সম্মোহন পর্ব ৬

0
483

#সম্মোহন

পর্ব-ছয়

অন্তরা একটু থামে। দীর্ঘশ্বাঃস ছেড়ে আবার বলে:

-জানো একবার আমার জন্মদিনে ও আমাকে উইস করতে ভুলে যায়। আর আমি রাগ করে কথা বন্ধ করে দিই। আর তাতেই জাবেদ ঢাকা থেকে ভোরের ফ্লাইটে কক্সবাজার চলে এসেছিলো শুধুমাত্র আমার রাগ ভাঙ্গাতে। এখানে এসে হোটেল বুকিং করে, আর সেইটা ফুলে ফুলে সাজিয়ে আমাকে চরম সারপ্রাইজ দিয়েছিলো। সে এক হুলুস্থুল কান্ড। আমি আর রাগ করে থাকতে পারেনি। সেদিন আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পরেছিলাম। তার পর ই বুঝতে পারি সেদিন ছিলো আমার যত্ন করে রাখা সম্ভ্রম হারানোর দিন। আমার ব্যক্তিত্ব হারানোর দিন। আর সেদিনের পর থেকেই জাবেদ বদলে যেতে থাকে।

সুরাইয়া বলে:

-এরকম সারপ্রাইজ ও আমাকেও দিয়েছিলো। আর যেদিন ওর উদ্দেশ্য সফল হয় সেদিনের পর থেকে ওর ব্যস্ততাও বাড়ে।

মীরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো সব। অন্তরা বলে:

-হুম। আমি বেশ কয়েকবার ওকে ধরে ফেলেছি। বারবার ক্ষমা করেছি। কিন্তু তারপর দেখলাম এটা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে। তার বেশির ভাগ সময় কাটে নতুন নতুন নারীর গন্ধ খুঁজে খুঁজে। তখন ই আমি এর গোড়াটা খুঁজতে থাকি। তারপর বিভিন্ন ভাবে পেয়ে যাই তোমাদেরকে। আরো কয়েকজনকে পেয়েছিলাম তবে ওরা সামনে আসতে চায়নি। আস্তে করে সড়ে গেছে জাবেদের জীবন থেকে। বা জাবেদ কৌশলে সরিয়ে দিয়েছে।

কথা বলতে বলতেই গাড়ি হোটেলের সামনে চলে আসে। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই দুজন লোক এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। তাদের একজনকে মীরা চিনে। রিসিপশনে যে লোকটা মীরাকে চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিলো সেই লোক। ওরা ভি আই পি রিসিভ করার আদলে রিসিভ করছিলো মীরা,অন্তরা আর সুরাইয়াকে। গাড়ি থেকে নেমে অন্তরা আগে আগে হাঁটছিলো আর ছেলে দুটো ওদের পেছনে পেছনে। মীরা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। অন্তরাকে এত সম্মান করছে কেনো এরা? তাহলে অন্তরা কি খুব ক্ষমতাবান কেউ? উপর মহলের কেউ? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দুজনের মনে। অন্তরা খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে যেতে ছেলে দুটোকে জিগেস করছিলো;

-সব ঠিক আছে?

কাঁচুমাচু হয়ে অনুগত ভৃত্যের মতো ভঙ্গিতে একটা ছেলে বললো:

-ইয়েস ম্যাম। সব ঠিকাছে। যাদেরকে আসতে বলেছিলেন। উনারা কিছুক্ষণ আগেই এসছে। আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরেই পেছনের দিকটাতে একটা মাঝারি সাইজের রুম। ছেলে দুটো রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর ওরা তিনজন রুমের ভেতর ঢুকলো। রুমটাতে হালকা আলো জ্বলছে। রুমের চারপাশে সোফা বসানো। আর প্রতি সেট সোফার সামনে একটা করে টি টেবিল। সাজানো গুছানো। ভেতরে ঢুকতেই মীরা দেখতে পায় দুই পাশে সোফায় তিনজন লোক বসা। দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। এদের মধ্যে দুজনকে মীরা এবং সুরাইয়া দুজনেই চিনে। ছবিতে দেখেছে। এরা জাবেদের মা বাবা। জাবেদ ওদের দুজনকেই পরিবারের সবার ছবি দেখিয়েছে। এটা বিস্বস্ততা অর্জনের আরেকটা ট্রিক। উনাদের মুখ শুকনো। চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। জাবেদের বাবা লম্বা, ফর্সা চিকনা মানুষ। ছবিতে দেখেছিলো মীরা। মানুষটা অজানা আশঙ্কায় লালচে হয়ে কুঁজো হয়ে গেছে। জাবেদের মা ও তাই। টকটকে মুখটা কালো হয়ে আছে। ছবিতে দেখেছিলো বেশ পরিপাটি। কিন্তু ছেলের কি হলো সেই ভয়ে একদম এলোমেলো হয়ে আছে। মীরার বুকের ভেতর ও ঝড় হচ্ছে। এত কিছু জানার পর ও জাবেদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো! এটা ভেবে অস্থির লাগছে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। পানি তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে কিন্তু পানি চাইবার মতো পরিবেশ নেই। সুরাইয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেও চিন্তায় অস্থির। অন্তরা ভেতরে ঢুকে বলে।

-আপনারা জাবেদের মা বাবা আমি চিনি। আমি অন্তরা। আপাতত আমার পরিচয় আমি এই হোটেলের ওনারের ভাতিজি। তবে এটা আমার পরিচয় না। আমার পরিচয় পরে জানতে পারবেন। আমিই আপনাদেরকে এখানে ডেকেছি।

জাবেদের বাবা কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন:

-জাবেদ কোথায়? কি করেছে ও?

জাবেদের মা খুব শক্ত হবার চেষ্টা করলেন। প্রচন্ড রাগে দুঃখে গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলোনা। তিনি জাবেদের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

-আমি জানতাম একদিন এরকম কিছু হবে। ওর মতো কুলাঙ্গার সন্তান পেটে ধরে পাপ করেছি আমি আর তুমি পাপ করেছো ওকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে। সে পাপের সাজা তো পেতেই হবে।

বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি। অন্তরা বলে:

-আন্টি আমি জানিনা আপনারা কি ভেবে কাঁদছেন। তবে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকুন আজকে অনেক কঠিন কথা হজম করতে হবে। অনেক কঠিন কিছু দেখতে হবে। যা কোনো মা বাবার কাছে হজম করা সত্যিই মুশকিল।

-আমি এখানে আসার আগেই প্রস্তুত হয়ে এসেছি মা। বলো তুমি।

অন্তরার মনে হলো জাবেদের মা বেশ শক্ত মনের। এবং তিনি হয়তো জাবেদের এই স্বভাবের ব্যাপারে অবগত আছেন। অন্তরা বলে:

-ও হচ্ছে মীরা, আর ও সুরাইয়া। আপনারা ওদেরকে চিনবেননা। তবে ওরা আপনাদেরকে চিনে। কিভাবে চিনে সেইটা একটু পর বুঝতে পারবেন। আর উনি হচ্ছেন ডক্টর সরোয়ার রাশেদ। উনি আমার চাচার খুব কাছের একজন বন্ধু। আপনাদের সবাইকে এখানে ডেকে আনার কারণ টা বলবেন ডাক্তার আংকেল।

সবাই সোফায় বসে পড়লো। ডাক্তার সরোয়ার রাশেদ বললো:

-আসলে ডাক্তার জাবেদ আমার চাইতে অনেক জুনিয়র। তবে আমাদের কমিউনিটির হওয়াতে আমি উনাকে বেশ ভালোভাবেই চিনতাম। অন্তরার বাবা একদিন ডাক্তার জাবেদের ছবি দেখিয়ে বললেন এই ছেলেটার জন্য অন্তরা পাগল হতে বসেছে। যেহেতু ছেলেটা ডাক্তার তাই আমার কাছে বলা। আমি তো দেখেই চিনে ফেলি। আর খুব অবাক হই এটা ভেবে যে অন্তরার মতো একটা মেয়ে এই ছেলেটার ফাঁদে কিভাবে পড়লো। ছেলেটাকে যতদূর জানি হসপিটালে নার্স বা আয়া লেভেলের মেয়েদের সাথে উল্টা পাল্টা সম্পর্কের কথা প্রচুর কানাঘুসা হতো। অন্তরাকে সবটা বলার পর অন্তরা ওর কিছু বন্ধু বান্ধব ছিলো যারা এসব সাইবার টাইবারের ব্যপারে বেশ জানা শুনা ওদেরকে দিয়ে জাবেদের আইডি হ্যাক করালো ওখান থেকে পেয়ে গেলো মীরা আর সুরাইয়া সহ আরো অনেক মেয়েদের; যাদের সাথে জাবেদের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। এদের মধ্যে বিবাহিত, বাচ্চার মা, ডিভোর্সী এসব বেশি। এরপর মীরা আর সুরাইয়ার আইডি ও হ্যাক করা হয় ওদের ব্যকগ্রাউন্ড জানার জন্য।

সবাই এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিলো। মীরা বলে উঠে:

-তাহলে কি সেইকারণেই গতরাতের মেইলগুলো গায়েব হয়ে গিয়েছিলো?

-হ্যাঁ মীরা! তোমাকে পাঠানো মেইল গুলো সিন হবার পর ই আমি এখান থেকে ডিলিট করে দিই। যাতে কোনো প্রমান না থাকে। কারণ আমাদের প্ল্যান ছিলো অন্যরকম।

এটা বলেই অন্তরা আবার জাবেদের মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে:

– আন্টি আপনি বোধহয় এখন বুঝতে পেরেছেন আমরা কারা?

জাবেদের মা “হুম” বলে সম্মতি জানায় তারপর আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে। অন্তরা বলে:

-আন্টি আমি জানি কোনো মায়ের ই নিজের সন্তানের ব্যপারে এসব শুনতে ভালো লাগেনা। কিন্তু আপনাকে…

জাবেদের মা অন্তরা কে থামিয়ে দেয়;

-আমি এসব জানি। তুমি বলো।

ডক্টর সরোয়ার রাশেদ বলে:

-আপনি হয়তো অনেক কিছু জানেন কিন্তু একটা ব্যপার যা শুধু আমি জানি অন্তরা বা আপনারা কেউ এখন অবদি জানেননা। যেটা বলার জন্য আমিই অন্তরাকে বলেছি আপনাদের সবাইকে এখানে ডাকতে।

-কি বলছেন আংকেল?

অন্তরা অবাক হয়ে এটা বলে। ডাক্তার রাশেদ চশমা খুলতে খুলতে বলেন:

-হুম। জাবেদ আসলে অসুস্থ। ও যা কিছু করেছে সব করেছে ঐ অসুখের জন্য। ইচ্ছাকৃত করা অপরাধ না।। ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেলেও চাইলেও এই অভ্যেস থেকে বের হতে পারবেনা।

-এটা আবার কেমন আসুখ?

সুরাইয়া প্রশ্ন করে। ডাক্তার সরোয়ার রাশেদ উত্তরে বলেন:

-মনরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে এটি একটি মানসিক ব্যধি, এর নাম স্যাটেরিয়াসিস। এই রোগ মেয়েদের ও হয়। মেয়েদের হলে সেক্ষেত্রে তাকে বলে নিমফোম্যানিয়া। এই অসুখে আক্রান্ত ব্যাক্তি একাধিক যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী বা শুধুমাত্র যৌন বাসনা চরিতার্থ করতে সামায়িক ভাবে যেকোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর এই জন্য তারা যেকোনো ধরনের ঝুকিপূর্ন কাজ করতেও পিছপা হয়না। এরা ভীষণ রকম এগ্রিসিভ হয়, কৌশলী হয়। তবে একজনের প্রতি যৌনাসক্তি দীর্ঘস্থায়ী না ও হতে পারে। এদের আরো কিছু বৈশিষ্ট হলো পর্নোগ্রাফির প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তি, নিয়মিত ঘন ঘন হস্তমৈথুন, অসুরক্ষিত এবং উদ্দাম যৌনজীবনের প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ, সাইবার সেক্স, ফোন সেক্স বা ভিডিও কনফারেন্সে যৌনতায় লিপ্ত হওয়া, অশ্লীলভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে অনাবৃত করার ইচ্ছা, অন্যকে অনাবৃত অবস্থায় দেখার বা যৌনতায় লিপ্ত হতে দেখার ইচ্ছা ইত্যাদি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here