#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
ভ্যাপসা গরমে ঘুম ভেঙে গেলো তোহফার। ঘুমের রেশ নিয়েই চোখ খুলে মাথার উপরে তাকালো। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে তাও গরম লাগছে। বৈশাখ মাসের শেষ সময়ের এই আবহাওয়াটা অসহ্যকর ঠেকে তার কাছে। গরমে একবার ঘুম ভাঙলে ভুলেও আর ঘুম আসবে না। তাই ফোন হাতে নিলো কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করার উদ্দেশ্যে। লক স্ক্রীন অন করতেই ফোনের উপর ভেসে উঠলো সময়। সময় দেখে তোহফার চোখ কপালে উঠে গেলো। দশটা বিশ বাজে। অথচ কেউ তাকে একটাবার ডাকলো না পর্যন্ত। এতো বেলা হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হলো রুম থেকে। সোফায় বসে আছে ইশা ভাবি। নতুন বউ ঘুম থেকে উঠে পড়লো অথচ সে এই বাড়ির মেয়ে হয়ে পরে পরে ঘুমোচ্ছে। ছি কি লজ্জার ব্যাপার! ইশা ভাবির পাশে ইরা বসে আছে। সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে রাগান্বিত স্বরে ডাকল কেউ। তাকিয়ে দেখে চাচীমনি রেগে তাকিয়ে আছেন। মেকি রাগ দেখিয়েই বললেন,
– “এতক্ষণ ঘুমিয়েছিস ভালো কথা। এখন আবার ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? এসে চুপচাপ খেয়ে নে।”
তোহফা গেলো চাচীর সাথে। খেতে বসলো। সবার খাওয়া শেষ। তাই টেবিল পুরো ফাঁকা। খুশিমনে খেতে বসেই কোণার চেয়ারটায় চোখ গেলো তোহফার। তানভীর বসে আছে। একহাতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আরেক হাতে ফোন দেখছে। তানভীরকে দেখেই মেজাজটা বিগড়ে গেলো তার। মনে পড়ে গেলো কাল রাতের কথা।
– “এটা কোন রাস্তা ভাইয়া?”
– “বাসার রাস্তা।”
– “আমি ছোট থেকে চট্টগ্রামে বড় হয়েছি। সব রাস্তাঘাট না চিনলেও আত্মীয়দের বাড়ির রাস্তাঘাট আমার চেনা। আগ্রাবাদের রাস্তা এইটা না সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।”
– “তোমাকে আমি এই রাস্তা দিয়েই নিয়ে যাবো আগ্রাবাদ। তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
– “অবশ্যই। আপনি এতরাতে একটা মেয়েকে বাইকে নিয়ে রাস্তাঘাটে উল্টাপাল্টা পথে যাবেন আর সেই মেয়েটা যদি আমি হই সমস্যা হবে না?”
তোহফার কথার মাঝেই আচমকা বাইক থামালো তানভীর। তারপর শীতল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
– “নেমে যাও।”
চমকে গেলো তোহফা। এই মাঝরাস্তায় নেমে যেতে বলার মানে কি? আশ্চর্য!
– “নেমে আমি যাবো কিভাবে? রাত সাড়ে বারোটায় কেউ নিশ্চয় আমার জন্য এইখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে না।”
– “তুমিই তো একটু আগে বললে আমি তোমাকে বাইকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি কি একবারও বলেছিলাম আমার বাইকে আসতে? তুমিই এসেছো। এখন নেমে পড়।”
তোহফা বুঝে গেলো সে এখন জেদ করলে বিপদে পড়ে যাবে। আসলেও তাকে এই মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিলে তখন? তাই সে আমতা আমতা করে বললো,
– “সরি ভাইয়া। আপনার যেই রাস্তা দিয়ে ইচ্ছা সেই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যান।”
মনে মনে হাসলো তানভীর। মেয়েটা ভেবেছে তাকে সত্যি সত্যি মাঝরাস্তায় ফেলে সে চলে যাবে। কিন্তু কিছু বললো না। আবারো এগিয়ে নিলো বাইক।
“কাল এই ছেলের জন্যই রাতে লেট হয়ে গিয়েছিলো। দুনিয়ার সব আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরিয়ে তারপর বাসায় এনেছে সে। নামিয়ে দেওয়ার ভয়ে কিছু বলতেও পারিনি। ফলস্বরূপ আসতে প্রায় দেড় ঘন্টার বেশি লেগেছে, আজ সকালেও উঠতে দেরি হয়ে গেছে।”
মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই খাচ্ছে তোহফা। তানভীর একবারও এদিকে তাকায়নি। খুশিমনে খেয়ে প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো সে।
তখনই মাথা তুলে তাকালো তানভীর। তোহফার তাকে দেখে রাগে গজগজ করাটা বেশ উপভোগ করে সে। ইচ্ছে করে আরেকটু রাগিয়ে দিতে। কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে বিপরীত হতে পারে। তাই ইচ্ছেটা থেমে গেলো এবারও।
ইরা মেয়েটাকে বেশ পছন্দ হলো তোহফার। তার এক বছরের জুনিয়র কিন্তু অমায়িক ব্যবহার। তাকে মিষ্টি করে আপু ডাকে আর বেশ সম্মান করে। তোহফার সমবয়সী কেউ নেই এই বাড়িতে। তোহফার বাবা সবার ছোটো। সবচেয়ে বড় তার বড় ফুপি। বড় ফুপির একটা ছেলে সীমান্ত আর একটা মেয়ে তাইমী। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সীমান্ত ভাইয়া ঢাকায় সেটেল আর তাইমী আপু চট্টগ্রামেই থাকে। বড় চাচ্চুর দুই ছেলে, সাকিব ভাইয়া আর সাহেল ভাইয়া। সাকিব ভাইয়ার বিয়ে হলো কাল আর সাহেল ভাইয়া চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ে। আর তোহফা মা বাবার একমাত্র সন্তান। তাই সাহেল ভাইয়া, সাকিব ভাইয়া, সীমান্ত ভাইয়া আর তাইমী আপুকেই সে নিজের ভাইবোনের মত সম্মান করে। তারাও তোহফাকে ছোটবোনের মতো ভালোবাসে। বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ায় সবার চেয়ে আদর ভালোবাসাও যেনো তার বেশি।
ইরাকে পেয়ে প্রায় সমবয়সী সঙ্গ পেলো তোহফা। তাই গল্প জুড়ে দিলো। ইরা মেয়েটা বেশ মিশুক। অনেক কথা বলতে পারে। বেশি কথা তোহফার মনে বিরক্তির সৃষ্টি করলেও ইরার কথাগুলো কেনো জানি তার একটুও বিরক্ত লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে এই কথাগুলো শুনতে না পারলে তার অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। এমন সময়ই ঘরে এলো সাহেল। ইরাকে দেখে বললো,
– “আরে বিয়াইন, আপনি এখানে কি করছেন?”
– “আপনার বোনের সাথে গল্প করছি।”
সাহেল যেনো অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এমন ভান করে বললো,
– “তুমি তোহফার সাথে কথা বলছো? ও কথা বলতে জানে?”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো তোহফা। ইরা একবার সাহেলের দিকে আরেকবার তোহফার দিকে তাকালো। তারপর আবার সাহেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– “কথা বলতে জানবে না কেনো? আপু অনেক সুন্দর করে কথা বলে। আপনিই বরং জানেন না। হাহ।”
সাহেল হাসতে হাসতে বললো,
– “বোবার মুখে কথা ফুটেছে তাহলে!”
– “তোমার কি আর কোনো কাজ নাই ভাইয়া আমার পিছে লাগা ছাড়া?”
– “কি করবো বল পেটের ভাতগুলো তো হজম হওয়া দরকার, নাহলে তো আবার শরীর খারাপ করবে।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সাহেল। আজকের জন্য এতটুকু। বেশি করলে আবার মায়ের হাতে মার না খেতে হয় সাহেলের।
ইরা হো হো করে হেসে যাচ্ছে তখন থেকেই। তোহফা নাক মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সরাসরি বোবা বলে গেলো! আবার শেষে কিসব বলে গেলো। এমনে অপমান!!
ইরা হাসতে হাসতেই বললো,
– “আপু, ভাইয়া তো খুবই মজার মানুষ। আপুকে সবসময় বলতাম বিয়ে করলে তোর দেবরকে করবো। তাহলে আর শ্বশুরবাড়িতে কাজ করা লাগবে না। শাশুড়ি আমাকে কাজ দিলে সেটাও তোকে দিয়ে করিয়ে নেবো। এখন সাহেল ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা খুব দ্রুত সারতে হবে।”
বলেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো ইরা। তোহফা এতক্ষণ চুপ করেছিলো। এখন মৃদু হাসছে। ইরা প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও এখন কেমন জানি লাগছে। কিছু একটা মনে হতেই পেছনে ঘুরল ইরা আর সাথে সাথেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। পেছনে সাকিব, ইশা আর তাদের পেছনে সাহেল দাড়িয়ে আছে। সাহেল তুলনামূলক বেশি লম্বা তাই পেছনে থাকলেও সাহেলের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ রসিক সাহেলকে দেখলেও এখন বেশ গম্ভীর আর শান্ত সাহেলকে আবিষ্কার করলো ইরা। সাকিব, ইশা মিটিমিটি হাসছে যা দেখে ইরার বেশ লজ্জা লাগছে কিন্তু সাহেল অদ্ভুত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতো শান্ত দৃষ্টি কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস?? ভেবে পেলো না ইরা।
ঝড়ের পূর্বাভাস পেলে যেমন মানুষ সচেতন হয় নিজেকে ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য, ঠিক তেমনই ইরাও নিজেকে রক্ষা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একবার মনে হচ্ছে চোখ মুখ খিচে ওয়ান টু থ্রি বলেই দৌড় দেবে কিন্তু পরক্ষণেই সেই চিন্তা ফেলে দিলো মাথা থেকে। না ফেলেই বা কি করবে। সাকিব আর ইশা রুমের ভেতরে ঢুকে গেলেও সাহেল তখনও দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অদ্ভুত আর শান্ত চাহনিতে!!
ইরার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো তোহফা। মেয়েটা বেশ লজ্জায় পরে গেছে। তাই বললো,
– “ইরা, চলো তুমি আর আমি গ্রামটা ঘুরে দেখি। আগে তো কখনো আসোনি। আমারও খুব একটা আসা হয় না ঈদ বা কোনো অকেশন ছাড়া। চলো আজ দুজন ঘুরে ঘুরে রাস্তাঘাট আবিষ্কার করি। যাবে তো?”
এমন কোনো সুযোগের অপেক্ষায় যেনো ছিলো ইরা। জোরে জোরে উপর নিচে মাথা ঝাঁকালো যার অর্থ যাওয়ার জন্য সে পা ছাড়াই খাড়া। মৃদু হাসলো তোহফা। তারপর সাহেলকে সরিয়ে ইরাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
চলবে??
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।