#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#ষষ্ঠ_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
স্লিপ খেয়ে পড়ার সময়ই চোখ মুখ খিচে ফেলেছে ইরা। কিন্তু কোমরে কারো শক্ত হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলল। সাহেল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতো শান্ত দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেল সে। কিন্তু কেনো যেনো সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছিল তার। তবে মুহূর্তেই সুখ সুখ অনুভূতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সাহেলের কথা শুনে।
– “আমার হাত তোমার কোমর ধরুক এটা তোমার চাওয়া সরাসরি বললেই পারো। এভাবে গাউনের উপর পা বেজে পড়ে যাওয়ার কি ছিলো বলো। ভাগ্যিস ধরেছিলাম নাহলে তো সবাই আমাকে বলতো ‘মাজা ভাঙ্গা বউ’ বিয়ে করেছি আমি। মান সম্মান কিছু থাকতো?”
সাহেলের এমন নির্লজ্জের মতো কথা শুনে তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো ইরা। সাহেল যে তখনও তার কোমর জড়িয়ে আছে সেটাও মনে নেই তার। সে ভাবছে এতো নির্লজ্জ একটা মানুষ কিভাবে হয় ভাই। সে গাউনের সাথে কি ইচ্ছা করে হোচট খেয়েছে নাকি। একটু বেশি লম্বা গাউনটা তাই তো এমন হলো।
ইরাকে এমন ভাবনায় মগ্ন দেখে বললো,
– “তুমি একটু বেশিই মোটা। আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। দয়া করে কি উঠবে নাকি নিচে ফেলে দেবো? নিচে ফেলে দিলে কিন্তু বোনকে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিজের কাজ করিয়ে নেওয়ার আশা নিরাশা হয়ে যাবে।”
সাহেলের একের পর এক নির্লজ্জের মত কথা শুনে কান ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে ইরার। সে দ্রুত সাহেলকে সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। কিছু বলতে নিবে তখনই সাহেল উল্টো ঘুরে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো। ইরার মাথা তখনও ভো ভো করে ঘুরছে। এই ছেলের মুখে কিছু আটকায় না নাকি। তাকে কিনা মোটা বলে গেলো। নিজেকেই যেনো মনে মনে বলছে ইরা
“ছি ইরা, তুই কি একটু দেখে চলতে পারিস না? এই ছেলের কোলের উপরেই কেনো তোর পড়তে হলো? বারবার এই ছেলের সামনেই কেনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়িস তুই? এই ছেলে তোকে বারবার লজ্জা দেয় তারপরও তুই তার সামনেই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হোস।”
লম্বা করে দম নিলো ইরা। আর নিচে গেলো না। অনেক অপমানিত লাগছে তার। সেদিন সে এমনিই কথার কথা বলেছিলো, পরে ক্ষমাও চেয়েছিল সে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত এই একই ব্যাপার নিয়ে খোঁচা দেওয়ার মানে খুঁজে পেল না ইরা। রুমে যেয়ে দরজা আটকে শুয়ে রইল। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু সে কাঁদল না। চুপ করে শুয়ে রইল।
খাওয়ার টেবিলে বসে সাহেল খেয়াল করল ইরা টেবিলে নেই। এমনকি তখনের পর থেকে ইরাকে আর নিচে দেখেনি সে। কিন্তু কাওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করাটাও জানি কেমন লাগে। আবার কি না কি ভেবে বসে। তার কাজটা সহজ করে দিল ইশা। বলল,
– “মা? ইরা খাবে না আমাদের সাথে?”
– “ওকে তো দেখছি না অনেকক্ষন হলো। মনে হয় রুমে বসে আছে।”
– “আচ্ছা দাড়াও আমি ডেকে আনছি।”
উঠে গেল ইশা। সাহেলের সন্দেহ হলো। রুমে বসে আছে কেনো? তার কথায় কি কষ্ট পেলো? মেয়েটাকে রাগিয়ে দিতে ভীষণ ভালো লাগে। চোখ মুখ কুচকে যখন আঙ্গুল তুলে সেদিন ঝাঁঝালো গলায় কথা বলছিলো, সাহেলের সেই মজা লাগছিল। বিয়াইন বিয়াইন ফিল আসে এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করে তার।
ইশা দরজা ধাক্কা দেওয়ার দুই মিনিট পর দরজা খুললো ইরা। ইরার চোখ মুখ দেখে থমকে গেলো সে। বিদ্ধস্ত চেহারা বানিয়ে রেখেছে ইরা। বিস্ময় নিয়েই ইশা প্রশ্ন করল,
– “তুই কি দরজা আটকে কাঁদছিলি?”
এমনেই মেজাজ চটে আছে তার উপর আপুর এমন কথা শুনে রেগে গেলো ইরা। রেগেই বলল,
– “শুধু শুধু কাঁদতে যাবো কেনো আজব। তুই কেনো এসেছিস সেটা বল।”
– “এভাবে রেগে যাচ্ছিস কেনো? বাবা তোকে খেতে ডেকেছে। সবাই খেতে বসেছে। তুইও আয়। একসাথে খাবো আজ অনেকদিন পর।”
– “তোরা খেয়ে নে। আমার ভালো লাগছে না। খিদেও নেই। পরে খাবো।”
– “আয় না। এমন করছিস কেনো? আবার কখন আসতে পারব জানা নেই। আদৌ আসতে পারব কিনা তাও জানি না। একসাথে খাই আয়।”
বোনের কথায় তার দিকে তাকালো ইরা। তার বোন কি শ্বশুর বাড়িতে কষ্টে আছে?? প্রশ্ন করেই ফেলল শেষ পর্যন্ত।
– “আপু? তুই ভালো আছিস তো?”
– “আশ্চর্য ভালো থাকবো না কেনো?”
– “তাহলে আসতে পারবি না বললি কেনো? ওরা কি তোকে টর্চার করে?”
– “আরে বোকা মেয়ে সবসময় তো আর আসা হবে না। এই ধর পাঁচ ছয় মাসে কিংবা বছরে একবার আসা হবে। এজন্যই বললাম। তুই কি উল্টাপাল্টা ভেবে বসে আছিস। আমার শ্বশুর, শাশুড়ি মা খুবই ভালো মনের মানুষ। উনাদের আমার কখনো শ্বশুর শাশুড়ি মনে হয়নি, নিজের মা বাবা মনে হয়েছে। আমি আরেকটা মা পেয়েছি, আরেকটা বাবা পেয়েছি। আমার ছোট ভাইয়ের জায়গাও সাহেল পূরণ করেছে। ওর মতো একটা ভাই পেয়েছি। সাহেল হয়তো আমার দেবর কিন্তু ভাইয়ের চেয়ে কম নয়। সাহেল তো আমাকে ভাবি বলে ডাকে না। আপু ডাকে। আগেই বলে দিয়েছে সে আমাকে আপু ডাকবে। তার অনেক শখ একটা বড় বোনের। আমি বড় বোন তাই আপু ডাকবে আর বিভিন্ন আবদার করবে। যাই হোক আয় খেতে আয়।”
ইশা চলে গেলো। ইরা বুঝল আপু বেশ ভালই আছে। সেই উল্টাপাল্টা ভেবেছে। আবার মনে পড়লো সাহেলের কথা। এই ছেলেটাকে আপু যতটা ভালো ভেবে প্রশংসা করে গেল ছেলেটা যে ঠিক তার উল্টো সেটা তার আপুকে কে বোঝাবে!!
না যাওয়ার অদম্য ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে নিচে গেলো ইরা। তারপর সাহেলের উল্টো পাশের চেয়ারে খেতে বসলো আর মনে মনে সবাইকে একশো একটা গা লি দিলো। এই চেয়ারটাই ফাঁকা রাখতে হলো তার জন্য? আর কি চেয়ার ছিল না? কিন্তু মনের কথা মনে রেখেই খেতে শুরু করলো ইরা।
ইরা টেবিলে বসার পরে সাহেল প্রথম থেকেই খেয়াল করছে ইরার মন খারাপ। সাহেল পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলো সত্যিই ইরার মন খারাপ অনেক। মেয়েটার সাথে বোধহয় আজ বেশি করে ফেলল সে। ক্ষমা চেয়ে নেওয়াটা প্রয়োজন। তাই ভাবল খাওয়ার পরে একা পেলেই ক্ষমা চেয়ে নেবে।
____________________________
বাইরে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় হওয়ায় শাহনাজ পারভীন হাতের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলেন। তোহফা তখন সোফায় বসে টিভি দেখছিল। সে বলে উঠল,
– “কোথায় যাও মামী?”
– “ছাদে কাপড় দিয়েছি। সেগুলো আনতে হবে। বৃষ্টি আসতে পারে।”
– “তুমি বসো আমি যাই। এমনিতেও টিভি দেখছি। কাজ নাই তেমন।”
বলেই শাহনাজ পারভীনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছাদে উঠে গেলো তোহফা। তারপর কাপড়গুলো নিয়ে ঘরে ফিরে আসলো। মামীর রুমের খাটে কাপড় রেখে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
– “মামী, তোমার খাটে কাপড়গুলো রাখলাম। আমি আবার ছাদে যাচ্ছি।”
– “এখনই বৃষ্টি নামবে, ছাদে কি? একদম ভেজার পায়তারা করবি না। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
কিন্তু ততক্ষণে তোহফা বেরিয়ে পড়েছে বাসা থেকে। এতো গরমের মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়া কিছুতেই মিস করা সম্ভব না তার পক্ষে।
প্রায় ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে বাসায় ফিরলো তোহফা। দরজায় এসে দাড়িয়ে পরলো সে। আনন্দে অনেক বেশি ভিজে গিয়েছে। জামা কাপড় এভাবে নিয়ে বাসায় ঢুকলে বাসায় পানি পড়বে অনেক। ইশ কি করবে এখন সেটাই মাথায় আসছে না তার। কামিজের নিচের দিকটা ভালোমতো হাত দিয়ে নিংড়ে নিয়ে পানি ঝড়িয়ে ফেললো। সালোয়ার যতটুকু সম্ভব চেপে পানি ঝড়ালো। এরপর চাবি দিয়ে দরজার নব খুলে ভেতরে ঢুকলো সে। ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমের দিকে গেল সাবধানে। দৌঁড়ে গেলে আবার পিছলে পরে যাবে তখন আরেক বিপদ। যাওয়ার সময় সামির ঘরের সামনে দাড়িয়ে পরল তোহফা। দরজা কিছুটা ভিড়িয়ে রাখা। দরজা ভিড়িয়ে রাখা হলেও স্পষ্ট দেখতে পেলো তোহফা তানভীর বসে আছে। তানভীর এখানে কেনো??
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল তোহফা। তাকে ফলো করতে করতে বাসায় চলে এসেছে এই ছেলে!! সমস্যা কি এর এটা জানতেই হবে। প্রতিদিনই ভার্সিটিতে কথা বলার কোনো না কোনো অজুহাত খুঁজে কিন্তু সরাসরি কিছু বলে না। আবার মাঝে মাঝে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে। তবে একটা ব্যাপার বেশ মুগ্ধ করে তোহফাকে। ছেলেটা কখনো খারাপ ইন্টেনশন নিয়ে তার দিকে তাকায় না, তার দিকে তানভীরের তাকানো বেশ সহজ সাবলীল। তানভীর যে তার দিকে আর দশজনের দিকে তাকানোর মতো সাধারণ চোখে তাকায় না এটা তোহফা বুঝতে পারে। তাও চুপ করে থাকে সে।
আগে তানভীরের প্রতি প্রচন্ড বিরক্তি আসলেও এখন আর সেটা আসে না। কারণ প্রথমদিনের কাজটা বিরক্ত করার মত হলেও এই কদিন তানভীর তার সাথে বা তার সামনে এমন কোনো আচরণ করেনি যা বিরক্তিকর। হঠাৎ তার দিকে তানভীরকে তাকাতে দেখে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে রুমের দিকে হাঁটা দিলো তোহফা।
সামিকে কেমিক্যাল বন্ড এর ইকুয়েশন সলভ করতে দিয়ে দরজার দিকে তাকালো তানভীর। তারপরেই থমকে গেল। চোখাচখি হয়ে যেতেই দ্রুত সরে পড়ল তোহফা। কিন্তু তানভীর তখনও ঘোরের মাঝে আছে। কাকে দেখলো সে এটা? তোহফা এখানে? কিন্তু কিভাবে? দেখেছে খুবই ভালো কথা তাই বলে এভাবে?
“এতোটা আবেদনময়ী হয়ে সামনে আসার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো তোহফা? আমার ভেতরের তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলে তুমি।”
হঠাৎ এসব ভাবনার মাঝেই সামির ডাকে বাস্তবে ফিরলো তানভীর। লেখা শেষ করেছে সে। তানভীরের মনোযোগ যেন আর পড়ায় নেই। সে তোহফার কথাই ভেবে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া জামা, চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানি সব কিছু যেনো মুহূর্তের জন্য শিহরিত করেছিলো তাকে। তবুও নিজেকে নিজেই ধমক দিয়ে সামির খাতা নিলো। লেখা সব ঠিক আছে। ছেলেটার মা ছেলেটার ব্যাপারে তাকে যা বলেছিল সেগুলো আংশিক সত্যি হলেও আংশিক ভুল। ছেলেটা পড়াশুনা করে না কিন্তু চেষ্টা করলে পারবে। আর ছেলেটার চেষ্টা বাড়ানোর জন্যই তানভীরের এখানে আসা।
সামির হাতে কিটক্যাট দিতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল সে। তানভীর বলেছে প্রতিদিনের পড়া সুন্দরভাবে প্রতিদিন কমপ্লিট করলে প্রতি সপ্তাহে কিটক্যাট দিবে তাকে। যদিও সামি ছোট বাচ্চা না, ক্লাস নাইনে পড়ে তবুও কিটক্যাট তার এতই পছন্দ যে এটা পেলে তার বাচ্চামি স্বভাব বেরিয়ে আসে।
– “আজকে কিটক্যাট দিয়েছি সব কমপ্লিট করেছো বলে। পরের সপ্তাহে যদি মিস যায় একদিনও তাহলে কিন্তু এটা আর পাবে না।”
– “পড়া মিস যাবে না কিন্তু হ্যাঁ আমার চকলেট যেনো মিস না যায়।”
হেসে সামির মাথার চুল এলোমেলো করে দিল তানভীর। তারপর আগামী দিনের পড়া বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
চলবে??
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন