গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ
লেখকঃ Parvez Rana
পর্বঃ ২
নওরিনকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে আছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স বেশি। রেগুলার অভ্যাস মতো হাটাচলার জন্য তারা নাতি-নাতনীদের সাথে বিকাল বেলায় ঘুরতে বেরিয়েছিল। নওরিনকে দেখে মোটামুটি সেখানে তিনজনের একটা ছোট খাটো ভীর জমে গেল। প্রথম জন ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘এহ! মাইয়াডা সুন্দরী আছে। মনে হয় জ্বীনে ধরছে। তাই অজ্ঞান হইয়া পইড়া গেছে।’
দ্বিতীয় জন ভাঙা ভাঙা গলায় কিছু একটা বললেন। তার বয়স প্রায় ষাট পার হয়েছে। তিনি বললেন, ‘আমার তো মনে হয় কেউ অজ্ঞান কইরা ফালাইছে। পরে ঝামেলা হইব বুইজ্জা কাইটা পড়ছে। এখন এইডারে কি করমু।’
তৃতীয়জন বললেন, ‘আমার মনে হয় জানেন এই মাইডারে কেউ অজ্ঞান করে নাই। হেই একাই অজ্ঞান হইয়া গেছেগা। মনে হয় মৃগীর ব্যারাম আছে। নাকে চামড়ার জুতা হুগাইলে ঠিক হইয়া যাইব।’
দ্বিতীয় জন বলল, ‘আমার পায়ে চামড়ার জুতা আছে। হুগামু নাকে?’
প্রথম জন আবার বলল, ‘হ হুগান। পরে যদি জ্ঞান না ফিইরা আহে তাইলে লোকজন ডাইকা হাসপাতালে লইয়া যাওন যাইব। আমরা বুড়া মানুষ যতখানি পারি হেই খানি করি।’
তৃতীয়জন বলল, ‘ঠিকই কইছেন মিয়া ভাই। তাই করা হোক।’
যখন লোকটা নওরিনের নাকে চামড়ার জুতা শুকানোর জন্য জুতা খুলতেছিল তখন নাবিলা চলে আসে। নাবিলা ভীর দেখে রিকশা থেকে নেমে দ্রুত চলে আসে। কারণ ভীরটা টু ফোরটি ফাইভ নাম্বার বেঞ্চের কাছে ছিল। আর নওরিন সেখানেই নাবিলাকে আসতে বলেছিল। নাবিলা সেখানে গিয়ে যা দেখল তা দেখে পুরো অবাক। নাবিলা দেখল নওরিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর একজন বৃদ্ধ নাবিলার মুখের উপর জুতা উঠিয়ে ফেলেছে। নাবিলা হৈ চৈ শুরু করে দিল। আর মুহুর্তের মধ্যে ঐ বৃদ্ধ লোকটি হাতের জুতা ফেলে দেয়। নাবিলা বলল, ‘আপনারা কি করতে যাচ্ছিলেন?’
দ্বিতীয় জন বলল, ‘আমরা তো দেখলাম এই মাইয়াডারে অজ্ঞান হইয়া আছে তাই ভাবলাম মৃগী ব্যারাম হইব। তাই জুতা হুগাতে গেছিলাম।’
‘না। ওর কোন মৃগী রোগ নেই। আপনি জুতাটা সরান৷ আপনাদেরকে কি আর বলব বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুদ্ধিটা কমে গেছে৷ আর ও অজ্ঞান হইছে কিভাবে?’
প্রথম বলল, ‘কি জানি। আমি তো আইসাই দেহি মাইডা পইরা আছে।’
‘আচ্ছা আপনারা একটু সরে যান। আমি দেখতেছি কি হইছে। আমি ওর বান্ধবী। আর ওকে কেউ কিছু করেনি তো?’
‘না। ভালোর কোন যুগই নাই। আমরা মাইডারে একটু সাহায্য করতে চাইলাম আর আমাদেরকেই তাড়িয়ে দিতেছে।’
নাবিলা ওনার কথায় তেমন কান দিল না। নাবিলা এমনই কোন কিছু ওলটপালট দেখলেই রেগে যায়। আর এ ব্যাপারটা তার রাগকে চড়ম পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে। বৃদ্ধ লোক তিনজন চলে যাওয়ার পর নাবিলা নওরিনকে কয়েকবার ডাকদিল। কিন্তু নওরিন চোখ খুলছিল না দেখে নাবিলা কিছুটা টেনশনে পড়ে গেল। পরে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে নওরিনের মুখে পানি ছিটানোতে নওরিন চোখ খুলল। নওরিন চোখ খোলার সাথে সাথে নাবিলাকে দেখতে পেয়ে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলল। নাবিলা নওরিনের পিঠের উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘কাদিস না। আমি চলে এসে গেছি। আর আমাকে বল তোর কি হয়েছিল।’
নওরিনের চোখে তখনও পানি ছিল। কিছু বলতে পারছিল না। নাবিলা নওরিনের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল। নাবিলা বলল, ‘এই পানি খেয়ে নে। আর শান্ত হ। আমি চলে এসে গেছি না। এখন আর কোন ভয় নেই। আর কি হয়েছিল সেটা বল।’
নওরিন পানি খাওয়ার পরও কিছুক্ষণ ফোপাঁতে থাকল। আর নওরিন জোরে জোরে আর আওয়াজ নিঃশ্বাস ফেলছিল। নওরিন বলল, ‘আমি যখন এখানে আসি তখন দেখি এখানে কেউ নেই। তখন মোটামুটি দুইটা চল্লিশ এর আশেপাশে বেজেছিল। আমি এই বেঞ্চের কাছে এসে দেখি এখানে কিছু ফুল আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। ফুল গুলো কারও হাতে ধরা ছিল না। সেগুলো সম্পূর্ণ ভেসে ছিল। আর সেগুলো আমার কাছাকাছি আসতেই আমি বোধহয় ভয় পেয়ে যাই। আর ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই।’
‘তুই সত্যি বলছিস?’
‘আমি তোকে মিথ্যা বলতে যাব কেন?’
‘আর সেই লোকটি কি এসেছিল?’
‘আমি দেখিনি। আমার মনে হয় সে কোন মানুষ না। সে আসলে একটা ভুত।’
নাবিলার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা গেল। কারণ ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু নওরিনের কথাও ফেলে দেয়া যায় না। কারণ সে জানে নওরিন এ ধরনের ফাযলামি করার মেয়ে না। আর নওরিনের যে অবস্থা তাতে সে কোনভাবেই নাবিলার সাথে ফাযলামি করবে না। অন্তত এই মুহুর্তে না। নাবিলা বলল, ‘আমার সাথে তুই চল।’
‘কোথায় যাব?’
‘তোর বাসায়। আর যদি না ইচ্ছা হয় তাহলে আমার বাসায় চল।’
‘আমার বাসায় যাব। তুই আমার সাথে চল।’
নাবিলা নওরিনের হাত ধরে দাড়া করালো৷ তারপর দুজন হাটতে শুরু করল। নওরিনের বাসা থেকে পার্কটা তেমন বেশি একটা দুরে না। নাবিলার সাথে নওরিন হাটার সমিয় কয়েকবার কেপে কেপে উঠছিল। তার মধ্যে ভয়টা কাজ করে যাচ্ছিল। নাবিলা বিষয়টা হালকা করার জন্য বলল, ‘আমার তো মনে হয় তুই ভুতটার প্রেমে পড়ে গেছিস। দেখ তুই তার সাথে দেখা করার জন্য কি সুন্দর একটা সবুজ শাড়ি পড়ে এসেছিস। হাতে ম্যাচিং চুড়ি। আমি ছেলে হলে আমিই তোর প্রেমে পড়ে যেতাম। তাই বোধহয় ভুতও তোর প্রেমে পড়ে গেছে।’
নওরিন কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। নাবিলার কথায় নওরিনের ভয় কিছুটা কমে আসল। নওরিনকে আসলেই অনেক সুন্দর লাগছিল। সে এমনিতেই অনেক সুন্দরী। মায়াভরা চোখ, অপরূপ চুলের বাহারে তাকে কোন অংশে রূপকথার পরীর চেয়ে কম মনে হয় না৷ এই কারণে তার পেছনে পড়ে থাকা ছেলেদের লাইনটা বিশাল। কিন্তু এদের সবাইকে ডিঙিয়ে একজন রহস্যময় ব্যক্তি চলে এসেছে। তার কাছ থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পারছে না। নওরিন অনেকটা ভয় পেয়েছে কিন্তু সে এই রহস্যটা উদঘাটন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তবে আজ যেটা হয়েছে এতে তার রহস্য উদঘাটনের আগ্রহটা৷ ফিকে হয়ে গিয়েছিল। নওরিন বাসায় যেতে যেতে বলল, ‘তুই কিন্তু আব্বুকে এ ব্যাপারে কিছু বলবি না।’
‘কোন ব্যাপারে?’
‘আমি যে এখানে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তাহলে আব্বু যে কি শুরু করে দিবে তার ঠিক নেই। বুঝিস তো আব্বু আমাকে কতটা ভালোবাসে। আর যদি জানতে পারে আমি পার্কে গিয়ে ভুত দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছি তাহলে অনেক হাসাহাসি করবে।’
নাবিলা শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
নাবিলা গভীর মনোযোগ দিয়ে নওরিনের ব্যাপারটা ভাবছিল। এই ব্যাপারটা তাকে অতিরিক্ত অবাক করে তুলছিল। কারণ নওরিনের ফোনে কল আসছিল আর সেটাও ফোন ফ্লাইট মোডে থাকা অবস্থায়ও। আবার ফোনে সিম কার্ড বা ব্যাটারি না থাকলেও ফোন আসছে। এই সব ব্যাপারগুলো নাবিলা শুরুতে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ নওরিনকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে নাবিলাও কিছুটা ভয় পেয়েছে। দুজনে ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে নওরিনের বাসায় পৌঁছে গেল। নওরিনের বাবার সাথে নাবিলা স্বাভাবিক ভাবেই কথা বার্তা বলল। যেন কিছু হয় নি। আর নওরিনের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও আড়াল করে গেল। রাত নয়টার দিকে নাবিলা নিজের বাসায় চলে যায়। নাবিলা চলে যাওয়ার পর নওরিন অনেকটা একা হয়ে যায়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বিছানার উপর এপাশ ওপাশ করতে থাকে কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। সারাক্ষণ তার দুপুরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। যখন রাত আড়াইটা বেজে যায় নওরিনের হঠাৎ করেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। তার বার বার মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তার কাছে সেই ব্যক্তি কল করবে। আর আজও করবে। কিন্তু সে এই ব্যক্তির কাছ থেকে দুরে পালাতে চায়। কিন্তু সে পারছিল না। রাত দুইটা চল্লিশ বেজে গেল। এবার সে যেন নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস যে পাঁচ মিনিট পরেই তার কাছে কল আসবে। আর এমন কিছু সে শুনবে যা সে কল্পনা করতে পারছে না। কিন্তু সে কথা বলতে চায় না। এই কারণে সাথে সাথে সে নিজের ফোন সুইচ অফ করে ফেলেছে। কিন্তু সে জানে তার ফোনে কল আসবেই। সে এই কল থেকে পালাতে পারবে না।
দেখতে দেখতে রাত দুইটা পয়তাল্লিশ বেজে গেল। ঠিক দুইটা পয়তাল্লিশ মিনিটে তার ফোনে কল আসল। এক সেকেন্ডও এদিক ওদিক হলো না। আর ফোনের রিংটোনের আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছিল। রিংটোন চেঞ্জ হয়ে গেল। সে ভয়ঙ্কর রিংটোন শুনতে পাচ্ছিল। যেটা তার গায়ে কাটা দিচ্ছিল। সে কয়েকবার কলটা কেটে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে ব্যার্থ হয়ে গেল। একটা মুহুর্ত এমন হলো কান হাত দিয়ে ধরে রাখছিল। তবুও কানের কর্ণকুহর পর্যন্ত আওয়াজ যাচ্ছিল। সে ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিল যে তার রুমে এতো আওয়াজ হচ্ছে কিন্তু তার আব্বু সেটা শুনতে পাচ্ছে না। তার বাবা একটু আওয়াজ পেলেই ঘুম থেকে উঠে তার কাছে চলে আসে। ফোনের রিংটোনের আওয়াজ বেড়ে চলেছিল। নওরিন বুঝতে পারছিল এই অসহ্য আওয়াজ থেকে বাচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার ফোন কলটা রিসিভ করতে হবে। তাই সে ফোন কলটা রিসিভ করে ফেলল৷ নওরিন ফোনটা রিসিভ করার পর কানের কাছে নিতে চাইছিল না। কিন্তু তার হাত যেন মোবাইলসহ আপনা আপনি নওরিনের কানের কাছে চলে। ওপাশ থেকে একটা সাবলীল হাসি আওয়াজ আসল। যে হাসিটা যে কারো মনকে ভালো করে দিবে। নওরিনের ক্ষেত্রেও সেটি ঘটল। হাসির আওয়াজ শুনেই তার স্ট্রেস কমে গেল কিছুটা। হাসি দিতে দিতে বলল, ‘এখন রাত দুইটা পয়তাল্লিশ বাজে৷ আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?’
নওরিন ভীত অবস্থায় ছিল। সে অনেকটা কষ্ট করে নিজের শক্তি জোগার করে বলল, ‘আপনি যে আজ দুপুরে যে পরিমাণ ভয় দেখিয়েছেন সেটা কি কম ছিল যে আবার এখন ভয় দেখাতে ফোন করেছেন।’
‘এক মিনিট, এক মিনিট! আমি কিন্তু দুপুরে আপনাকে ভয় দেখাইনি। আপনি একাই ভয় পেয়েছিলেন।’
‘একাই ভয় পেয়েছিলাম মানে? আপনি আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন তাই আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।’
‘দাড়ান আমি ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতেছি।’
‘আপনি অজ্ঞান হয়েছিলেন দুইটা চুয়াল্লিশ মিনিটে। আর আমি বেঞ্চ নাম্বার টু ফোরটি ফাইভে ঠিক দুইটা পয়তাল্লিশ মিনিটে পৌছেছিলাম। অর্থাৎ আমার পৌছানোর এক মিনিট আগে আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।’
‘মানে? কি বলছেন সেটা আপনি পরিষ্কার ভাবে বলুন।’
‘আপনি সেখানে যাওয়ার পর দেখছিলেন যে আপনার দিকে ফুল এগিয়ে আসছে। যেগুলো শুন্যে ভাসমান ছিল। যেটা আপনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি বলে আপনি অজ্ঞান হয়ে যান। আমি ঠিক বলছি তো?’
‘হ্যা। কিন্তু আমি কি দেখেছিলাম সেটা আমি কাউকে বলিনি কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে? আমি শুধু নাবিলাকে বলেছিলাম। নাবিলা কি আপনাকে এসব বলেছে। এর মানে এগুলো আপনি ঘটিয়েছিলেন।’
‘না। নাবিলা আমাকে বলেনি আর আমি এগুলো ঘটাইনি। এগুলো আসলে বাস্তবে কিছু ঘটেনি। বাস্তবে আপনার দিকে কোন ফুল এগিয়ে আসছিল না। ঠিক ওই মুহূর্তে আপনার সাথে যা ঘটছিল সেটা মনবিজ্ঞানের ভাষায় হ্যালুসিনেশন বলে। অর্থাৎ সেটা আপনি দেখছিলেন ঠিকই কিন্তু আসলে বাস্তবে কিছু ঘটেনি।’
‘মানে?’
‘আপনি সারাক্ষণ ভেবেছেন আমি একজন ভুত। আর আপনার এক্সপেকটেশন ছিল যে আমি কোন ভুতই হব। আর সেই ইচ্ছাটা আপনার মস্তিষ্ক পূরণ করে দেয়। যখন আপনি ভৌতিক কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন তখন আপনার সেই ইচ্ছাটা আপনার মস্তিষ্ক পূরণের জন্য আপনার চোখের সামনে একটি কল্পনার অবস্থা তৈরি করে। যেটাতে আপনি দেখেন আপনার দিকে ফুল এগিয়ে আসছে। এ ধরণের সমস্যা একজন যখন অনেকটা স্ট্রেসে থাকে তখন ঘটে থাকে। আর আপনি অনেকটা স্ট্রেসে ছিলেন। তাই আপনি তখন ভুল দৃশ্য দেখে ফেলেন। এতে আমার কোন হাত নেই। এতে যার হাত আছে সে হচ্ছে আপনার মস্তিষ্ক। আর আপনি জিজ্ঞাসা করলেন না যে আমি কিভাবে জানলাম আপনি কি দেখে অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। এটা আমি আপনাকে পরে বলব। এখন বললে বুঝবেন না।’
‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। আপনি মিথ্যা বলছেন।’
‘আমি মিথ্যা বলি না। মিথ্যা বলা আমাদের নীতির বাহিরে। আপনাকে সহজভাষায় বললে আপনি যেটা দুপুরে দেখেছিলেন সেটাকে আপনি স্বপ্ন হিসেবে ধরতে পারেন।’
‘তাহলে এটাও কি স্বপ্ন?’
‘না। এটা সত্য। আর বাস্তবে আমার সাথে কথা বলছেন।’
‘আমি কিভাবে বুঝব এটা স্বপ্ন না?’
‘আপনি যে কমলা রঙের নাইট ড্রেস পড়ে আছেন সেটির রং কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন? যদি দেখতে পারেম আর বুঝতে পারেন টা কমলা রং তাহলে বুঝে নিবেন এটা স্বপ্ন না। এটা বাস্তব। কিন্তু আপনি দুপুরে কি রঙের ফুল দেখেছেন সেটা মনে করতে পারছেন না। কারণ স্বপ্নে রং দেখা যায় না।’
নওরিন কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। কারণ সে যে কমলা রঙের নাইটি পড়ে আছে সেটা সে দেখতে পারছে। তার মানে সে বাস্তবে এই ভয়ঙ্কর লোকটির সাথে কথা বলছে। কিন্তু এই লোকটি তার ড্রেস কি বুঝতে পেরে গেছে। কিন্তু কিভাবে? এই প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে ড্রেস চেঞ্জ করার পর থেকে কারো সাথে দেখা করেনি। আর তার রুমে কেউ এসে তাকে দেখবে এটাও প্রায় অসম্ভব। কারণ তাদের ফ্ল্যাট আটতলায়। তার রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল। সে ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। লোকটা তখন বলল, ‘আপনি ভয় পাবেন না।’
নওরিন আরো বেশি হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ সে যে ভয় পাচ্ছে এই লোকটা সেটাও বুঝে ফেলছে। নওরিন ভীত গলায় বলল, ‘আপনি কে প্লিজ বলুন। আর আমার অবস্থা কিভাবে বুঝতে পারছেন?’
‘আমি সেটা আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর নাহয় বলব।’
‘আমি তো আজ দেখা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনি তো এলেন না।’
কথাটা বলে মনে হলো যেন নওরিন কেদে ফেলছে। লোকটা বিচলিত কন্ঠে বললেন, ‘আপনি কাদবেন না। আমি আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আপনি ঠিক দুইটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিটে অঘান হয়ে যান। তারপর আমি সেখানে দুইটা পয়তাল্লিশ মিনিটে পৌছাই। তারপর সেখানে আমি ঠিক দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড ছিলাম। তারপর চলে আসি। এরপর আপনাকে কয়েকজন বৃদ্ধ দেখতে পায়। তারপর তারা ভেবে নেয় আপনার মৃগী রোগ হয়েছে। তারা তো আপনার নাকের কাছে জুতা নিয়ে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তার কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ দুইটা পঞ্চান্ন মিনিটে আপনার ফ্রেন্ড নাবিলা এসে পৌছায়। বাকিটুকু নাহয় তার মুখে শুনবেন।’
‘দাড়ান। আপনি বললেন আপনি দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড সেখানে ছিলেন। আর তারপর আপনি ফিরে আসেন। কিন্তু তারপর পরের ঘটনাগুলো আপনি এতো স্পষ্টভাবে বলতে পারেন কিভাবে?’
‘দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড হয়ে আসছে আপনার কি আমার কাছে আজকের জন্য কিছু চাওয়ার আছে?’
‘আপনি আমার কথার উত্তর দিন।’
‘এটা এতো অল্প টাইমে দেয়া যায় না। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে বলতে পারেন আমি সেটা পূরণ করে দিব।’
নওরিন তখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিল। নওরিন বলল, ‘আমি আপনার কাছে চাই আপনি যেন আমাকে আর ফোন না করেন। আর আমি এখন ঘুমাতে চাই।’
‘আপনি মিথ্যা বলছেন আপনি এখনো আমার সাথে কথা বলতে চান। কিন্তু আজ সেটা সম্ভব না৷ আমি কাল আবার ফোন করব। তবে এখন আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। আপনি ঠিক দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড পর ঘুমিয়ে পড়বেন। আর কাল ঠিক সাতটা আটান্ন মিনিটে ঘুম থেকে উঠবেন। গুড বাই।’
ফোনটা ঠিক দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড পর কেটে গেল। নওরিনের কান্নার পরিমাণটা সত্যি সত্যি অনেক বেরিয়ে বেড়ে গেল। কারণ সে ঠিকই বলেছিল। তার মন আসলেই লোকটার সাথে কথা বলতে চাইছিল। হঠাৎ তার ঘুম ধরতে শুরু করে দিল। গভীর ঘুম তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। আর কেউ যেন তাকে জাগিয়ে রাখতে পারবে না। নওরিন ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
নওরিন ঘুম থেকে উঠে সাথে সাথে ঘুরির দিকে তাকালো৷ আর সে সত্যি সত্যি সাতটা আটান্ন মিনিটে ঘুম থেকে উঠেছে। নওরিনের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ সে ঠিক সাতটা আটান্ন মিনিটে ঘুম থেকে উঠেছে। নওরিনের কাছে ব্যাপারটা আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল। নওরিন নাবিলার কাছে ফোন দিল। নাবিলার কাছ থেকে শুনবে যে আসলেই সে অজ্ঞান হওয়ার পর কি কয়েকজন বৃদ্ধ তাকে মৃগী রোগী ভেবেছিল কিনা। নাবিলার কাছে ফোন দিয়ে নাবিলা বলল, ‘হ্যালো! কিরে ঘুম কেমন হলো? রাতে কি আবার ফোন দিছিল?’
‘হুম। আচ্ছা কাল কি কয়েকজন বৃদ্ধ আমাকে মৃগী রোগী ভাবছিল?’
‘হুম। দাড়া তুই কিভাবে জানলি? আমি তো বলিনি।’
‘সে বলেছে। সে বলছে কাল নাকি আমি অজ্ঞান হওয়ার পর সে এসেছিল। আমি নাকি হেলুসিনেশন দেখেছিলাম। আর সেটা দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই।’
‘আসলেই? কিন্তু আমি তো সেখানে কম বয়সী কাউকে দেখলাম না।’
‘জানিস সব থেকে অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে সে আমার কিছুটা মাইন্ড পড়তে পারে।’
‘ধুর। বাদ দে। আন্দাজে বলে সব। আজ ভার্সিটিতে আসবি না।’
‘না। আমার ভালো লাগছে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই রেস্ট নে।’
নাবিলা ফোনটা কেটে দিল। নওরিন সারাদিন কোন কারণ ছাড়াই তার অনেকটা খুশি লাগছিল। সে বুঝতে পারছিল না সে কেন এতোটা খুশি। দেখতে দেখতে রাত নেমে আসল। রাত আসলেই সারাদিনের আনন্দটা ফিকে হয়ে যায়। কারণ সে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে তিনি কি রাতের বেলায় নাবিলার ফোন আসার কোন শব্দ শুনেছিল কিনা। কিন্তু তার বাবা বলে বলেন যে তিনি নাকি রাতে কোন ধরনের আহব্দ শুনতেই পাইনি। তার ভয় করতে শুরু করে। সে রাত এগারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। নওরিনের ঘুম ঠিক দুইটার দিকে ভেঙে গেল। তার আর ঘুম ধরতেছিল না৷ সে আবার পরীক্ষা করার জন্য নিজের ফোন থেকে সিম কার্ড আর ব্যাটারি খুলে ফেলল। আর এবার যে সে কোন স্বপ্ন দেখছে না সে জেগে আছে সেটার উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে। এই রকম তার প্রতিবারই মনে হয়। কিন্তু নওরিন যেসব ব্যাপারের সম্মুখীন হয় সেগুলো আর মনে হয় না যে সে বাস্তবে এসব ঘটে। দেখতে দেখতে রাত দুইটা পয়তাল্লিশ বেজে গেল। আর ঠিক এই সময়ে আগের মতো তার ফোনে কল আসল৷ কারণ তার ফোনে ব্যাটারি নেই। কিন্তু ফোনে কল আসছে। তার বুকটা কেপে উঠল। নওরিন ফোন তুলে নিজের ভিয় ভাবটা দূর করার জন্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘এখন দুইটা পয়তাল্লিশ বাজে। আপনি কি জেগে আছেন?’
লোকটা হেসে দিল। তার হাসির আওয়াজটা নওরিনকে মুগ্ধ করে তুলল। যে হাসির আওয়াজ শুনে নওরিনের বুকটা কেপে উঠত। কিন্তু এখন তার হাসির আওয়াজ শুনলে তার মনে প্রশান্তি আসে৷ লোকটি হেসে বলল, ‘না। আমি ঘুমাইনি। আপনার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় আছি।’
‘তার আগে আমার প্রশ্ন গুলোর জবাব দিন। আপনি আমাকে কাল অজ্ঞান থাকতে দেখেও কেন সাহায্য করলেন না? আপনি কাল কিভাবে চলে যাওয়ার পরও কি কি ঘটল সেটা জানতে পারলেন। আপনাকে সাহায্য করে কে? আর আমার ব্যাপারে কিছু কিছু কথা বলেন যা একদম মিলে যায়। কিভাবে বলেন?’
‘প্রথমত আমি আপনাকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরেও আপনাকে সাহায্য করিনি কারণ আমি জানতাম আপনাকে সাহায্য করার জন্য নাবিলা আসছে। আর আমি সেখান থেকে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আবার যাইনি। আমাকে কেউ সাহায্য করে না। আমি একা।’
‘আপনি একা মানে?’
‘আমার কেউ নেই। পরিচিত বলতে শুধু আপনি।’
‘মানে বুঝলাম না।’
তখন লোকটি একটা হাড় হিম করা হাসি দিল। বিষয়টা জটিল হয়ে গেল। হঠাৎ সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। যেন লোকটি কিছুক্ষণের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে গেল। নওরিনের ভয় করতে শুরু করল। এভাবে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে নওরিন এমন আশাও করেনি। লোকটা কন্ঠ ভারী হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমি আপনার পাশে সব সময় থাকি৷ যেমন এখনো আপনার পাশে আছি। এতোটা পাশে যে আমি আপনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর আপনি ঘাড় ডান দিক থেকে বা দিকে ঘুরালেই আমাকে দেখতে পারবেন।’
সাথে সাথে আগের মতো কুকুরের কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। নওরিন ভয় পেয়ে গেল। নওরিন ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে যাচ্ছিল। ঠিক তখন লোকটা আবার বলল, ‘আপনি তাকাবেন না। আমি আছি ঠিকই কিন্তু আপনি আমাকে দেখতে পাবেন না। এতে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন। আপনি অলরেডি ভয় পেয়ে গেছেন।’
এই কথাগুলো সাবলীল ভাষায় বলল৷ কিছুক্ষণ আগে তিনি যেভাবে বললেন সেটা শুনে নওরিনের রক্ত পানি হয়ে যাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। সে সাবলীল ভাবে বলার পরও নওরিন ভয় পাচ্ছিল। নওরিনের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। কিন্তু ভয়ের কারণে তার কন্ঠ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না৷ নওরিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিল৷ তার গা ছম ছম করছিল। সে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে তার পাশেই লোকটা আছে। সে তাকাতে চাইতেছে কিন্তু পারছে না। তার মন বলছে সে তাকালেই হয়তো দেখতে পাবে তার দিকে সে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। খুটিয়ে খুটিয়ে নওরিনকে দেখছে। তার চোখগুলো পিশাচের মতো। কিন্তু সে তাকাচ্ছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটি বলে উঠল, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন? হাহাহা।’
তার এমন হাসি শুনে নওরিনের মনে হচ্ছিল সে হারিয়ে যাচ্ছে কোন ভয়ঙ্কর দুনিয়ায়। যেখানে তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে যেতে চাইছেনা। নিজের উপর থেকে সে যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। আর অন্য কেউ তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।
চলবে,,,