চতুষ্কোণ পর্ব ৫

0
100

#চতুষ্কোণ /পর্ব:-০৫
Sharifa Suhasini

মাহদী সন্তর্পণে কাগজগুলো তুলে নিলো। রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইলার সাথে নাবিলার ছেলের ডিএনএ পঞ্চাশ ভাগ ম্যাচ করছে, যেখানে পিতার সাথে সন্তানের ডিএনএ একই পরিমাণ ভাগ ম্যাচ করে। তার মানে এই ছেলেটি তারই ঔরসজাত। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? মাহদী নিজের প্রতি সম্পূর্ণরুপে আত্মবিশ্বাসী, নাবিলার সাথে তার কোনো ধরণের সম্পর্কই নেই। এমনকি, এর আগে তাকে কোনোদিন চিনতোও না। তাহলে সেই মেয়ের সন্তানের বাবা কীভাবে হবে সে!

মাহদী কী বলবে-সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। সমস্ত প্রমাণ যখন তার বিরুদ্ধে, তখন নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে আর বিশেষ লাভ নেই। এই পরিস্থিতিতে তার একমাত্র কলিজার টুকরো ছোটভাই শামীম রাফিয়ান তার কথা শুনবেও না। তার জায়গায় সে থাকলেও নিশ্চয় এমনই করতো। মাহদী নির্বাক হয়ে শুধুমাত্র রিপোর্টগুলোর দিকেই চেয়ে আছে। এটা সম্ভব নয়, কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নাবিলার দিকে সে আজ পর্যন্ত ফিরেও তাকায়নি। সেখানে তার গর্ভে মাহদীর সন্তান!

শামীম বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে ওপর-নিচ করে মাথা দুলালো। তারপর বললো,
—এবারও নিশ্চয় বলবে,“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” তাই তো?

—এসব বললেই কী তুই মানবি? মানবি না। তবে আমি এই বাচ্চার বাবা নই। আমার কল্পনাতেও আমি এমন কিছু করিনি, যার দরুণ এই বাচ্চা আমার হতে পারে।

—তাহলে মেডিকেল রিপোর্ট কী ভুল বলছে?

—না, সেটাও ভুল নয়। তবে আমি যা ধারণা করছি, তা যদি সত্যি হয়-তবে তোর বউ মানে নাবিলা দোষী। কিন্তু নাবিলা কেন এমন কাজ করতে গেল, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।

—শোনো ভাইয়া, শুধু নাবিলার উপর দায় চেপে তুমি পার পাবে না। এত বোকা আমি নই। তুমি আমার সাথে যেটা করেছো, সেটা কোনো ভাইয়ের কাজ নয়। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘৃণা তোমাকে করি। তুমি আমার ভাই হবার যোগ্য নও।

শামীম রাফিয়ান মাহদীকে পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকতে গিয়ে আতিয়া ভাবির মুখোমুখি হলো। মেয়েটা গাল ফুলিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। না শামীমের দিকে চাইলো, আর না নিজের স্বামীর দিকে। জগতের তামাম বস্তু যেন এই মুহুর্তে হাওয়াই মিঠাইয়ের মত উবে যাচ্ছে তার দৃষ্টিসীমা থেকে। “মাহদী এমন করতে পারে? মাহদী! যেই মানুষটাকে সে বুকের ভেতর আগলে রেখে ভালোবাসা শিখিয়েছে, যেই মানুষটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক বিশ্বাস করেছে, সে কি-না নিজের আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে এমন নোংরা কাজ করতে পারলো?” আতিয়ার গা গুলিয়ে বমি আসার উপক্রম হতে শুরু করলো। মুখ চেপে ধরে সে একছুটে বেসিনের দিকে দৌঁড়ে গেল। আতিয়ার কন্ঠস্বর মাহদীর শ্রবণেন্দ্রিয় স্পর্শ করে যায়। সিক্ত চোখে সে পিছন ফিরে তাকায়। মাহদীর বুকের ভেতর এক অজানা শঙ্কায় ভার হয়ে ওঠে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সেও আতিয়ার পিছু পিছু ঘরের ভিতর ঢুকলো।

কিন্তু ততক্ষণে আতিয়া নিজের ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। বারবার দরজা ধাক্কালেও ভেতর থেকে সে একটি টু শব্দও করে না। ভাবির এই পরিস্থিতি দেখে শামীমও আর রাগ করে বসে থাকতে পারলো না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উঁচু আয়াস্বরে ডাকে,
“ভাবি, দরজাটা খুলুন প্লিজ। রাগের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এর সত্যতা আমি বের করেই ছাড়বো। ভাবি প্লিজ, আপনি আমার উপর একটু ভরসা করুন।”

শামীমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আতিয়া দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। শুধু সে একা নয়, তার হাতে লাগেজ। আর তার ঠিক দরজার সম্মুখে মাহদী, শামীম, ইলা দাঁড়িয়ে আছে। অপরপাশের দরজায় নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নাবিলা। আতিয়া ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে একেবারে সামনে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
—তোমাকে আমি ছোটবোনের মত স্নেহ করতাম নাবিলা। কিন্তু সেই তুমিই আমার কলিজায় হাত দিয়েছো। আমার চেয়েও বেশি ঠকিয়েছো শামীমকে। এই ছেলেটা তোমাকে কতখানি ভালোবাসতো, তা যদি একটা মুহুর্তের জন্যেও টের পেতে, তবে এতবড় নোংরা কাজ করার আগে কোটিবার ভাবতে। অবশ্য এখন এসব বলেই বা লাভ কী! তোমরা যা করেছো, তা করেই ফেলেছো।

কথা বলতে বলতে আতিয়ার দুই চোখে জল জমে ওঠে। এতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটা নিজের বুকের ভেতরকার যন্ত্রণা চাপা রাখলেও শেষ মুহুর্তে আর সামলাতে পারলো না। ইলার হাত ধরে একবার মাহদীর দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। মাহদী ছুটে এসে ওর লাগেজে টান দিয়ে থামিয়ে দিলো। এরপর মেয়ের দিকে একপলক চেয়ে আতিয়ার দিকে করুণভাবে চেয়ে বললো,
—আতিয়া, আমার সবচেয়ে কোমল স্থানটি তুমি। সারা পৃথিবীর দেওয়া দুঃখ আমি গায়ে মেখে তোমার বুকে আশ্রয় খুঁজি। সেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আর কাকে ভরসা করে সামনে এগোবো? তুমিই তো সেদিন বললে, আমাকে তুমি চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস করো।

—বিশ্বাস তো করি। কিন্তু কোনো চরিত্রহীন বেঈমানকে নয়। তোমারও জানা উচিত ছিল, নারীর মন কাঁচের মত। তুমি যতক্ষণ যত্ন করবে, ততক্ষণ আলো বিকিরণ করতে থাকবে। কিন্তু তাকে যদি একবার অবহেলায় ভেঙে ফেলো, তবে আর কোনোদিনই সেই আগের বিকিরণ ক্ষমতা দেখাবে না। আমার ক্ষমতা তুমি নিজে হাতে নষ্ট করেছো। আমি এ নিয়ে তোমার সাথে আর দ্বিতীয় কোনো কথাও বলতে চাই না। ইলা সব শুনছে। আমার মেয়েটার সামনে এইসব অসুস্থ বিষয় নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাচ্ছি না। রাস্তা ছাড়ো।

—আতিয়া,আমি কিচ্ছুটি করি নাই। তোমাকে কীভাবে বিশ্বাস করাবো, আমি জানি না। কিন্তু কসম খোদার, এটা আমি করিনি। তুমি আমার খুঁটিনাটি সব জানো। জানো না? এক মিনিট, নাবিলাকে প্রশ্ন করো। নাবিলা, তুমি সত্যিটা খুলে বলো। তোমার সন্তানের বাবা আমি হতে পারি না। কখনোই না।

মাহদী নাবিলার দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু এ নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই। যেন সে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খুবই আনন্দ পাচ্ছে, অথবা এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সে আপনমনে নিজের ছেলেকে আদর করতে ব্যস্ত। শামীম স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ দুটির দৃষ্টিসীমা যথাসম্ভব প্রসারিত করে প্রশ্ন করলো,
—কতদিন ধরে চলছে এইসব?

—কীসব?

—মাহদীর সাথে তোমার এই নোংরা কুকর্ম? বিয়ের কত বছর আগে? মাহদীর সাথে বিয়ে করতে পারোনি বলেই আমাকে বিয়ে করেছো। আর এটা তোমাদের দুজনের প্ল্যান, তাই না?

—তোমার ধারণামতো এসব হলে আমি কী আর ভিতরে ভিতরে এত এত যন্ত্রণায় পুড়ে মরি? মাহদী এমন নিষ্ঠুর পুরুষ, আমার দিকে কোনোদিন ফিরেও তাকায়নি। আর না আজ পর্যন্ত তাকালো।

নাবিলা এমন করুণ ভঙ্গিতে মাহাদীর দিকে চেয়ে কথাগুলো বললো, এরপর ঘরের একটি মানুষেরও কন্ঠস্বর শোনা গেল না। নাবিলার কথায় এত জটিলতা, এত আফসোস, এত আক্ষেপ!
—তাহলে এই বাচ্চা কীভাবে হলো? তুমি আমাদেরকে কিছুই খুলে বলছো না কেন? মাহদীর সাথে সত্যিই তোমার সম্পর্ক ছিল না?

—না নেই। নাবিলার সাথে আমার কোনোদিনই কোনো সম্পর্ক ছিল না।

পিছন থেকে চিৎকার করে বললো মাহদী। শামীম একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবার নাবিলার দিকে ফিরে চায়। হাতে প্রমাণ নিয়েও মুখের কথা সে বিশ্বাস করবেই বা কীভাবে! নাবিলা কিছুটা বিমর্ষিত ভঙ্গিতে জানায়,
—শামীম, তুমি আর যাই করো, মাহদীর সাথে এইভাবে কথা বলতে পারো না। সে তোমার বড়ভাই। সম্মানীয় মানুষ। আর তুমি আমার থেকেই জানতে চাও তো? হ্যাঁ, উনি ঠিকই বলেছেন। উনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর না কোনোদিন ছিল। এই বাচ্চার ডিএনএ-র সাথে উনার মিল থাকলেও এর বাবাও উনি নন। উঁহু, সারোগ্যাসি নয়। তবে আমি যেই উপায়ে এই বাচ্চার মা হয়েছি, তা তোমাকে বলতে পারবো না।

পিছন থেকে মাহদী আবার বলে উঠলো,
—এক মিনিট, তুমি কী জয়িতা ক্লিনিকে গেছো কোনোদিন?

নাবিলা চমকে উঠে তার চোখের দিকে তাকালেও জবাব দিলো না। নীরবে অন্যপাশে ফিরে রইলো। মাহদী আতিয়ার কাছে এসে ওর হাত ধরে বললো,
—আমার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তুমিই দায়ী, আতিয়া। দেখেছো, দুই বছর আগে তোমার উদারতার ফল আমাকে কীভাবে ভোগ করতে হচ্ছে! তুমি এখনও বুঝতে পারছো না, এই বাচ্চাটা কীভাবে হতে পারে?

আতিয়া ব্যাগ ছেড়ে দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে গেল। নিজের অজান্তেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অনুশোচনার ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকালো। এতক্ষণ কেন এই ব্যাপারটা তার মাথায় এলো না! অথচ সেই থেকেই মাহদীকেও দোষারোপ করে সে ঘর ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করছিলো না।

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here