#চতুষ্কোণ /পর্ব:—০৪
— Sharifa Suhasini
—ছেলে হলে মানুষ খুশিতে গদগদ হয়। আর এক তোকে দেখছি। সেদিন থেকে কেমন মনমরা হয়ে আছিস। কী হয়েছে রে তোর?
—আমার কী হচ্ছে, সেটা তো সবার আগে তোমারই জানার কথা ভাইয়া।
ভায়ের সাথে এমন কড়া সুরে সে কথা বললো যে, ক্ষণিক মুহুর্ত পর নিজেই অবাক হয়ে গেল। এ তার কী কথা বলার ছিরি! সে মিটিমিটি চোখে ভায়ের দিকে তাকালো। মাহদী তখনও ভেবাচেকা খাওয়ার মত ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। শামীম ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বললো,
—ভাইয়া, তুমি আমাকে ঠকিয়েছো। আমার আপন ভাই হয়েও তুমি আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলে কীভাবে? তোমার বিবেকে নাড়া দিলো না ভাইয়া?
শামীমের প্রশ্নে মাহদী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তার কথার উপর কথা বলার সাহস শামীমের কখনোই ছিল না। সেই ভাই আজ এমন আচরণ করে বসেছে! মাহদী কম্পিত কন্ঠে ভাইকে জিজ্ঞাসা করে,
—তোর শরীর ঠিক আছে শামীম? তোর মুখ থেকে কীসব আজেবাজে কথাবার্তা বের হচ্ছে!
ভাইয়ের কথায় শামীম রাফিয়ানের ভ্রম কাটলো। সে বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে কড়া শাসনে সামলে নেয়। তারপর বলে,
—তোমাকে এতদিন যে ভাইয়া হিসেবে জানতাম, আসলে তুমি তা নও। চোখের সামনে যেই মাহদী ভাইয়াকে আমি চিনি, যাকে সম্মান করি, সেই মানুষটা তুমি নও।
শামীম একবার আড়চোখে আতিয়া ভাবির উপস্থিতি যাচাই করে নিলো। তারপর আবার বললো,
—তুমি আতিয়া ভাবি ছাড়াও অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করেছো। তাই না? আমাকে মিথ্যে বলবে না ভাইয়া। আমি সব জানি।
শামীমের কথায় মাহদী যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার ভাই এসব কী বলছে! তার সেই ভাই, যে তাকে ফুলচন্দন দিয়ে রীতিমতো পূজো করতে ভালোবাসে। আজ সেই ভাইয়ের কী এমন হলো? মাহদী যথাসম্ভব শান্তভঙ্গিতেই ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
—তুমি যা বলছিস, তা ভেবে বলছিস তো? তুই তোর বড় ভাইয়ের চরিত্রের প্রতি আঙুল তুলছিস। ছিঃ, আমার দিকে আঙুল তুলতে তোর লজ্জা করছে না?
—না, করছে না। আমার কাছে প্রমাণ আছে।
—কী প্রমাণ! আমিও জানতে চাই। কোন মিথ্যে প্রমাণের ভিত্তিতে তুই আমাকে এতবড় এবং নোংরা দোষে দোষী সাব্যস্ত করছিস, তা আমিও দেখতে চাই।
—অপেক্ষা করো। আর দুইটা রাত পেরোলেই জানতে পারবে। কিন্তু যাই করতে, সেটা তোমার পার্সনাল জায়গায় রাখতে। আমার জীবন নিয়ে খেলা করার তো প্রয়োজন ছিল না।
শামীম তার ভাইকে আর দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগই দিলো না। রেগেমেগে রীতিমতো আগুন হয়েই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এই বাড়ি, এই ঘর-সংসার তার কাছে আজ বিষ লাগছে। যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসে, যে ভাইকে সে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে পূজো করে এসেছে, তাদের সন্তানকে তার পেলেপুষে বড় করতে হবে। আর এমন সন্তান, তার কোনো বৈধতা নেই। শামীমের দুই চোখের কোণ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে খুব করে চেয়েছিল অন্তত রিপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কারো সাথে টু শব্দটিও করবে না। কিন্তু মাহদীকে দেখার পরেই তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। এই মানুষটির সন্তানই তো তার স্ত্রী এতদিন নিজের গর্ভে ধারণ করে এসেছে। তাকে সে কীভাবে সহ্য করবে!
তার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ থাকলে কী করতো? নিশ্চয় শামীমের চেয়েও অধিক প্রতিক্রিয়া দেখাতো। আর সেখানে সে তো খুব সামান্যই করেছে, নিতান্তই সামান্য।
অন্যদিকে মাহদী একেবারে হতভম্ব হয়ে সোফায় বসে আছে। তার ভাই পাগলের মত কীসব প্রলাপ বকে গেল। শেষ পর্যন্ত কি-না তার চরিত্র নিয়ে এতবড় প্রশ্ন? কিন্ত কেন! ব্যাপারটা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। শামীমের কাছে কী এমন প্রমাণ আছে! কী সেটা? ভাবনার অন্তরালে নিছক আনন্দ-উল্লাসের ভুলে করা কোনো ত্রুটির ইতিহাসই খুঁজে পাচ্ছে না।
স্বামীকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে আতিয়া ওর পাশে এসে বসলো। সে কতক্ষণ আগে বসেছে, তা মাহদী এক মুহুর্তের জন্যও টের পায়নি। আতিয়া স্বামীর হাতে আলতো স্পর্শ করে ধরলো। তারপর কপালে, গলায় যাচাই করে প্রশ্ন করলো,
—জ্বরটর তো নেই। তবে মুখখানা অমন করে আছো কেন শুনি?
মাহদী চমকে উঠে স্ত্রীর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ দিগ্বিদিকশূণ্য হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
—বিশ্বাস জিনিসটা বড্ড ঠুনকো। খুব সামান্য কারণেই সারাজীবনের অর্জন করা বিশ্বাস একেবারে নিমিষেই উঠে যায়। তাই না আতিয়া?
—এসব কেন বলছো!
—তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো?
—ঠিক বুঝলাম না।
—তোমার কখনও মনে হয়েছে,তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর প্রতি আমার কস্মিনকালেও আগ্রহ থাকতে পারে, এই কথাটি বিশ্বাস করবে? আমি যে তোমাকে কতখানি ভালোবাসি, এটা বিশ্বাস করো?
—তোমার সাথে কী হয়েছে, তা জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আর আমি আতিয়া এটাও খুব ভালো করেই জানি, তুমি আমাকে কী ভীষণ যত্ন করে ভালোবাসো। তাই সারা পৃথিবী তোমার বিরুদ্ধে গেলেও আমি তোমাকে অবিশ্বাস করতে পারবো না। যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমি তোমার পাশে থাকবো। ট্রাস্ট মি।
মাহদী ছলছল চোখে স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি ফেরালো। কিছুক্ষণ আগে তার ভাইয়ের কথার প্রসঙ্গ সে আর তুলে ধরার সাহস পেল না। তার পরিবর্তে আতিয়ার বিশ্বাসের প্রতিদানে সে তার হাতের আঙ্গুলি টেনে নিয়ে নির্মল চুমু খেল।
আর এই দৃশ্য নিজের ঘরের দরজার পাশ থেকে অবলোকন করছে তার ভাইয়ের স্ত্রী, অর্থ্যাৎ নাবিলা। মাহদী এবং আতিয়ার ভালোবাসায় মাখামাখি মুহুর্ত দেখে তার চোখে কিঞ্চিৎ জল জমে ওঠে। তবে সেই জল আর ছল করে মেঝেতে পড়ে না। ক্ষণিকেই চোখের কোণে শুকিয়ে মৃদু দাগ হয়ে লেপ্টে যায়।
নিজের ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে হুট করে তাদের সামনে এমন ভাব ধরলো, যেন সে অজান্তেই চলে এসেছে। আতিয়া সঙ্কোচে নিজের হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চুলায় তরকারি দিয়ে এসেছে। সেটাই দেখার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে নাবিলাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—তোমার কিছু লাগবে?
—না আপা। ঘরে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলাম। তাই বের হলাম একটু। কিন্তু কোমরে যে ব্যথা, বাবু নিয়ে বসতেও পারছি না।
—কষ্ট হলেও ঘরে বিশ্রাম নেওয়াই ভালো বইন। নরমালে হলেও এই অবস্থায় এতবেশি হাঁটাচলা করো না। আর শোনো, বেবিকে মাহদীর কোলে দাও। আমার হাতে মরিচের গুড়ার ঝাঁঝ রয়ে গেছে। আমি তো ওকে নিতেও পারবো না। মাহদী, তুমি একটু ওকে হেল্প করো না।
মাহদী একবার অসহায় ভঙ্গিতে স্ত্রীর দিকে তাকালো। ভাইয়ের স্ত্রীর সাথেও তার খুব বেশি কথার আদানপ্রদান হয় না। মূলত, সে নিজেই অপ্রয়োজনে একটি শব্দও ব্যয় করে না। আতিয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে নাবিলার দিকে একপলক চেয়ে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে এগিয়ে নিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে যায়,
—আমি ওকে আমাদের ঘরেই নিয়ে গেলাম। রাফিয়ান ফিরলে নিয়ে আসতে বলো।
এরপর সে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না। বাজপাখি দেখে ছোট খরগোশ ছানা যেমন গর্তে লুকিয়ে পড়ার জন্য আপ্রাণে ছুটে ম*রে, মাহদীর অবস্থাও ঠিক তেমনই হলো। চোখের পলকেই সে ডাইনিং রুম ত্যাগ করে। তার পথের দিকে চেয়ে থেকে নাবিলা মুচকি হাসে। ধীরে ধীরে সেই হাসির রেখার সীমানা সমস্ত মুখমণ্ডলে বিস্তৃতি লাভ করে।
৪.
শামীম রাফিয়ান ইলার ডিএনএ রিপোর্ট হাতে পেল দুইদিন পর। সকালের নাস্তা না করেই সে তড়িঘড়ি করে ল্যাবে ছুটে যায়। সবার আগের সিরিয়াল তার দরকার। এই রিপোর্টের উপর জীবনের অনেক কিছুর হিসাব-নিকাশ নির্ভর করছে। সেই হিসাবের পাঠ চুকাতে গত দুদিনে একটা সেকেন্ডও সে দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। বিছানায় মাথা রাখলেও লুকোনো যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। নিজের ভাইয়ের দৃষ্টির সীমানা থেকে থেকেছে বহুদূরে। এমনকি সেদিন রাতে বাচ্চাটাকে আনতে ভাইয়ের ঘরেও ঢোকেনি। বাচ্চাটাকে দিয়ে গেছিল আতিয়া ভাবি।
রিপোর্ট ম্যাচিং করে শামীম যে পেল, তার জন্য সে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এতকিছুর পরেও তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি সত্যিই ইলা এবং নাবিলার ছেলে আপন ভাই-বোন। তার মানে এই বাচ্চাটি সত্যিই তার আপন ভাই মাহদীর সন্তান।
শামীম রাগে গজগজ করতে করতে তক্ষুণি বাসায় ফিরে আসে। মাহদী মাত্রই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিলো। ভাইয়ের মুখোমুখি হয়ে সে ইলা এবং ছোট্ট বাচ্চা মায়ানের ডিএনএ রিপোর্ট ছুঁড়ে মেরে রুঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
—এরপরেও বলবে, তুমি সাধু সন্ন্যাসী মাহদী মাশরুক? এরপরেও তুমি বলবে, নাবিলার সাথে তোমার কিছু ঘটেনি! তুমি, তুমি মাহদী মাশরুক নাবিলার একমাত্র ছেলে মায়ানের জন্মদাতা পিতা। আর একারণেই নাবিলা ওর ছেলের নাম মায়ান রাখতে চাচ্ছে, তাই না ভাইয়া? থুথু, তোমাকে ভাইয়া ডাকছি কোন আহ্লাদে! তুমি তো এটার যোগ্যই নও।
মাহদী সন্তর্পণে কাগজগুলো তুলে নিলো। রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইলার সাথে নাবিলার ছেলের ডিএনএ ৫০% ম্যাচ করছে। তার মানে এই ছেলেটি তারই ঔরসজাত। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? মাহদী নিজের প্রতি সম্পূর্ণরুপে আত্মবিশ্বাসী, নাবিলার সাথে তার কোনো ধরণের সম্পর্কই নেই। এমনকি, এর আগে তাকে কোনোদিন চিনতোও না। তাহলে সেই মেয়ের সন্তানের বাবা কীভাবে হবে সে!
(চলবে…)