে রিশাদ। অনিক যদি কোন বইয়ের মতো কল্পনা করা হয় তবে সেই বইটাকে রপ্ত করার চেষ্টা করছে রিশাদ। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে এসব করছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ও অনির মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্যই তার আয়োজন।
ঘুমন্ত অনন্যময়ী বরাবরই রিশাদের নজর কেড়েছে সেই প্রথম দিন থেকেই। যা হয়ত রিশাদ এখনো অনুধাবন করতে পারেনি। পবিত্র হালাল সম্পর্কগুলোর জোর সবার উর্ধ্বে কেননা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এই সম্পর্কগুলো গড়িয়ে দিয়েছেন।
রিশাদ এক ধ্যানে অনির দিকে তাকিয়ে আছে। অনির লম্বা লম্বা চোখের পাপড়িগুলো হালকা কাঁপছে। কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে সে। রিশাদও অনির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকে সংযত করে নেয়। অনিকে নিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে আসা কল্পনাকে গুলোর জন্য সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না সে। নানান ধরনের কল্পনা জল্পনার মধ্যে দিয়ে তন্দ্রাভাব চলে আসে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় রিশাদ।
চলবে…….