#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী
সানাউল রাশেদিন ড্রয়িংরুমে বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছেন। তার পাশে বসে আছে শফিউল রাশেদিন। দুইদিন ছুটি নিয়ে তিনি পরিবারের কাছে এসেছেন। আফরোজা নাজনীন এবং তাহমিনা আক্তার পিঠা তৈরী করছেন। তাহমিদ আর সিক্তা পিঠা খাওয়ার বায়না ধরেছে। তাই তারা দুই জা মিলে পাটিসাপটা বানাচ্ছেন। বেশ
কয়েকটা পিঠা বানানো হলে আফরোজা নাজনীন হাফপ্লেটে করে নিয়ে আসেন ড্রয়িংরুমে। নিচ থেকেই জোরে ডাক দিলেন তাহমিদ আর সিক্তাকে। ডাক শুনে ওরা নিচে এসে দেখল সামনের টেবিলে কয়েকটা পিঠা।
দুই ভাই-বোন পিঠা হাতে নিয়ে বাবা-চাচ্চুকেও নিতে বলে। সানাউল রাশেদিন হেসে একটা পিঠা হাতে নিলেন, তার দেখাদেখি শফিউল রাশেদিনও একটা পিঠা নিলেন। তার বরাবরই তাহমিনার হাতের বানানো পিঠা খুব পছন্দের।
আফরোজা নাজনীন তার শ্বাশুড়িকে ধরে এনে সোফায় বসালেন। আজকাল তিনি খুব একটা হাঁটতে পারেননা। শ্বাশুড়িকে বসিয়ে রেখে তিনি রান্নাঘর থেকে আরেকটা প্লেটে করে দুইটা পিঠা এনে আয়েশা সালেহার হাতে দিলেন।
” কি করছ বউমা! আমার ডায়াবেটিস আর তুমি আমাকে দুইটা পিঠা দিলে! আমি শুধু অর্ধেক পিঠা খাব। ”
” আম্মা, এই দুইটা পিঠাই আপনাকে খেতে হবে। আমি কোন বারণ শুনবনা। সারা মাস কোন প্রকার মিষ্টি না খেয়ে শুধু একদিন দুইটা পিঠা খেলে ডায়বেটিস বাড়বেনা। কোন কথা না বলে খেয়ে নিন। ” আফরোজা নাজনীনের ধমকে আর কিছু বলার সাহস পাননা বৃদ্ধা। কিন্তু তার চোখের কোনে ঠিকই পানি জমেছে। তার তিনটা ছেলের বউই এক একটা রত্ন। তবে এই বড় বউটা একটু বেশিই ভালো। তাকে কখনো মা বৈ শ্বাশুড়ির চোখে দেখেনি। অতি আবেগে ভেসে তিনি কামড় বসালেন পিঠায়।
” ভাবি, কুহু কোথায় ভর্তি হচ্ছে? ওর ভর্তির বিষয় কে দেখছে? ” ইতোমধ্যে একটা পিঠা সাবাড় করে আরেকটা হাতে নিয়ে শফিউল রাশেদিন জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীনকে।
কুহুর নাম শোনা মাত্রই তাহমিদের বুকের ভিতর ঢোল বাজতে শুরু করেছে। ঢোলের প্রতিটি আওয়াজে কুহুর নাম লিখা।
পিঠা হাতে নিয়েই মনযোগী হয় তাদের কথা শুনতে।
” এখানের একটা সরকারি গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছে কুহু। শাহনাজের দেবর সাজ্জাদ ঐ কলেজেই আছে। সে-ই সব ব্যবস্থা করেছে। আনান ওর ফর্ম পূরণ করেছে। সে-ই কলেজের চয়েস দিয়েছিল। কয়েকটা চয়েস দিয়েছিল, তারমধ্যে এই কলেজে চান্স পেয়েছে। ছেলেটা এই কয়েকদিন খুব ছুটোছুটি করেছে । ”
” ও কবে আসছে ঢাকায়? আর থাকবে কোথায়? ” আবারও প্রশ্ন করলেন শফিউল রাশেদিন।
” সাজ্জাদ হোস্টেলে সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ক্লাস শুরু হলেই কুহু চলে আসবে। আগামী সাত-আট দিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হবে। আনানকে বললেই ও কুহুকে নিয়ে আসবে। ”
” আফরোজা, কুহুকে শুধু ওর পোশাক আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে বলো। ওর বেডিং এখান থেকেই কিনে দিও। আর ও যেন হোস্টেলের খাবার না খায়। সপ্তাহে দুইদিন খাবার দিয়ে আসবে। সাজ্জাদকে বলে হোস্টেলের ফ্রিজে খাবার রাখার ব্যবস্থা করে নিও। কুহু হোস্টেলের খাবার খেতে পারবেনা। ” সানাউল রাশেদিন তাদের কথার মাঝেই কথা বললেন।
” ভাবি, কুহুর বেডিং, অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার জন্য আমিও তোমার সাথে যাব। আমরা ওর সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ওকে হোস্টেলে উঠিয়ে দিয়ে আসব। কি কি কিনতে হবে আমি তার লিষ্ট করে রাখব। ” তাহমিনা আক্তার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন।
এদিকে বারবার আনানের কথা শুনে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এত মানুষ থাকতে আনানকেই কেন কুহুর দ্বায়িত্ব দেয়া হল! হাতে থাকা পিঠা রেখে দিল তাহমিদ। আর পিঠা খাওয়া হলোনা ওর।
ড্রয়িংরুমে সবার কথপোকথন চলতে থাকে। কেউ লক্ষ্য করলনা রা’গে তাহমিদের শরীর কাঁপছে।
নয়দিন পর। আজ কুহু ঢাকা আসবে। আনান গতকাল ফুলতলা গেছে। আজ সকালেই ওরা রওনা দিয়েছে। আফরোজা নাজনীন রান্না সেরে নিয়েছেন অনেক আগেই। রান্না শেষ করে তিনি আর তাহমিনা শপিংয়ে গেছেন কুহুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে।
তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বই নিয়ে বসেছে। ওর আর দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে। বাসায় শুধু ও আর দিদুন। মা, বড়মা নেই সিক্তাও কলেজে গেছে। গতকাল থেকে ওর ক্লাস শুরু হয়েছে। তাই আপাতত সে বাড়ি পাহারার কাজে রয়েছে।
কিন্তু তাহমিদের হাতে শুধু নামমাত্র বইটা রয়েছে। ওর মন পরে রয়েছে কুহুর কাছে। সেই সাথে মাথায় চিন্তা চেপে বসেছে, আনান আছে কুহুর সাথে। কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছেনা।
বিকেলে কুহু আর আনান এসে পৌঁছায় কলেজের হোস্টেলের সামনে। সেখানে আগে থেকেই আফরোজা নাজনীন, শাহনাজ সুলতানা আর তাহমিনা আক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। তারা দুপুরের দিকে কুহুর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে হোস্টেল সুপারভাইজারের নিকট রেখেছেন। সাজ্জাদ আগেই সুপারভাইজারকে বলে রেখেছিলেন। তাই কোন সমস্যা হয়নি। এরপর তারা বাসায় এসে খাবার খেয়ে কুহুর জন্য খাবার সাজিয়ে নিয়ে আসেন।
কুহু গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে আসে ফুপুদের কাছে। আছড়ে পরে আফরোজা নাজনীনের বুকে।
” এখানে আমিও আছি কুহুসোনা। আমার দিকে তো একটু তাকা। ” তাহমিনা আক্তার মিটিমিটি হেসে বললেন।
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন আপনি? দিদুন কেমন আছে? আর আংকেল ভালো আছে তো? ”
” একবারেই এত প্রশ্ন করলে আমি কোনটার উত্তর আগে দিব! আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে। ” কুহুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু আঁকেন তাহমিনা আক্তার।
তার খুব ইচ্ছে ছিল এই শান্ত, বোকাসোকা মেয়েটাকে ছেলের বউ করার। আজ তার ছেলের ত্যাড়ামির জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
কিছুক্ষণ তাহমিনা আক্তারের সাথে কথা বলে কুহু ছোট ফুপুর কাছে আসে। ছোট ফুপুও কুহুকে আদরে বুকে জরিয়ে নেয়৷
এরপর তারা একসাথে হোস্টেলের ভেতর প্রবেশ করেন। কুহুকে ওর রুমে পৌঁছে দিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে দেন। সব কাজ শেষ হলে আফরোজা নাজনীন কুহুকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলেন। কুহু ফ্রেশ হয়ে আসলে আফরোজা নাজনীন কুহুকে খাইয়ে দেন।
তারপর খানিকক্ষণ কুহুর সাথে কাটিয়ে তারা ফিরে আসেন যে যার গন্তব্যে।
আসার আগে তারা কুহুকে প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশ দেন। কি করনীয়, কি করনীয় নয় তার সকল কিছু বুঝিয়ে দেন। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত তাদের সকল কথা মেনে নেয়।
তাহমিদ পড়ার টেবিলে বসে আছে ঠিকই কিন্তু ওর মন পরে আছে কুহুর কাছে। কিভাবে কুহুকে দেখবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। হোস্টেল থেকে কুহু কখন বের হবে, কখন কলেজে থাকবে সেটা কিভাবে জানবে
পরদিন সকালে নাস্তা করে তাহমিদ বেরিয়ে পরে। মা, বড়মা অনেকবার জানতে চাইলেও কিছুই বলেনা।
কুহুর কলেজের সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কুহুর দেখা নেই। দুপুর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে তাহমিদ অবশেষে বাসায় ফিরে।
কিন্তু বেচারা তো আর জানেনা কুহু আজ কলেজেই আসেনি।
তাহমিদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। পড়াশোনায় ব্যস্ত তাহমিদের বুকের ভিতর কুহু নামক মেয়েটির একছত্র আধিপত্য থাকলেও গত ছয় মাসে তার হৃদয়ের অধিশ্বরীকে একবারও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। একবার সেই হৃদয়ের অধিশ্বরীকে দেখতে থেকে থেকেই ওর মন আঁকুপাঁকু করে। কিন্তু সে নিরুপায়। একই শহরে থেকেও আজ ভীতুকন্যার সাথে তার হাজার মাইলের দূরত্ব।
সেদিনের সেই দুর্ব্যবহার না করলে আজ কুহু তার কাছেই থাকত, খুব কাছে।
তাহমিদ বই রেখে চেয়ার ছাড়ে। আজ তার কিছুই ভালো লাগছেনা। বারবার কুহুকে মনে পরছে। কুহুকে দেখার তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে কুহু নামক সঞ্জীবনী বিনা। এ এমন এক সঞ্জীবনী যার ছোঁয়ায় নিমেষেই তাহমিদের বুকে সৃষ্টি করতে পারে আস্ত সরোবর।
তাহমিদ ছাদে আসে। সেই হাসনাহেনা গাছের কাছে এসে ছুঁয়ে দেয় গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা। একসময় সটান হয়ে শুয়ে পরে গাছের পাশেই। ছোট গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁক গলে তাকিয়ে থাকে সূদুর মহাশূন্যে। অন্তরীক্ষের নীলচে তারার আলো ঠিকরে পড়ছে ধরনীর বুকে। সেই আলোর কিয়দাংশ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে এক উদাস প্রেমিকের শরীর। যে তার প্রেমিকার দর্শন পাবার আশায় চাতকের ন্যায় প্রতিক্ষায় চেয়ে রয়েছে। এই প্রতিক্ষার অন্ত কবে তা জানা নেই এই প্রেমিক পুরুষের।
সুদূর পানে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দুই চোখের পাতা এক হয়েছে তা জানা নেই তাহমিদের।
ভোরের উজ্জ্বল আলো চোখে পরতেই পিটপিট করে তাকায়। কোথায় আছে তা ঠাওর করতে একটু সময় লাগে। উঠে বসতেই ব্যাথার অস্তিত্ব টের পায় শরীরে। ছাদের মেঝেতে শোয়ার ফল। হাফ হাতা টি শার্ট শরীরে থাকায় কনুই থেকে পুরো হাতে লালচে দাগ। চুলকাচ্ছেও প্রচুর। এমনকি মুখেও চুলকাচ্ছে। বুঝতে পারে সারারাত মশাদের ভালোই ভোজন হয়েছে।
( গল্প লিখার পর রি-চেইক দেয়ার সময় পাইনা। একবারেই যা লিখি তাই পোস্ট করি। এতে বানান ভুল হয়। বানানের ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
চলবে….