প্রেমানুরাগ পর্ব ১

0
1616

‘এই মেয়ে? এই জঙ্গলে শুয়ে আছো কেন? হ্যালো?’

হাতে থাকা কড়ই গাছের চিকন ডাল দিয়ে মেয়েটির গালে হাল্কা গুঁতো দিয়ে বললো রবি। মেয়েটির কোনো প্রকার হেলদুল নেই। নেতিয়ে পরে আছে শুকনো পাতার উপর। রবি মাটিতে এক হাটু গেড়ে বসলো। আঁখিদুটি বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো ছোট ছোট করে মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সে। চারদিক নিস্থব্ধতায় ছেঁয়ে আছে। মাথার উপর থাকা বিশাল বৃক্ষের উপর দিয়ে উড়ন্ত বাজপাখির ডাক ভয়াংকর রুপে ভেসে এলো। গহীন জঙ্গল। চারপাশে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। কিয়ৎক্ষণ পরপর ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির ধ্বনিতে মুখরিত এই গহীন জঙ্গল। এতো বড় জঙ্গলে এই মেয়ে একা কি করতে এসেছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না রবি। কাধের ব্যাগ থেকে হাল্কা বেগুনি রঙের পাতলা স্টিলের পানির বোতল বের করে পানি হাতে নিয়ে মেয়েটির মুখে ছিটেফোঁটা দিলো রবি। পরপর কয়েকবার দেবার পর মেয়েটি পিটপিট করে তাকায়। কপালের এক পাশ ফুলে বাঁশ হয়ে আছে। সেখানে হালকা চিনচিন ব্যাথা করছে। কুঁচকানো চোখ মেলতেই ঝাপসা ঝাপসা পরিবেশ দৃশ্যমান হয়। মুখের সামনে অপরিচিত একজন ছেলেকে ঝুকে থাকতে দেখে ধরফড়িয়ে পিছিয়ে যায় শশী। ভয়ার্ত গলায় অস্পষ্ট সুরে বলে উঠে, ‘প্লিজ আমাকে ম’র’বেন না। প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। ‘

রবি তার কপালে ভাজ ফেলে বললো, ‘তোমাকে ধরে রেখেছে কে?’

শশী তার ঝাপসা চোখে দৃষ্টি মেলে আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। জুরপূর্বক শুকনো ঢুক গিললো। উঠে দাঁড়ালো রবি। বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে বললো, ‘ভেবেছিলাম ম-রে টরে গেছো বুঝি। যাক ভালোই। এবার বাড়ি যাও।’

রবি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই শশী বলে উঠে, ‘পানি খাবো আমি।’ মলিন চোখে তাকালো রবি। নিশ্চুপ থেকে এক হাতে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। শশী বোতল হাতে নিয়েই ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি সাবার করে দিলো। রবি দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করলো, ‘জঙ্গলের রাস্তায় কেউ আসে না। এইসময় জঙ্গলের মাঝখানে কি করছিলে তুমি? বাই এনি চান্স কোনো ক্রা’ইমের সাথে জড়িত নও-তো তুমি?’

শশী বিস্মিত চোখে তাকায় রবির দিকে। প্রতিত্তুর না করে উঠে দাঁড়িয়ে নীল রঙের কুর্তিতে থাকা ধুলোবালি হাত দিয়ে ঝাড়ে। রবি এখনো শশীর অবস্থান বুঝার চেষ্টা করছে। জামা ঝাড়া শেষ হলে শশী রবিকে প্রশ্ন করে উঠে, ‘এটা কোন জায়গা?’

চোখ বড়বড় করে তাকায় রবি। অবাকের সপ্তম আকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে প্রায়। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠে, ‘জায়গার নাম জানো না? তাহলে এখানে এলে কি করে?’

শশী বললো, ‘আষ্টর্য আমি এখানে স্বেচ্ছায় ঢেং ঢেং করে আসছি নাকি? ভুলেচক্রে পা-চা-র-কারীর হাতে পরেছিলাম। ভাগ্যিস চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে এখানে এই খাম্বাটার সাথে ধাক্কা লেগে বাংলা সিনেমার মতো অজ্ঞান হয়েছি। কিন্তু জায়গাটার নাম কি? কি-ড-ন্যা-পার জঙ্গলে আনলো কেন আমায়?’

রবি বিরক্ত হলো। সংক্ষেপে বলে দিলেই তো পারতো সে পা’চার’কারীদের হাতে পরেছে। এতো প্যাঁ-চাল পারার কি আছে? বিরক্তি নিয়ে শশীর দিকে তাকালো রবি। কিছু না বলে চুপচাপ জঙ্গলের মাঝে হাটা শুরু করলো। শশীও তার পিছু পিছু হাটতে থাকে। চারপাশ কোলাহলমুক্ত হওয়ায় কেবলমাত্র পদচরণে ঝমঝম আওয়াজ হচ্ছে। পা ফেলার সাথে সাথে গাছের শুকিয়ে যাওয়া পাতা মচমচিয়ে উঠছে। শশীকে পিছু আসতে দেখে রবি দাঁড়িয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে, ‘এই মেয়ে আমার পিছে আসছো কেন?’

শশী ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, ‘তাহলে কোথায় যাবো?’

‘আমি কিভাবে বললো? যেখানে খুশি যাও। আমার পিছু নিও না।”

শশী কপাট ক্রোধ দেখিয়ে বললো, ‘জঙ্গলের মাঝে একটা মেয়েকে একা ফেলে যাবেন? কতো বড় নির্দয় লোক আপনি।”

রবি বললো, ‘হ্যা ফেলে যাবো। যে দিকে ইচ্ছে সে দিকে যাও। আই ডোন্ট কেয়ার। বাট আমার পিছু নিও না।’

শশী কাদুকাদু স্বরে বলে, ‘ভাইয়া প্লিজ আমাকে একা ফেলে যাবেন না। এই জঙ্গলে আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আমাকে বিপদে ফেলে যেতে পারেন না। এ হতে পারে না। আপনি এমন করতে পারেন না। কিছুতেই না।’

বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে রবি। কটমট চোখে শশীর দিকে তাকালো। কি এক উটকো ঝামেলা এসে ঘাড়ে পরলো তার। কিড়মিড় করতে করতে নিরবে সামনে এগোতে থাকে। শশী মনের আনন্দে তার সাথে আগাচ্ছে। ঝোপঝাড়ের মাঝে সরু রাস্তা ধরে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে দু-জন যুবক যুবতি। রবি হাতে থাকা কিচন ডাল দিয়ে সামনের আগাছা সরিয়ে এগোচ্ছে। শশীও তার একদম কাছাকাছি থেকে হাটছে। বড়বড় লতা গাছের পাতা গুলো চকচকে সবুজ। কিছু কিছু গাছ একদম সোজা উঠে আকাশ ছুঁয়ার চেষ্টা করছে। শশী গহীন জঙ্গলের চারপাশ দেখতে লাগলো। ছোট ছোট গর্ত গুলোতে বড়বড় কদম ফেলে পার করছে। শশী খেয়াল করছে ক্রমশ দুজন জঙ্গলের দিকেই এগোচ্ছে। কৌতুহল বশত শুধাল, ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা জঙ্গলের মাঝে চলে যাচ্ছি। মেইন রোড কোন দিকে?’

রবি পিছনে না ফিরে সামনে হাটতে হাটতে উত্তর দিলো, ‘জঙ্গলের মাঝেই যাচ্ছি। কোনো মেইন রোড এইদিকে পাওয়া যাবে না।’

অবাক হলো শশী। চেঁচিয়ে উঠলো, ‘মানে কি? জঙ্গলে থেকে না বেড়িয়ে আপনি জঙ্গলের মাঝে যাচ্ছেন?’

শশীর চেঁচানোর আওয়াজে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় রবি। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললো, ‘আমি কি একবারো বলেছি যে হাইওয়েতে যাচ্ছি?’

‘না কিন্তু জঙ্গলের মাঝে গিয়ে কি হবে? যে দিকে গেলে হাইওয়ে পাওয়া যাবে সে দিকে যাই।’

রবি দাতে দাত পিষে বলে উঠলো, ‘আমি তো আগেই বললাম তুমি তোমার ইচ্ছে মতো যাও। পিছু নিও না। আমি জঙ্গলের মাঝেই থাকি। সো সেখানেই যাচ্ছি। আসলে আসো না হলে বিদায় হও।’

বলেই হাতের শক্ত কড়ই গাছের লাঠিটা দিয়ে ঠাস ঠাস করে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে সামনে এগোতে লাগলো। শশী পিছে পিছে হাটতে হাটতে বললো, ‘জ’ঙ্গি’রা জঙ্গলের মাঝে থাকে শুনেছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। তাহলে জঙ্গলে থাকেন কেন?’

উত্তর দিলো না রবি। চুপচাপ এগোতে লাগলো। শশী উত্তর না পেয়ে আবার বলতে লাগলো, ‘ওহ বুঝলাম বুঝলাম। নিশ্চয় কোনো প্রকার আ-কাম করছেন যার জন্য আপনার বাপ মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশ আপনাকে তন্যতন্য করে খুঁজচ্ছে। জঙ্গলের মাঝে তো কেউ আসে না। তাই এখানেই থাকছেন। প্রাইভেসি ফাস্ট। দেখেছেন আমি কতো ইন্টেলিজেন্ট? কি সহজে বুঝে গেলাম।’

দাঁড়িয়ে পরলো রবি। ধমকে উঠলো, ‘আর একটা ফালতু কথা বললে গালে চড় লাগাবো মেয়ে।’

শশী ঠোঁট উল্টে বলে, ‘এই মেয়ে বলবেন না। আমার নাম শশী।’

‘শশী মশা শশা যাই হোক। তুমি চুপ থাকলে আসো নাহলে নিজের রাস্তা দেখো। মাথা খারাপ করবে না।’

শশী তাৎক্ষনাৎ মাথা দুলিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে কথা বলবো না। মুখে কস্টেপ লাগিয়ে নিলাম।’

রবি স্বজোড়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো। এগোতে লাগলো সামনে। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে বিকেল ৩:৪৫ বাজে। দ্রুততার সাথে কুড়ে ঘরে ফিরতে হবে।
_____________

‘হোয়াট ননসেন্স। এতো টাকা দিয়ে তোমাদের রাখলাম কেন? টাকা গুলো কি আমি হাওয়ার উপর দিয়েছি? একটা মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারো নি? নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে?’

কেবিনে বসে হুংকার দিয়ে বললো ডঃ সোহরাব। রাগে শরির তার মৃদু কাপছে। আধপাকা চুল গুলো এক হাতে পিছে ঠেলে আবারো বলতে লাগলো, ‘আমার মেয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয় আই সোয়ের তোদের আমি একদম মে-রে ফেলবো।’

ফোনের অপর পাশে থাকা কালো কাপড় পরা তিনজন দেহরক্ষী ভয়ে কাচুমুচু হয়ে আছে। শশী কিভাবে তাদের চোখের ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে তারা তিনজন মোটেও টের পায়নি। ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো তিনজন। শুধাল, ‘চিন্তা করবেন না স্যার। ম্যাডামকে আমরা খুঁজে বের করবো।’

এ যেনো জলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার উপক্রম। ডঃ সোহরাব মাত্রারিক্ত ক্রোধে টেবিলের উপর থাকা ফ্লাওয়ার বেজ ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘জাস্ট শাট আপ ইউ ইডিয়ট। ইমিডিয়েক্টলি লোক লাগাও। আমি আমার মেয়ে কে চোখের সামনে দেখতে চাই। এবং সুস্থতার সাথে যেনো তাকে পাই। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পরো!’

তিনজন সম্মতি দিলো। অতঃপর হুড়মুড়িয়ে শশী কে খোঁজা শুরু করলো। সোহরাব কল কেটে তার বন্ধু ইন্সপেক্টর ইকবাল কে কল দিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললো। ইকবাল আশ্বাস দিলো তারা পুলিশ ফোর্স লাগাবে শশীকে খোঁজার চেষ্টা করবে। তবুও শান্ত হলো না সোহরাব। কপালের উপর জমে থাকা ঘাম গুলো এক হাতে মুছলো। ভয় হচ্ছে তার। শিশিরকে হারিয়ে একদম ভেঙ্গে পরেছিলো সে। এখন একমাত্র মেয়েকে নিয়েই তার দুনিয়া। মেয়ের জন্যই বুকে শত কষ্ট চেপে বেঁচে আসে সে। আর শশীকে হারালে সে বাঁচতে পারবে না। কিছুতেই না।

চলবে??

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#সূচনা_পর্ব

নোট : এটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প। গল্পের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here