মোনালিসা পর্ব ১১

0
2344

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ১১

এদিকে গত তিন – চারদিন যাবত আচমকা রাজীবের ব‍্যবহারের আকস্মিক পরিবর্তনে মনে মনে বেশ অবাক হয় আবীর।
সে যে এখন কয়েক বছর ইন্ডিয়াতেই থাকবে, একথাও আর রাজীবকে জানানো হয়নি।
অবশ‍্য এমনিতেই তার জীবনের অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করার জন‍্য তাকে থাকতেই হতো ইন্ডিয়াতে।
এদিকে রাজীবের সাথে অনেককিছু ডিসকাস করা দরকার।
কিন্তু, রাজীবেরই পাত্তা নেই।

তাই, আগের রাজীব আর এখনকার রাজীবের আকস্মিক পরিবর্তনের মুহূর্ত গুলো মনে মনে মেলাতে থাকে সে। এখন ফোন করলেও ফোনে সেই ভাবে কথা বলে না রাজীব। আবার বার বা ডিস্কোয় যাবে বলে কথা দিয়েও আসেনা।
নিজের জীবনের এখনকার ঘটনার কিছুই শেয়ার করেনা, কেমন যেন এড়িয়ে যায়।
অথচ এতোদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার পর এমন আচরণ অভাবনীয় ।

এ সমস্ত ভাবনার মাঝেই এক কাপ ব্ল‍্যাক কফি নিয়ে নিজের দোতলার ঘরের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
সেখানে দাঁড়িয়ে দূরে রাস্তায় চলমান মানুষগুলোর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতরো হয়ে ক্রমে মিলিয়ে যাওয়ার দৃশ‍্য দেখে মনে মনে হাসে আবীর এবং ভাবে – “জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই হয়তো এভাবে ক্ষুদ্র থেকে আবছা হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। ”
উইথআউট সুগারের ব্ল‍্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে তার স্বাদ আস্বাদন করতে করতে মনে মনে একটা ক্রূর হাসি হেসে সে ভাবে – “জীবনের তিক্ততাকে ভুলে মানুষ বাঁচতে চায় ,একথা ঠিক। কিন্তু, যারা এই স্বাদহীন কফির মতো জীবনের তিক্ততাকে পান করে তার আস্বাদন নিয়ে বেঁচে থাকে, তারাই হয়তো প্রকৃত শক্তিশালী।
তাই মি: রাজীব তুমি চাইলেও তোমাকে আমি তো আবছা হতে দেবোনা জীবন থেকে।

বছরে ঋতু পরিবর্তন যেমন সময়ের সাথে সাথে ঘটে ঠিক তেমন ভাবেই সময়ের সাথে সাথে মানুষের মনের পরিবর্তনও ঘটে। ঠিক যেমনটা রাজীব আর লিসার জীবনে ঘটছিল তাদের নিজেদের অজান্তেই।
আর সেইসঙ্গে দুই প্রতিবেশী (লিসা ও রাজীব) – র মনেই একে অপরের বিষয়ে কৌতূহলের পারদও ক্রমে বেড়ে চলছিল।
পাশাপাশি থাকতে থাকতে ক্রমে একে অপরের অভ‍্যাসে পরিণত হচ্ছিল দুটি মন।
তাই প্রবল উৎসাহের সাথে একজন অপেক্ষা করতো একজনের অফিসে বেড়িয়ে যাওয়ার সময়ের জন‍্য । যাতে সেই সময়টুকুতে নতুন কোনো চিঠি পুনরায় সে আবিষ্কার করতে পারে।
আর অন‍্যজন অপেক্ষা করতো একজনের গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন মুহূর্তের জন‍্য। যাতে সেই মুহূর্তে ঘুমন্ত এক নিষ্পাপ মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ সে তাকিয়ে থাকতে পারে এবং সুযোগ বুঝে লিসার লুকিয়ে রাখা ফটোর ব‍্যক্তিটির রূপ সে আবিষ্কার করতে পারে।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন মাঝরাতে আচমকা রাজীবের ঘুম ভেঙে যায়। এত রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেলে, তা যে অতি সহজে এসে আবার তার চোখে ধরা দেবেনা – একথা সে বিলক্ষণ জানে । তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে বেশ বেশ কয়েকটা টান দেওয়ার পর শূন‍্যে কয়েকটা ধোঁয়ার বলয় ছেড়ে ,অ্যাশ ট্রেতে সিগারেটটা ফেলে আড়মোড়া ভেঙে ঘরের বাইরে বেরোয় সে।
দরজা খুলে বাইরে বেরোনো মাত্র সে দেখে লিসার ঘরের দরজা খোলা।
সেদিকে চুপিচুপি সন্তর্পণে এগিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখে লিসা গভীর ঘুমে মগ্ন।
আর ঠিক তার মাথার কাছে একটা ব‍্যাগ রাখা।

অন‍্যের ব‍্যাগে না বলে হাত দেওয়া অন‍্যায় জেনেও ফটো রহস‍্যের সত‍্য উদঘাটনের জন‍্য চুপিচুপি ব‍্যাগটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে রাজীব।
তারপর ব‍্যাগ খুলে তা হাঁতরানো মাত্রই তার ভেতর থেকে প্রথমেই বিভিন্ন তারিখ দেওয়া চিঠি সে আবিষ্কার করে । একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে প্রতিটি চিঠির ভেতরের লেখার ফটো সে ফোনে তুলে নেয়।
তারপর ব‍্যাগ হাঁতরে তার হাতে পড়ে একটা বন্ধ মোবাইল।
সবশেষে সেই ফটো ফ্রেমটা সে আবিষ্কার করে। কিন্তু ,ফটো ফ্রেমের ফটোটা দেখামাত্র তার মন খারাপ হয়ে যায়। ফ্রেমে একজন ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলার ফটো একসাথে বাঁধানো এবং জন্ম ও মৃত‍্যু সাল দেওয়া।
ফটোটা দেখার পর থেকেই যেমন ফটোর মানুষগুলো যে লিসার বাবা- মা জেনে তার যেমন নিশ্চিন্ত লাগে ঠিক তেমনই ভুল সন্দেহের জেরে বুকের বোঝা নেমে গেলেও তাকে তার নিজের বিবেকই যেন ভৎসনা করতে থাকে।

নিজের কার্য সিদ্ধি হওয়ার পর ব‍্যাগের সবকিছু গুছিয়ে একইরকম ভাবে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে লিসার ঘরে গিয়ে ব‍্যাগটা যথাস্থানে রেখে আসে রাজীব।

রাতের বাকি সময়টুকু নিজের কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটানোর জন‍্য একটার পর একটা চিঠি পড়তে শুরু করে রাজীব। পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই বাইশ বর্ষীয় তন্বীর প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে সে।
শেষ যে চিঠিটাতে এসে তার চোখ আটকে যায় , সেটি হল এইরূপ –

আমি লিসা,

মন ঠিক কী রকম হয়! তা আমার জানা নেই। কারণ, আজ অবধি মন আমাকে বারে বারে এমন অবস্থার সম্মুখীন করেছে যেখান থেকে ফিরে আসা প্রায় সম্ভবই নয়।
আমি খুব ভালো করে জানি, আমার এ নতুন ঠিকানায় থাকার মেয়াদ ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। তবুও এক অমোঘ টানে যেন এ ঠিকানার প্রতিটি ইঁট – কাঠের সাথে আমার মন মিশে যাচ্ছে।
প্রতিদিন একটা চিঠি প্রাপ্তির নেশায় আমি আসক্ত হয়ে পড়েছি। স্টাডিরুমের প্রতিটি বইয়ের পাতা জানে আমার আকুলতা।
কারোর জীবনের গোপন পাতাগুলোর উন্মোচন করতে গিয়ে ,সেই পাতাগুলো জুড়ে কখন যে একটা আস্ত বই রচনা করে ফেলেছি আমি, তা আমি নিজেও জানিনা।
কিন্তু, ভারী অবাক লাগে তখন ,যখন আমার খেয়ালে বা বেখেয়ালে সেই বইয়ের প্রচ্ছদে আমি যেন একজনের পাশে আমার ছবিই দেখতে পাই। জানি, এ কথা ভাবাও পাপ।
যে মনের ঘর আগেই অন‍্য কেউ দখল করে বসে আছে, সেখানে কাউকে উচ্ছেদ করে নিজের স্থায়ী ঠিকানা গড়তে আমি চাইনা।
অপেক্ষারও একটা আলাদা অনুভূতি থাকে প্রাপ্তি বিশেষে। কিন্তু, যে অপেক্ষায় বিদায় অবশ‍্যম্ভাবী, তা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক! তার উপলব্ধি একমাত্র সেই করতে পারে, যার সাথে তা ঘটে।
গত পরশু “দেবদাস” বইয়ের ভাঁজে যে চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে আমার মনের আকুলতা দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। তা হল সেই চিঠিতে উল্লেখ্য কয়েকটা লাইন – “প্রত‍্যেক প্রেমিকই তার মনের ঘরে পার্বতীর স্থান ফাঁকা রাখে। কিন্তু, অজানা ঝড়ের গ্রাসে তা তছনছ হয়ে যায়। পার্বতীরা হারিয়ে যায়। প্রেমিকের যন্ত্রণা বোঝে শুধু সুরা। আর ধীরে ধীরে প্রেমিক পৌঁছে যায় তার গন্তব্যে। যেমন দেবদাস পৌঁছে গেছিল।
জীবনের অন্তিম ক্ষণেও যদি একটিবার তার মুখ দেখতে পাই তাই হবে আমার প্রাপ্তি।
উর্বশী আজও তোমার পথ চেয়ে একান্তে অপেক্ষামান তোমার দেবদাস।”
এই লাইনগুলো সেই চিঠি থেকে যতবার পড়েছি ,তা যেন ততবারই আমার মনে স্পষ্ট ভাবে ছাপা হয়ে গেছে।
আমি জানিনা একজন মানুষের আমৃত্যু আর একজনের জন‍্য অপেক্ষা করার জন‍্য তার প্রতি কাতরতা দেখাবো।
নাকি নিজে শূন‍্যস্থানে দাঁড়িয়ে আছি বলে কষ্ট পাবো!
জীবনের এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে শুধু প্রার্থনা ব‍্যতীত আমার আর কিছুই করণীয় নেই।
আজ আমি প্রার্থনা করছি আমার প্রতিবেশীর জন‍্য। নিজের সর্বোচ্চ ক্ষতি স্বীকার করেও আমি চাই – সে যেন তার প্রাপ‍্য ভালোবাসা সুদ সমেত ফেরত পায়।

——————————–

ভোরের সূক্ষ আলো ঘরে ঢুকে পড়ে বিছানার কিছুটা দখল করে নিয়েছে।
আর বিছানার একপাশে বসে উদাস মনে ভোরের স্নিগ্ধ আলোর দিকে তাকিয়ে রাজীব মনে মনে ভাবে – “ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে সকল প্রাণীকে যেমন জেগে উঠতে হয় ঠিক তেমনই মনের আঁধার ভেদ করে কারো জীবনে যখন ভোরের এক সূক্ষ আলোর প্রবেশ ঘটে। তখন সময় থাকতে সেই মানুষটিকেও জেগে উঠতে হয়।
তাই আর এ আলোকে আলেয়া ভ্রমে হারিয়ে যেতে সে দেবেনা। ”

তাই এবার কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটা চিঠি লিখে স্টাডিরুমে একটা বইয়ের ভেতর রেখে আসে সে।

এরপর যথাসময়ে একটু বেলার দিকে রাজীব অফিসে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র স্টাডিরুমে হানা দেয় লিসা। কারণ, এ যে তার অন‍্যতম অভ‍্যাসে পরিণত হয়েছে।

স্টাডিরুমের বিভিন্ন বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে শরৎচন্দ্রের “দত্তা” উপন‍্যাসের মাঝামাঝি একটা চিঠি সে আবিষ্কার করে । যে চিঠিতে লেখা –

নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা বড় কঠিন কাজ। আজ পর্যন্ত মনের আঁধারে ভালোবাসার আলো ভেবে যে আলেয়ার পিছনে ছুটেছি আমি তা যে নিছক ভালো লাগা ছিল তা বেশ উপলব্ধি করতে পারি এখন।
উর্বশীর একদিনের মোহ টান যে আমাকে ক্রমশ অতলে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তা এতোদিনে বুঝলাম।
আসলে ভালোবাসার প্রকৃত মানেই হয়তো এতদিন আমার অজানা ছিল। শরীরী টানের আসক্তি অপেক্ষা মনের টানের ব‍্যাপ্তি যে অনেক বৃহৎ তা এতোদিনে বুঝলাম।
আসলে আশ্চর্যের অনুসন্ধানে এগিয়ে আমরা হয়তো অনুধাবন করতে করতে সবচেয়ে সস্তা জিনিসের আকর্ষণকে নিজের সর্বোচ্চ পাওয়া হিসাবে ভাবি।
তবে সে ভ্রম তখনই ভাঙে, সত‍্যিকারের আশ্চর্য কিছু এসে আমাদের ঝুলিতে ধরা দেয়।
যে আশ্চর্যকে যতই পরখ করিনা কেন সবশেষে ততোধিক আশ্চর্যই হতে হয়!
আমার মনের অন্ধকার নাশ করতে বদ্ধ দ্বারের ছিদ্র ভেদ করে কখন যে ভোরের আলো এসে প্রবেশ করেছে ,তা আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি।
এখন শুধু দ্বার খুলে তাকে অভ‍্যর্থনার অপেক্ষা। জানি না, সে আদৌ আমার জীবনের চিরকালীন স্নিগ্ধ আলো হয়ে ধরা দেবে কিনা!
তাকে এক মুহূর্ত দেখতে না পেলে আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। জানিনা, একই অনুভূতি তারও হয় কিনা!
তবে তার অপেক্ষার উপহারে বিদায় নয় ,নিজের সারাটা জীবন তুলে দিতে পারি তার হাতে।

– রাজীব

চিঠির শেষের লাইনগুলো বার বার পড়ার পর মনের মধ‍্যে এক অদ্ভুত উন্মাদনায় সারা শরীর নেচে ওঠে লিসার।
একছুটে সিঁড়ি পার করে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের ঘরে গিয়ে, প্রথমেই নিজের ব‍্যাগ খুলে সবকিছু ঘাঁটাঘাঁটি করার পর তার বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, তার অজান্তেই তার গোপন ডেরায় হানা দিয়ে জমানো সমস্ত কিছুর পাঠোদ্ধার আর একজনের করা হয়ে গেছে।
একথা বুঝতে পারার পর তার রাগ হওয়ার বদলে দ্বিগুণ আনন্দ হতে থাকে।
এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে একটা চিঠি লিখে নিজের ব‍্যাগের উপর রেখে দেয় সে।

এদিকে অফিসে বসে অবধি রাজীবের মনে একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে চিঠিটা কি আদৌ মোনালিসার হাতে পড়লো! নাকি চিঠিটা বইয়ের পাতায় বন্দি হয়েই রইলো।

এসব ভাবনা শেষে বাড়ি ফিরে অধিক রাতে যখন সন্তর্পণে আবারও সে লিসার ঘরে হানা দিল, তখন বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর ভান করে থাকা লিসা – আর একজনের উপস্থিতির ঘ্রাণে মনে মনে বেশ আনন্দিত হতে থাকলো।

এরপর থেকে ধরা না দিয়েও এইভাবে চিঠিতে চিঠিতে ভালো লাগা শুরু হল দুটি পৃথক মনে।

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here