#সম্মোহন
পর্ব-তিন
-খাবারটা বেশ ভালো ছিলো বলো?
রুমে ফিরে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে জাবেদ। মীরা কপাল কুঁচকে আছে। ক্ষীন কন্ঠে “হুম” বলে জবাব দেয়। জাবেদ আবার ও জিগেস করে:
-আর কফি টা??
-হুম বেশ ভালো।
-কি হুম হুম করছো? মন খারাপ করছে এখনো?
জাবেদ মীরার পাশে এসে দাঁড়ায়। উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্নটা করে। মীরা জাবেদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শক্ত গলায় বলে:
-আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো!
-তো বলো..! এভাবে অনুমতি নিচ্ছো কেনো?
-জাবেদ আমার মনে হয় এবার বাসায় বলো বিয়ের কথাটা!
-মীর?
-কেনো জানাবে না? দেখো যেহেতু আমরা বিয়ে করে ফেলেছি সুতরাং এখন আমাদের প্ল্যান করার সময়। সংসার হবে, বাচ্চা হবে। এভাবে ভাল্লাগছেনা।
-জানাবোনা কখন বললাম? আমি ও তো চাই। কিন্তু বাসায় তো আগে বুঝাতে হবে। ওরা না মানলে কী করে…
হঠাৎ রেগে যায় মীরা। রাগে চোখে ভিঁজে যায়। জাবেদের কথা শেষ করতে না দিয়ে জাবেদের আঁধখোলা খোলা শার্টের কলার ধরে বলে:
-তুমি কি বাসায় বলে এসেছো যে মীরার সাথে নোংরামো করতে যাচ্ছি? তুমি বাসায় বলে বলে প্রতি সপ্তাহে তোমার এক রুমের বাসায় সংসার করো আমার সাথে? তোমার বাসায় বলেছো যে একটা মেয়ে তার মাকে খুলনাতে একা ফেলে রেখে ঢাকায় একা থাকছি শুধু তোমার সাথে শরীর…
-মীরা প্লিজ স্টপ ইট!! তোমার কথা গুলো জাষ্ট নেয়ার মতো না।
-তাই বুঝি? তা আর কি কি ঠিক নেয়ার মতো না? আমার শরীরের স্পর্শটা নেয়া যায় তো নাকি?
জাবেদ বুঝতে পারে মীরা খুব রেগে গেছে। মেয়েটা অসম্ভব শান্ত। এই বয়সে ওর আচরনের পরিপক্কতা ওকে এই বয়সের মেয়েদের থেকে আলাদা করে ফেলেছে। তাই এই রেগে যাওয়াটাও যেকোনো বিপদ ঘটাতে পারে। মীরাকে ঠান্ডা করতে হলে এখন নিজেকে কতটা ঠান্ডা রাখতে হবে সেইটা খুব ভালো করেই জানে ডাক্তার জাবেদ। জাবেদ মীরার গাল দুটো আলতো ধরে। আদুরে গলায় বলে:
-কি হয়েছে মীর? আমি কী বলেছি সংসার হবে না আমাদের? এডভান্স ভেবে নিচ্ছো কেনো?
-কেনো তুমি বলোনি আমার মা ডিভোর্সী জন্য তোমার বাসা থেকে মানবে না! বলোনি?
-আরে ঠিকাছে। কিন্তু আগেই হাল ছেড়ে দিচ্ছো কেনো? তোমাকে দেখাই, তোমার পড়াশোনা মাত্র শুরু; শেষ হোক, ভালো জব পাও তারপর দেখবে ওরা আর এইটা নিয়ে আপত্তি করবেনা!
-ভালো জব মাই ফুট! আমি তোমাকে ভালোবাসি এইটার ভ্যালু নেই? বিয়ে তো করেছোই তখন ভাবোনি এটা? আমার চাকরি হলে সেই চাকরির সাথে সংসার করবে তুমি? এমন লেইম এক্সকিউজ মেয়েরা দেয় জাবেদ।
-মীর বি প্রাকটিক্যাল। আমার দিকটা ভাবো। আমি ও তো চাই সংসার হোক। কিন্তু বিয়ের পর আমার বৌ কে কেউ ছোট করে কথা বললে আমার সেইটা ভাল্লাগবে? আমার বৌ কি কম ব্রিলিয়ান্ট?এখান থেকে গিয়ে শুধু পড়াশুনো কেমন?
মীরা জাবেদকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে:
-আই কান্ট লিভ উইথ আউট ইউ! প্লিজ ডোন্ট লিভ মি!
জাবেদ ও মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে:
-অনেক ভালোবাসি তোমায়।
মীরা শাওয়ার নিতে চলে যায়। এই সময় রুমে কেউ নক করে। বাথরুম থেকে মীরা শুনতে পায় রুমবয়ের গলা। বের হয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে:
-ছেলেটা কেনো এসেছিলো?
-তোমার পাপাইয়া জুস আর আমার মিন্ট লেমন দিতে।
-ও আচ্ছা।
-তুমি এটা বলে এসেছিলে বলোনি তো? যাক ভালো করেছো। দারুণ খেতে এদের মিন্ট লেমনটা। আমার যে এটা ফেবারিট বলেছিলাম তোমায়?
-হ্যাঁ বলেছিলে! কিন্তু আমি এসব দিতে বলিনি।
লোশন মাখতে মাখতে ব্যস্ততার ভঙ্গিতে বলে মীরা। জাবেদ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বলে:
-মানে?
-মানে আমি দিতে বলিনি। ওরা তোমায় বললো এটা আমি দিতে বলেছি?
-না। কিন্তু তাহলে দিলো কেনো?
-এমনি হয়তো দিয়েছে।
-দিতেই পারে কিন্তু জানলো কি করে আমি মিন্ট লেমনটা পছন্দ করি।
-আন্দাজে ঢিল মেরেছে। কারণ আমি পেপের জুস আর মিন্ট লেমন কোনটিই খাইনা। বমি পায়।
জাবেদ আর কিছু বলে না। এক চুমুকে সবটা জুস শেষ করে। তারপর বলে:
-মীর তুমি মেইল চেক করছিলা দুই একদিনের ভেতর?
-না। কেনো?
– তুমি তো আমার কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নিতে চাওনা। পার্ট টাইম জবের কথা বলেছিলে যে। কয়েকটাতে এপ্লাই করে দিয়েছি। ঐটাই আরকি। আপডেট তো মেইলে আসবে। ফোন ও করবে। তবে কোথায় কোথায় এপ্লাই করলাম এটা দেখে রাখা ভালো না?
-আচ্ছা ওয়েট!
ফোন হাতে নিয়ে মীরা দেখে কয়েকদিন আগের কয়েকটা মেইল। খেয়াল করেনি মীরা। একটা ফর্ম ওপেন করতেই মীরা দেখে ওর ম্যারিটিয়াল স্ট্যাটাস দেয়া ম্যারিড। আর স্পাউস নেইম ” জাবেদ মাহমুদ”। মীরার চোখ চক চক করে উঠে। জাবেদ যদি মীরার কথা বাসাতে না ই জানাবে তাহলে নিজের নাম দিবে কেনো ওর স্পাউস এর ঘরে। জাবেদ তো সত্যিই অনেক ভাবছে মীরাকে নিয়ে। মীরা ভাবে আমি শুধু শুধু ভুল বুঝছি জাবেদকে। কোথাকার কোন সুরাইয়া আমাকে সাবধান করলো আর তাতেই আমি জাবেদকে ভুল বুজছি?
ফোনটা রাখতে যাবে তখন ই হঠাৎ একটা আননন আইডি থেকে মেইল দেখতে পায়। এটা আজকের ই মেইল। ওপেন করতেই গা শিওরে উঠে। এটা তো জাবেদ। কিন্তু সাথে ঐ মহিলাটা কে? জাবেদের পরিবারের কেউ তো না। জাবেদ তো পরিবারের সবাইকে দেখিয়েছে। এদের কেউ তো এই মহিলা না। মীরার সন্দেহ আবার ঘনীভূত হয়। জাবেদকে জিগেস করবে ভেবেও জিগেস করেনা। হঠাৎ মনে হয় সুরাইয়া কি বলে এইটা আগে শোনা উচিৎ।
-মীর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার। শোবো?
মীরার সামনে দাড়িয়ে জাবেদ হাই তুলতে তুলতে বলে কথাটা। মীরা ও গম্ভীর গলায় বলে:
-হ্যাঁ ঘুমাও। এখন তো মাত্র ন টা বাজে। আমার ঘুম পাচ্ছে না।
জাবেদ কথা না বাড়িয়ে ঘুমোতে চলে যায়। জাবেদ ঘুমাবার পর মীরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটু বসে। মাথার ভেতর সুরাইয়া এখন পুরাদমে চেপে বসেছে। ঢাকায় থাকতে সুরাইয়ার সাথে যে নাম্বারে কথা হয়েছিলো সেই নাম্বারটাতে কয়েকবার ডায়াল করে। কিন্তু প্রতিবার ফোন সুইচড অফ দেখায়। মীরা এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছে ছবিটা দেখে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে রিসিপশন থেকে সুরাইয়ার রুম নাম্বার নিয়ে ওকে জিগেস করতে ও কি জানে? কিন্তু সেইটা ভালো দেখায়না বিধায় মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে থাকে কি করা উচিৎ। হঠাৎ মনে হয় এই ছবিটা ঐ মেয়ের না তো যার কথা জাবেদ বলেছিলো? তাহলে সুরাইয়া কি এই কথাই বলতে চায়? কিন্তু এতে সুরাইয়ার লাভ কি? আর কে ও? এত চাপ আর নিতে পারছেনা। মীরা উঠে গিয়ে দেখে জাবেদ ঘুমে বিভোর। কপালে একটু চুমু খায় আর আপন মনে বলে:
“সব যেনো মিথ্যে হয় জাবেদ। তুমি যেনো আমার ই থাকো”
খুব ভোরে আযানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় মীরার। সারা রাত এসি চলছে রুমটা বরফের মতো ঠান্ডা। জাবেদ এতটাই গভীর ঘুমে যে ছিলো যে কম্বলটাও টেনে নেয়নি। মীরা এসি বন্ধ করে দিয়ে হাত বোলায় জাবেদের গায়ে। একদম শীতল। অপলক তাকিয়ে দেখতে থাকে জাবেদের দিকে। অদ্ভুত মায়া আর কনফিউশনে আনমনে ডুকরে কেঁদে উঠে মীরা। মনে মনে বলে “খুব ভালোবাসি তোমায় ডাক্তার সাহেব”। ঘুমন্ত, শীতল জাবেদের চোখে, ঠোঁটে আর কপালে চুমু খায় মীরা। তারপর কম্বলটা টেনে ঢেকে দিয়ে বেড থেকে নেমে যায় ফোন হাতে নিয়ে। বেলকনীতে দাঁড়িয়েই গায়ে কাঁটা দেয়। ফেব্রুয়ারী মাসের ভোর বেলার বাতাসটাতে আশ্চর্য শীতলতা থাকে। গা হিম হয়ে যায়। সময় দেখতে ফোন আনলক করতেই দেখে তেরোটা মিসকল। কল ব্যাক করে কিন্তু ফোন সুইচড অফ। একটা সন্দেহ লাগে। এইটা সেই লোক না তো! যে আগে মেইল করেছিলো। নাকি সুরাইয়া? কি নামে মেইল আইডি টা আছে দেখতে হবে, তারপর নাম্বার সেইভ করলে হোয়াটস এপ আইডি থেকে নিশ্চয় ফোন নাম্বারের মালিককের নাম পাওয়া যাবে? তারপর এই দুটো মিলে গেলেই তো শিওর হওয়া যাবে এরা এক ই ব্যক্তি। কিন্তু ফেইক নেইম ও তো ইউজ করতে পারে! তবু ট্রাই করতে তো দোষ নেই! আগের মেইল চেক করে। কিন্তু ঐ আইডি থেকে পাঠানো কোনো মেইল ই নেই। মীরা তো রিমুভ করেনি। তবে কি জাবেদ??
নাহ জাবেদ তো ওর ফোনের আনলক পাসওয়ার্ড জানেই না। তাহলে কি ও স্বপ্ন দেখছিলো? জাবেদের ঐ সিটে বসে আনমনা হবার কথা টা যে বললো সেইটা, সেই মহিলার ছবি, এসব ই স্রেফ হ্যালুসিনেশন? আর সুরাইয়া?? ওটাও কি এই হ্যালুসিনেশনের একটা পার্ট? কিন্তু সুরাইয়ার সাথে তো ফোনে কথা হয়েছিলো ঢাকায় থাকতে। তাও অনেক লম্বা সময়। কি সব বলেছিলো জাবেদের ব্যপারে। আর সেসব শুনেই তো মীরা বারবার জাবেদকে সন্দেহ করছে। আচ্ছা ব্যপারটা এমন নয় তো যে জাবেদকে অতিরিক্ত ভালোবাসে বলে মীরার সাব-কনসাস মাইন্ড জাবেদকে হারানোর ভয়ে নিজের চারপাশে অনেকগুলো চরিত্র তৈরি করছে। যা শুধু মীরাই দেখছে। আর সেই চরিত্রগুলো ই নিয়ন্ত্রণ করছে মীরাকে? ভোরের ঠান্ডা বাতাসে মীরার হীম হয়ে যাওয়া শরীর হঠাৎ ই ঘামতে শুরু করে। মনে হলো পা থেকে শিরদাড়া বেয়ে মাথার উপর দিয়ে একটা পাতলা অনুভুতি বের হয়ে গেলো! মীরা দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। জাবেদকে সবটা বলতে হবে। ও তো ডাক্তার নিশ্চয় বুঝবে। পরক্ষনেই ভাবে এতে করে মীরাকে পাগল ভেবে যদি আরো দূরে সরে যায় জাবেদ?? নাহ কিচ্ছু বলা যাবেনা। মীরা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাত পা কুঁচকে দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে পরে।
এবারে নতুন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসে:
“রুম থেকে তোমার ব্যাগেস্ট গুছিয়ে জাবেদের মোবাইল তিনটে এবং ওয়ালেট নিয়ে বের হয়ে সোজা নিচে চলে আসো! কুইক!
মীরা ভয় পেয়ে যায়। জাবেদকে ডাকবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না। গা আরো ঘামতে থাকে। ক্ষানিকক্ষনের জন্য পুরো মাথাটা ব্রেইনলেস মনে হয়। এই মেসেজটাও হ্যালুসিনেশন?
চলবে….