#আরোহী [08]
#sharmin_akter_borsha (লেখিকা)
হাসপাতালে পৌঁছে বেগ পেতে হয় আরাফের। আরোহী নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পরে। মিতা ও নিপা দু’জনকে মিলেও আরোহীকে সামলাতে পারছিলো না। আরাফ এগিয়ে এসে আরোহীর দুই বাহু চেপে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। চারজনে একসাথে হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করে। মর্গে রাখা আছে আরংমান ও তার স্ত্রীর মৃত দেহ। ডাক্তার ও দুজন নার্স সাথে তিনজন পুলিশ ইন্সপেক্টর আরোহী আরাফের সাথে মর্গে যায়। এক সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে তাদের।
আরোহী অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে আরাফের দিকে আরাফের দৃষ্টি সামনে সঞ্চিত।
একজন নার্স বয় এগিয়ে গিয়ে দু’জনের উপর থেকে সাদা কাপড় সরিয়ে দিলো। তাদের মুখের একপাশ খুব খারাপ ভাবে থিতলে গেছে। শুধু একপাশ ভালো রয়েছে। আরোহী আব্বু বলে চিৎকার দিয়ে আরমানের উপরে উপচে পরে। মুখের উপর থেকে কাপড় সরানোর পরপরই মিতা, নিপা দু’জনেই একসাথে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় ভয়তে তাদের মুখের একপাশ দেখে ভয়তে হিমহিম করে কাঁপছে মিতা ও নিপা। শুধু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আরোহীর সে কেঁদে কেঁদে বলছে, “ আব্বু আমি বলেছিলাম ন গেলে হয় না?
তুমি কেন আমার কথা শুনে যাওয়া ক্যান্সেল করলে না। আব্বু আমি কি দোষ করে ছিলাম কেনো ছেড়ে চলে গেলে তোমরা দু’জন আমাকে? ও আব্বু কথা বলো না আমার সাথে ওই আম্মো কথা বলো। দু’জনে চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো। কথা বলো। তোমাদের নিরবতা আমার সহ্য হচ্ছে না। ”
শেষটুকু চিৎকার দিয়ে বলল। মাথা তুলে আরমান খানের মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো আরোহী। স্তব্ধ প্রায় দৃষ্টি স্থির তার থিতলে যাওয়া স্থান টায়। চোখ জোড়া উল্টে যাচ্ছে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। চোখের পলকে আরোহী জ্ঞান হারালো পরে গেলো ফ্লোরে। আচমকিত ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো আরাফ ‘আরোহী’ বলে চিৎকার করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলে তার কাছে। পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে মর্গ থেকে বের হয়ে যায়। আরোহীকে গাড়িতে উঠিয়ে বসায় পেছনে সিটে দুইপাশ গেষে বসেছে মিতা নিপা। আরোহী এখনো সেন্সলেস।
আরাফ নিজ দায়িত্ব ডাক্তার ও পুলিশদের সাথে আলোচনা করে লাশ দু’টো লাশবাহী গাড়িতে উঠায়। চলল আবারও তাদের গন্তব্যে গাড়ি চালাচ্ছে অভ্র সে ভেতর থেকে ঠিন নেই কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। কয়েকবার পেছনে ঘুরে সে দেখেছে আরোহীর নিষ্পাপ মুখটা। আড়ালেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলেছে, আরাফ খুব করে চাইছে আরোহীর জেনো জ্ঞান না ফিরে৷ কেননা, আরোহী জেগে উঠলে তাকে সামলানো খুবই কষৃটকর হয়ে যাবে। আরাফ খুব ভালো করেই জানে মা বাবা হারানোর কষ্ট সেও তো এমন পরিস্থিতি পার করে এসেছে। কোনো ভাবেই নিজেকে দূর্বল করতে চায় না আরাফ। তাকে যে আরোহীকে সামলাতে হবে। হুশশ ফিরে আসার পর কেমন রিয়েক্ট করবে তা সবার অজানা কেউ জানে না৷
বাড়ির সামনে আরমান খান ও তার স্ত্রীর লাশ রয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী ও তার অফিসের সকলে এসেছে তাকে শেষ বারের মতো দেখতে তার বিজনেস পার্টনার’রাও এসেছে। সকলে আফসোসের সাথে বলছে স্বামী স্ত্রী দু’জনেই ভালো ছিল।
সকলের সাহায্য আরাফ তাদের জানাজা পড়িয়ে কবরস্থানে নিয়ে যায়। তাদের কবর দেওয়া শেষ হলে বাড়ি ফিরে আসে। এখন তারা তাদের আসল ঠিকানায় শুয়ে আছে। এই সেই ঠিকানা যেখানে সকলকে যেতে হবে। হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, জন্ম হওয়া সকল জীবজন্তুর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
আরোহী কে ঘিরে চারপাশে লোকজন বসে আছে তার এখনও জ্ঞান ফিরেনি। আরাফ বাড়িতে এসে সকলের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে সকলে যার যার বাড়ি চলে যায়। আরোহীর কাছে আছে এখন মিতা, নিপা ও আরাফ। বেলকনিতে একা দাঁড়িয়ে আছে আরাফ তার মনে ভয় এই বুঝি আরোহী জেগে যাবে। আর কোনো না কোনো পাগলামি করবে তাকে সামলাতে হবে। মন ও মস্তিষ্ক দুটোকেই স্থির করেছে আরাফ৷ বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
আরোহীর দুইপাশে বসে আছে মিতা ও নিপা। হঠাৎ আরোহী চোখ মেলে তাকালো। কোনো কিছু না বলেই উঠে বসল। মিতা ও নিপা দু’জনে ঘাবড়ে গেলো। মিতা ভয় পেয়ে যায় হঠাৎ আরোহীর উঠে বসায় চিৎকার দিয়ে উঠে মিতা। চিৎকার শুনে বেলকনি থেকে ছুটে আসে আরাফ। রুমে এসে দেখে আরোহী নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আরাফের দিকে তাকাতে আরোহী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আরাফ ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আরাফের শার্ট খাবলে ধরেছে আরোহী। অষ্টজোড়া বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে। আরোহীর কান্না দেখে মিতা ও নিপাও কান্না জুড়ে দেয়। আরাফ মনে মনে বলতে লাগল, “ একজন কি কম ছিলো? যে এর সাথে আরও দু’জন কান্না জুড়ে দিলো। এবার তো আমারও কান্না পাচ্ছে। ”
সব সময় বকবক করা আরোহী চুপ হয়ে গেলো। পুরো বাড়ি জুড়ে শুধু নিস্তব্ধতা। আরাফ নিজের সবটা দিয়ে আরোহীকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করছে কিন্তু আরোহী আরাফ কিছুক্ষণের জন্য আড়াল হলেই সে তার বাবা মা’র হারিয়ে ফেলেছে সে শোকে ডুবে যায়।
আজ তিনদিন হয়েছে আরোহী আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। গত তিনটা দিন আরাফের জীবনের খুবই ভয়ানক ছিলো প্রতিটা সময় নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে মরতে দেখেছ। কোনো ভাবেই আরোহীকে হারাতে চায় না আরাফ। সে তার মা’কে হারানোর পর যে আজও বেঁচে আছে শুধু আরোহীর মুখটি চেয়ে হয়তো আজ পর্যন্ত নিজের ভালোবাসা মুখে বলতে পারেনি। বলবেই কিভাবে? সে যে চাপা স্বভাবের মনের কথা মুখে বলতে পারে না। আর আরোহী ও তো তাকে বন্ধু ছাড়া কিছু মনে করে না। সেখানে ভালোবাসি শব্দ টা বললে যে তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে হবে হয়তো বন্ধুত্ব ও নষ্ট হয়ে যাবে। নিজের চোখের সামনে আরোহীকে কান্না করতে দেখে নিজেকে খুব কষ্টে সামলিয়েছে আরাফ। আরোহীর চোখ পেয়ে পরা প্রতিটা অশ্রুকণা জেনো আরাফের গা থেকে ঝরে পরা এক একটা রক্তের ফোঁটা।
দু’দিন পর্যন্ত আরোহীর বাড়িতে ছিল নিপা ও মিতা কাল বিকেলে চলে গেছে। তাদেরও তো ফ্যামিলি আছে তাদের ফ্যামিলি তো আর রোজ তাদের মেয়েকে অন্যের বাসায় থাকতে দিবে না। কাল চলে যাওয়ার আগে মিতা নিপা আরোহী কে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু আরোহী কোনো কথাই হয়তো শুনতে পায়নি। সে এখন শুধু নির্ভরশীল আরাফের উপরে আরাফের কথা ছাড়া তার কান হয়তো কারো কথা শুনতে পায় না। তিন বেলা তো আরোহীকে খাওয়ানোই যায় না। সে কোনো কিছু খেতেই চায় না। আরাফের তাকে জোর করে সামনে বসিয়ে বাচ্চাদের মতো নানান কথা বলে বুলিয়ে বালিয়ে খাওয়া তে হয়।
বিকেলে হল রুমে বসে আরোহীর চুলে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো আরাফ তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলো আরোহীর ফুপা, ফুপি তাদের দেখে হাইপার হয়ে গেলো আরোহী।
তারা এসে পায়ের উপর পা তুলে সোফার উপর বসল। আরোহীর ফুপি তার দিকে তাকিয়ে তেজি কন্ঠে বলল, “ বাড়ির লোকারের চাবিকাঠি এনে আমাকে দিয়ে যা। আজ থেকে সবকিছু আমার কাছেই থাকবে৷ বাড়ির সবকিছু আমি দেখবো আর অফিস তোর ফুপায় দেখবো বুঝছোস। ভাইয়া ভাবি তো নাই তাদের জায়গা তো এখন আমাদেরই নিতে হইবো। ”
আরাফ তাদের উদ্দেশ্য কর্কশকন্ঠ ব্যবহার করে বলে, “ আপনার ভাই মারা গেছে আজ তিনদিন হলো। কোই আপনি এসে আপনার ভাস্তির কথা জিজ্ঞেস করবেন। তা না করে এসে সম্পত্তির চাবি চাইছেন? ”
আরোহীর ফুপা মোস্তফা বললেন, “ এই পোলা এত বেশি কতা কও কেরে? বেশি কতা কইলে না এক্কেবারে চাকরি থেকা বাইর কইরা দিয়াম। ”
আঙুল তুলে কথাগুলো বলল। জবাবে আরাফ শাণিতকন্ঠে বলল, “ আমাকে বরখাস্ত করার কোনো রাইট আপনাদের নেই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আরোহীর পাশে থাকার প্রমিস করেছি আমি আরমান আঙ্কেলকে। আপনাদের মতো লোভী মানুষ আমি দু’টো দেখিনি। আসতে না আসতেই টাকা নিয়ে পরেছেন। ”
“ এই পোলা তুমি চুপ করো। আমাদের পারিবারিক ব্যাপার নিয়া তুমি কথা কওনের কেডা? এইসব সয় সম্পত্তি আমার ভাইয়ের আমার ভাই মইরা গেছে এহন এই সব আমাগো। তুমি বাইরের মানুষ বাইরের মতো থাকো। ” আরোহীর ফুপি বললেন।
স্তব্ধ আরোহী তাকিয়ে আছে আরাফের দিকে আরাফ একনজর আরোহীর দিকে তাকিয়ে সরু কন্ঠে বলল, “ আপনারা হয়তো জানেন না। আঙ্কেলের নতুন উইলের সম্পর্কে আমি উনার উকিলকে কল দিচ্ছি উনি আসলে উনার সাথে সরাসরি কথা বলে সবটা ক্লিয়ার হয়ে নিবেন। কে বাইরের আর কে ঘরের পরেই বুঝতে পারবেন। ”
বলে আরাফ প্যান্টের পকেট থেকে তার ফোনটি বের করল। কল দিলো উকিলের নাম্বারে কয়েকবার কল রিং হলে সে কল রিসিভ করে। এদিকের ঘটনা উনাকে জানালে উনি বলেন, সে দশ মিনিটে আরোহীর কাছ আসছে। আরাফ ফোনটা আগের ন্যায় প্যান্টের পকেটে গুঁজে রেখে তাদের উদ্দেশ্য বলল, “ দশ মিনিট অপেক্ষা করুক উনি আসছে। ”
দশ মিনিটের আগেই উকিল নাছির হাসান এসে উপস্থিত হয়। সে আরোহীর ফুপির উদ্দেশ্য বলেন, “ আপনার ভাই আরমান খান সে তার মৃত্যুর দুইমাস আগে নতুন উইল বানিয়েছেন। সেখানে লেখা আছে কোনো দূর্ঘনায় যদি তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর ওর উনার সব সম্পত্তি উনার মেয়ে হুমাইরা বিনতে আরোহীর নামে ট্রান্সফার হবে। এখন আরমান খানের সকল সম্পত্তির এক মাত্র ভাগিদার ও মালিক মিস হুমাইরা বিনতে আরোহী। আর এরমধ্যে আপনারা কেউ যদি জোর করে সম্পত্তির ভাগ বসাতে আসেন। তাহলে মিস হুমাইরা বিনতে আরোহী আপনাদের নামে কেস করতে পারবেন। আর মিস হুমাইরা যদি দয়া করে আপনাদের উনার বাড়িতে থাকতে দেন। সেটা তার নিজস্ব ব্যক্তিগত ডিসিশন। এখানে কারো কোনো জোর জবরদস্তি চলবে না। ”
আরাফ আরোহীর উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ে, “ তুমি কি চাও উনারা তোমার বাড়িতে আশ্রিত থাকুক আরোহী? ”
আরোহী চোখ দু’টো ছোটছোট করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথা দুই দিকে ডানে বামে দুই বার নাড়ালো মানে হচ্ছে আরোহী চায় না তারা এখানে থাকুক। আরোহীর মাথা দুলালো দেখে দু’জনে রাগে হাত মুঠি বন্ধ করে নেয়। আরাফ উকিলের সামনে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে, “ মিস আরোহী চায় না আপনারা এখানে থাকুক। তাই দুঃখের সহিত জানানো যাচ্ছে আপনারা এখন আসতে পারেন। ”
আরাফের কথায় সাই দিয়ে উকিল নাছির হাসান বললেন, “ মিস হুমাইরা চায় না এখানে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আপনারা বরং আসুন। ”
অপমানে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। উকিল বিদায় নিয়ে চলে যায়। বলে যায় এরপর যদি এমন হয় তাহলে তাকে জেনো সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়।
উকিল চলে যাওয়ার পর আরোহী আরাফকে বিস্মিত করে দেয়। হঠাৎ করে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আরাফ বিস্ময় নিয়ে বলল, “ তারা চলে গেছে ভয় পাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। ”
আরাফের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আরোহী বলে উঠল, “ সবাই চলে গেছে। অথচ তুমি কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছো। কথা দাও আরাফ তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। আরাফ কখনো ছেড়ে যেও না প্লিজ ”
আরাফ আরোহীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “ কথা দিচ্ছি, মৃত্যু ছাড়া তোমার থেকে আমাকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। ”
__________
হল রুমে সোফার সামনে থাকা কাঁচের টেবিলের উপর লাণ্থি মারল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাত থেকে আটজন মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠল।
মাটির ফুলদানি সজোরে ফ্লোরে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে হুংকার দিয়ে বলল, “ মরার পাখনা গজিয়েছে, মরার মাখনা গজিয়েছে, মরবে মরবে। আমি আসছি তোর মৃত্যু হয়ে। ”
বলেি সে তার পৈশাসিক হাসি দিলো। তার হাসির শব্দে তারই পোষা কুকুর ভয়ে সোফার আড়ালে লুকিয়ে পরল।
#চলবে?
(কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ)