#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#একাদশ_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
ঈদের এক সপ্তাহ পরেই ভার্সিটি খুলে গেল তোহফার। তাই এবার ঈদের পর পাঁচদিন থেকেই ঢাকা ফিরে এসেছে সে। আসার ইচ্ছে না থাকলেও চলে এসেছে। ইরাও চলে এসেছে তার সাথে। যদিও অ্যাডমিশনের আরো সময় বাকি আছে কিন্তু হিউজ সিলেবাস যত দ্রুত শেষ করে রিভিশন দেওয়া যায় ততই ভালো। তাই চলে আসা। পরে নাহয় যেয়ে ঘুরে আসবে আবার।
আজ তোহফার রেজাল্ট দিবে। এইজন্যই একটু আগে আগে ভার্সিটি গেল সে। গিয়ে দেখে রেজাল্ট টাঙিয়ে দিয়েছে বোর্ডে। ফার্স্ট ইয়ার আর ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে। ফাইনাল ইয়ারের সবাই বেরিয়ে যাবে আর তিন মাস পরেই অ্যাডমিশন। তোহফা এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবে। যেয়ে রেজাল্ট দেখল। সিজিপিএ ৩.৯৭। একটুর জন্য ৪.০০ হল না। আফসোস করতে করতে বের হয়ে দেখতে পেল তানভীরকে সবাই congratulations জানাচ্ছে। এত সিনিয়রের মাঝে আর সেদিকে গেল না তোহফা। একজনকে জিজ্ঞেস করল,
– “উনাকে সবাই হঠাৎ অভিনন্দন জানাচ্ছে কেন?”
– “আয়হায় তুমি চেনো না উনাকে? উনি এখানের টপার। প্রতিটা সেমিস্টার সিজিপিএ ফোর আউট অব ফোর পেয়ে কমপ্লিট করেছেন। এবার ফাইনাল সেমিস্টারে লাস্ট একুশ বছরের রেকর্ড ভেঙেছেন মার্কস দিয়ে।”
কথাগুলো বলে চলে গেল মেয়েটা। তোহফা তাজ্জব বনে গেল একেবারে। তানভীর ব্রিলিয়ান্ট সেটা জানত সে কিন্তু এতটা আশা করেনি। এই ছেলেটার সম্পর্কে কত খারাপ কিছু ভেবেছিল তোহফা। এখন নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে তার। ছি!!
তানভীর দূর থেকে দেখল তোহফা তাকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসল তোহফা। তানভীরও হাসল। তারপর পাশের ছেলেটিকে কিছু একটা বলে এগিয়ে এলো তোহফার দিকে।
তানভীর তোহফার কাছাকাছি আসতেই তোহফা বলল,
– “congratulations তানভীর ভাই।”
তানভীর হেসে বলল,
– “ধন্যবাদ।”
– “আপনি যে এতো মেধাবী আগে বলেননি তো?”
– “কেউ কি মেধাবী হলে সেটা বলে বেড়ায়?”
– “অনেকেই কিন্তু বলে বেড়ায়।”
তোহফার কথায় আবারো হাসলো তানভীর। তারপর বলল,
– “আমি বেরিয়ে যাব। আর কখনো হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। আজকে যদি একটু ঘুরতে চাই ঘুরবে আমার সাথে?”
– “আপনি বেরিয়ে যাবেন বুঝলাম কিন্তু দেখা হবে না বলছেন কেন? সামিকে তো পড়াতে যাবেনই।”
– “সামিকে আমি আর দু মাস পড়াতে পারব। এমনিতেই সেশন জটের কারণে ইয়ার গ্যাপ গিয়েছে। নাহয় আরো আগেই বেরিয়ে যেতে পারতাম।”
– “কেন কেন? আর দুমাস কেন?”
– “আমি হায়ার এডুকেশন এর জন্য এপ্লাই করছি। বেশ কয়েকটায় করেছি। আশা করি হয়ে যাবে কোনো একটায়। তারপর তো চলে যাব স্কলারশিপ নিয়ে ইনশাল্লাহ।”
তানভীর চলে যাবে শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো তোহফার। যদিও নিশ্চিত না স্কলারশিপ পাবে নাকি কিন্তু যেই রেজাল্ট দেখছে না পেয়ে যাবেই বা কই। কেমন বন্ধু বন্ধু মনে হয় তানভীরকে নিজের কাছে। তাই বলল,
– “ঠিক আছে চলুন। আজ আর ক্লাস করব না। আপনার সাথে ঘুরি।”
– “কোথায় যেতে চাও বলো।”
– “আপনি যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যেতে পারেন। আজ আপনার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যান, আমি সেখানেই যাব।”
মুচকি হাসলো তানভীর। তারপর তোহফার বাম হাত নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যাম্পাস থেকে।
হঠাৎ এভাবে হাত ধরায় প্রথমে তোহফার অস্বস্তি হচ্ছিল। এই প্রথম তানভীর তার হাত ধরেছে। কিন্তু কিছু বলল না সে।
ঢাকা থেকে বেশ দূরে ডেমরার দিকে চলে এসেছে তোহফা আর তানভীর। তোহফা প্রথমে এতদূর আসা নিয়ে আপত্তি করতে চেয়েছিল পরে আবার থেমে গিয়েছে। থাকুক না শেষ কিছু মুহূর্ত স্মৃতির পাতায়। উবারের ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে লাগল তানভীর। ওর পাশাপাশি তোহফাও হাঁটছে। তানভীর কিছু বলছে না, তোহফাও আগ বাড়িয়ে কথা বলছে না। কিছু মুহূর্ত নিরবেই সুন্দর। সব মুহূর্তে মনের ভাব কথার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয় না। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে নিশ্চুপ অনুভূতিও শেয়ার করা যায় নিজেদের মধ্যে। হঠাৎ হাঁটার মাঝেই নেশালো কণ্ঠে তানভীর বলল,
– “তোহফা?”
– “হু বলেন।”
– “তোমার কাছে যদি একটা আবেদন রাখি সেটা গ্রহণ করবে?”
– “চেষ্টা করবো। কি আবেদন বলুন?”
– “আমাকে বিয়ে করবে?”
চমকে গেল তোহফা। সাধারণত ছেলেরা প্রেমের প্রস্তাব দেয় কিন্তু এই ছেলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিল!! কিন্তু তোহফা তো এখন বিয়ে করবে না। পড়াশুনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি পেয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পরেই বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়াবে সে। তোহফাকে চুপ থাকতে দেখে তানভীর বলল,
– “এখনই বিয়ে করতে বলছি না। আমি দেশের বাইরে যদি যাই তিন/চার বছরের মধ্যেই ব্যাক করবো। ততোদিনে তোমার পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে। তখনই নাহয় বিয়ে করলাম।”
এবারও চুপ করে আছে তোহফা। সে কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এখনও এসব নিয়ে কিছু ভাবেনি সে। এভাবে হুটহাট বিয়ের প্রস্তাব দিবে জানলে আসতো না আজকে। প্রেমের প্রস্তাব দিলে নাহয় রিজেক্ট করে দেওয়া যেত কিন্তু এখন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তোহফার নিরবতা দেখে তানভীর বলল,
– “কি ভাবছো এতো??”
– “এভাবে হঠাৎ করে বললে তো আর হয় না। আমার সময় প্রয়োজন।”
– “ঠিক আছে, সময় নাও। সমস্যা নেই তো।”
– “আপনার আমাকে পছন্দ বুঝলাম। আপনার মা বাবা আমাকে পছন্দ করবে? আপনি যে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন?”
– “আমার মা বাবা থাকলেই তো পছন্দ করার বিষয়টা আসবে। মা মারা গেছেন ছয় বছর হতে চলল। বাবা মারা গেছেন দু বছর। সেই হিসেবে আমি এতিম। তোমাকে জাজ করার জন্য চাচিমনি ছাড়া কেউ নেই আর চাচিমনি আমার পছন্দকে কখনো অপছন্দ করবেন না। সেদিক থেকে তুমি সেফজোনে আছো বলতে পারো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তোমার পরিবার আমাকে মেনে নেয় কিনা। তার চেয়েও বড় কথা তুমি রাজি কিনা।”
এতক্ষণ তানভীর সামনে তাকিয়ে কথা বললেও শেষ কথাটা তোহফার দিকে তাকিয়ে বলল। তোহফা অবাক হয়ে গেল সব শুনে। ছেলেটাকে দেখলে মনেই হবে না তার মা বাবা নেই। কি সুন্দর হাসিখুশি আর সবার সাথে মিলেমিশে চলে। কেউ সরাসরি জানতে না চাইলে জানতেও পারবে না তানভীর নামক ছেলেটা দু বছর আগেই এতিম হয়ে গেছে। একটা চাপা শ্বাস নিল তোহফা। তারপর আবার বলল,
– “সময় প্রয়োজন আমার।”
________________________________
আটটা বেজে সাতাশ মিনিট। লতিফুর রহমান গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছেন। বারবার ঘড়ি দেখছেন তিনি। রুমানা বেগম চিন্তিত হয়ে আছেন। ঠিক তখনই বাড়িতে ঢুকলো সাহেল। চোখে মুখে তার খুশির ঝলক। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে থমথমে পরিবেশ দেখে কিছুটা চমকে গেল সে। সবাই হঠাৎ এভাবে বসে আছে কেনো বুঝে আসলো না তার। লতিফুর রহমান ছেলেকে দেখে বললেন,
– “কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
– “এদিকেই ছিলাম। আমি…”
– “এদিকটা কোথায় সেটাই জানতে চাচ্ছি।”
– “সুহানদের সাথে সামনের কফিশপে ছিলাম।”
– “তুমি এখন যথেষ্ট বড়। পড়াশুনা শেষ করেছো। তাই তোমাকে এসব কারণে জেরা করা মানায় না। বাবা হিসেবে আমিও সেটা করব না। কিন্তু ছেলে হিসেবে তোমার উচিত বাসায় ফিরতে দেরি হলে সেটা জানিয়ে দেওয়া। তুমি সবসময় সাতটার ভেতরে বাড়ি ফিরে আসো কিন্তু আজ অফিস না থাকা সত্ত্বেও দেরি করেছো যার কারণে মা বাবা হিসেবে আমাদের চিন্তা হয়। কি চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক না?”
সাহেল বুঝলো সে ভুল করেছে বাসায় না জানিয়ে। কিন্তু ফোন চার্জ শেষ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এটাই ভুল হয়েছে। কিন্তু বাবার সাথে আর এ নিয়ে তর্ক করা অসম্ভব। তাই মিনমিন করে বলল,
– “সরি বাবা, ফোনে চার্জ ছিল না। নেক্সট টাইম থেকে খেয়াল থাকবে।”
– “ঠিক আছে এখন যাও।”
বরাবরই লতিফুর রহমানকে বেশ ভয় পায় সাকিব আর সাহেল। সাহেল বেশি ভয় পায়। এখানে মা, ভাইয়া ভাবি সবাই আছে। কিন্তু বাবা সবার বড়। তাই তাকে সম্বোধন করেই কথাটা বলা উচিত মনে হলো সাহেলের। তাই বলল,
– “বাবা, আমি বিসিএস প্রিলিমিনারিতে চান্স পেয়ে গেছি।”
শুনে অবাক হলো ঘরে বসে থাকা প্রতিটা মানুষ। রুমানা বেগম আর সাকিব খুশিতে জড়িয়ে ধরল সাহেলকে। কিন্তু লতিফুর রহমান উঠলেন না। সাহেল কষ্ট পেল ভীষণ। বাবা তাকে কখনো বাহবা দেন না কিংবা কিছুই বলেন না। আজ আশা করেছিল কিন্তু আজও হলো না। ছোট থেকে সবসময় ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড হতো সে। বেশিরভাগ সময় সেকেন্ড হতে হতো কারণ ফার্স্ট পজিশন তানভীর তাকে পেতে দেয়নি। কিন্তু তার রেজাল্ট খারাপ হতো না। পয়েন্ট ফাইভ অর ম্যাক্সিমাম ওয়ান মার্কস এর ডিফারেন্স থাকতো তার তানভীরের সাথে। কিন্তু তবুও বাবা তাকে কখনো বাহবা দেননি। সাহেল কিছু বলল না। ভাই আর মা কে ছাড়িয়ে রুমে চলে গেল। বাবা এতো গম্ভীর আর কাঠখোট্টা স্বভাবের না হলে হয়তো তারও তার বন্ধুদের মতো বাবার সাথে শত শত শৈশবের স্মৃতি থাকত। এগুলো সব দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
______________________________
সারাদিন পড়তে পড়তে মাথা ধপ ধপ করছিল ইরার। তাই বিছানায় শুতে গেল রেস্ট নেওয়ার জন্য। তোহফা সামিকে নিয়ে নীলক্ষেত গেছে সেই বিকেলে। রাত হতে চলল কিন্তু এখনও ফেরেনি দুজন। ফিরতে ফিরতে বোধহয় আরও দেরি হবে। শুয়ে মাত্র চোখ বন্ধ করেছিল ইরা তখনই ফোন বেজে উঠল। বিরক্তি নিয়ে দেখল তোহফার ফোন বাজছে। ফোনের উপর সাহেলের ছবি ভেসে উঠেছে। সাহেল ফোন করেছে। ঈদের পর ঢাকা ফিরে আসার পর থেকে সাহেলের সাথে আর কথা হয়নি ইরার। যেই মানুষটা কখনও তার হবেই না তার সাথে কথা বলে মায়া বাড়ানোর কি প্রয়োজন? অনুভূতিগুলো ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাক, তবুও সে মানুষটাকে ভুলে যাক। ফোন কেটে গেলে বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবারও শুয়ে চোখ বুজলো ইরা। মনে মনে বললো, “যেহেতু আপনি কখনও আমার হবেন না তাই আপনাকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনুভূতিগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাক আমার মনের গহীনে। আপনার প্রতি আমার এক আকাশ সমান ভালোবাসার মৃত্যু হোক।”
আবারও ফোন বেজে উঠল। এবার রিসিভ করল ইরা। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলল,
– “আমি বিসিএস প্রিলিমিনারিতে চান্স পেয়ে গেছি। Congratulations জানা আমাকে ফাস্ট। আর হ্যাঁ দোয়া করিস যাতে ফাইনালেও হয়ে যাই।”
– “আমি ইরা। তোহফা আপু বাইরে গিয়েছেন বিকেলে। রাতে ফিরলে আবার ফোন দেবেন। রাখছি।”
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিল ইরা। তারপর আবারও চোখ বুজে শুয়ে রইল।
কল কেটে যাওয়াতে কেমন যেনো অপমানিত বোধ করল সাহেল। মেয়েটা কোনো কথা না শুনে ঠাস করে কল কেটে দিল। মনে পড়ে গেল ঈদের দিনের কথা। তার মতো হয়তো সেদিন ইরাও খুব অপমানিত বোধ করেছিল। হয়তো সেদিনের ব্যাপারগুলো নিতে পারেনি তাই এভাবে কল কেটে দিয়েছে। কিন্তু সেই বা কি করবে, দায়িত্বের কাছে সে যে বড্ড অসহায়।
চলবে???
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।