চতুষ্কোণ শেষ পর্ব

0
129

#চতুষ্কোণ / পর্ব:—১১(শেষ)
Sharifa Suhasini

“আমি এসব জানতাম না। শুধু আমার বান্ধবীর জন্য এটা করেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। কিন্তু আপনার ভাইয়ের সম্মান নিয়ে আমি কিছুই করিনি। উলটো আপনার ভাই’ই তো নাবিলাকে এতবড় দুঃসাহসিক কাজের জন্য পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়েছে। একলা আমার বেচারী বান্ধবীকে দোষ দিচ্ছেন কেন?”

—তুমি মাফ পাবার মত কাজ করেছো? আমার সংসার,আমার জীবন একেবারে তছনছ করে দিয়েছো তুমি। এক মিনিট, কী বললে একটু আগে?

শামীম কথার মাঝে ইতি টেনে ভ্রু কুঁচকে এশার চোখের দিকে তাকালো। তার ভাই মাহদী পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়েছে মানে! সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো। এশা কম্পিত স্বরে বললো,
—কোনটা? আমি সত্যি বলছি, আপনার ভাইয়ের সম্মান নিয়ে আমি কিছু করিনি।

—না, এরপর। আমার ভাই কী করেছে?

— হ্যাঁ, উনিই তো উৎসাহ দিয়েছেন। নাহলে নাবিলা একলা মেয়ের এতবড় সাহস হয় কীভাবে? আপনি কী কিছুই জানেন না! নাকি জেনেও নিজের ভাইকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য নাটক করছেন?

শামীম রাফিয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। এশার কথার কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। এশা ক্ষণিক মুহুর্ত ওর ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে। তার মানে শামীম সত্যিই কিছু জানে না। এশা অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে উপহাসের সুরে হেসে ওঠে।

শামীম যতটুকু জানে, ততটুকু সত্য। তবে বাকি যেটুকু জানে না, সেই সমস্ত অংশে মাহদী জড়িয়ে আছে। মাহদীর ইউভার্সিটিতে যেদিন আরাফাতের সাথে নাবিলা গেছিল, সেদিনই মাহদীর সাথে পরিচয় হয়। আরাফাত নিজেই মাহদীর সম্পর্কে বলেছে, “এই ছেলেটা সবার সাথে থেকে আলাদা। ক্লাসের কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে না, মেশে না। এমনকি, বন্ধুবান্ধবও কম। অবশ্য, এতে ওর দোষ নেই। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো মেয়ে ওর সাথে দুদিন মেশার সুযোগ পেলেই ওকে নাকি প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আর এজন্যই ওকে মেয়েদের সাথে খুব একটা মিশতে দেখা যায় না।”

আরাফাতের কাছে প্রথম মাহদীর সম্পর্কে জানতে পেরেই নাবিলার এক অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি হয়। যে ছেলে ব্যক্তিগতভাবে এমন রক্ষণশীল, তার সাথে নির্দ্বিধায় সারাটাজীবন কাটানো যায়। আর যাই হোক, সে কখনোই দ্বিতীয় কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে ঠকাবে না। আরাফাতের সামনে নাবিলা মাহদীর সাথে আগ বাড়িয়ে কথা না বললেও ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরুত্বে গিয়ে সেদিন ঠিকই কথা বলেছিল। মাহদীও ভীষণ স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে পরিচিত হয়।

আর ওর এই উত্তম পুরুষের আচরণ নাবিলাকে ঘরে আটকাতে পারে না। আরাফাতের সাথে প্রায়ই ওর ভার্সিটিতে যাওয়া, গোপনে মাহদীর সাথে সাক্ষাৎ করা তার রুটিনে পরিণত হয়। মাহদীর বলা প্রতিটা শব্দ যেন তার বুকে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগাতে থাকে। ব্যাপারটা শুরু থেকে মাহদী নিজেও টের পায়। আর মাহদী যে ওর সমস্ত অনুভূতির ব্যাপারে টের পাচ্ছে, সেটুকু নাবিলাও উপলব্ধি করতে পারতো। একারণেই একদিন নিজের ফ্যাকাল্টির বাইরে গিয়ে সে নাবিলাকে বেশ কড়া সুরে জানিয়ে দেয়,
—নাবিলা, তোমার এই অকারণ আমার ক্যাম্পাসে আসাটা অন্যরা ভালোভাবে নিবে না। হ্যাঁ, যদিও আমি আমার পরিচিত সার্কেলের বাইরে গিয়ে তোমার সাথে আলাপ করি। করি বলছি কেন, আলাপ করতে বাধ্য হই। তারপরেও ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না।

—আমাদেরকে কে দেখছে তাই? আর ক্যাম্পাসে এলে সমস্যা কী? ক্যাম্পাস তো উন্মুক্ত। যে কেউ আসতে পারে। তাই না?

—পারে। কিন্তু এখানে এসে তুমি শুধু আমার সাথেই কথা বলার সুযোগ খোঁজো। এটাকে নিশ্চয় অস্বীকার করতে পারবে না। দেখো নাবিলা, তুমি আমাকে পছন্দ করো কি-না জানি না৷ কিন্তু আমার এসব প্রেমপ্রীতি পছন্দ নয়। তাই আর যাই হোক, এখানে আমার সাথে তুমি দেখা করবে না।

মাহদী এত শক্তভাবে কথাগুলো বলে যে, এরপর নাবিলার মুখ থেকে আর একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে। মাহদী তখন আশেপাশে নজর রেখে ফিসফিস করে নাবিলাকে জানায়,
—তোমার যদি আমার সাথে জরুরি কোনো বিষয়ে এতই কথা বলার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে আমার আইডিতে মেসেজ দাও। এভাবে সামনে এসে মানুষের সামনে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার তো মানে হয় না, তাই না?

নিজের কথা শেষ করেই মাহদী নাবিলার হাত থেকে তার ফোন এগিয়ে নেয়। তারপর নাবিলার ফোনে তার নিজের আইডি দিয়ে রহস্যজনকভাবে হাসে। সে হাসির অর্থ নাবিলা বুঝতে পারে না। তবে মাহদী যে তাকে এভাবে সামনে আসার পরিবর্তে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে, নাবিলার কাছে ওইটুকুই এক জীবনের পরম প্রাপ্তি অনুভূত হয়।

এরপর থেকে মাহদীর সাথে ওর প্রায়ই কথা হয়েছে। নানান বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। মাহদী কখনোই তাকে “ভালোবাসি” বলেনি। আর না সেটার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু তার আচরণ এমন হত, যার প্রতিফলনে নাবিলা রোজ তার প্রেমে পড়েছে। আর সেটা খুব গভীরভাবেই পড়েছে। মাহদী নিজে তাকে ভালোবাসার কথা জানান না দিলেও তার প্রতিটা কথায় নাবিলা অনুভব করতো, মাহদী তার ভালোবাসাটাকে প্রশ্রয় দেয়। আর এই ভাবনাতে ডুবেই নাবিলা নিজের মনের অনুভূতির কথাও তাকে জানাতে আর দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু সেদিনই মাহদী হঠাৎ বেঁকে বসে। তার ভাষ্যমতে, “নাবিলাকে সে তো কেবল মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে। সে চাইতো বলেই সময় দিয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে এতকিছু সে কখনোই ভাবেনি।” অর্থ্যাৎ মাহদী এমন কৌশলে নাবিলাকে নিয়ন্ত্রণ করতো যেন, তাকে নিজে থেকে ভালোবাসার প্রস্তাব না দিতে হয়। কিন্তু নাবিলা তাকে প্রস্তাব দিয়ে বসে। আর ঠিক সেটাই ঘটে।

মাহদী একবারও নাবিলার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে না। করবেই বা কেন? সে তো কখনো নাবিলাকে ভালোবাসি বলেনি, সংসার পাতানোর স্বপ্ন দেখায়নি। তার মতে, সে কেবলই নাবিলার অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে তার সঙ্গ দিয়েছে।

মাহদীর এই কূটকৌশল নাবিলা টের পায় না। নিজের ভুল ভেবেই বুক চাপড়ে প্রত্যাখ্যান হবার শোক পালন করে। মাহদীর সোস্যাল একাউন্টে লম্বা লম্বা মেসেজ পাঠায়। মাহদী পড়ে, এড়িয়ে যায়। মাঝেমাঝে বোঝানোর চেষ্টাও করে, “নাবিলা, আমি তো তোমাকে ভালোবাসতে বলিনি।”

আর এভাবেই চলতে চলতে নাবিলা নিজেই তাকে বলে বসে,
—আচ্ছা, আমার সাথে আপনার সম্পর্ক করতে হবে না। আমরা তো বিয়ে করতে পারি। তাই না? আমি আমার মাকে বলি আপনার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে? আপনি ঠিকানা দিন।

—নাবিলা, এটা সম্ভব না। আমি এখন বিয়েশাদি নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই করিনি। আগামী পাঁচ বছরে এসব সম্ভাবনা নেই। তুমি কী পাগল হলে? এসব আমার পক্ষে সম্ভব না। বোঝার চেষ্টা করো।

—আমি আজীবন আপনাকেই ভালোবাসতে চাই। আপনি কত ভালো একটা ছেলে। আমাকে কত সুন্দর করে বোঝান। এভাবে কেউ কী আমাকে বুঝাতে আসবে? একটা মেয়ের সাথে এতদিন কথা বলেও কোনোদিন তার প্রতি আপনার ফিলিংস আসেনি। আপনার মত এমন ভালো মানুষ আমি কী আর পাবো?

—আচ্ছা, তোমার যা ইচ্ছে করো, যেভাবে ইচ্ছে আমার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকো। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি তোমাকে কোনো ব্যাপারেই কিছু বলবো না। শুধু এরপর থেকে আমাদের যোগাযোগ রাখা উচিত হবে না।

সেদিন মাহদীর ফেলে যাওয়া দুঃখগুলো সন্ধ্যের ধূসর গোধূলি হয়ে নাবিলার বুকে প্রশ্রয় নেয়। মাহদীকে সে ভালোবেসেছিল, সত্যিই ভালোবেসেছিল। নিজের সবটুকু অনুভূতি দিয়ে যাকে ভালোবাসলো, সে ক্ষণিক মুহুর্ত হলেও নিশ্চয় তার ভালোবাসার কদর করেছে? মাহদীর পথের দিকে চেয়ে থেকে নির্বাক হয়ে ভাবে সে। তবে সেই ভাবনাটুকু নিয়ে নদীর স্রোতের মত জীবনের গতির পরিবর্তন হয় না। মাহদীর ঠিকানা সে জানে না। কিন্তু ভালোবাসা? ওইটুকু কীভাবে ভুলতে পারে সে?

দীর্ঘ বছর ধরে মাহদীর সামনে যায় না সে। এরমধ্যে হাজার চেষ্টা করেও মাহদীর সন্ধান পায়নি। আরাফাত ভাইও দূর প্রবাসের বাসিন্দা হবার পর থেকে নিজেকে সবার থেকেই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নাবিলার আর সাহস হয়নি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার। বছর পাঁচ পর একদিন এশার মাধ্যমেই জানতে পারে মাহদী বিয়ে করেছে। এমনকি তার ঘরে একটি মেয়ে সন্তানও রয়েছে। কিন্তু শামীম রাফিয়ান যে মাহদী’র ভাই কিংবা মাহদীর কোনো ভাইবোন আছে, এসব ব্যাপার নিয়ে সে কখনোই মাথাব্যথা করেনি।

এশার কাছেই সে শুনেছিল, মাহদী বছরে কয়েকবার তাদের ক্লিনিকে যায়। আর ক্লিনিকে যাবার একমাত্র কারণ স্পার্ম ডোনেশন। এশার কাছ থেকে মাহদীর ক্লিনিকে আসার ডেট খোঁজ নিয়ে নাবিলাও সেদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাহদী প্রথমে দেখেও না দেখার ভান করে যদিও। তবে বিশেষ লাভ হয় না। নাবিলার চোখ ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ধরা পড়া চোরের মত সেই প্রথম নাবিলাকে জিজ্ঞাসা করে,
—কেমন আছো?

নাবিলা অসহায়ের মত ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করে,
—আমাকে না করার এক বছর পরেই আপনি বিয়ে করলেন। আমি কী আপনার চয়েজ হিসেবে খুব খারাপ ছিলাম? এমনটা আমার সাথে না করলেও তো পারতেন।

—দেখো নাবিলা, তুমি আমাকে ভুল ভাবছো। আমি কখনোই কারো সাথে সম্পর্ক করিনি। আর না কোনো মেয়ের কথা আমার বাবাকে বলতে পারতাম। বাবা সবসময় যা বলেছেন, তাই করেছি। আর তাছাড়া আমি তো তোমার সাথে কোনো কমিটমেন্টেও ছিলাম না।

—সবকিছু যতটা সহজ ভাবছেন, ততটা সহজ আসলে সব হয় না। আপনি জানতেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি এখন কী করবো, মাহদী? আমাকে বলে দিন প্লিজ। বাসা থেকে বিয়ের কথা বলছে। আমি তো কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। উঁহু, আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে না। কিন্তু আমি বাঁচবো কী করে! মনে একজনকে জায়গা দিয়ে আরেকজনের পাশে আজীবন থাকবো কী করে! আপনাকে আমি ভুলতে চাই না, ভুলতে পারবোও না।

মাহদী সেদিন বেশ খানিক মুহুর্ত চুপ থাকে। নাবিলাকে সে কোনো জবাব দেবার প্রয়োজনই মনে করে না। দূর থেকে এশা তাদের বাক্যালাপ শুনলেও তারও বিশেষ কিছু করার থাকে না। অনেক ভেবে মাহদী জানায়, নাবিলা চাইলে সে মাঝে মাঝে তার সাথে যোগাযোগ রাখবে, দেখা করবে। সমস্যাটা রিকভার করতে সহযোগিতা করবে। কিন্তু নাবিলা ব্যাপারটাতে রাজি হয় না। যে মাহদীকে সে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে রেখেছে, তার সাথে যোগাযোগ করতে গেলে যদি অনাস্থা ঘটে যায়!

নাবিলার দৃঢ় মনোভাবে মাহদী কিছুটা বিরক্তই হয়। সে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে জানায়, নাবিলার জন্য তার কিছুই করার নেই। তবে সে চাইলে মাহদীর যেকোনো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকুক। দুনিয়ায় অপশনের তো শেষ নেই। নাবিলা যা ইচ্ছে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এসব নাবিলার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু মাহদীর ব্যক্তিগত জীবনে যেন সে নাক গলাতে না আসে।

আর ঠিক সেই মুহুর্ত থেকেই নাবিলা এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। মাহদীর স্মৃতি হিসেবে সে বিয়ের আগে ইন-ভিট্রো পদ্ধতিতে বাচ্চা নেয়। এশা তাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে । কিন্তু প্রেমে অন্ধ নাবিলা পৃথিবীর কোনো নিয়মকেই আর তোয়াক্কা করে না। মাহদীর কথাগুলো সে বারবার ভাবে। বারবার। সে নিশ্চয় তাকে তার বাচ্চার স্মৃতি ধরে রাখতে বলেছে। আর সে সেটাই করবে।

অথচ মাহদী সেদিন চাইলেই নাবিলাকে ঠিকঠাকভাবে জীবন গোছানোর পরামর্শ দিতে পারতো। মাহদী চাইলেই নাবিলার সমস্ত দুর্বলতা জেনেও তার থেকে দূরে সরে থাকতে পারতো, আগে থেকে বিষয়টা তার কাছে ক্লিয়ার করতে পারতো। অথচ সে এসবের কিছুই করেনি। ভদ্র পুরুষের মুখোশ পরে দিনের পর দিন নাবিলার অনুভূতির ভাব প্রকাশ নিয়ে উপভোগ করেছে। শেষ মুহূর্তেও মেয়েটার জীবনের ঠিকঠাক সমাধান না দিয়ে তার মনকে বিশৃঙ্খল করে দিয়েছে। তাহলে মাহদী সম্পূর্ণ নির্দোষ হয় কীভাবে? মানুষ মানুষকে দূর থেকে ভালোবাসতে পারে, কিন্তু প্রশ্রয় না দিলে কী কোনো পুরুষের প্রতি অমন অধিকারবোধ কেউ দেখাতে পারবে?

এশার কাছ থেকে সমস্ত জানার পর শামীম একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

৭.
মায়ানের বয়স দুই বছর। মাহদী একা একাই নিজে হাতে তাকে যত্নে বড় করছে। তার কাছে নাবিলার ভুল ছিল। কিন্তু সেই ভুলের শাস্তি সে ভুলের অনুপাতে বেশি দিয়ে ফেলেছে। গত দু বছরে মাহদী একটা রাতের জন্যও ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে না। বালিশে মাথা দিয়ে বিছানায় ছটফট করে। অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খায়। আসল শাস্তি তো তার ভাইয়ের পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু চাইলেই কী সে তার ভাইকে মা*রতে পারবে? হ্যাঁ, পারবে। তবে হুটহাট সিদ্ধান্তে নয়।
এখন সে বাবার বাড়িতেই ফিরে এসেছে। যে মানুষটার জন্য সে ঘর ছেড়েছিল, সে মানুষটা আজ আর তার জীবনে নেই। কী দরকার, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ম হবার!

একদিন মাহদীর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে শামীম তার ভাইয়ের গাড়ি থামিয়ে দাঁড়ালো। মাহদী কিছুটা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে,
—তুই এখানে কী করছিস? তোর না অফিস বন্ধ আজ?

—বাইরে কাজে গেছিলাম। ফেরার পথে ভাবলাম তোমার সাথেই বাসায় যাই।

—ওহ। গাড়িতে উঠে বস।

শামীমও বাধ্য ছেলের মত ভাইয়ের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। পারিবারিক, অফিসিয়াল নানান বিষয়ে আলাপ করতে করতে শামীম হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে,
—ভাইয়া, নাবিলাকে তোমার মনে পড়ে?

—মনে পড়বে না কেন? প্রায়ই মনে পড়ে। এমন বোকা মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আমার সম্মানটাও একেবারে বিকোতে বসেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার বিচার অন্যরকম। পাপের শাস্তি সবাইকেই পেতে হবে।

—তোমার পাপের শাস্তি কবে পাবে ভাইয়া? তুমি যে তার বোকামির সুযোগ নিয়েছিলে। তার বোকামিকে ব্যবহার করে মজা করেছো, তার দুর্বলতাকে উপভোগ করেছো, তার সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ করেছো। তোমারও তো শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই না ভাইয়া?

শামীমের কথায় মাহদী অকস্মাৎ মস্তিষ্কের ভিতর বিশাল বড় ধাক্কা খেল। শামীম এসব কীভাবে জানলো! ভাইয়ের কথা শুনে ওর মস্তিষ্কের ভেতর বিভ্রাট শুরু হয়। ভয়ে আর শঙ্কায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করতেও ভুলে যায় সে। শামীম আবার পিছন থেকে বলে ওঠে,
—হয় ঠিক করে চালাও, আর নাহয় আমাকে নামিয়ে দাও।

মাহদী সাথে সাথে গাড়ির ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে। শামীম তার ভাইয়ের দিকে চেয়ে উপহাসের ভঙ্গিতে একবার মৃদু হাসলো, এ হাসি ঠিক দু বছর আগেকার সেই এশার মতন। এরপর অন্যপাশে ফিরে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। মাহদী শুধু ভাইয়ের পথের দিকে চেয়ে রইলো। এই মুহুর্তে বাড়ি ফিরবে কী করে সে! আর বাড়ি ফিরলে শামীম, আতিয়া কিংবা বাবার সামনেই বা মুখ দেখাবে কী করে?

সেদিন রাতে ঘড়ির কাঁটায় রাত দুটো বেজে গেলেও মাহদী আর বাড়ি ফেরে না। ফোনে অনেকবার কল দেওয়া হলো বাড়ি থেকে। কিন্তু ওপাশের নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে।

(সমাপ্ত)

[প্রিয় পাঠক, আগামী পরশু থেকে শুরু হবে নতুন রোমান্টিক থ্রিলার গল্প “ত্রিকোণমিতি”। গল্প পড়তে অবশ্যই পেজ ফলো করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here