বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ১০

0
2446

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১০
জাওয়াদ জামী

রাতে কায়েস বাড়িতে আসলে তার তিন বোন জানায় কুহুকে নিয়ে তারা ঢাকা ফিরবে। ঢাকায় কোন একটা কলেজেই ওকে ভর্তি করিয়ে দিবে। তখন শাহনাজ সুলতানা জানায় কুহুকে তার বাসায়ই রাখবেন। এতে অবশ্য কায়েসের কোন আপত্তি নেই। এবং শিউলিও মনে মনে খুশি হয় আপদ বিদেয় হবে বলে। কিন্তু কুহু বড় ফুপুর বাসার ঘটনা মনে করে ছোট ফুপুর বাসায় থাকার জন্য না করে দেয়। সে চায়না আর কারও কাছে অপমানিত হতে। কুহুর আপত্তি মেনে নিয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় যেই কলেজেই ভর্তি হোকনা কেন কুহু হোষ্টেলে থাকবে।
কায়েসের কাছ থেকে কুহুর স্কুলের হেডমাস্টারের নম্বর নিয়ে তার কাছে ফোন করেন আফরোজা নাজনীন। তিনি জানতে চান যাবতীয় পেপারস কবে নাগাদ পাওয়া যাবে। তিনি জানান পনের-বিশ দিন সময় লাগবে৷
কুহু এবারেও আপত্তি করে ফুপুদের সাথে ঢাকা যেতে। সে চায় একবারে সকল কাগজপত্র হাতে নিয়েই তবে যাবে। আফরোজা নাজনীন বুঝতে পারেন কুহুর বারবার এরূপ আপত্তির কারন৷ তার বাসায় সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারনে সে যেতে চাচ্ছেনা। তাই তিনিও জোর করেননা। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় যাবতীয় পেপারস হাতে আসলেই আনান এসে কুহুকে নিয়ে যাবে। আননই ওর ভর্তির সব ঝক্কিঝামেলা করবে।

পরদিন দুপুরের খাবার পর তিন বোন রওনা দেয় নিজ নিজ গন্তব্যে। আফরোজা নাজনীন আর শাহনাজ সুলতানা যাবেন ঢাকার দুই এলাকায়। এবং নাজমা পারভিন যাবেন চিটাগং। বাচ্চাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। আবার কবে, কতদিন পর ওরা একসাথে হবে তার ঠিক নেই। কুহু সেই সকাল থেকেই একটু পরপর কাঁদছে ফুপুরা চলে যাচ্ছে জন্য। ও চেয়েছিল আর একটা দিন তারা থাকুক। কিন্তু পরিবার ছেড়ে এভাবে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
সকালে খাবার পর আফরোজা নাজনীন প্রতিবেশি এক ছোট ভাইকে ডেকে নিয়ে তাকে বাজারে পাঠান। কয়েকরকম মাছ যেগুলো কুহু, শিহাব আর দৃষ্টির পছন্দের, মাংস, ফলমূলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে আসতে টাকা দেন।অবশ্য তার ছোট দুই বোনও টাকা দিয়েছে। তারা চান এত বাজার দেখলে শিউলি অন্তত কুহুকে না খাইয়ে রাখবেনা। শিউলিও খুব খুশি এত বাজার দেখে। তার অন্তত একমাস কোন মাছ-মাংস কিনতে হবেনা। আবার বাপের বাড়িতেও পাঠানো যাবে।
সবাই তৈরী হয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েছে। কায়েসও ব্যবসা প্রতিষ্ঠাস থেকে বাড়িতে এসেছে বোনদের বিদায় দিতে।
তারা বারবার কায়েসকে বলেন, বাড়িতে এসেই কুহুর খোঁজ নিতে। শিউলিকে বলেন, কুহুর যত্ন নিতে।
” সোনা মা, তোর কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাদের জানাবি। আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর তুই আমাদের কাছে থাকবি। আনান কালকে থেকেই অনলাইনের সব জেনে নিবে। তারপর যা করার করবে। তুই সব রেডি রাখিস যাতে ও চাওয়া মাত্রই সবকিছু পায়। সাবধানে থাকবি। কোন চিন্তা করবিনা। ” আফরোজা নাজনীনের কথায় মাথা নাড়ায় কুহু।
” কুহুতান, আগে ভর্তি হয়ে নে। তারপর ছুটি হলেই আমার কাছে যাবি বুঝলি? ” নাজমা পারভিনও হেসে বলেন।
” তোকে প্রতি সপ্তাহে আমার কাছে যাবি। আমি তোর পছন্দের খাবার রান্না করব। ” ছোট ফুপুর কথা শুধু হাসে কুহু।
” এইযে আমার আব্বাটা, তুমিও ভালো করে পড়াশোনা কর। তুমিও ঢাকা যেয়ে পড়বে। তিন মেয়ের একটাই আব্বা তুমি। তোমার জন্য সব ফুপুর বাড়ির দরজা খোলা আছে৷ আব্বা তুমি বড় আপুকে দেখে রেখ। আপুর কোন সমস্যা হলে তার কাছে থেক। ” নাজমা পারভিন শিহাবকে আদর করতে করতে বলেন৷
” আর দৃষ্টিতো আমাদের সৎ মা। সে আমাদের কাছেই ভিড়েনা। আমাদের কাছে থেকে পড়াশোনা আর কি করবে। তবুও ভালো করে পড়াশোনা করিস। আমরা আছি তোদের জন্য। আর কুহুর সাথে মিলেমিশে থাকিস, কেমন? সে তোর বড় আপু, তার কথা শুনে চলিস। ” ছোট ফুপুর কথা শুনে দৃষ্টিও মাথা নাড়ায়।

আফরোজা নাজনীন এবং শাহনাজ সুলতানা একসাথে যাবেন। আর নাজমা পারভিন যাবেন আলাদাভাবে। শাহনাজ সুলতানার স্বামী জামান হাসান সকালেই গাড়ি পাঠিয়েছেন। আরেকটা গাড়ি এসেছে আফরোজা নাজনীনের বাসা থেকে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা গাড়িতে উঠেন।
বিদায় বেলায় সকলেরই চোখে পানি। তিন কন্যা ঘুরেঘুরে দেখছে তাদের বাবার বাড়ির প্রতিটি কোন। একসময়ের কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়িটা ঘিরে। তাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল বাড়ির প্রতিটা ঘর, উঠান, বাগান এমনকি পুকুরপাড়ও। যখন আম্মা- আব্বা বেঁচে ছিল তখন এ বাড়ির বাতাসে তাদের গন্ধ পাওয়া যেত।তারা মারা যাওয়ার পর সব গন্ধ হাওয়ায় মিলিয়েছে। শিউলি তাদের অস্তিত্ব কোথাও রাখতে দেয়নি। জন্ম থেকেই যেখানে বেড়ে উঠেছে, পড়াশোনা করেছে আজ সেই বাড়িতে তারা দুইদিনের অতিথি। অথচ ওরা জানে কি আদর মাখা ছিল সেই দিনগুলো। আফরোজা নাজনীন ভাবেন বিধাতার নিয়মগুলো এত কঠিন কেন? যে গ্রাম, যে বাড়ি অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে সেখানে তাদের কোন অধিকার নেই, নেই কোন ভালোবাসা কিংবা সস্মান। কেন সব সময় মেয়েদেরকেই তাদের আপনজনদের ছাড়তে হয়? যে মাটিতে একসময় তাদের পদধূলি মিশে ছিল সেই মাটি আজ তাদের ভুলে অন্যকে আপন করে নিয়েছে।
গাড়িতে উঠে বসেও তারা দেখতে থাকে এই চিরচেনা গ্রামের অচেনা রূপ। আবার কবে এই মাটিতে পা রাখবে তার কোন ঠিক নেই। গত তিনটা দিন এখানে থেকে, এই মাটির সংস্পর্শে এসে যেন আম্মা-আব্বার সেই আদরমাখা ছোঁয়া উপভোগ করেছে। আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আব্বা-আম্মার সেই ছোঁয়ার বিচ্ছেদ ঘটছে।
একসময় গাড়ি রওনা দেয় তার আরোহীদের নিয়ে তাদের নিজ গন্তব্যে। পেছনে পরে রয় কিছু আপনজন, শৈশব, কৈশোর, যৌবনের অগণিত স্মৃতি। যেগুলো মৃত্যু অব্দি মস্তিষ্কে বিরাজ করবে। সময়ে-অসময়ে বহুবার দোলা দিবে বুকের মাঝে।

কুহু ঘরে এসে কাঁদছে। তিনটা দিন ফুপুদের আঁচলের নিচে ছিল, যেখানে ছিলনা কোন ভয়৷ ঠিক যেন মায়ের আঁচল। এখন কোন স্নেহের আঁচলও থাকলনা, থাকল শুধু ছোটমার রো’ষা’ন’ল।

বোনেরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর কায়েসও তার কর্মস্থলে যায়। আজ থেকে শিউলি একদম মুক্ত। তার উপর হুকুমজারি করার কেউ নেই। যা ইচ্ছে রাঁধবে, যাকে ইচ্ছে খেতে দিবে, ইচ্ছে না করলে দিবেনা। ওর উপর কথা বলার কেউ নেই।
” এইযে নবাবজাদী, গতরে আর কত বাতাস লাগাইয়া ঘুইরা বেড়াবে? এই তিনদিন তো খুব উড়লা, যেন বা’জা’রে’র মাইয়া। খুব পাংখা গজাইছিল এই কয়দিন। আইজ আইছে সেই পাংখা কাটনের দিন। তুমি কি ভাবছিলা আমি কিছুই কমুনা? কাম কইরা কইরা আমার শরিলে বি’ষ ধইরা গেছে আর তুমি গতরে হাওয়া লাগায় ঘুরো। আইজ তোমার সুখ কমাইতাছি। ” শিউলি আক্তার ঠাসঠাস করে কয়েকটা থা’প্প’ড় মা’রে কুহুর গালে।
কুহু গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ছোটমার দিকে। ছোটমা ওকে কেন মারল তা সে বুঝতে পারেনা।
” ঐ ফ’কি’ন্নি’র বেটি, তুই তাগোরে হাঁস-মুরগি বাইন্ধা দিলি ক্যা? নিজের ট্যাকায় কিনছোস তাই সবই তর হইয়া গেছে? আমি যে তোরে এগুলান রাখবার দেই তাতে কিছুই না? কই আমার বাপের বাড়ি থাইকা কেউ আইলে তুই তো রান্ধবার জন্যও একটা মুরগী দেসনা? ফ’কি’ন্নি’র মাইয়া। এম্নে কইরাই ফুপুগোরে হাত করছস! কি সেয়ানা মাইয়া দেখছ! এই বয়সেই এত কিছু! আর ইক্টু বগ হইলে তো দেখতাছি সেয়ানাগিরি করবার জন্য রাস্তায় নামবি। এম্নে কইরাই না’গ’রও জুটাইবার পারবি কইলাম৷ ” শিউলি আক্তারের কথার মাঝেই কুহু ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে বাগানে আসে। ছোটমানমর ঐসব নোং’রা কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।
শিহাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়ের বলা প্রতিটা কথাই শুনে। ও অপেক্ষা করছে মায়ের বাহিরে যাওয়ার। মা বাহিরে গেলেই ও কুহু আপুর ফোন দিয়ে মেজো ফুপুর সাথে কথা বলবে।
ফুপুরা যেমন শিহাবকে ভালোবাসে তেমনি শিহাবও ফুপুদের ভালোবাসে৷ ফুপুরা ওকে কিছু বললে ও বিনা বাক্যে তাদের কথা শুনে। এমনকি যখন ফুপুরা ওর সাথে কথা বলে তখন আড়ালে যেয়ে ও ফুপুদের জানায় আপুর সাথে মায়ের করা আচরণ।

আফরোজা নাজনীনের বাসায় আসতে রাত এগারোটার বেশি বেজে যায়। তিনি প্রথমে শাহনাজকে তার বাসায় নামিয়ে দেন। শাহনাজ সুলতানা কিছুতেই বোনকে না খাইয়৷ ছাড়বেননা৷ তাই বাধ্য হয়ে খেতে হয়। শাহনাজ সুলতানার শ্বাশুড়ি রান্না করে রেখেছেন। তিনি পরম মমতায় আফরোজা নাজনীনকে খেতে দেন।
বাসায় আসতেই তাহমিদের সামনে পরলেন তিনি৷ তাহমিদ বড়মাকে দেখে হেসে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে।
” কেমন আছিস বাপ? তুই ড্রয়িংরুমে কি করছিস? পড়াশোনা নেই তোর? ”
” কি বড়মা, এসেই পড়াশোনার কথা শুরু করেছ! তোমার ছেলে কি ফাঁকিবাজ, যে তোমার এত চিন্তা করতে হবে! আগে বল তুমি কেমন আছো? ”
” আমি ভালো আছি বাপ। তুই খেয়েছিস? তোর বড় চাচ্চু কোথায় রে? ”
” তোমার অপেক্ষায় আছি তাই খাইনি। আর তোমার সম্মানিত হাজবেন্ড তার রুমেই আছে। ” তাহমিদের কথা শুনে আফরোজা নাজনীন হেসে ছেলের চুল ধরে হালকা করে ঝাঁকিয়ে দেন।
” তোমাদের মা-ছেলের গান শেষ হয়ে থাকলে এবার আমার দিকে নজর দাও। আমি একজন মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ” তাহমিনা আক্তার মেকি রাগ দেখান।
” আগে মা-ছেলের কথা শেষ হলে তারপর তোর কাছে আসছি। এত হিং’সা করিস কেন শুনি? ”
” আমি মোটেও হিং’সা করছিনা। তোমার ছেলে তার বড়মায় জন্য বসে আছে খাবে বলে। এখানে যত দেরি হবে তোমার ছেলের ক্ষুধা তত বাড়বে। আর তুমি একা এসেছ কেন? নাজমা আপা, শাহনাজ ওরা কই? ওদের নিয়ে আসতে বললামনা? ”
” ওরা কেউই থাকতে পারবেনা তাই আসলনা। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোকে খাওয়াচ্ছি বাপ একটু অপেক্ষা কর। ” আফরোজা নাজনীন রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
” ভাবি, তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? কুহু ভালো আছে? ও কি ঢাকা এসেছে? ”
” বাড়ির সবাই ভালো আছে। কুহুকে নিয়ে আসার জন্য জোরাজোরি করেছি কিন্তু ও বলল, একবারে ভর্তির সময় আসবে। ”
” ও এখানে ভর্তি হবে! কোথায় থাকবে মেয়েটা? ”
” এখানের কোন কলেজেই ভর্তি করিয়ে দিব। হোস্টেলে থাকবে। আনান দেখবে ওর ভর্তির সকল বিষয়। এখন দেখা যাক কোন কলেজে চান্স পায়। ”
তাহমিদ একমনে তাদের কথা শুনছে। কুহুর ঢাকায় ভর্তি হওয়ার কথা শুনে ওর হার্টবিটেরা ডামাডোল করছে। তবে কি ও আবার তার ভীতুকন্যাকে দেখতে পাবে!
তাহমিদ মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, এবার আর ভীতুকন্যাকে হারাতে দিবেনা।

(অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমার ছেলের কথা। আলহামদুলিল্লাহ এখন ও আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছে। ওর ছোটবেলা থেকেই নানান সমস্যা। প্রায় সময়ই কোননা কোন রোগে ভুগে। নিয়মিত ট্রিটমেন্ট করাই। ডক্টররা বলেছেন, এক সময় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। আপনাদের কাছে দোয়া প্রার্থী)

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here