#অন্যরকম_ভালোবাসা ?পর্ব::১৪
#ইফা_আমহৃদ
— মা নামক কলঙ্ক আমি।।নিজের মেয়ের সংসার ভেঙ্গে দিয়েছি।। তোমার আর তোমার পরিবারের শান্তি কেড়ে নিয়েছি।। আমি কি করতাম বলো।। নিজের স্বামীকে বাঁচানো ছাড়া আর কোনো উপায় যে আমার হাতে ছিলো না।। কিন্তু দেখ ,, প্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে পারলাম না।।ইশরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে সব শান্তি নিয়ে গেল।।(আঁচলে নিজের চোখ মুছে তমোনা)
— আন্টি প্লীজ ,,, আপনি এইসবের জন্য নিজেকে দোষারোপ করবেন না।।এখানে আপনার কোনো দোষ নেই।।সব দোষ আমার ,, নিজের ভালোবাসা ,, ভালোবাসার উপহার আগলে রাখতে পারি নি।। অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছি।। (ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো আয়ান)
তমোনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।। কাবার্ড থেকে লাকেজ আর কিছু প্রয়োজনীয় জামা কাপড় বের করে গুছিয়ে নিলো।।আজ ইশরা থাকলে হয়তো এইসব করতে হতো না।।কাউকে কষ্ট পেতে হতো না,, আঁচলে চোখ মুছতে হতো না ।।আয়রার দুষ্টুমিতে পুরো বাড়ি আলোকিত করে রাখতো।। কিন্তু তমোনাই বা কি করতো,, কে চায় নিজের প্রিয় মানুষটিকে হারাতে।।নাকি চায় নিজের মেয়ের সংসার ভাঙ্গতে।।
___________
হাত দিয়ে অংক গননা করছে আর ভাবছে আয়রা।। গাড়িতে উঠার পর থেকে কোনো একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত সে।।তার পাশে ইশরা বসে ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।আর মেয়ের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামলো আয়রার স্কুলের সামনে ।।ইশরা দরজা খুলে আগে নেমে দাঁড়ালো।।ইশরাকে নামতে দেখে দেরী করলো না আয়রা ।সেও দূরত্ব পায়ে নেমে দাঁড়ালো।।ইশরাকে হাত দিয়ে টাটা ইশরারা করে সামনে দিকে পা বাড়ালো।।কয়েকটা বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল ।আয়রার সামনে একজন বাবা তাঁর ছেলেকে কিসব বলছে ,,দূরে থাকার কারনে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,, চুমু খাচ্ছে।।গাড়িতে ওঠার আগে আবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে পরখ করে নিলো ইশরা।।আয়রাকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ,, তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো।। বুঝতে বাকি রইল না,, নিজের বাবাকে খুব মিস করছে।।ইশরা দেরী না করে তাড়াতাড়ি আয়রার কাছে গিয়ে বসে পড়লো।। প্রতিদিন সকালে স্কুল ভালো ভাবে পরিস্কার করা হয়।। গাছ গুলো সারিবদ্ধভাবে কেটে সমান করা হয়েছে।। সকালে হয়তো গাছে পানি দেওয়া হয়েছিলো,, তাই পানি গুলো এসে মাঠের মাঝখানে জমা হয়েছে।।যাতে কাঁদাচ্ছন্ন ও পিচ্ছিল হয়ে গেছে জায়গাটা।।ইশরা সেদিকে পরোয়া না করে সেখানে বসে পড়লো।।এখন মেয়ের পাশে থাকার চেয়ে যেন পৃথিবীতে আর কোনো কাজ নেই।।
মেয়ের হাত টেনে কোলে বসিয়ে দিল।। অনবরত ভাবে,,আয়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।।আয়রা মায়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।। অশ্রুসিক্ত নয়নে ইশরার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বললো..
— মাম্মা আমার পাপা কবে আসবে!!
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ইশরা।। মেয়েকে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে হবে।। নিজের চোখের অশ্রু জমার আগেই মুখ ফুটে বলে উঠলো..
— আসবে মাম্মা ,,তুমি যখন বড় হবে তখন চলে আসবে??
ইশরার মুখের উত্তর পেয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন করলো আয়রা।।
— মাম্মা ,, ওদের পাপা তো ওদের সাথেই থাকে ।।তাহলে আমার পাপা দূরে থাকে কেন?? কেন আমি বড় হলে আসবে মাম্মা!!
এবার আর সহ্য করতে পারলো না ঠোঁট চেপে কেঁদে দিলো ইশরা।।মায়ের এমন কান্না দেখে সেও কেঁদে দিলো।।আধো আধো ছোট ছোট হাত দিয়ে মায়ের চোখ মুছে দিতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল…
— সরি মাম্মা !! আমি কখনো তোমাকে পাপার কথা জিজ্ঞেস করবো না ।। তুমি কেঁদো না।।আর পাপা ফিরে এলে ,, পাপাকে ভিষন করে বোকে দিবো।।কেন আমাদের ছেড়ে ওই বিদেশে পড়ে আছে।।
আয়রার এমন কথা শুনে একটু আবেগগত হাসি হাসলো ইশরা।।আজ যেখানে মেয়েকে শান্তনা দেওয়ার কথা সেখানে মেয়ে ইশরাকে শান্তনা দিচ্ছে।। পরপর মেয়ের গালে চারটি চুমু খেল।।আয়রার গলায় থাকা লকেট টা স্কুল ফ্রোকের নীচ থেকে বের করে আয়রার হাতে ধরিয়ে দিলো।।লকেটা হাতে পেতেই আয়রা সেখানে শব্দ করে চুমু খেল।। নিজের গলা থেকে লকেটটা খুলে মায়ের গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো…
— এই তো আমার পাপা।।দেখেছো মাম্মা তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ।। আমাদের পাপা তো আমাদের সাথেই আছে।। তিনি দূরে থেকেও আমাদের সাথে ছায়া হয়ে রয়ে আছে।।
— তাই তো ,,এই না হয় আমার প্রিন্সেস আয়ু সোনা!
ইশরা কথায় আয়রা মুখ ভাড় করে অন্যদিকে ফিরে রইল।। ঠোঁট দুটি আস্তে আস্তে বাঁকিয়ে বললো..
— আমি প্রিন্সেস আয়ু সোনা না ।।আমি প্রিন্সেস,, বাবুই, আয়ু ,,সোনা।।ভুলে গেছো।।(অভিমানী সুরে আয়রা)
— এই তো নাক ধরছি,, কান ধরছি ।।ভুল হয়ে গেছে আমার প্রিন্সেস ,,বাবুই,, আয়ু সোনা!!
ইশরা অপেক্ষা করলো না ,,,পূর্নরায় আবার গলার লকেটটা খুলে আয়রার গলায় পরিয়ে দিলো।।মায়ের সাথে এমন হাজারো কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল ছোট আয়রা।। সত্যি মানুষের জীবনটা বরই অদ্ভত।।দেখা যায় হাজারও কষ্ট কাউকে মুখ ফুটে বলা যায় না।।আর বলে দিলেও বুঝতে অনেকটা সময় লাগে।। কিন্তু মাকে কিছু বলে দিতে হয় না।।সে তার অস্তিত্ব দিয়ে সবটা বুজে নেয়।।।
_______________
সেই কখন থেকে “”শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর”” এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুয়ান ।।এক হাত দিয়ে আয়রার হাত ধরে অন্যহাতে থাকা ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে।।কখন তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনয়ার দেখা মিলবে।। তাড়াতাড়ি অফিসের কাজ শেষ করে সোজা আয়রার স্কুলে গিয়েছিলো।। কিন্তু তখন আয়রার স্কুল ছুটি হয় নি তাই ঘড়ির টাইম দেখতে দেখতে সময় ওয়েস্ট করেছে।। হয়তো তখন এমন ছিলো,,অনয়ারা তখন নিজেদের বাড়িতে ছিলো।।একটু আগে প্লেন ল্যন্ড করেছে ।।বের হতে একটু দেরি হচ্ছে।।দুয়ানের ইচ্ছে করছে ,, দৌড়ে প্লেনের ভেতরে ঢুকে যেতে।।এতো কেন দেরী হচ্ছে।।প্রতিটা মুহুর্ত এক একটা যুগের থেকেও বেশী মনে হচ্ছে।।ভিডিও কলে প্রায় প্রতিদিনই অনয়ার সাথে তার কথা হয় ,, কিন্তু সে দেখা আর কাছাকাছি দেখা কি কখনো এক হয়।।আজ আর একজন প্রেমিক অপেক্ষা করছে তার প্রিয়শ্রীর জন্য।
অপেক্ষায় অবসান ঘটিয়ে অনয়া আর তার পরিবারের দেখা মিললো।।পড়নে গাঢ় নীল রঙের চুরিদার।।এক পাশে সেপটেফিন দিয়ে ভালো ভাবে লাগানো ,, অন্যপাশে চুলগুলো গুছিয়ে বেনুনি করা।।নয়নে নীলাভ কাজল ।।যেই আঁখি এদিক ওদিকে কিছু একটা খোঁজার জন্য বিরল!!দুয়ানের কাছে অনয়াকে পরীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছে।।অনয়ার দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।। সামনের দিকে এগিয়ে গেল।।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে লাকেজ টেনে নেওয়ার সময় খেয়ার করে আয়রা পাশে নেই।।লাকেজ গুলো ওভাবে রেখে আয়রা আয়রা বলে চারদিকে খুঁজতে লাগলো।।প্রথমবার এয়ারপোর্ট দেখে নিজেকে সামলাতে পারে নি আয়রা ,,তাই একা একা ঘুড়তে বেরিয়ে গেছে।। হঠাৎ অনয়া পেছনে থেকে ভাউ করে উঠলো আয়রা।।সবাই দৃষ্টি গিয়ে পড়লো তখন আয়রার দিকে।।দুয়ানের তো ইচ্ছে করছে আয়রাকে ঠাঁটিয়ে কয়েকটা লাগিয়ে দিতে।। কিন্তু এখন দিলে একটু পর আবার ইশরার হাতের মার তাকে খেতে হবে।। তাই দমে গেল।। তবুও রাগি দৃষ্টি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো উঠলো…
— কোথায় গিয়েছিলিস তুই ।।জানিস কতোটা টেনশনে ছিলাম।।তোর কিছু হলে তোর মা তো আমাকে একদম কুটিকুটি করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতো।
— আচ্ছা মামা ,, কুটিকুটি করে কি দিয়ে বঁটি দিয়ে নাকি ছুড়ি নাকি চপাটি দিয়ে !!( ভাবার অভিনয় করে আয়রা)
আয়রার এমন অভিনয় দেখে দুয়ানের রাগ নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল।।সাথে সাথে হেসে দিলো সবাই ।।দুয়ান হাসতে হাসতে বললো..
— সেটা যখন তোর মা আমাকে কুটিকুটি করবে ।।তখন দেখিস কেমন।। এবার চল পাকা বুড়ি।।দেরী হয়ে যাচ্ছে।।
ফুলে উঠলো আয়রা।।ধপ করে মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগলো ।।
— আমি পাকা বুড়ি না আমি প্রিন্সেস বাবুই আয়ু সোনা।।আর প্রিন্সেস কখনো হেঁটে যায় না।। ঘোড়ায় করে যায়।।তাই আমি এখন ঘোড়ায় করে যাবো।।
দুয়ান বেচারা পড়েছে মহামুসকিলে।।ইচ্ছেমতো গালি দিচ্ছে জয়ীকে ।।কেন আজই অসুস্থ হতে হলো তাকে।।এখন আয়রাকে সামলাবে নাকি লাকেজ গুলো নিয়ে যাবে বুঝতে পারছে না।।দুয়ানের ইনোসেন্স ফেইস দেখে আয়ান আয়রাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো ।।আয়রা কান্না থামিয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ কি এমন কিছু তার বোধগম্য হলো না।।প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও পরক্ষনে মন দিয়ে তাকিয়ে রইল।।এই মুখটা যেন তার খুব চেনা।। নিজের কাছের কারো।।আয়রা হাত বাড়িয়ে আয়ানে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।।আয়রার এমন ব্যবহারে আয়ানকে ইশরার কথা মনে করিয়ে দিল।।ইশরার কাছে আয়ানের এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো খুব পছন্দের ছিলো।।
সারারাস্তা দুজন দুজনার দিকে এক মায়া ভরা দৃষ্টিতে চাই ছিলো।।
চলবে…??