অসময়ের বৃষ্টিফোঁটা পর্ব ৫

0
545

#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#পঞ্চম_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা

এক হাতে পার্স আর আরেক হাতে শাড়ির কুচি ধরে বুয়েটের গেটে পা রাখলো তোহফা। তার স্বপ্নের জায়গা! স্বপ্ন পূরণের স্থান!! গেট পেরিয়ে সামনের দিকে এগোল সে। শাড়ি পড়া হয় না বলে অভ্যাস নেই তেমন। তাই সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। কিন্তু এভাবে তো আর বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সে দাড়িয়ে আছে ইসিই ভবনের সামনে। বিশাল এই বিল্ডিং এর কোনো একটা ক্লাস রুমে তার ক্লাস হবে ভাবতেই মনের মাঝে অন্য রকম এক অনুভূতি খেলা করছে। চারপাশে ছেলে মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনুষ্ঠান বোধহয় হলরুমে হবে। এখানে তেমন কোনো আমেজ দেখা যাচ্ছে না। সে যখন ভবন দেখতে ব্যস্ত তখনই একজন ছেলে এসে বললো,
– “এক্সকিউজ মি আপু? প্রোগ্রাম টা হলরুমে এরেঞ্জ করা হয়েছে। কাইন্ডলি ওদিকে যাবেন হলরুমে যাওয়ার জন্য।”
তোহফা তাকালো ছেলেটির দিকে। গলা ঝুলানো আইডি কার্ড দেখে বুঝলো ছেলেটি ভলান্টিয়ার। মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে হলরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। যাওয়ার সময়ই সামনে কয়েকজন ছেলে মেয়েকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল তোহফা। সামনে সাহেল ভাইয়ার ফ্রেন্ড তানভীর ভাইয়া দাড়িয়ে আছে। তানভীর বুয়েটে পড়ে? কই সাহেল ভাইয়া আগে বলেনি তো! আজ প্রায় তিন মাস পর দেখছে এই ছেলেকে। রিসিপশনের দিন রাতেই ঢাকা চলে এসেছিলো তানভীর। সেবারই শেষ দেখা। এই ছেলেটাকে তার মোটেও পছন্দ না। দেখলেই ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে তোহফা। রাগ সামলাতেই দ্রুত হেঁটে স্থান ত্যাগ করলো সে।

হলরুমে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়লো তোহফা। খানিক বাদে দেখলো তানভীর আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে তার দিকেই আসছে। তার পাশে বসবে নাকি আবার!! পাশ কাটিয়ে যেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো তোহফা। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আবার পিছিয়ে এলো তানভীর। ভালোমতো পরখ করলো তোহফাকে। এভাবে তাকে স্ক্যান করার কি আছে বুঝল না তোহফা। আবার সিনিয়র তাই ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। যদি কোনো ঝামেলা হয়? প্রথমদিন এসেই বিপদে পড়তে চাইছে না সে।

তোহফাকে দেখেই চিনতে পারলো তানভীর। সেই যে সাকিব ভাইয়ের বিয়েতে দেখেছিলো আর দেখা হয়নি। মেয়েটার চেহারায় একটা কেমন মায়া মায়া ভাব থাকলেও মনের মাঝে ঝাঁঝালো ব্যাপার স্পষ্ট। প্রতিবাদী টাইপ মেয়ে তোহফা। তোহফাকে বেশ ভালো লাগতো তানভীরের। যতদিন ছিলো বিয়ে বাড়িতে, তোহফাকে দেখা যেনো তার একটা দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিলো। এখন তো একই সাথে পড়ছে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আরো বেশি করে রাগিয়ে দেওয়া যাবে। সেটার প্রস্তুতি শুরু করতেই জাহিদকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসিয়ে তানভীর বসলো তোহফার পাশের চেয়ারে।

মনে মনে যেই ভয়টা পাচ্ছিলো সেটা সত্যি হয়ে যাওয়ার পরেও বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না তোহফার মাঝে। ভাবখানা এমন যেনো সে সব জেনে শুনেই এই চেয়ারে বসেছে। তখনই তানভীরের ফিসফিসানি কণ্ঠ কানে এলো,
– “তুমি সেই মেয়েটা না যে সাকিব ভাইয়ার বিয়েতে গিয়েছিলে? আমার সাথে বাইকে চড়ে বাড়ি ফিরেছিলে?”
তানভীরের চেয়েও দ্বিগুণ ফিসফিস করে তোহফা জবাব দিল,
– “না না, আমি সেই মেয়েটা নই। আমি ওর জমজ বোন। আমার বোন বিয়েতে গিয়েছিলো, আমি যেতে পারিনি পরীক্ষার কারণে।”
– “কিন্তু আমি তো জানতাম তুমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আন্টি আংকেলও কি গুলিয়ে ফেলেন তোমাদের দুবোনকে?”
এবার ফিসফিস বাদ দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে তোহফা বললো,
– “আপনি আমার সিনিয়র ভাই। আপনাকে আমি অসম্মান করতে চাইছি না। দয়া করে আমাকে সেই পরিস্থিতিতে ফেলবেন না।”
তোহফার কথায় মুগ্ধ হলো তানভীর। মেয়েটা বেশ স্পষ্টভাষী। এই প্রথম কোনো মেয়ের কোনো কিছু নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ পেলো তানভীরের চোখে মুখে।

অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। ক্যাম্পাসটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখছিলো তোহফা। এই প্রথম বুয়েট ক্যাম্পাস এর ভেতরে এসেছে সে। আগে পলাশীর এদিকে আসলেও ভেতরে আসেনি। আজই প্রথম। তোহফা মনে মনে ভেবে নিলো একদিন মা বাবা আর মামা মামী কে নিয়ে আসবে। তার ভাবনার মাঝেই পাশে এলো তানভীর। পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো তোহফার সাথে। তোহফা কিছু বলল না। তানভীর বলল,
– “জায়গাটা তোমার চেনা নেই। চলো চিনিয়ে দেই।”
– “আমি দেখতে পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না। ধন্যবাদ।”
– “তোমার কাছে আমি জানতে চাইনি। আমি শুধু তোমায় দেখাতে চেয়েছি। চলো।”
তানভীরের কঠিন কথায় থতমত খেয়ে গেলো তোহফা। আর কিছু না বলে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। তানভীর এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছিল আর কোনটা কি বলছিল।

________________
সকালে নাস্তার টেবিলে খেতে বসলো সবাই। ইশা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। তারপর নিজেও খেতে বসলো। তখনই রুমানা বেগম (সাহেলের মা) বললেন,
– “কাল বেয়াই সাহেব ফোন করেছিলেন। তাদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের যেতে বলেছেন। সাকিব, সাহেল আর ইশা তোমরা যাও।”
ইশা বললো,
– “আপনি আর বাবা যাবেন না মা?”
– “না মা, তোমরা যাও। আমি আর তোমার শ্বশুর পরে কোনো একসময় যাব।”
আর কিছু বললো না কেউ। সাহেল হাসলো মনে মনে। আজ বাঘিনীকে রাগিয়ে দেওয়া যাবে ভাবতেই তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে হাসিতে। তবে রাগলে মেয়েটাকে সুন্দর লাগে।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ রওনা হলো ইশা, সাকিব আর সাহেল। যেতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে যাবে। রাস্তাঘাটের জ্যাম তো আর বলা যায় না। এইজন্যই একটু আগেই বের হওয়া। সাকিব আর সাহেল দেরিতে বের হতে চেয়েছিল। ডিনারের দাওয়াত, এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু রুমানা বেগম ইশার কথা ভেবে পাঠিয়ে দিলেন। সেই যে এসেছে আর যায়নি মেয়েটা। কিছুক্ষণ মা বাবার সাথে কাটিয়ে আসবে এই ভেবে সাকিব আর সাহেলকেও ইশার সাথে জোর করে দিয়ে দিলেন।

যতটা দেরি হবে আশা করেছিলো সাহেল আর সাকিব তার চেয়েও চল্লিশ মিনিট দেরিতে যেয়ে পৌঁছালো তারা। প্রায় সাতটা বাজতে চললো। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললো ইরা। বোনকে জড়িয়ে ধরে তারপর দুলাভাইকে সহ ঢুকতে দিলো। সাহেলকে তখনও খেয়াল করেনি ইরা। বোনের সাথে হাসি তামাশা করতেই ব্যস্ত। ইশার সাথে কথা বলতে বলতে দরজা লাগিয়ে দিতে নিলেই গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো ইরার কানে। কেউ যেনো বলল,
– “আমাকে কি ঢুকতে দেবেন না বিয়াইন আপা?”
চোখ কপালে তুলে দরজার দিকে তাকালো ইরা। অফ হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি আর ব্ল্যাক কালার জিন্স পরিহিত সাহেলকে দেখে আরেকদফা ক্রাশ খেলো সে। জিন্সের পকেটে হাত গুজে সোজা হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সাহেল। আজকেও এই ছেলের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো তাকে। সেটা মনে হতেই লজ্জায় কুকড়ে যেয়ে পাশে সরে পড়লো। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। এটা দেখে সাহেল মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকল। ইরা তখনও দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। সাহেল সোফায় বসতেই ইশা বললো,
– “সাহেল এসে সোফায় বসে পড়েছে। তুই দরজা খুলে আর কার জন্য অপেক্ষা করছিস?”
বোনের কথায় মাথা তুলে তাকালো ইরা। এক পলক সাহেলের দিকে তাকিয়ে দরজা লাগিয়ে দৌড়ে রুমে চলে গেলো।
ইরার আকস্মিক এমন কাণ্ডে সাকিব আর ইশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু সাহেল ভেতরে ভেতরে হাসতে হাসিতে ফেটে পড়ছে। বাহিরে অবাক হওয়ার চেষ্টা চালালেও সফল হতে পারছে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে সে।

___________________
শাহনাজ পারভীন চেয়েছিলেন সামির জন্য বাসায় টিচার রাখবেন। কোচিংয়ের পড়া সে নিজ থেকে বাসায় পড়ে না। সারাক্ষণ ধান্দা করে কিভাবে বাহিরে সময় কাটাবে আর খেলবে। ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। স্কুল থেকে ফিরে বের হয় আসে সন্ধ্যার পরে। কোচিং গুলো করে না ঠিকমতো। তাই তিনি ছাড়িয়ে আনবেন ভেবেছিলেন। তার এই কাজটাই আরেকটু সহজ করে দিলো তোহফা। এখন তিনি ভাবছেন তোহফার কাছে পড়তে বসাবেন সামিকে। কিন্তু সামি এতো ভদ্র না। বাঁদরামি তার শিরা উপশিরায় চলাচল করে। সে দুদিন বসেছিলো তোহফার কাছে। কিন্তু এমন ভাবে থাকে তোহফা সহ্য করতে পারে না আবার মামাতো ভাইকে বকাও দিতে পারে না। আবার মামা মামী কিছু মনে করে কিনা। সামি ছোট না যে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পড়াবে। উল্টো সামি তার সামনে এমন সব যুক্তি দাঁড় করায় যেটা তার মাথার উপর দিয়ে যায়। তাই আজ সকালে তোহফা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সামিকে পড়ানোর দায়িত্ব সে ছেড়ে দেবে। কিন্তু জিনিসটা খুবই বেমানান লাগছে। তবুও মামীর কাছে আমতা আমতা করে বলল,
– “মামী??”
– “হ্যাঁ কিছু বলবি?”
– “আসলে মামী আমি এখন যা বলবো তুমি কিছু মনে করো না। আমি আসলে স্ট্রিক্টলি সামিকে হ্যান্ডেল করতে পারছি না। ওর জন্য তুমি যদি কড়া কোনো ছেলে টিচার রাখো তাহলে হয়তো আরেকটু সহজ হবে ব্যপারটা।”
শাহনাজ পারভীন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
– “আমি জানতাম তুইও একই কথা বলবি। এর আগে ওর জন্য বাসায় আরো তিনটা টিচার রেখেছিলাম। তিনজনেই আমাকে একই কথাগুলো বলেছে। ভেবেছিলাম বড় বোন হিসেবে সম্মান করে হলেও সামি তোর কাছে ঠিকমত পড়াশুনা করবে। কিন্তু আমার সেই আশায় গুড়েবালি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর বললেন,
– “ঠিক আছে, তুই যা। আমি দেখি কি করা যায়।”
তোহফা সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। মামীর অবস্থা দেখে তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সে তো চেয়েছিলো সামিকে পড়াতে কিন্তু ছেলেটা কথা শোনে না। যেই ছেলে কথা তো শোনেই না উল্টো যা বলা হয় তার বিপরীত করে সেই ছেলেকে আসলে পড়ানো সম্ভব হয় না। মনে মনে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তোহফা।

চলবে??

বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here