তুমি অতঃপর তুমিই
২২.
Writer Taniya Sheikh
“ইমা দরজা খোলো। ইমা তুমি কী শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? ইমা!” কয়েকবার দরজায় আঘাত করেও ইমার সাড়াশব্দ পেল না শান। এবার চিন্তা হতে লাগল। এই মেয়ের বুদ্ধির তুলনায় নেই। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে! শানের বুক কেঁপে ওঠে। ঘন ঘন দরজায় আঘাত করে ইমা, ইমা বলে। না সাড়াশব্দ পাওয়া গেল আর না দরজা খুললো ভেতর থেকে ইমা। চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে শানের। একটু পিছিয়ে যেই না দরজা ভাঙার জন্য রেডি হচ্ছিল – অমনি খুট করে দরজা খুলে এককোনে দাঁড়াল ইমা৷ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শান এগিয়ে এসে ধমকে বলল,
” দরজা খুলছিলে না কেন?”
কেঁদে কেঁদে নাক,মুখ লাল করে ফেলেছে ইমা। মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জবাব না দিয়ে। ইমার এই অবস্থা দেখে খারাপ লাগে শানের। নিজেকে শান্ত করে মৃদু হাসার চেষ্টা করে। হাসি ঠিক আসে না। কাছাকাছি গিয়ে ইমার চিবুক ধরে মুখ তোলে। বলে,
” আ’ম সরি। চলো খাবে।”
নিজের কর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হলেও ক্রোধ একটু শান্ত হয়নি ইমার। বরঞ্চ ঐ ঘটনার পর আরও যেন বেড়েছে। ঘুরে ফিরে সব দোষ সে শানকে দিচ্ছে মনে মনে। ক্রোধান্বিত রক্তিম চোখে চেয়ে ঝটকা মেরে শানের হাত সরিয়ে দেয়। চেঁচিয়ে ওঠে,
” কতবার বলেছি আমাকে ছোঁবেন না। কথা কানে যায়না আপনার?”
ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে শানের। ছুটে গিয়ে ইমার চুলের মুঠি ধরে বিছানায় ফেলে জোরপূর্বক স্পর্শ করে। কপাল,ওষ্ঠ,চিবুক ছুঁয়ে বুকের দিকে ঝুঁকে যায়। শানের চুলের ঘ্রানে এতক্ষণের অশান্ত ইমা মুহূর্তে শান্ত, নিথর হয়ে গেল। সমস্ত শরীর শক্ত করে পড়ে আছে বিছানায়। ইমা চেয়েও বাধা দিতে পারছে না। শক্তি, ভাষা সে হারিয়ে ফেলল এই মুহূর্তে। শান রাগে দিশেহারা। কী করছে কোনো হুশজ্ঞান নেই। হঠাৎ সকালের কথা মনে পড়ল। ভালোবাসলে ধৈর্য্যশীল হতে হয়। এতো তাড়াতাড়ি কী করে ভুলে গেল সে? চট করে উঠে দাঁড়াল শান। শান উঠে দাঁড়াতে উপুড় হয়ে দু’হাতে চাদর খামচে শব্দ করে কেঁদে ওঠে ইমা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে শানের। এই তার ধৈর্য্য! এই কী তার ভালোবাসা? সে সরি বলতে চাইল। কিন্তু কিছুতেই মুখ দিয়ে বের করতে পারল না। ইমার গায়ে চাদর টেনে চুপচাপ চলে এলো বাইরে৷ নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইল লিভিং রুমে। বিকেলটাও দুজনে অভুক্ত রইল। নিজেকে প্রস্তুত করে সন্ধ্যায় আবার ইমার রুমে গেল শান। এবার দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল খাটের এককোনে দু’ হাটু জড়িয়ে বসে আছে ইমা। দৃষ্টি সামনের জানালার বাইরে। ওড়না ঠিক আগের জায়গায় পড়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। ওড়নাটা হাতে তুলে শান ধীর পায়ে পাশে গিয়ে বসল,কিছুটা দূরত্ব রেখে। শানের উপস্থিতি টের পেয়েও নড়ল চড়ল না ইমা। সে দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে অপলক সামনে তাকিয়ে আছে। দু’জনে ওভাবে অনেক্ষণ বসে রইল। দুজনের চোখ থেকে নীরবে,নিভৃতে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
” আমার ভুল হয়ে গেছে ইমা। ওয়াদা করছি তুমি না বলা পর্যন্ত আর এমন কিছু করব না আমি।”
ইমা পলক ফেলে একইভাবে বসে থেকে। শানের কাতর কণ্ঠ তার মন বিন্দুমাত্র গলাতে পারেনা। শান সামনে তাকিয়ে ওড়নাটা ওর দিকে বাড়িয়ে পুনরায় বলে,
” স্পর্শ করব না বলেছি বলে ভেবো না তোমাকে সহজে ছেড়ে দেবো। না,কোনোদিন না। আমার অপরাধ আমাকে খুলে না বলা পর্যন্ত তোমার মুক্তি নেই। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি তুমি সব খুলে বলবে আমাদের উভয়ের জন্যেই সেটা ভালো হবে।” ইমা হাত বাড়িয়ে ওড়না নেয়না। কোনোরকমের প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। শান নীরবে উঠে দাঁড়ায় ওড়নাটা পাশে রেখে। দরজা পর্যন্ত এসে বলে,
” আমি তো তোমার চোখে নীচ। আশা করব আর বেশি নীচ হতে বাধ্য করবে না আমাকে। চুপচাপ খেতে এসো।”
শান বেরিয়ে যেতেই ইমা ফের নিঃশব্দে কাঁদে হাঁটুতে মুখ ঠেসে। আধঘণ্টা পার হলেও ইমা ডাইনিং টেবিলে আসে না। প্রচণ্ড রাগ হয় শানের। টেবিলসুদ্ধ খাবার দু’হাতে ঠেলে ফেলে বাড়ির বাইরে চলে যায়। রাগান্বিত শানকে বেরিয়ে আসতে দেখে দ্রুত গেট খুলে সরে দাঁড়ায় মতিন। শান হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলে যায় পুবদিকের রাস্তা ধরে। মতিন সভয়ে উঁকি দিয়ে একবার দেখে চুপচাপ নিজের জায়গায় বসল।
ইমরোজ মাহিবের গাড়ি ফলো করতে করতে এসে পৌছাল একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের পাশে। ভালো করে আশপাশটা দেখে বুঝতে পারল এটাও মাহিবের বাবা মঈন খানের সম্পত্তি। মাহিবকে ধরে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে মেয়েটি। একা কিছুতেই সামলে উঠছে না। ইমরোজ একবার ভাবল এগিয়ে যাবে কিন্তু সামনে মাহিবের বডিগার্ড দেখে গেল না। বডিগার্ডের সাহায্যে মাহিবকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েটি এখনো ফেরেনি। ইমরোজ অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখল বিধ্বস্ত চেহারায়, ছেঁড়া পোশাকে মেয়েটি পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এলো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। পেছন পেছন বডিগার্ডগুলো ছুটে আসছে। ইমরোজের ধারণা তবে ঠিক ছিল! ইমরোজ বডিগার্ডদের পেছনে ফেলে মেয়েটির কাছে গিয়ে হাজির হয়। দ্রুত দুজন একটি বিল্ডিংএর আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটি আতঙ্কিত মুখে সবটা দেখছে আর হিচকি টেনে টেনে কাঁদছে। বডিগার্ডরা এদিকে না পেয়ে অন্যদিকে খুঁজতে চলে গেল। ইশরায় নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে সতর্কে নিরাপদ স্থানে চলে এলো ইমরোজ।
” আপনি চলুন আমার সাথে।”
” কোথায়?” মেয়েটি অসহায় মুখে ফুঁপিয়ে বলল। ইমরোজ বলল,
” মাহিব খানের নামে থানায় কমপ্লেইন করতে।”
মেয়েটি চমকে ওঠে। আতঙ্কিত হয়ে ইমরোজের হাতটা ধরে অনুরোধ করে,
” প্লিজ, এমনটা করবেন না। আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে তাহলে। এসব জানাজানি হলে আমার বাবা-মা মরেই যাবেন। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আমারই ভুল। আমি কেন বান্ধবীদের প্ররোচণায় ক্লাবে গেলাম। কেন ঐ বদ লোকটাকে সাহায্য করলাম। সব দোষ আমার।”
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে। ইমরোজ তাকিয়ে দেখে মেয়েটির হাতার,পেটের অনেকখানি কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ওড়নাটাও নেই দেহের উপর। দৃষ্টি সরিয়ে নিজের গায়ের ব্লেজার খুলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দেয়,
” নিন,এটা পড়েনিন।”
মেয়েটির লজ্জিত মুখে এক হাত বাড়িয়ে ব্লেজার টা নেয়। গায়ে জড়িয়ে নাক টেনে টেনে বলে,
” আমার বাবা গ্রামের সামান্য স্কুল মাস্টার। আমাদের দুই বোনকে বহু কষ্টে বড়ো করেছেন তিনি। অনেক চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়েছে আমার। এখানে আপনজন বলতে কেউ নেই। হলে যাদের সাথে থাকতাম ওরাই আজ জোর করে ক্লাবে নিয়ে এসেছিল। ঐ লোকটি মাতাল হয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। আমাকে দেখেই হেল্প চাইল। আমি গ্রামের মেয়ে। শহরের মানুষের প্যাঁচ বুঝতে পারিনি।” এতোটুকু বলে আবার কাঁদতে লাগল। দু’হাতে শরীরের ব্লেজারটা আঁকড়ে ধরে বলল,
” উনার বডিগার্ডদের কাছে দিয়ে চলেই আসতাম। হঠাৎ হাতটা ধরে অনুরোধ করলেন বাসা পর্যন্ত যেন দিয়ে আসি। আমার মোটেও ভালো লাগছিল না তার স্পর্শ। আমি চলে আসতে চাইলাম। ওমনি জোর করে লিফটে টেনে নিলেন। চিৎকার করার পূর্বেই মুখ চেপে ধরে আমার। লিফট থেকে বেরোতেই উনার সাথে ধস্তাধস্তি হয় আমার। জানেন, আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি মরেই গেলাম। অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে ছুটে পালিয়ে আসি।” মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইমরোজ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন বহুবার হয়েছে। মেয়েটির কান্না তাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করল। ইমরোজ মেয়েটির হাত ধরে এক স্থানে বসল। এক বোতল পানি এনে দিল পাশের দোকান থেকে। সেটা দু’হাতে কোলের মধ্যে ধরে মেয়েটি কাঁদছে, ইমরোজ চুপচাপ পাশে বসে আছে। আড়চোখে দেখছে কিন্তু সান্ত্বনার ভাষা আজ খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে মেয়েটি বলল,
” আমি জানি আপনি আমার ভালোর জন্যেই রিপোর্ট করতে বলছেন, কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের সম্মানটাই সব। এটা চলে গেলে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে সমাজে। প্লিজ বুঝুন আমাকে,আমার অসহায়ত্বকে।”
ইমরোজ কিছুক্ষণ ভেবে অবশেষে বলল,
” ঠিক আছে। ”
মেয়েটি ওকে অনুরোধ করল এই কথা যেন কাওকে না বলে সে। কেন যেন কথাটা না চাইতেও মেনে নেয় ইমরোজ। মেয়েটি নত মুখে বলল,
” এই অবস্থায় হলে উঠতে পারব না আমি। মিরপুর আমার এক বান্ধবী থাকে। আপনি যদি দয়া করে সেখানে পৌঁছে দিতেন!”
” জি,অবশ্যই।”
মেয়েটিকে বাইকে চড়িয়ে মিরপুর দশের একটি বিল্ডিংএর সামনের এসে থামে। বাইক থেকে নেমে মেয়েটি বলে,
” ধন্যবাদ আপনাকে।”
” ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই,এটা আমার দায়িত্ব। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন।” এক টুকরো কাগজে নিজের নাম্বার লিখে মেয়েটির হাতে দেয়। কাগজে লেখা নাম্বারটায় দৃষ্টি রেখে মেয়েটি বলল,
” চলি তাহলে।”
” ঠিক আছে।”
সামনের গেট পার হতেই একবার ফিরে তাকাল ইমরোজের দিকে। অসহায় সে চাহনী ইমরোজের ভেতর পর্যন্ত নাড়া দেয়। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি মাথা নুয়ে ভেতরে চলে গেল। বেশকিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে ফিরে ইমরোজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ইমরোজের বাইকে যেতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটি। তখনই একটা অটো এসে হাজির হয় সামনে। অটোতে চড়ে বিপরীত দিকে রওনা হয় সে। অটোওয়ালার মোবাইল বেঁজে ওঠে৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে রিসিভ না করেই মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। এতোক্ষনের অসহায় মেয়েটিকে চেনায় যায়না। ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। ব্লেজারটা গা থেকে খুলে সামনে ধরে মোবাইল রিসিভ করে। ঘাড় কাত করে ক্রুর হাসি হেসে ব্লেজারটা দেখছে। হাসি থামিয়ে মোবাইলের ওপর পাশের মানুষটাকে বলে,
” প্লান এ সাকসেসফুল, বেবি।” ফের এক অদ্ভুত হাসিতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মেয়েটি সহ অটো ড্রাইভারের।
রাত ঘন হতেই শান ফিরে আসে। মলিন, অবসন্ন ভাব এসেছে চেহারায় সারাদিনের অভুক্তি,ক্লান্তিতে। দরজা খুলে উপরে উঠে যায় সোজা। লম্বা শাওয়ার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। খুব তাড়াতাড়িই ঘুম নেমে আসে দু’চোখে। ক্ষুধার্ত শানের কাঁচা ঘুম ভেঙে যায় কিছু পড়ার আওয়াজে। ভ্রু কুঁচকে অন্ধকারে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে আওয়াজটা। এবার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল শব্দটা। নিচে কেউ কাজ করছে। প্লেট,গ্লাস নাড়াচাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। চট করে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে এলো। ডাইনিং হলে লাইট জ্বলছে। শান এগিয়ে যেতেই ইমাকে দেখল। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে এক এক করে টেবিলে সাজাতে ব্যস্ত সে। একবার শুধু শানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। টেবিল সাজানো শেষ। শান অপেক্ষা করছে কখন ইমা ওকে খেতে ডাকবে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়না। হঠাৎ তখনকার কথা মনে পড়ে যায়। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ডাইনিং এরিয়ায় খাবার ফেলে যাচ্ছে তাই অবস্থা করে গিয়েছিল। পুরো ডায়নিংএ চোখ বুলিয়েও ময়লা,উচ্ছিষ্ট চিহ্ন দেখল না শান। বুঝে নিল এসব ইমায় পরিষ্কার করেছে। কিন্তু কেন? তার তো রাগ,ক্ষোভ শানের উপর৷ বিকেলের ঘটনা এতো সহজে ভুলে গেল? শানের কিছুটা অদ্ভুত লাগে ইমার হঠাৎ পরিবর্তন। তবে খুশি হয় এই ভেবে যে, ইমা স্বাভাবিক হয়েছে। অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ইমা খেতে ডাকল না-শানের অভিমান হলো। মনে মনে বলল,
” এতোকিছু করতে পারছে, অথচ একটু খেতে ডাকতে পারছে না। কী ভেবেছে ও? শান ক্ষুধায় পাগল হয়ে খেতে বসে যাবে? এতো সহজ নয় ম্যাডাম। খাবার সাজিয়ে থাকেন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। আমি চললাম।”
ইমা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই দেখল শান ফিরে যাচ্ছে। মেজাজ বিগড়ে গেল। বিরবির করে বলল,
” এতো কষ্ট করে মাঝরাতে উনার জন্য রান্না করলাম, টেবিল সাজালাম। আর উনি। দেমাগে বাঁচে না। মন তো চায়,, উফ!” নিজের রাগ কিছুটা দমিয়ে রান্না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। গলা চড়িয়ে বলে,
” যাচ্ছেন কই? খাবার দিয়েছি চোখে পড়েনা?”
শান মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে যায়। না ঘুরেই গম্ভীর গলায় বলে,
” চোখে তো কতকিছুই পড়ে, তাতে কী?”
” কতবড়ো বদ, আমি বলি এক আর উনি বলেন পাঁচ। আমি ভালো বলে বেঁচে গেলি তুই শানের বাচ্চা। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোর,,, ” ইমার বিরবিরানি থেমে যায় শান সিঁড়িতে পা দিতেই। দাঁতে দাঁত পিষে ইমা বলে,
” খেতে বসুন।”
শানের হাসি যদি তখন কেউ দেখত! একটু ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তা দেখে ইমা বলল,
” এখন কী ঝুঁকে কুর্নিশ করে বলতে হবে?”
” নো,নো। ইটস ওকে। আমি তো খেতে আসতামই। মোবাইল আনতে যাচ্ছিলাম আরকি। এতো অনুরোধ করার কী ছিল? তুমিও না।” শান ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা খাবার টেবিলের চেয়ারে এসে বসে। শানের ভাব দেখে আর কথা শুনে ইমার ইচ্ছা করছে চুল টেনে ছিঁড়তে। নিজের না, শানের। শান ইমার রাগে শক্ত হওয়া মুখটা দেখে মনে মনে হাসলেও বাহিরে স্বাভাবিক। ভাত প্লেটে বাড়তে বাড়তে শান বলল,
” তুমি খাবে না?”
” সাহেবদের খাওয়ার পরে কাজের লোকেরা খায়।”
প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায় শান৷ ইমার গলা শুকিয়ে যায় শানের রক্তচক্ষু দেখে। এই ভয় পাওয়াটা যেন শান বুঝতে না পারে তাই সাথে সাথে অন্যদিকে তাকায়।
” আমি খাব না ” শান যেতে উদ্যত হতেই ইমা মিথ্যা বলে,
” আমি আগেই খেয়েছি।”
” মিথ্যা বলছ তুমি।”
” মিথ্যা বলছি! আপনি কী করে বুঝলেন মিথ্যা বলছি? সবজান্তা শমসের আপনি? আজাইরা। খেলে খাবেন না খেলে নাই।” ইমা রান্নাঘরে চলে যায় রেগে। শান উঁচু গলায় বলে,
” সত্যি বলছ তো?”
” না, মিথ্যা বলছি। খাইয়েন না আপনি। এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা রাখেন,যান।”
” ভালো করেও তো বলা যেত কথাটা।”
” আমি ভালো কথা জানিনা৷ পছন্দ হলে কাজে রাখবেন নয়তো রাখবেন না।”
” বার বার কাজের লোক,কাজের লোক কেন বলছ নিজেকে?”
” আমার ইচ্ছা হইছে তাই। আপনার কী?”
“তোমার এই তর্কের স্বভাব আমার অপছন্দ ইমা। মেজাজ খারাপ করে দাও এসব করে তুমি।”
” হু, তাতে আমার বয়েই গেল।”
শান দেখল কথায় কথা বাড়ছে। যা কি’না ধীরে ধীরে ঝগড়ায় পরিবর্তন হতে সময় লাগবে না। সুতরাং চুপ হয়ে গেল শান। চেয়ারে বসে খেতে লাগল। বরবটি ভাজা চোখে পড়তেই সেটা পাতে তুলে নেয়। বউয়ের হাতের বাঙালিয়ানা রন্ধনের স্বাদ আয়েশ করে নিতে গিয়ে আস্ত মরিচে কামড় দিল। পুরো মুখ জ্বলছে ঝালে। তড়িঘড়ি গ্লাস উঠাতেই হাত ফসকে পড়ে গেল সেটা। ছুটে এলো ইমা।
” কী হয়েছে আপনার?”
” ঝাল, ঝাল।” মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলল শান। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ঝালে। জগ থেকে পানি গলায় ঢেলেও ঝাল কমাতে ব্যর্থ হলো। ইমার মায়া হচ্ছে শানের অবস্থা দেখে। যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, শান ইমার দিকে এগিয়ে এসে বলল
” ইমা কিস মি।”
” অ্যাআআআ।” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে দাঁড়ায় ইমা।
” শুধুমাত্র একটা ডিপ কিস তারপর সব ঝাল ভ্যানিশ, মুভিতে দেখোনি তুমি?”
ইমার কেন যেন মনে হচ্ছে শান এবার চালাকি করছে ওর সাথে। সাথে সাথে এখানে আসার প্রথম রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। কী বিশ্রী একটা মুভি চলছিল। কটমট করে তাকিয়ে ইমা বলল,
” ওসব ফালতু,লুইচ্চা মার্কা ছবি ইমা দেখে না৷”
” প্লিজ ইমা, কিস মি। নয়তো ঝালে মরে যাব আমি।”
অবস্থা সুবিধার না দেখে দৌড়ে রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ইমা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মাথা বের করে বলল,
” কিস,কুসে ভিটামিন নেই। ঝালে ভিটামিন সি আছে। আপনার মধ্যে ভিটামিন সি’র মারাত্মক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। একটু জ্বলাতে যদি ভিটামিন ঘাটতি পূরণ হয় তবে ক্ষতি কী? সহ্য করেন। বাই।”
শান অসহায় মুখ করে এগোতেই দাড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয় ইমা। হাতের গ্লাসটা দরজা দিকে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয় শান। বিরবির করে বলে,
” আমাকে কাইষ্টা বলত। আর নিজে কী, কাইষ্টার বউ কাইষ্টি? কাইষ্টি বলে কী কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে আছে? ধুর শালা! কী কপাল করে একটা বউ পেয়েছিলি! ঝালে মরে গেলেও ঝাল নিবারক একটা কিস দিতে চায়না। একটা কিস দিলে কী হতো ইমা? আমার ভিটামিন সি চাইনা,কিস চাই কিস। ঝাল নিবারক কিস।”
চলবে,,,,