চতুষ্কোণ পর্ব ৯

0
85

#চতুষ্কোণ/পর্ব:—০৯
Sharifa Suhasini

শামীম একবার স্থির হয়ে ভাইয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। ব্যাপারটা কী?

শেষ লাগেজটি পিক-আপ ভ্যানে তুলে দিয়ে সে নাবিলাকে গাড়িতে গিয়ে উঠতে বলে দেয়। বাবা বলেছেন, সকালে বাসায় ফিরে যেন তিনি নাবিলাকে না দেখতে পান। ঠিক একারণেই এত তোড়জোড়।
নাবিলা একবার আড়চোখে সমস্ত ঘরটা দেখে নিলো। কিন্তু মাহদীর ঘরের দিকে তাকালো না। অথচ তার তাকানো উচিত ছিল। যতটুকু ভালোবাসায় সে মাহদীর প্রতি আচ্ছন্ন, সেই অনুভূতির কাছে নাবিলা পরাজিত মৌমাছির মতন। তাকে সেদিকে ফিরে তাকাতেই হত। তবুও নাবিলা তাকালো না। ব্যাপারটা শামীম শুরু থেকেই খেয়াল করেছে।

নাবিলা বের হয়ে যাবার পর শামীম আতিয়া ভাবির সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড় করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। একেবারে বাচ্চাদের মতন তার সেই কান্না। ছেলেটাকে এর আগে অতখানি দুখী সে হতে দেখেনি। বিগত এক বছর ধরে সে যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে গেছে, সেটা আতিয়াকে কোনোদিন মুখ ফুটে বলেনি। অথচ আতিয়াকে সে মায়ের পরবর্তী স্থানেই বসিয়েছিল। শামীমের দুঃখের প্রবাহ আতিয়ার বুকেও স্পর্শ করে গেল। শোকের এই এক বিচ্ছিরি ছোঁয়াচে খেলা, এক বুক থেকে আরেক বুকে স্থানান্তর হয়। আতিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শামীমের কাঁধে হাত বুলিয়ে বললো,
—কোন সিদ্ধান্তে আমাদের সকলের ভালো হবে, তা বুঝার ক্ষমতা তোমার আছে। আর আছে বলেই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমি কোনোদিনই বলবো না, নাবিলাকে তুমি ছেড়ে দাও। আবার এও বলবো না, তাকে আমার ধারেকাছে দেখার সহ্যক্ষমতা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। যৌথ ফ্যামিলিতে দুই বউ আনন্দ-ফুর্তিতে সংসার করবো, একসাথে আমাদের বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবো। অথচ আমার নির্মম ভাগ্য তা চায়নি। শামীম, ভাই আমার, তুমি আমার কাছে ক্ষমা চেও না। তুমি ওই মেয়েটির জন্য আমার কাছে যতটা দোষী, এই এত ঘটনার পেছনে আমিও কোনো না কোনোভাবে দোষী। সেই দায় আমি এড়াবো কীভাবে? মানুষের চোখ জলপট্টি দিয়ে জ্বরের উত্তাপ কমানো যায়, কিন্তু বিবেকে জলপট্টি দিয়ে ভুলের উত্তাপ কমানো যায় না। আমিও পারবো না। শুধু বলবো,ভালো থাকার চেষ্টা করো। বাবার কথাগুলো স্বরণে রেখো। কোনোদিন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সারাজীবন ভুগতে যেও না প্লিজ।

শামীমের খুব ইচ্ছে করছিল তার ভাই মাহদীকে একবার জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু এই মুহুর্তে সেইটুকু সাহস তার সঞ্চার হলো না। মাঝে মাঝে সুদের আশা করে যে আসলটাও উসুল হয় না, শামীমের পরিস্থিতি ঠিক তেমন। ভাইকে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা, তাকে বিদায় দিতে মাহদী একবারও বাইরে এলো না।

আতিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে শামীম রাফিয়ান তার ভাইয়ের ঘরের দিকে উঁকি দিলো। মাহদী ঘরের ভেতর থেকে সবটা দেখছে বটে, তবুও বের হচ্ছে না। শামীম ভ্রু কুঁচকে একবার ভাবির দিকে চেয়ে সোজা মাহদীর ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। অফিসের পোশাক পরে মাহদী বিছানায় এক পা তুলে বসে আছে। অপর পা মেঝেতে। চোখেমুখে এক অদ্ভূত দুশ্চিন্তার ছাপ। শামীম ভাইয়ের পাশে বসে বললো,
—তোমার কী হয়েছে ভাইয়া?

—আমার! আমার আবার কী হবে? এই যে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছি।

—ভাইয়া, যা হয়েছে, তার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে আবার তোমাকে লজ্জা দেবো না। শুধু এতটুকুই বলবো-এটা হওয়া উচিত ছিল না। আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া। তোমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। ভাইয়া, আমার বুকটা ভারি হয়ে আসছে, ভীষণ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। আমাকে একবার…

কথা বলতে বলতে শামীমের কন্ঠস্বর জড়িয়ে এলো। পূবের জানালার দিককার রাস্তা দিয়ে দশ চাকার একটা ট্রাক ছুটে গেল মুহুর্তেই। “ভাগ্যিস, সেই শব্দে শামীমের কন্ঠস্বরের আড়ষ্টতা মাহদী ভাই টের পায়নি!” মনে মনেই ভাবলো শামীম। অথচ ভাইকে সে বলতে চেয়েছিল, একবার জড়িয়ে ধরতে চায়। সেসবের কিছুই হলো না। মাহদী পাঁচশো টাকার আশিখানা নোট বের করে শামীমের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
—এটা রেখে দে। দরকারে কাজে লাগবে।

এতখানি টাকার অভাব শামীমের নেই যে, তাকে ভাইয়ের থেকে টাকা নিতে হবে। তবু না করলো না। চুপচাপ টাকাগুলো পকেটে ভরে সে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আর শামীমের বেরিয়ে যাবার মুহুর্তটুকুই যেন আজ মাহদীর হাফ ছেড়ে বাঁচার উল্লেখযোগ্য কারণ।

৬.
নতুন বাসায় নাবিলা যেন সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। না, শামীমের প্রতি ভালোবাসা, দরদ তার এখনও নেই। কিন্তু সেই নাবিলা আর এখনকার নাবিলার মধ্যে নদীর দুই কিনারের মত তফাৎ। বিগত দশ বারোদিনে নাবিলা একা হাতে যেমন নিজের বাচ্চাকে সামলেছে, তেমনি ঘরের সব কাজও গুছিয়েছে। অবশ্য নাবিলার মা সায়লা বেগম মাঝেমধ্যে এসে মেয়ের সংসার গুছিয়ে দিয়ে যান। মেয়ের ঠিক এমন গোছানো জীবনই তো তিনি চেয়েছিলেন। শামীম খেয়াল করে দেখে, নাবিলা একেবারে পাক্কা সংসারী মেয়ের মত তার সাথে আচরণ করছে। আর তার এই পরিবর্তনে শামীমও যেন স্বস্তি পাচ্ছে।

তবে নাবিলার বান্ধবী এবং কাজিন আরাফাতের খোঁজ নিতে সে ভোলে না। বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করে উঠতে না পারলেও ঠিকই দেড় মাসের মাথায় গিয়ে আরাফাতের ফোন নাম্বার যোগাড় করে। বাবা-মা’হীন বড় হওয়া আরাফাত অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করতে ইতালি চলে গেছিল। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করেছে। এরপরে সে স্থানান্তর হয়েছে নরওয়েতে। ইউরোপ অধিভুক্ত দেশ হওয়ায় খুব অল্প সময়েই সে নরওয়েতে যেতে পেরেছে। সেখানেই পিএইচডি সম্পূর্ণ করার সুযোগও সে হাতছাড়া করেনি। বর্তমানে সে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছে। তবে নরওয়েতে যাবার পর আর কারো সাথেই তার যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। নিজেই পিএইচডির জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, এরপর আর কাউকে নিয়ে মাথাব্যথার ফুরসত তার জোটে না। আত্মীয়দের মধ্যেও বিশেষ আগ্রহ না থাকায় বাবা-মা’হীন ছেলেটার সম্পর্কগুলো বাধনবিহীন দড়ির মত হয়ে পড়ে।

শামীম বহু চেষ্টার পর আরাফাতের সাথে যোগাযোগ করলেও ব্যাপারটা আর কাউকেই জানায় না। তবে, আরাফাতকে নাবিলা আর মাহদীর বিষয়ে খোঁজ নেবার ব্যাপারটা প্রকাশ করতে নিষেধও করে না। সে জানে, কাউকে কোনো বিষয়ে নিষেধ করা মানে সেটা বারবার তার মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করার প্রেরণা দেওয়া। অমন ভুল শামীম করতে চায় না।

আরাফাতের সাথে ফোনে কথা বলার দিন শামীম নাবিলাকে অবাক করে দিয়ে নাবিলার জন্য একগুচ্ছ গোলাপ এনে তাকে উপহার দেয়। নাবিলা তো রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়। শামীম তাকে ভালোবেসে এভাবেই তো আগলে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই দূর্ঘটনার পর শামীম যে তাকে এভাবে মানিয়ে নেবে, এটা তার কাছে অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতন। নাবিলা ফুলগুলো নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শামীম চোখের ইশারায় ইঙ্গিত দিয়ে প্রশ্ন করে,
—কিছু বলবে?

—সবকিছুর পরেও তুমি আমাকে এতখানি ভালোবাসো শামীম। তোমার এই ভালোবাসাই আমি বুঝতে পারিনি?

—বুঝে উঠার আগেই অন্ধ হয়ে গেছিলে। আমি সত্যিটা না বের করে আনলে সেই অন্ধত্বের অপারেশন কোনোদিনই হত না।

—কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। মানুষের ভালো ব্যবহার আমার সহ্য হয় না। ঘৃণা লাগে। বারবার মনে হয়,এ নিশ্চয় আমার সাথে অভিনয় করছে। আমি খুব শীঘ্রই ঠকবো।

—কেন? এর আগেও কী ঠকেছো নাকি?

নাবিলা চুপ করে রইলো। তার নির্বাক ঠোঁটের দিকে একনাগাড়ে চেয়ে থেকেও আর জবাব আসে না। শামীম গলা থেকে টাই খুলতে খুলতে ঘরের ভেতর চলে যায়। কিন্তু নাবিলা আর সেখান থেকে নড়ে না। না সামনে, আর না পেছনে। নিজেকে তার মনে হচ্ছে বয়স আর অভিজ্ঞতার ভারে থিঁতু হয়ে যাওয়া বটবৃক্ষ, যার শেকড় আছে, ডালপালা আছে, অনুভূতি আছে, কেবল চলবার শক্তি নেই।

ফুলগুলো ফুলদানিতে রাখতে রাখতে শামীম আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। কমলা রঙের কলারবিহীন একটা টি-শার্ট পরেছে সে। শামীমের মন যখন প্রচন্ড রকমের ভালো থাকে, তখন সে রঙিন কাপড় পরে। নিজের অজান্তেই পরে। এই ব্যাপারটা সে আতিয়ার কাছে শুনেছিল। ফুলগুলো সাজিয়ে সে শামীমের দিকে অপরাধীর মত দৃষ্টি তাকালে শামীম বললো,
—মায়ানের দুধ ফুরিয়ে গেছে, বলোনি তো।

—আসলে ওর জন্য তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাইনি। আমি নিজেই নিয়ে আসবো কাল।

—এমনভাবে বলছো, যেন মায়ান আমার পর। ও তো আমাদেরই রক্ত। ওর দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার কাঁধেও আছে। এরপর থেকে কিছু লাগলে আমাকে জানাবে।

নাবিলা ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখে টেনে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। শামীম আবার পেছন থেকে ডেকে ওঠে,
—নাবিলা…

নাবিলা দাঁড়িয়ে পড়লো। শামীমের দিকে ফিরে তাকালেও প্রশ্ন করলো না। শামীম নিজে থেকেই তাকে জানায়,
—এ মাসের সতেরো তারিখের দিকে আমার অফিস থেকে ছুটি আছে। ছয়দিনের ছুটি। ভাবছি, আমরা সবাই কক্সবাজার আর হিমছড়ি ঘুরতে যাবো। তুমি কী বলো?

—আমরা বলতে?

—আমি, তুমি, মায়ান আর তোমার মা।

—আম্মাও যাবে?

—অবশ্যই।

নাবিলা হ্যাঁ কিংবা না কোনো জবাব দিলো না। বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে শামীমের দিকে চেয়ে রইলো শুধু।

৭.
সায়লা বেগমের চোখ লাল। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখে তাকানোর ক্ষমতা নেই এখন। ছোট মায়ানকে বুকে নিয়ে বারবার আছড়ে পড়ছেন সোফার কোনে। তার একমাত্র মেয়ে মা*রা গেছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন, সব নিয়ম কানুন শেষে কাল রাতে তার দাফন হলো।
“পাহাড় থেকে পড়ে এমন নির্মম মৃত্যু বোধহয় কর্মের প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহই তাকে ফলভোগ করালেন। মন খারাপ করে আর কী হবে ভাই? তোমার যত দায়িত্ব, তুমি তা পালন করেছো। এতকিছুর পরেও তুমি যে তাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলে, এইতো অনেক।”
শামীমের পাশে বসে তাকে বুঝাচ্ছে আতিয়া। কিন্তু শামীম নির্বাক। সোফায় আধাশোয়া করে হেলান দিয়ে নাবিলার ছবির দিয়ে চেয়ে আছে। কাল রাতে অনেক কান্না করেছিল। আজ সকাল থেকেই সে নির্বাক, নিশ্চুপ। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। নাকি ছিল?
আতিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
—কীভাবে কী ঘটেছে শামীম?

ঘরভর্তি উৎসুক জনতা শামীমের মুখের দিকে চেয়ে আছে। নাবিলার মৃত্যুর বর্ণনা এখন তাকেই দিতে হবে।

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here