বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_৬

0
884

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_৬

আমি মাথা নিচু করে রইলাম, হেমন্ত ভাই আমার পাশে এসে পিঠ চাপড়ে বলল,
—তুমি দারুণ গান করো সাহিত্য!
বৃতি জ্বলে উঠলো,
—বুবু তো ওকে ভালোবাসে এজন্য ওকেই গান শিখিয়েছে আমাকে শেখালে আমিও পাড়তাম, হুহ।
হেমন্ত ভাই স্বভাব সুলভ হাসলো তুলন হেমন্ত ভাইকে বলল,
—আমি খোজ নিয়ে জেনেছি হেমন্ত ভাইও খুব ভালো গান করে
হেমন্ত ভাই বুবুর দিকে তাকালো,বুবু আসন দিয়ে বসে আমাকে বললো,
—আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ো তো সাহিত্য
আমি চুপচাপ তাই করলাম, বুবু আমার চুলে হাত বুলিয়ে চুল টেনে দিতে দিতে বলল
—দাদাই তোমার বন্ধুকে বলো গান শোনাতে আমিও দেখি তুলনের নেওয়া খোজ সঠিক কি না,
হেমন্ত ভাই অবাক হয়ে বুবুর দিকে তাকালো বৃতি উঠে গিয়ে হেমন্ত ভাইয়ের পাশে বসে বলল,
—হেমন্ত ভাই তুমিও গান গাও! কই তুলন আপা আমাকে তো কখনো বলে নি!
হেমন্ত ভাই লজ্জা পেয়ে বললো,
—ছোটবেলায় টুকটাক শিখতাম কখনো সেভাবে গাওয়া হয় না,
দাদাই হাই তুলতে তুলতে বলল,
—আগে গাইতে বললে কোন বিশেষ মানুষ কে শোনাবে বলে গাইতো না, আগে তো বুঝতাম না সেই বিশেষ মানুষ আমার ছোট বোন,
বুবু হেমন্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো চোখ নামিয়ে নিলো না।
আমি ছোট্ট করে বললাম
—এমন একটা গান গাও তো হেমন্ত ভাই যাতে মনে হয় তুমি বুবুর জন্য গাইছো…
হেমন্ত ভাই বুবুর থেকে নজর না সরিয়ে গাইলো,

শোন বলি কানে কানে
কিছু কথা গানে গানে
তুমি যে আমার কামনা
কত জীবন মরণ সাধনা

কোনদিন নদী যদি থেমে যায়
সাগরকে কাছে যদি না’ই পায়।।
আমি চলবোই,ভালোবাসবোই
আমি চলবোই,ভালোবাসবোই
হারবোনা কিছুতেই না।

পাহাড়ের বাহারে বাহারে
কত সুর আছে যে আহারে।।
তুমি তার চেয়ে আরো সুন্দর
তুমি তার চেয়ে আরো সুন্দর
তুমি তোমারি তুলনা

চাঁদ যদি ডুবে যায়,যাকনা,
মেঘে ঢাকা তারা পড়ে থাকনা।।
তুমি যতদিন আছো পাশে মোর
তুমি যতদিন আছো পাশে মোর
করিনা আলোর ভাবনা।

শোন বলি কানে কানে
কিছু কথা গানে গানে
তুমি যে আমার কামনা
কত জীবন মরণ সাধনা।।

আমি তুলনের দিকে চেয়ে রইলাম তুলন চোখ সরিয়ে নিলো হয়তো এবার বুঝতে পারছে হেমন্ত ভাই বুবুকে কতটা চায় কেন চায়…আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।বুবু আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
—একটা গান গাইতে বলব গাইবে সাহিত্য?
আমি চোখ বন্ধ রেখেই বললাম
—তুমি বললে আমি এক বসায় একশ টা গান ও গাইতে পারি,
—একশ টা গাইতে হবে না তুমি রবীন্দ্রনাথের যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ওই গান টা গাও তো।
আমি চোখ খুলে বুবুর দিকে শান্ত চোখে তাকালাম
—এই গান টা কেন গাইবো?
—আমি তো গান জানিনা সাহিত্য গান পারলে এখন এই গান টা গাইতাম
—না এই গান আমি গাইবো না
—প্লিইজ?
আমি আবার চোখ বন্ধ করে গাইলাম,

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে –
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় –
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।

আমি গানটা গাইলাম ঠিকই কিন্তু আমার খুব কষ্ট হলো, আমার বুবুর এত কিসের কষ্ট, কেন সে সব সময় এরকম দুঃখী হয়ে থাকে? কেন?তার মতো এমন চমৎকার একটা মেয়ে যে আর কোত্থাও নেই এই কথা কি সে বোঝে না?তারপর সবাই টুকটাক আরো কিছু আলাপ করলো আমি আর কোনো গল্পে যোগ না দিয়ে চোখ বন্ধ করেই চুপচাপ রইলাম একসময় আসর ভাঙলো, বুবু আমায় ডাকল তুলনকে পার করে দিতে আমি উঠলাম না পরে বুঝলাম হয়তো দাদাই পার করে দিলো,সবাই নিচে নেমে যাবে আমায় ডাকত্র চাইলে বুবু বলল,
—তোমরা যাও ভোর হতে খুব বাকি নেই আমি থাকি,
দাদাই আপত্তি করলো কিন্তু বুবুর কথার উপর আর কে কথা বলে আমি জানি বুবুর কষ্ট হবে তাও উঠলাম না, সবাই নিচে নেমে গেলেও কিছুক্ষণ পর হেমন্ত ভাইয়ের গলা পেলাম,হেমন্ত ভাই একটা বালিশ নিয়ে এসেছে বুঝলাম সে আমার পাশে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো, কিছুক্ষণ নিরবতার পর বুবু বলল,
—তুলন কিন্তু কিছু ভুল বলে নি,আপনি এমন একটা ব্যাক্তিত্বের মানুষ আপনার জন্যে এখন চাইলে মেয়েদের লাইন পড়ে যাবে,দেশে বিরাট একটা কম্পানিতে আপনি অফার লেটার পেয়েছেন,আপনার মায়েরও আমায় খুব একটা পছন্দ নয়,আপনি কেন বলুন তো আমার জন্যে এখনো অপেক্ষা করছেন?
কিছুক্ষণ হেমন্ত ভাই কিছু বলল না, বুবুও চুপচাপ তারপর হেমন্ত ভাই বললেন
—তোমাকে আমি তখন থেকে চাই যখন আমি চাওয়ার মানেও বুঝতাম না আমার অনুভূতির প্রথম দখলদারিত্ব নিয়েছো তুমি,আমি যে কাল রাতে দেশে এসেছি এ কথা একই এলাকায় থেকে আমার পরিবারের কেউ জানেনা সবার আগে যে জানে সে তুমি,আমি খুব শান্ত একটা ছেলে তবুও আমার পরিবারে আমার একটা অদৃশ্য দাপট আছে, আমার ব্যাক্তিত্ব যে কারো কাছে পছন্দনীয় তবুও আমি তোমার জন্যে বেহায়া হয়ে যাই,পাগলামি করি, আট ঘন্টা জার্নি করে এসে আরো আট ঘন্টা তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।একসময় ভাবতাম এই তুমি ধরা দেবে এই তুমি বুঝবে ভালোবাসবে ওসব এখন আর ভাবি না এখন আমার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে অপেক্ষায় এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে জানো? প্রাপ্যের চেয়েও প্রাপ্তির অপেক্ষায় অনেক সুখ,আমি জানি যে যদি তুমি আসো কোনোদিন ভালোবাসো তাহলে সেটা আমিই হবো এই অনুভূতি আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না,এখন আর তোমার কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তুমি যা করো সেটাই আমার প্রাপ্তি, আমার ভাবতে ভালো লাগে একদিন তুমি ধরা দেবে, তোমার মত চমৎকার একটা মেয়ে একমাত্র আমার হবে, তোমার সমস্ত দুঃখ আমি শুষে নেবো, তোমার মনের মাঝে যে উথালপাথাল ঝড় বয়ে যায় সবসময় যা তুমি একা মোকাবেলা করো এক সময় তা আমরা এক সাথে পাড় করব।একসময় আসবে আমি দুজন দুজনকে ভালোবাসবো,একদিন তুমি মন খুলে সবটা বলবে আমি শুনবো।একদিন তুমি আপনি থেকে আমায় তুমি বলে সম্বোধন করবে।

হেমন্ত ভাই খুব বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,আমার মুখের ওপর একফোটা পানি পড়লো আমার বুকের মধ্যে কেপে উঠলো বুবু কি কাদছে! আমি শেষ কবে বুবুকে কাদতে দেখেছি!আমার বুবু কাদতেও জানেন!বুবু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,খুব ছোট করে বলল,
—উঠে বসো তো হেমন্ত বালিশ টা দাও আমার পায়ে ব্যাথা করছে,
হেমন্ত ভাই লাফিয়ে উঠলো আমার মাথা খুব সাবধানে বালিশে রাখলেন। বুবু আমার মাথা থেকে হাত না নামিয়ে বলল,
—তুমি দেখো তো হেমন্ত সাহিত্যের মুখে এক অদ্ভুত মায়া আছে কি না?এই ছেলেটা আমাকে পাগলের মতো ভালো বাসে ওর তিন লাইনের কথায় দেড় লাইন থাকে বুবু, আমার জন্মদাতাও আমায় খুব ভালোবাসে আমার দাদাই আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না,আমি এমনই আমার মধ্যে কোনো মায়া নেই মমতা নেই কোনো কৃতজ্ঞতা নেই।
—তুমি যে ভালোবাসার মতোই একজন এ কথা কি বোঝো?
বুবু বিদ্রুপ কণ্ঠ নিয়ে বলল,
—তাই নাকি?
—তুমি কি এখনো প্রান্তকে নিয়ে ভাবো?
বুবু ঝংকার দিয়ে উঠে বলল,
—আমি তাকে কখনোই ভাবি না, কখনোই না।
—আচ্ছা বেশ, ভাবো না তুমি উত্তেজিত হইও না প্লিজ।
—কিছু কিছু ক্ষত খুব গাঢ় কাউকে বলা যায় না আমরা আড়াল আবডাল করে রাখতে চাই,
—বেশ বলতে হবে না।
বুবু ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— সকাল আমার সবচেয়ে প্রিয় চলো সকাল দেখি, আমার সাথে সকাল দেখবে?
—অবশ্যই দেখবো,তুমি না রেগে গেলে আমি কি একটা কথা বলব?
—হুউ বলো
—কাল রাতে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো জানো? আমি চেয়েছিলাম এক পলক তোমাকে দেখে বাসায় যেতে কিন্তু তুমি জেদ করে দেখা দাও নি,আমারো কি হলো আমি রাগ করে এখানেই থাকলাম অপেক্ষা করলাম দেখো!আমার এক রাতের অপেক্ষার শেষে যদি আজ সারাদিনের মত সুন্দর দিনটা পাই এমন একটা রাত পাই যেখানে তোমার পাশে জেগে কাটানো যায় তোমার সাথে সকাল দেখা যায় তাহলে ভাবো আমার আগের ছয় আর এখন দুই আট বছরের অপেক্ষার সুখ হবে কতটা! আমি সইতে পারব তো?
আমি তাকিয়ে দেখলাম
বুবু উঠে দাড়ালো, হেমন্ত ভাই বুবুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলছে
—তুমি কিন্তু বলেছ রাগ করবে না,পুষ্প কিন্তু কখনো কথার খেলাফ করে না।
বুবু বসে রইলো সকাল না হওয়া পর্যন্ত বসে রইলো আমি তারপর সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম আজ আমার সকাল না দেখলেও চলবে আজ সকাল দুজন মানুষকেই দেখুক ভালোবাসার তৃষ্ণায় অপেক্ষারত একজন মানুষ কে আজ সকাল দেখুক তার ভালোবাসার মানুষের পাশে বসে থাকতে।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here