মোনালিসা পর্ব ৬

0
2268

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৬

হালকা শীতের আমেজে বাতাসে ঠান্ডা ভাব উপস্থিত। গঙ্গার পাড়ে বসে সূর্যের পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া লালচে আভার দিকে তাকিয়ে আর একটা সিগারেট ধরায় রাজীব। তারপর বলতে থাকে –
“বাইনোকুলারে দেখা মোহময়ীর টানে শর্টস পরা সেদিন সেই অবস্থাতেই ছুটলাম সমুদ্রের দিকে। কিন্তু, আমি যখন গিয়ে পৌঁছালাম তখন অন‍্যান‍্য লোকজনের উপস্থিতির মাঝে আমার চোখ যাকে খুঁজছিল তাকে পেলাম না। একরকম ভাবে নিরাশ হয়ে ফিরলাম রিসর্টে। সন্ধ‍্যেবেলা কানে হেডফোন দিয়ে গান গান শুনতে শুনতে আর বিয়ারের ক‍্যান নিয়ে গিয়ে বসেছি সমুদ্রের বীচে।
সমুদ্রের উদ্দাম ছন্দ, হেডফোনে গান আর তার সাথে কয়েক সিপ বিয়ার নিয়ে মনের উদ্দাম ছন্দে যখন মন তাল মেলাতে ব‍্যস্ত ,তখনই ছন্দপতন ঘটলো।

কিছুটা দূর থেকে জোরে জোরে আসা কিছুর আওয়াজে আমার ছন্দে প্রাথমিক ভাবে ব‍্যাঘাত ঘটে।
ঠিক করি যে বা যারাই জোরে জোরে আওয়াজ করুক না কেন, তাদের গিয়ে বলবো একটু আওয়াজটা কম করতে।

কানের হেডফোন খুলে আওয়াজ লক্ষ‍্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখি একদল ছেলেমেয়ে গোল হয়ে বসে অন্তাকসরি খেলছে।
“শুনছেন?”….. বলে সবে কিছু বলতে যাবো…ঠিক সেই সময় তাদের মাঝ থেকে নীল রঙের গাউন পরে গিটার হাতে যে ‘ইয়েস’ বলে আমার দিকে এগিয়ে এলো । প্রথমে তাকে দেখে বিস্ময়ের ঘোরে আমার মনে হতে থাকে , সকালের সেই মোহময়ীর রূপ নিয়ে সমুদ্রের একটি ঢেউ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, আমার হয়তো নেশা হয়ে গেছে তাই আমি ভুলভাল দেখছি।
ভাবনার দোলাচলে যখন আমি পাথরের মতো নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে তখন প্রথম তার গলা আমি শুনতে পাই । ভাবনার ঘোর কেটে দেখি সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে জিজ্ঞাসা করছে – “কিছু বলবেন?”

আমি শুধু হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, “না”।

সে ততটাই বিনয়ীভাবে চারপাশটা দেখে নিয়ে আমাকে বলেছিল,” ইফ ইউ ফিল অ্যালোন, ইউ ক‍্যান জয়েন উইথ আস। আমরা সব বন্ধুরা এসেছি এখানে,সো আপনার প্রবলেম হবেনা। ”

“নো থ‍্যাংকস।”….বলে কোনরকমে সে যাত্রায় আমি সেখান থেকে হোটেলে চলে এলেও আমার হৃদস্পন্দনের গতি দ্বিগুণ মাত্রায় ছুটছে তখন।

সে রাতে আর ঘুম এলোনা। সারারাত একটা মুখই আমার চোখের সামনে ভাসছিল। তার বলা কথাগুলো কানের সামনে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

পরদিন সকালে উঠতে একটু বেলা হয়ে যায়। প্রাতরাশ সেরে ব‍্যালকনিতে বসে চোখ বন্ধ করে গতকাল রাতের কথা ভাবছি এমন সময় রিসর্টের রিসেপশন থেকে একটা ফোন আসে আর আমাকে জানানো হয় – বিকেলের মধ‍্যে রিসর্ট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে আমাকে অন‍্যান‍্য টুরিস্টদের মতো। কারণ, আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের জন‍্য রিসর্ট ছাড়তে হবে।

জানিস, তখনও ভাবতে পারিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সাথে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জীবনেও এক চরম দুর্যোগ আসতে চলেছে।

যথারীতি সন্ধ‍্যে ছটা নাগাদ রিসর্ট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বিকেল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল আর তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল।
গাড়ি সাথে ছিল বলে আমার খুব একটা চাপ ছিলোনা। লাগেজ ডিকিতে তুলে কয়েকটা বিয়ারের বোতল সামনে রেখে হালকা মিউজিক চালিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছি নিস্তব্ধ নির্জন রাস্তা ধরে।
এরকম একটা ওয়েদারে একা লংড্রাইভ করে বাড়ি আমার কাছে ড্রিমের মতো ছিল।
গাড়ি চালাতে চালাতে বুঝতে পারছিলাম বৃষ্টির বেগ বেশ বেড়ে চলেছে । কারণ, গাড়ির কাঁচ দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।
নিস্তব্ধ নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি । মাঝে মাঝে দু- এক সিপ বিয়ার গলায় চালান করে দিচ্ছি। ঘন্টাখানেক এভাবে চলার পর আচমকা একটা গাছের নিচে আধভেজা অবস্থায় কাউকে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন‍্য হাত নাড়তে দেখে গাড়ি থামালাম। গাড়ির আলোর সামনে যখন হাত নাড়তে থাকা আগন্তুক কে দেখলাম তখন যেন আমার হার্ট আর হার্টের জায়গায় নেই।
এ যে সেই মোহময়ী! কাঁপতে থাকা হাতে গাড়ির কাঁচ নামানোর সাথে সাথে সে জানায় তার বন্ধুরা অন‍্য গাড়িতে এগিয়ে গেছে আর বাসও মাঝপথে তাকে নামিয়ে দিয়েছে তাই আমি যদি তাকে কলকাতা পৌঁছাতে সাহায্য করি তাহলে সে উপকৃত হবে।
ভগবান অলক্ষ‍্যে থেকে সেদিন যে লুকোচুরি খেলা খেলছিল আমার সাথে তাতে আমার মনকে নিজের আয়ত্তে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা।
অগত‍্যা তাকে লিফট দিই। এবং নিজের মনকে বোঝাই বিশেষ দরকার ছাড়া তার চোখের দিকে আমি তাকাবো না ।
সর্বাঙ্গ ভেজা অবস্থায় সেদিন সামনের সীটে বসেছিল উর্বশী। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিজের নাম, পরিচয় একে একে সব জানিয়েছিল সে আমাকে। এইভাবে দু – একটা বাক‍্যবিনিময়ের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর আমার কাছে আমাদের সম্পর্কটা হঠাৎ যেন খুব সহজ হয়ে যায় । এ অবধি সব ঠিকঠাকই ছিল । কিন্তু, তারপর…….”
এ অবধি বলে এক উদাসী দৃষ্টি নিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব।

রাজীবের কাঁধে ভরসার হাত রেখে আবীর বলে ওঠে , “তারপর কী হল?”

একটু কেশে নিয়ে রাজীব বলতে থাকে –
“গল্পে কথায় আরো ঘন্টা খানেকের মত পথ সবে পার করেছি। কলকাতা পৌঁছাতে তখনও দু – আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে। এমন সময় অন্ধকার নির্জন রাস্তায় আমাদের এগিয়ে চলার পথে দেখি একটা বড় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে।
এদিকে তখন বৃষ্টিও মুষলধারে পড়ছে । আশেপাশে কোনো লোকজনের চিহ্ন মাত্র নেই। বুঝতেই পারি সকালের আগে গাছ সরানো সম্ভব নয়। অগত‍্যা কিছু দূরে ফেলে আসা একটা বাড়ির কথা মাথায় আসতেই গাড়ি ব‍্যাক করি।
গাড়ি ব‍্যাক করলে কী হবে! সেদিন হয়তো ভগবান সত‍্যি অন‍্য কিছু ভাবনা ভেবে রেখেছিল আমাদের জন‍্য।
নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চাইলে সেদিন বাড়ির মালিকের অবর্তমানে কেয়ার টেকার আমাদের বাড়ির গ‍্যারেজে গাড়ি সমেত রাত কাটানোর অনুমতি দেয়।
গ‍্যারেজে গাড়ি রেখে পাশের ফাঁকা জায়গায় যখন সিগারেট ধরিয়ে বেশ কয়েক টান মেরে সামনে ফিরতেই দেখি গাড়ির ভেতর রাখা বিয়ারের ক‍্যানের একটি তুলে নিয়ে গাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে গলায় চালান করছে উর্বশী।
সেই প্রথম তার কাঁপতে থাকা গলা থেকে চোখ সরে গিয়ে আমার নজর আটকে গেল তার শরীরের দিকে। গাড়িতে থাকার জন‍্য তার ভেজা শরীরের দিকে দৃষ্টি যায়নি আমার।
কিন্তু, ভিজে শালোয়ারে উর্বশীর শরীরী অবয়বের চিত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠার সাথে সাথে এক আদিম সত্তা ক্রমে আমার অন্তরে প্রকট হচ্ছিল।
যে সত্তা আদিম হিংস্রতায় ভর করে এক ক্ষুধার্ত হায়নায় আমাকে পরিণত করছিল ক্রমে। মনের শত বাধা সত্ত্বেও শরীরকে বাধা দিতে মন অপারগ হয়ে পড়েছিল সেদিন।
যে কথা আজও মন পড়লে নিজের উপরই নিজের ঘেন্না হয় আমার।”
এইবলে কিছুক্ষণ থামার পর রাজীব আবারও বলতে থাকে,
“উর্বশীর শরীরী গন্ধের ঘ্রাণ খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার জন‍্য মন্ত্রমুগ্ধের মত ধীর পদক্ষেপে আমি এগিয়ে যেতে থাকি তার দিকে।
তার মুখোমুখি গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন তার ভেজা চুল বেয়ে ঝরতে থাকা জলবিন্দু কখনো তার গাল, কখনো চিবুক, কখনো ঠোঁট বেয়ে ঝরে পড়ছে শালোয়ারে।
চোখের দিকে তাকানোমাত্র বুঝলাম সেও তার ভিজে যাওয়া চোখের পলকের জলবিন্দু ফাঁক দিয়ে এক নেশারু দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণে ব‍্যস্ত।
আর অদ্ভুত ভাবে আমার মনে হচ্ছিল তার কাঁপতে থাকা গোলাপি ঠোঁটের পাপড়িরা আমাকে অস্বীকার আর আহবানের ইঙ্গিত একত্রে যেন দিচ্ছে।
কোনরকমে উর্বশীর একদৃষ্টে আমার তাকিয়ে থাকা নজর থেকে নিজেকে সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে প্রথম সে আমাকে এমনভাবে বাহুবন্দি করে যে নিজের ভাবনা চিন্তা বোধ আমি হারিয়ে ফেলি।
প্রথম কোনো নারী শরীরের পূর্ণ সমর্পণ আমাকে নিরুপায় করে তোলে। আমি পারিনি সেদিন উপেক্ষা করতে সেই মুহূর্তকে। সমর্পণ করে দিয়েছিলাম নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে। ডুবিয়ে দিয়েছিলাম নিজের নিকোটিন ছোঁয়া ঠোঁটকে তার গোলাপি ঠোঁটের পাপড়িতে। আস্বাদন করেছিলাম জীবনের প্রথম ভালোবাসার স্বাদ।
সারারাত গাড়িতে কাটিয়ে সকালে দুর্যোগ শেষে আলোর রেখা যখন গাড়ির কাঁচে পড়ে তখন তাকিয়ে দেখি একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে আমরা গাড়ির ভেতর। উর্বশী তখনও ঘুমিয়ে। ঘুমন্ত অবস্থায় আরও একবার তার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে ভালোবাসতে মন চাইলেও আমি চুপ করে শুধু তার ঘুমন্ত রূপ দেখতে থাকি।
সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একবারের জন‍্যও বুঝতে পারিনি যে, সেদিন বাইরের দুর্যোগের থেকেও ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে আসতে চলেছে আমার জীবনে। আর সেই দুর্যোগ থেকে রেহাই পাওয়ার পথ আমি আজও খুঁজে পাইনি ।”

“মানে?……” অবাক ভাবে জিজ্ঞাসা করে আবীর।

“মানে – পরেরদিন কলকাতায় পৌঁছনোর পর আমাকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার নম্বর নিয়ে তাড়াহুড়োতে আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় উর্বশী। গাড়িতেও খুব বেশি কথা আর সে বলেনি সেদিন। আমি ভেবেছিলাম লজ্জায় হয়তো কথা বলতে পারছে না।”

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here