#চতুষ্কোণ পর্ব:—০৬
Sharifa Suhasini
মাহদী আতিয়ার কাছে এসে ওর হাত ধরে বললো,
—আমার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তুমিই দায়ী, আতিয়া। দেখেছো, দুই বছর আগে তোমার উদারতার ফল আমাকে কীভাবে ভোগ করতে হচ্ছে! তুমি এখনও বুঝতে পারছো না, এই বাচ্চাটা কীভাবে হতে পারে?
আতিয়া ব্যাগ ছেড়ে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে গেল। নিজের অজান্তেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অনুশোচনার ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকালো। এতক্ষণ কেন এই ব্যাপারটা তার মাথায় এলো না! অথচ সেই থেকে মাহদীকে দোষারোপ করে সে ঘর ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করছিলো না। আজ সে নিজের মনের অবিশ্বাসের মালা পরে কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছিল! উঁহু, সত্যিই অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মাহদীর মত মানুষকে সে অবিশ্বাস করেছে, মাহদী! তার মানে নাবিলা নিজেই কৌশলে তাদের জীবনের এত মহান একটি উদ্যোগকে এমন বিচ্ছিরি একটি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে?
আতিয়া লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে মাহদীর চোখের দিকে তাকালো। মানুষ ভুল করে, ভুল বোঝে। তারপর দুঃস্বপ্নের অমানিশায় ডুবে দূরাশা দেখতে দেখতে একদিন প্রিয় মানুষ আর সময়ের থেকে দূরে সরে যায়। অথচ আজ সে ক্ষণিকের ব্যবধানেই নিজের শরীর আর মন দু’স্থানেই দুরূত্বের বেড়াজাল তৈরি করে নিয়েছে। তাও আবার এমন একটি মিথ্যেকে আঁকড়ে ধরে সেই বেড়াজাল, যেখানে মাহদীর বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই।
বছর দুই আগে আতিয়ার জরায়ুমুখের বিশেষ সমস্যার জন্য জয়িতা ক্লিনিকে যেতে হয়েছিল। কৈশোর বয়স থেকেই ক্লিনিকটির সাথে আতিয়ার দৈনন্দিন জীবনের মতই সখ্যতা। পারিবারিক যেকোনো শারীরিক সমস্যাতেই সে জয়িতা ক্লিনিকে চলে যেত। ক্লিনিকের ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী এবং ডাঃ আতিকুর রহমান আতিয়া’র বাবা ফরাজি শেখের বিশেষ পরিচিত। তিন বছরের ব্যবধানে ফরাজি শেখ ডাঃ অনুপম এবং ডাঃ আতিকুরকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। পরবর্তীতে তার বিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রই একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। ভদ্রলোকের শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্রই বহু উচ্চাসনে আসীন হয়েছে বটে। তবে এই দুজনের সাথে নতুন করে সাক্ষাৎ জয়িতা ক্লিনিকেই। প্রথমবার স্ত্রীর অসুস্থতার সময় স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা সন্তান আতিয়াকে নিয়ে জয়িতা ক্লিনিকে যাবার প্রথম দিনেই তার দুজন প্রাক্তণ ছাত্রের সাথে পুনঃ আলাপ ঘটে। যে কয়টা দিন তিনি ক্লিনিকে ছিলেন, দুজন ডাক্তার মিলে একটা দিনও তাকে সমস্যায় পড়তে দেয়নি।
সময়ের ব্যবধানে ডাঃ আতিকুর রহমান চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চলে গেলেও ডাঃ অনুপম এখনও জয়িতা ক্লিনিকেই রয়ে গেছেন। পুরনো সখ্যতার সূত্রে নিজস্ব যেকোনো অসুস্থতায় আতিয়া আজও জয়িতা ক্লিনিকেই ছুটে যায়। ঠিক যেভাবে গেছিল বছর দুয়েক আগে। ডাক্তার দেখানো শেষে রিপোর্টের অপেক্ষায় মাহদীর সাথে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করেছিল সে। সেখানেই মিনিট দশেক পর একটি অল্পবয়সী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের সাথে আলাপ পরিচয়ের পসরা সেজে ওঠে তাদের। ছেলেটির নাম রিদ্য রিসান। মাহদীর দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে প্রশ্ন করে,
—আপনার ওয়াইফকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন নিশ্চয়?
মাহদী বেশ অবাক হয়েই তাকে প্রশ্ন করে,
—তা সত্য। তবে তুমি কীভাবে বুঝলে?
—এ আবার কঠিন কী হলো বলুন তো? আপনাকে দেখে যথেষ্ট সুস্থ, সবল এবং জোশ একজন যুবক লাগছে। নরমালি স্ত্রীরা অসুস্থ হলে তার স্বামীই সাথে করে নিয়ে আসে। আর আপনি উনার স্বামী-এটা এখানকার দু বছরের বাচ্চাও বলতে পারবে। দুনিয়ার যেখানেই যান না কেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে এমন কিছু কমন আচরণ পাওয়া যায়, যেটা অন্য কোনো সম্পর্কে পাওয়া যায় না। আর সত্যি বলতে, বাকিটা আমি একেবারে আন্দাজ করে বলেছি। আর আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেও সঠিক জায়গায় লাগলো। হা হা হা।
মাহদী এবং আতিয়া ছেলেটির কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর দুজনেই বেশ শব্দ করে হেসে ফেলে। ছেলেটির কথায় জাদু আছে। আর সেই জাদুতে মুহুর্তেই অন্যের মন ভালো করার ক্ষমতা। আতিয়া ছেলেটির আপাদমস্তকে একবার দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করে,
—দেখে মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বয়সে ছোটই হবে। তুমি সম্বোধন করেই বললাম ভাই। কিছু মনে করো না যেন। তা তুমি কাকে নিয়ে এসেছো?
—কাউকে না। আমি নিজেই এসেছি।
—কিন্তু এখানে তো অধিকাংশই চর্ম, যৌণ, শারীরিক বিশেষ জটিলতার বিশেষজ্ঞরা বসেন।
এইটুকু বয়সে তোমারও সমস্যা হয়ে গেছে?
মাহদী তার চোখের সীমানা প্রায় কপালে তুলেই প্রশ্ন করলো। ওর বিস্ময়ের ভার দেখে রিদ্য হাসতে হাসতে জবাব দেয়,
—উঁহু, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তো এখানে মানুষকে সহযোগিতা করতে আসি। সত্যি বলতে আমি একজন ডোনার, স্পার্ম ডোনার। এই পৃথিবীতে অনেক দম্পত্তি আছেন, যাদের সন্তান হয় না। সন্তান এবং জীবনের আশা শেষ বসন্তে পৌঁছে যাদের আর বিশেষ কোনো স্বপ্ন থাকে না, আমি তাদের আশার আলো দেখাই।
স্পার্ম ডোনেশন বিষয়টি একেবারে নতুন নয়, বেশ পুরাতন। কিন্তু সেই কাজেও কেউ যে নিজের খুশি খুঁজে পায়, সেটা আজ স্বচক্ষে না দেখলে ওরা দুজন কখনোই টেরই পেত না। রিদ্যের মুখে যত তার কার্যক্রম নিয়ে শোনে, ততই যেন মুগ্ধ হয়ে যায় তারা। ওর এই কাজটি তাদের কাছে চমৎকার লাগলো। পূর্বে ব্লাড ডোনেশন, অর্গান ডোনেশন নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আতিয়া নিজেই অনেক কাজ করেছে। কিন্তু স্পার্ম ডোনেশন নিয়ে কখনো কারো পক্ষ থেকে বিশেষ তথ্য পায়নি।
সেদিন রিদ্য চলে যাবার পর আতিয়া নিমগ্ন হয়ে ব্যাপারটি ভাবে। এরপর মাহদীর দিকে ফিরে নিষ্পলক ভঙ্গিতে চেয়ে সদ্য জাগ্রত বিবেকের কথা বুঝিয়ে দেয়। মাহদী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো,
—আমাকে দিয়ে এসব সম্ভব? দেখো, আমাকে এত মহান হতে বলো না। আমি পারবো না। এসব লজ্জাজনক কাজ।
—মাহদী! আমি তোমাকে কিছুই করতে বলছি না। কিন্তু আজ আমার কলেজের খুব কাছের একজন বান্ধবী, মিথিলার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ওর স্বামীর সমস্যা। কলেজে থাকতেই বিয়ে হয়ে গেছিল। আজ দীর্ঘ নয় বছরেও মা ডাক শুনতে পায়নি। এরকম কতশত দম্পত্তি সন্তানহীন হয়ে জীবন পার করছে, তাই না বলো? রিদ্যের মত কিছু মহান মানুষ আমাদের অজান্তে তাদের ভালোবাসার ডালি উপহার দিচ্ছে। এত সুন্দর কাজ আর দ্বিতীয় কিছু হয়?
আতিয়ার কথাগুলো সেদিন বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও বাড়ি ফেরার পর ব্যাপারটা নিয়ে মাহদী একটু বেশিই সিরিয়াস হয়ে পড়ে। গুগলে, ওয়েবসাইটে খোঁজ নিতে শুরু করে- এভাবে ঠিক কতশত মানুষকে সে সহযোগিতা করতে পারবে! এভাবেই সময়ের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটিই সে নিয়ে বসে। আতিয়া অবশ্য মাহদীর এই সিদ্ধান্তে বেশ খুশিই হয়।
তবে আজ সেই সিদ্ধান্তের ফল এমন জঘন্যরকমভাবে ভোগ করতে হবে, এটুকু সে কখনোই ভাবেনি। আজ নাবিলার এইরুপ নিশ্চুপতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই এত সমস্যার মূল আসলে জয়িতা ক্লিনিক। মাহদী সেখানে স্পার্ম ডোনেট করে, এটা তো বাইরে তথ্য যাবার কথা নয়। অমন নিরাপত্তা আর নিয়মের গন্ডি পেরিয়েও কীভাবে স্পার্ম স্ক্যাম হতে পারে, সেটাই বোধগম্য নয়।
সব শুনে শামীম হতভম্ব হয়ে নাবিলার দিকে চেয়ে আছে। এই মেয়েটিকেই সে অমন গভীর অনুভূতি দিয়ে ভালোবেসেছিল! শামীমের শরীর কেঁপে উঠলো। পুরুষ মানুষের সত্যিকার ভালোবাসা এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর অনুভূতিগুলোর একটি। আর সেই অনুভূতিতে আঘাত লাগলে একজন পুরুষ নিঃশেষ হয়ে যায়। শামীম রাফিয়ানের অবস্থায়ও এই মুহুর্তে ঠিক তেমনই। তার এই কুঁড়ে খাওয়া যন্ত্রণা নাবিলাকে স্পর্শ করলো না। আতিয়া নাবিলার কাছে এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করলো,
—কেন এমনটা করলে নাবিলা? কেন? এত ভালো একটা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হলো। তবুও কেন এমনটি করলে? এসব কথা লোক জানাজানি হলে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না, এটা কী কোনোদিনও ভাবলে না?
নির্লিপ্ত কন্ঠে নাবিলা আতিয়াকে বললো,
—আমি তো কোনোদিনই এসব সত্যি ফাঁস করতে চাইনি। আজ পর্যন্ত কখনও কাউকে বলেছি? এমনকি, জয়িতা ক্লিনিকে কীভাবে এসব করেছি, কেন করেছি, এসবও কোনোদিন কাউকে বলবো না। আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলবো না। আমি যা করেছি, তা আমার জন্য। আপনার কিংবা মাহদীর সংসার ভাঙার উদ্দেশ্য আমার নেই। থাকলে অন্য কথা ভাবতাম।
শামীম আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে সে নাবিলার গালে সজোরে একটা চ*ড় বসিয়ে বললো,
—অসভ্য মেয়ে, এখনও এসব বলতে লজ্জা করছে না? নেহাত এই সন্তানটি আমাদের রক্তের, নাহলে এই মুহুর্তে তোমাকে আমি এই বাড়ির ত্রিসীমানার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে আসতাম। কিন্তু সেটা তো করতে পারবো না। তবে এইটুকু জেনে রাখো, তোমাকে আমার পরিবারে রাখা সম্ভব নয়। তোমাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থেকে তোমার চোখের সামনেই তোমার সমস্ত কুকর্মের ইতিহাস আমি খুঁজে বের করবো। তবে একটা কথা মনে রেখো নাবিলা, “ কাউকে যতটা ভালোবাসলে আর নিজেকে ভালোবাসা যায় না, ঠিক ততটাই তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে অপর মানুষটার বেঈমানীর জন্য সেই ভালোবাসাকেও ত্যাগ করে ফিরে আসতে হয়। ভালোবাসা হারায় না, ম*রে যায়। এজন্যই তাকে আর ফেরত পাওয়া যায় না।” একদিন তুমি আমাকে পাবার জন্য পাগলের মত ছুটবে, কিন্তু আমাকে পাবে না।
শামীম আতিয়া ভাবির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চোখের জল ফেলে সে ভাবির কাছে হাতজোড় করে বললো,
—যা ঘটেছে, তা এই ঘরের বাইরে প্রকাশ করো না ভাবি। তুমি তো জানো, তোমাদেরকে আমি কত সম্মান করি। তোমাদের সংসারে অশান্তি হোক, এমন সুযোগ আমি রাখতে চাই না। আজই আমি এই বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যাবো। নাবিলাকে নিয়ে আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে সরে যাবো। অনেক দূর।
এতক্ষণ পর নাবিলা শামীমের দিকে ফিরে তাকায়। তার সেই ফেরানো দৃষ্টিতে নিদারুণ অসহায়ত্ব। শামীম কী সত্যিই আলাদা হয়ে যাবে?
(চলবে…)