দুইটা পয়তাল্লিশ পর্ব ৩

0
331

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ

লেখকঃ Parvez Rana

পর্বঃ ৩

নওরিন তখনও সেই পৈশাচিক হাসি শুনতে পাচ্ছিল। নওরিন এতোটা ভয় পাচ্ছিল যে তার ঘামে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিল তবুও সে কিছু বুঝতে পারছিল। সে যেন শুধু তার হাসি শুনতে পায়। আর অন্যান্য অনুভূতি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ করেই চারপাশে নীরবতা ছেয়ে গেল। আর হাসির শব্দ আর নওরিন শুনতে পাচ্ছিল না। শুধু হাসির শব্দ না। সে কোন ধরনের শব্দই শুনতে পাচ্ছিল না। চরম নীরবতার মাঝেও মানুষ অনেক কিছু শোনা যায়। কিন্তু নওরিন সেটাও শুনতে পাচ্ছিল না। নওরিনের মনে হচ্ছিল যেন তার শ্রবণ শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। সে তাকাচ্ছিল চারপাশের সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল। নীরবতার সময় তার রুমের ওয়াল ক্লকের আওয়াজটা প্রায়ই পায়। কিন্তু এবার পাচ্ছিল না। সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে তখনও কানে ফোন লাগিয়ে রেখেছিল। ঠিক কিছুক্ষণ পর নওরিন কিছু শুনতে পেল। সেই লোকটির কন্ঠ। কিন্তু এবার তার কন্ঠ পুরো পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার কন্ঠে কোন পৈশাচিক ভাব নেই। তার কন্ঠস্বর মধুর হয়ে গেছে। তার কন্ঠস্বর অনেকটা সাবলীল হয়ে গেছে। সেই লোকটি বলল, ‘আই এম সরি। আই রিয়েলি সরি।’
এই কথা সাথে নওরিন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল। হঠাৎ করেই তার কানে বিভিন্ন ধরণের শব্দ শোনা যেতে লাগল। যেমন আগের মতো ঘরির কাটার শব্দ, তার রুমের সিলিং ফ্যানের শব্দ। নওরিন চুপ করে রইল। তার চোখ দিয়ে শুধু পানি বের হচ্ছিল। লোকটা আবার বলল, ‘আসলে আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারিনি। আসলে একা একা থাকতে থাকতে আমার কাছে ‘একা’ শব্দটাও এখন বিষের মতো লাগে। ‘একা’ শব্দটা শুনলে আমি আর নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারিনি। আই এম সরি।’
নওরিনের কান্নার পরিমাণ বেড়ে গেল। নওরিন কান্না মাখা কন্ঠে বলল, ‘আপনি প্লিজ আমাকে আর ফোন করবেন না। এভাবে আমাকে ভয় দেখাবেন না। আমার সাথে আপনার কোন শত্রুতা নেই। তাহলে কেন এমন করেন আমার সাথে? আমি কি এমন আপনার সাথে অন্যায় করেছি যার শাস্তি আপনি এভাবে দিতেছেন? আর যদি কোন অন্যায় করেও থাকি আপনি প্লিজ আমাকে মাফ করে দেন। অথবা তার শাস্তি একবারে দিয়ে দেন। আমি এভাবে আর সহ্য করতে পারছি না।’
নওরিনের কান্নার বাধ ভেঙে গেল। তার কান্নার পরিমাণ বাড়ছিল। লোকটির নীরব ভাবে নওরিনের কথা শুনল। কিন্তু কিছু বলছিল না। নওরিন আবার বলল, ‘আপনি আমার কাছে যেটা চান আমি নিজের সাধ্যের মধ্যে থাকলে দিয়ে দিব কিন্তু আপনি আমাকে এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে প্লিজ মুক্তি দিন। আমি আর নিতে পারছি না।’
‘আমি শুধু আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। আপনার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে আপনার দিকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। কিন্তু আজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারিনি এর জন্য সরি। আমি আর আপনাকে ফোন করব না। এরপর শুধু আপনার ইচ্ছা হলেই করব। আমি যেমন আগে নিঃসঙ্গ ছিলাম সেই জগতে আবার ফিরে যাব। আপনি হয়তো জানেন না যে আপনি একমাত্র আমার থেকেও একমাত্র কাছের মানুষ ছিলেন।’
‘আমি যদি আপনার নিকট এতোটা গুরত্বপূর্ণ হতাম তাহলে আর আপনি আমার সাথে এমন করতেন না। আপনি আমাকে আপনার কাছ থেকে মুক্তি দিন। আর আমাকে ফোন করবেন না।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনাকে আর ফোন করব না। তবে আপনি বিপদে পড়লে আমি সেখান থেকে আপনাকে সাহায্য করব। আর সেটা আপনি না চাইলেও আমি করব। কিন্তু আপনি আমার উপস্থিতি বুঝতে পারবেন না।’
‘আশা করি এরপর থেকে আমার আপনার সাহায্যের কোন প্রয়োজন হবে না। আর যখন আজই শেষ কথা হচ্ছে আমাকে আপনার নামটা একটু বলে দেন।’
‘আর যখন কথাই হবে না আমাদের মাঝে তখন নাহয় আমার নামটা অজানাতেই থেকে গেল।’
‘হুম।’
‘আমি আপনার কাছে লাস্ট একটা রিকুয়েষ্ট করতে চাই। সেটা কি রাখবেন?’
‘আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাই। যেমন গতকাল দিয়েছিলাম। আর ঘুমের মধ্যে আপনি একটা স্বপ্ন দেখবেন। যেটা হবে আপনার জীবনের সবথেকে মধুর স্বপ্ন। আর এই স্বপ্ন সাদা কালো হবে না৷ এটা হবে সম্পূর্ণ রঙিন। আমি প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে এই স্বপ্নটি আপনাকে দেখাব। কিছু কিছু নিয়ম প্রকৃতি ভাঙতে দেয় না৷ কিন্তু আমি এই নিয়মটা একবারের জন্য অন্তত ভাঙব শুধুমাত্র যাকে ভালোবাসি তার জন্য।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু এরপর থেকে আপনি আর আমাকে ফোন করতে পারবেন না।’
‘আমি আগেই বলেছিলাম মিথ্যা বলা আমাদের নীতির বাহিরে। যদি আমি আপনাকে ফোন করি সেটা আমার এই কথাটাকে মিথ্যা বানিয়ে ফেলবে। ঠিক আছে গুড বাই। দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড হয়ে এসেছে। এখন রাখলাম।’
নওরিন অনেকটা খুশি হয়ে গেল। তাকে আর এই পৈশাচিক ব্যক্তির সাথে আর কথা হবে না। নওরিন ভাবল তার সাথে কিছু কথা অন্তত বলার দরকার ছিল। কারণ লোকটার কোন অস্বাভাবিক শক্তি আছে যার সমাধান তার জানা দরকার ছিল। যেমন সে কাল বলেছিল তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে। ঠিকই নওরিন ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আর তার কথা অনুযায়ী ঠিক দুই মিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড এর মধ্যেই। এছাড়া সে নওরিনের ভাবনা সম্পর্কে দুর থেকেই জেনে যায়। নওরিনের মনে করে লোকটা নওরিনকে সব সময় দেখতে পায়। কিন্তু নওরিনের মন এতোটা খুশি যে তার এখন এগুলো রহস্যের সমাধান নাহলেও চলবে। কারণ তার সাথে কথা বলার সময় নওরিন কিছু এমন কথা বলে ফেললে সে আবার পৈশাচিক হয়ে যেতে পারে। যেমন এবার শুধু নওরিন শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল সে একা কি না। এতেই সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এমন মানুষের সাথে আর কোন কথা বলার প্রশ্নই আসে না। হোক না সে অনেক মহাপুরুষ বা রহস্যময় মানুষ। এসব চিন্তা করতে করতে তার চোখে ঘুম চলে আসে। গভীর ঘুম। ঘড়িতে দেখে মাত্র দুই মিনিট হয়েছে সে ফোনটা কেটে দিয়েছে। নওরিন কয়েকবার হাই তুলল। তার ঘুম যেন চোখকে গ্রাস করে ফেলছে। নওরিন ঘুমিয়ে পড়ল।
নওরিনের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। সে মনে মনে ভাবল তার ঘুম তো ভেঙে গেল কিন্তু সে এখনো লোকটার কথা মতো স্বপ্ন দেখেনি। এর মানে কি তাকে সে মিথ্যা বলেছিল। নওরিনের লোকটার উপর অনেক রাগ হলো। কারণ সে বলেছিল নওরিন নাকি জীবনের সব থেকে সুন্দরতম স্বপ্ন দেখাবে। কিন্তু নওরিন এর ঘুম ভেঙে গেল কিন্তু স্বপ্ন দেখেনি। কিন্তু সকাল হয়ে গেছে। সে পাখির কিচির মিচির আওয়াজ শুনতে পেল। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে গেল। কারণ নওরিন আট তলায় ঘুমিয়ে ছিল। সে এখান থেকে কোন পাখির আওয়াজ তেমন সে শুনতে পায় না। কিন্তু এবার সে শব্দটা শুনতে পাচ্ছে। নওরিন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। রুমটাও একটু পরিবর্তিত মনে হচ্ছিল। উঠে দরজা খুলে বাহিরে বের হলো। বাহিরে বের হওয়ার সাথে সাথে নওরিন যা দেখল তা দেখে সে সম্পূর্ণ অবাক। নওরিন দেখল সে নিজের বাসায় নেই। একদম নতুন এক জায়গায় চলে এসেছে। সে লক্ষ্য করল একজন মানুষকে। সে অসম্ভব সুন্দর চেহারার এক পুরুষ। মেয়েদের স্বপ্নের রাজকুমার যতটা সুন্দর হয় তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি সুন্দর। অসম্ভব ফর্সা, চোখগুলো টানা টানা, মুখে মায়াময় হাসি। নওরিনকে দেখেই সে একটা মায়াভরা হাসি দিল। হাসিটা এতোটা সুন্দর যে নওরিনকে সম্পূর্ণ অভিভূত করে ফেলল। নওরিন তার দিকে এগিয়ে গেল৷ নওরিন তারদিকে একবার হাত বাড়িয়ে ছোয়ার চেষ্টা করল। পরে আবার নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। নওরিনকে লোকটা হাসিমুখে বলল, ‘ঘুম ভেঙেছে তোমার?’
‘হুম। কিন্তু আপনি কে?’
‘কি হলো আমাকে তুমি ভুলে গেলে কিভাবে? এতো ডিস্টার্ব করার পর তোমাকে কাছে পেলাম সেই তুমি আবার আমাকে ভুলে গেলে।’
‘বুঝলাম না। আমি তো এখনই আপনাকে জীবনের প্রথম বার দেখছি। আর আমি এখন কোথায়? আর আপনার সাথে আমি কি করছি এখানে।’
‘তুমি তোমার নিজের বাসায়।’
নওরিন একটা ধাক্কা খেল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘নিজের বাসায় মানে? আমি তো আব্বুর সাথে অন্য একটা বাসায় ছিলাম। সেটা তো আটতলায়। কিন্তু আমি এখানে কেন? আর আপনিই বা কে? আপনার নাম কি?’
লোকটা হেসে দিল। লোকটা বলল, ‘আমি সেই ব্যক্তি যাকে তুমি অসম্ভব ভালোবাসো। আর আমাদের মধ্যে এটাই সম্পর্ক। আর আমার নাম শুভ্র।’
নওরিন ভ্রু কুচকালো। নওরিন বলল, ‘আমি আজই আপনাকে প্রথম দেখছি। কিন্তু আপনি বলছেন আমি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এখন আর বুঝতে হবে না। আমার খেতে বসো এখন। তোমার জন্য এতো কিছু রান্না করলাম। আর তুমি খেতে না বসে শুধু কথা বলতেছো৷ নাও হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসো। আর আমাকে তুমি আপনি করে বলছ কেন? তুমি করে বলবে।’
‘আগে আপনি আমার কথাগুলোর জবাব দেবেন তারপর আমি খেতে বসব।’
‘আগে তুমি আমাকে আপনি করে বলা বাদ দিয়ে তুমি করে বলবে। তারপর আমার সাথে খেতে বসবে। তারপর আমার রান্নার প্রশংসা করবে। তারপর আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিব।’
নওরিন একটু বিরক্ত হলো। সে ভাবল, এই লোকটা তো ভারী ছ্যাচড়া টাইপের। আমাকে তুমি করে বলছে। আবার আমাকে বলছে যেন তাকে তুমি করে ডাকি। আবার তার রান্নার নাকি প্রশংসা করতে হবে। মনে তো হয় কোন অখাদ্য রান্না করে রেখেছে। তাই নিজেই প্রশংসা চেয়ে নিচ্ছে৷ কিন্তু নওরিনের ক্ষুধা লেগেছিল। তাই নওরিন হাতমুখ ধুতে গিয়ে আবার ভাবল রান্না করেছে হয়তো অখাদ্য। এটা খেয়ে তার খিদে না কমলেও খাওয়ার ইচ্ছা অনেকটাই কমে যাবে। হাতমুখ ধুতে ধুতে লক্ষ্য করল নওরিন ফুলের সুবাস পাচ্ছে। যা তার মনকে প্রশান্তি দিচ্ছে৷ শুধু প্রশান্তি দিচ্ছে না মনটা উৎফুল্ল করে তুলছে। নওরিন হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে এল। নওরিন বের হওয়ার পর দেখল শুভ্র নওরিনের দিকে তাকিয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে মুচকি হাসছে। যেটা নওরিনের মন ছুয়ে যাচ্ছে। আর খাবার টেবিল সাজাচ্ছে। খাবার টেবিলের পাশে গিয়ে নওরিন অনেকটা অবাক হলো। কারণ খাবার গুলো অনেক সুন্দর ভাবে সাজানো। ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টগুলোতেও হয়তো এতো সুন্দর ভাবে সাজানো থাকে না। সে বেশির ভাগ খাবারের নামই জানে না। কিন্তু সেগুলো দেঝতে অপুর্ব লাগছে। শুভ্র নওরিনের বসার জন্য নওরিনের চেয়ারের কাছে এসে চেয়ারটা দকটু পিছে টেনে নিল। যাতে নওরিন বসতে পারে। নওরিন চেয়ারে বসে পড়ল। আর নওরিন অবাক ভঙ্গিতে শুভ্রর দিকে তাকাচ্ছে। যতবার তাকাচ্ছে শুভ্রর মধুর হাসি তার মন ছুয়ে যাচ্ছে। যেন শুভ্রকে দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছে। নওরিন বসার পর শুভ্র খাবারগুলো এক এক করে নওরিনের দিকে খাবারগুলো এগিয়ে দিল। নওরিন বলল, ‘আপনি বসুন। আমি নিজে নিয়ে খএতে পারব।’
‘আবার আপনি বলছ! আমি না বলেছি তুমি করে বলতে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বসো।’
শুভ্র গিয়ে নওরিনের সামনাসামনি বসল। খাবার মুখে দেয়ার পর নওরিন যে অনুভুতি পেল সেটা বলার মতো না। নওরিন যেন কোন খাবার মুখে দেয়নি। যেন সে স্বর্গীয় কিছু মুখে দিয়েছে। এতোটা সুন্দর৷ জিনিস সে জীবনে কিছু খায়নি৷ কেউ খেয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও তার সন্দেহ জাগল। নওরিন নিজের উপর একটু লজ্জা করতে লাগল। কারণ সে ভেবেছিল তাকে বোধহয় কোন অখাদ্য খেতে হবে। কিন্তু এ খাদ্য যে এতোটা সুস্বাদু হবে। সুস্বাদু বললেও ভুল হবে অমৃতের মতো হবে সে ভাবতেও পারেনি। নওরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল সে সবসময়ের মতো তার সুন্দর হাসিটা দিতেছে। নওরিন বলল, ‘এসব খাবার কি তুমি রান্না করেছো?’
‘এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কে আছে যে রান্না করবে? কেন ভালো হয়নি?’
‘না…।’
শুভ্র নওরিনকে আটকে দিল। সে ‘না’ শব্দটা শুনে কিছুটা কষ্ট পাওয়ার মতো মুখ করে ফেলল। তার মুখটা দেখতে বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল। শুভ্র বলল, ‘ভালো হয়নি?’
নওরিন হেসে দিল। এমন অবস্থা যে হাসতে হাসতে যেন চেয়ার থেকে পড়ে যাবে। নওরিন বলল, ‘তোমার মুখের অবস্থা দেখে আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। আমার কথাটা তো শেষ করতে দাও। তোমার রান্না শুধু ভালো হয়নি। হয়েছে অসম্ভব ভালো৷ যাকে বলে অমৃত হয়েছে।’
‘ও। আমি ভাবলাম বেশি ভালো হয়নি। যাক থ্যাংকস।’
‘আমার বিশ্বাস হয় না। আমি এতো সুন্দর খাবার খেতেছি। আচ্ছা তুমি বললে যে এখানে কেউ থাকে না৷ এটা কি সত্যি?’
‘হ্যা। আমার আর তোমার মাঝে আর কেউ নেই। আমি কাউকে আসতে দেই না।’
‘কেন?’
‘কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমার ভালোবাসার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি না আমি পছন্দ করি না।’
নওরিন অবাক হল। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফেলল। নওরিন বলল, ‘আচ্ছা। এখানে কি কোন ফুলের বাগান আছে?’
‘হুম৷ রুম থেকে বেরোলেই সেটা দেখতে পাবে।’
‘ও। আমি সেটা দেখতে চাই।’
‘খাওয়া দাওয়া শেষ কর। তারপর আমি তোমাকে বাগানে নিয়ে যাব। দেখবে সেখানে অনেক ধরনের ফুল গাছ।’
‘আচ্ছা আমরা এখানে কতদিন আছি? আর তুমি কি আমার হাজবেন্ড। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
শুভ্র একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তারপর বলল, ‘এসব ব্যাপারে এখন না ভাবলেও চলবে। আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করো।’
নওরিন খাওয়ার দিকে মনযোগ দিল। খাওয়ার মাঝে কোন কথা বলল না। শুভ্রও নিজের খাওয়াতে মনযোগ দিল। নওরিন মনে মনে শুভ্রর রান্নার প্রচুর প্রশংসা করতে থাকল। শুভ্র কিছুক্ষণ পর নওরিনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। যেন সে নওরিনের মনের কথা বুঝে ফেলেছে। দুজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেলল। নওরিন বাড়ির রুম গুলো দেখতে থাকল। নওরিন দেখল বাড়িতে মাত্র একটা বেড রুম। তার পাশে একটা ড্রয়িং রুম আর ডাইনিং রুম আছে। বাড়িটা অসম্ভব সুন্দরভাবে সাজানো। শুভ্র নওরিনের পাশে এসে দাড়িয়ে বলল, ‘এখন কি বাগানে যাবা?’
‘হুম। আমার দেখার অনেক ইচ্ছা।’
‘চলো তাহলে।’
শুভ্র দরজা খোলার পর নওরিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। নওরিন দেখল তার চোখের দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যায় বাগানটা তার থেকেও বেশি বিস্তৃত। দরজা থেকে রাস্তা শুরু হয়ে বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। শেষ হয়েছে কোথায় নওরিন তা জানে না। নওরিন অভিভূত হয়ে গেল। নওরিন দেখল বিভিন্ন রঙের ফুল। হয়তো এখানে পৃথিবীর সব ধরনের ফুল আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ শুভ্র বলল, ‘দরজার সামনেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি বাহিরেও যাবে।’
নওরিন বের হলো। পাশাপাশি শুভ্রও বের হলো৷ নওরিন বলল, ‘আচ্ছা আমি কি মারা গেছি? আর এখন কি জান্নাতে আছি? আমি শুনেছি জান্নাতে নাকি সব কিছু সুন্দর থাকে। আর সেখানে নাকি এতো বড় বাগান থাকবে যেটা শেষ পর্যন্ত দেখাও যায় না।’
শুভ্র হেসে দিল। নওরিন সরু দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র বলল, ‘না তুমি মারা যাওনি। আর তুমি জান্নাতেও আসোনি। আচ্ছা এই মুহূর্তটা কি তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্ত?’
‘হুম। আমার এতো সুন্দর মুহূর্ত জীবনে আসেনি।’
‘যদি এটা জীবনের সব থেকে সুন্দরতম স্বপ্ন হয় তাহলে কি খুশি হবে?’
‘না। স্বপ্ন কখনো স্থায়ী থাকে না। সেটা ভেঙে যায়। কিন্তু এটা স্বপ্ন হলেও পৃথিবীর মধুরতম স্বপ্ন।’
‘তাহলে বলি আমি আমার কথা রেখেছি। আমি বলেছিলাম আমি তোমাকে সব থেকে সুন্দরতম স্বপ্ন দেখাব। আর তুমি এখন সেটাই দেখছ। কিন্তু হয়তো আমাদের মাঝে এই মুহূর্তটা বাস্তবে আসতে পারে। কিন্তু আমাদের মাঝে রাতেই সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’
‘তুমিই কি সেই ব্যক্তি যে আমাকে রাত দুইটা পয়তাল্লিশ এ ফোন করতে?’
‘হুম।’
‘কেন এমন করতে আমার সাথে প্লিজ বলো না? আমি সত্যি স্বপ্ন দেখছি? আর যদি স্বপ্ন দেখি তাহলে আমি চাই আমি যেন এই স্বপ্নেই চিরদিন থাকতে পারি।’
‘আর সম্ভব না। সকাল অনেকক্ষণ আগেই হয়ে গেছে। তোমার বাবা তোমাকে ডাকতে আসছে। এখন তুমি চলে যাবে। আর আমি এখানে সেই আগের মতো একা থেকে যাব। আর তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমার মন হাহাকার করবে।’
‘তুমি এখানে কি একা থাকো। আর এখান থেকেই কি আমার সাথে কথা বলতে। আর আমি কি সত্যি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে তো রং, গন্ধ এবং স্বাদ কিছুই পাওয়া যায় না। আমি তো পাচ্ছি।’
‘হুম। আমি এখানে একা থাকি। এখান থেকেই তোমার সাথে কথা বলতাম। তুমি স্বপ্নে আছো৷ আর কিছুক্ষণ পর জেগে উঠবে। আর রঙিন দেখছ, ফুলের গন্ধ পাচ্ছ, আর আমার রান্না করা খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারছ কারণ আমি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে স্বপ্নে তোমাকে এসকল অনুভূতি দিয়েছি। আর এর জন্য প্রকৃতি আমাকে ক্ষমা করবে না। এর শাস্তি নিশ্চয় আমাকে দিবে।’
নওরিন চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। তার বুকের ভেতর যেন হাহাকার করে উঠছিল। নওরিন বলল, ‘আমি কি এখন চলে যাব? আর কি আমাদের দেখা হবে না? তুমি কেন এমন করলে আমার জন্য। যাতে তোমার শাস্তি পেতে হবে এমন কাজ আমার জন্য কেন করলে?’
‘আমি আগেই বলেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসার মানুষের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। এর জন্য আমি যেকোন শাস্তির জন্য প্রস্তুত আছি।’
নওরিন সম্পূর্ণ কেদে ফেলল। নওরিন প্রায় হাউমাউ করে কান্না করছিল। নওরিন বলল, ‘আমি তোমাকে একটু ছুয়ে দেখতে চাই।’
‘আর সময় নেই।হয়তো এটাই ছিল আমাদের প্রথম আর শেষ দেখা। আর দেখা হবে না। গুড বাই।’
‘না। আমি যেতে চাই না। আমি এখানেই থাকতে চাই। তোমার সাথে থাকতে চাই। আমাকে চলে যেতে দিও না। তোমার তো অনেক শক্তি। আমাকে একটু আটকে রাখো না।’
নওরিনের কাছ থেকে সব কিছু দূরে সর যাচ্ছিল। ফুলের বাগান ফিলিয়ে যাচ্ছিল। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছিল। কিন্তু নওরিন চিৎকার করছিল। কিন্তু তার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। সে চলে যাচ্ছে। শুভ্রকে সেখানে একা রেখেই একা চলে যাচ্ছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here