বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_২
বুবু খুব সুন্দর করে চা খায়, চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলে মনে হয় কত তৃপ্তি তার চোখে মুখে!
—আচ্ছা বুবু তুমি রাতে ঘুমাওনি কেন তোমার কি পরীক্ষা?
বুবু ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
—সাহিত্য তুলন একটু পরপর উকি দিচ্ছে কেন বলোতো?
আমি একটু বিষম খেলাম তুলন যে উকি দিচ্ছে একথা সত্যি কিন্ত ও তো বুবুর উল্টো পাশে বুবুর তো বোঝার কথা নয়,বুবু স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলল,
—চিন্তা করো না আমার কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি নেই প্রান্ত ভাইদের থাই গ্লাসে ওর অবয়ব দেখা যাচ্ছে তুমি অযথা ঘাবড়াচ্ছো কেন?
আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম, তারপর খুব সহজভাবে বুবু আমার লেখাপড়া এবং গানের খোজ খবর নিলো,
হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো আমাদের বাড়ির সীমানা পেরিয়ে গেটের পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে!
—বুবু ওইটা হেমন্ত ভাই না!
বুবু সে দিকে না তাকিয়েই হাই তুলতে তুলতে বলল
—হবে হয়তো
—কিন্তু হেমন্ত ভাই বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছে!মা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন!
বুবু আয়েশ করে চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ গুছিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
—আমি এখন ঘুমাবো সাহিত্য তোমাকে একটা কাজ দেব করতে পারো?
—অবশ্যই পারি!তুমি বললে আমি ছাদ থেকে লাফও দিতে পারি
—ছাদ থেকে লাফ দিতে হবে না,আমি ঘুমাতে যাবো তুমি খেয়াল রাখবে কেউ যাতে আমায় না ডাকে, ঠিকাছে?
আমি উপর নিচে দ্রুত মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম,
—বুবু হেমন্ত ভাই কি বাইরেই দাড়িয়ে থাকবে!
—সেটা তার ইচ্ছে আমি তো তাকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে বলি নি,
বুবু ছাদের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল,
—এক কাজ করো তো সাহিত্য তুমি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে তোমার হেমন্ত ভাইকে ভেতরে আসতে বলো আমি ফ্লাক্সে চা করে রেখেছি তাকে খেতে দাও বেচারা সারারাত মনে হয় কিছু খায় নি,দাড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছে খুব বিধ্বস্ত লাগছে এক কাজ করো চায়ে বেশি করে চিনি গুলিয়ে দিও গ্লুকোজ পাবে, আর মা কে বলবে খুব বেশি আদিক্ষেতা করতে হলে সে যেন একাই করে অযথা আমাকে ডাকাডাকি করবার দরকার নেই, ঠিক আছে?
এবার আর আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না,মানে কি হেমন্ত ভাই সারারাত বাইরে দাড়িয়ে ছিল!
আমি নিচে নেমে এসে দেখলাম হেমন্ত ভাই প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাড়িয়ে সিগারেট ফুকছেন, আমাকে দেখে সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে তা ফেলে দিলেন,এলোমেলো চুল, চোখমুখ শুকনো একদম কাহিল লাগছে তাকে
—হেমন্ত ভাই ভেতরে আসুন,
—তোমার বুবু…
—বুবু বলেছেন আপনাকে ভেতরে গিয়ে চা খেতে
—তোমার বুবু কি করে সাহিত্য? তার কি মেজাজ খুব খারাপ
—না! মোটেই না তো বুবু তো মাত্রই আমার সাথে বসে চা খেলো গল্প করলো খুব স্বাভাবিক ভাবে! কিছু কি হয়েছে ভাইয়া!
হেমন্ত ভাই মুখ শুকনো করে বলল,
—কিছু হয় নি,সাহিত্য আমি বরং আজ আসি।
—হেমন্ত ভাই আপনি যদি বুবুর ওপর অভিমান করে চলে যান বুবু কিন্তু খুব কষ্ট পাবে
—তোমার বুবু কষ্ট পায় না সাহিত্য, সে কেবল কষ্ট দিতে জানে,
আমি মাথা নিচু করে, বিড়বিড় করে বললাম
—কত কষ্ট পাওয়ার পর যে সে আর কষ্ট পাবার পর যে আমার বুবু আর কষ্ট পায় না তা তো আপনি জানতেন!
হেমন্ত ভাই একবার অসহায়ের মতো আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর নিজেই বাড়ির ভেতর ঢুকে গিয়ে আম্মাকে ডাকতে লাগলেন,
—মামনি, ও মামনি সকালের কি নাস্তা হয়েছে? খুব খিদে লেগেছে দ্রুত খেতে দাও আমার এত সময় নেই কিন্ত বলে দিলাম,
আমি হালকা হাসলাম এইতো এটাই হেমন্ত ভাই যে বুবুর জন্যে সব করতে পারে আমি ভেতরে গিয়ে বুবুর কথা মতোন হেমন্ত ভাইকে চা দিতেই তার মুখে কিছুক্ষণ আগে থাকা কাঠিন্য দূর হয়ে গেলো, আম্মা আবার হাক ডাক শুরু করলেন
—পুষ্প,বৃতি! স্বাধীন কই তোরা দেখ হেমন্ত এসেছে, স্বাধীনের বাবা স্বাধীনের বাবা কই, বলি তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো নাকি!
আমি তাড়াতাড়ি আম্মার কাছে গিয়ে বললাম
—আম্মা খবরদার চিল্লাবেন না বুবু কিন্তু খুব রাগ করবে, বুবু বলেছে সে ঘুমাবে কেউ যেন না ডাকে
আম্মা বজ্রাহত হয়ে বলল,
—হেমন্ত এসেছে সে ঘুমাচ্ছে এ কেমন কথা!তার তো জানতে হবে হেমন্ত এসেছে!কতদিন পর ছেলেটা এলো! কতদূর থেকে এসেছে বলো তো!
—আম্মা আপনি তো জানেন বুবু রেগে গেলে কি হবে আপনি কি চান সে এমন কিছু করুক যাতে হেমন্ত ভাইয়ের এত দূর থেকে আসাটাই বৃথা হয়ে যাক?
আম্মা এবার চুপ করে গেলেন
—বেশ বাবু তুমি একটু বৃতি কে ডেকে দাও সে আমায় রান্নায় সাহায্য করুক।
—আম্মা বৃতি ঘরে নেই সে বাইরে গেছে
—বাইরে কোথায় গেছে!
—তুলনদের বাসায়
—তুলনদের বাসায় তার কি!
আমি আর কিছু বললাম না চুপ করে গেলাম, এখানে কথা বলে কোনো লাভ নেই আম্মা নিজের মনেই বকতে লাগলো
—স্বাধীন কই,এ বাড়িতে কি কেউ আমার কথা শুনবেই না! নাকি!
আমি হেমন্ত ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম তার চোখমুখে আর ক্লান্তি নেই,
বুবু ধুপ করে বাইরে এসে ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,
—সাহিত্য আমি তোমাকে বলেছি আমি ঘুমাবো এবং এর মধ্যে কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে একটুও না,
আম্মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বুবু আম্মার দিকে তাকিয়ে বলল,
—কিছু বলবে আম্মা?
আম্মা আর কিছু বললেন না।বুবুও ভেতরে গিয়ে আস্তে দরজা লাগিয়ে দিলো।
বুবু সারা সকাল সারা দুপুর দরজা খুললো না সে বিকেলে বের হলো আমরা অনেক বলেও হেমন্ত ভাই কে কিচ্ছুটি খাওয়াতে পারি নি,আমরা সারা দুপুর না খেয়ে রইলাম দাদাই বাড়ি ফিরলো না,সারা দুপুর বাড়িটায় একটা ঝিমঝিম ভাব রইলো,বুবু বের হলো বিকেলে আম্মার মুখ দেখে মনে হলো তিনি নিশ্চয়ই আজ বুবুকে কিছু কঠিন কথা শোনাবেন, কিন্তু বুবুকে দেখে কেউ কিছু বলতে পারলো না, বুবু লাল পাড়ের সাদা একটা কাতান শাড়ি পড়ে বের হলো সদ্য গোসল করে চুল ছেড়ে দিয়েছে দুই হাত ভর্তি লাল সাদা চুড়ি পড়া হালকা গোলাপি ঠোট চোখে কাজল টানা, বুবুকে দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো বুবু শেষ কবে এভাবে সেজেছে আমার মনে নেই আচ্ছা বুবুর যেদিন বিয়ে হবার কথা ছিলো সেদিন কি সে এভাবে সেজেছিলো? তাকে কি এত সুন্দর লাগছিলো? বুবু ড্রয়িং রুমে এসে দাড়াতেই হেমন্ত ভাই দাড়িয়ে গেলো, আমি দেখলাম আম্মা অবাক হয়ে বুবুর দিকে তাকিয়ে আছে, আব্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে,আব্বা চোখের জল আড়াল করে ভেতরে চলে যেতে গেলে বুবু কঠিন কন্ঠে বলল,
— দুপুরে খেয়েছেন আপনি?
আব্বা দাঁড়িয়ে গেলেন আম্মা দ্রুত আপার কাছে এসে বলল,
—আমরা কেউই খাই নি, তুই খাস নি যে…
—সবাই টেবিলে বসো আমি ভাত বাড়ব এখন, হেমন্ত তোমাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হলো খেয়ে ফ্রেশ হবে আমি তোমার সাথে বের হবো,
বলেই বুবু ডাইনিং এর দিকে চলে গেলো আমাদের ঘোর কাটতে কিছুক্ষণ লাগলো, সেদিন দুপুরের খাবার বিকেলবেলা আমরা খুব তৃপ্তি করে খেলাম, অনেক দিন পর! আপা হেমন্ত ভাইয়ের সাথে বাইরে বেরিয়ে গেলো,আমি ছাদে এসে দাড়ালাম যতদূর দুজনকে দেখা যায় তাকিয়ে রইলাম সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে দুটো মানুষ হেটে যাচ্ছে, একজন মানুষ আজ মাত্রাতিরিক্ত রকমের অবাক তার পাশের মানুষের দিকে বার বার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, বুবু সামনের দিকে তাকিয়ে হাটছে হেমন্ত ভাই সম্ভবত রিক্সা নিতে চাইলো বুবু বাধা দিলো বরাবরই বুবু খুব হাটতে পছন্দ করত, হেমন্ত ভাই আর বুবু পাশাপাশি হাটছে হেমন্ত ভাইয়ের কি ইচ্ছে করছে না এরকম একটা সন্ধ্যেবেলা বুবুর হাতটা ধরতে, তার কি কখনো সাহস হবে? সে কি অধিকার পাবে বুবুর হাতটা ধরার?না ধরতে পারলেই কি এই যে বুবুর পাশে সে হাটতে পারছে এতেই তো তার সারারাত জেগে থাকা স্বার্থক হবার কথা, বুবুকে কি কখনো তার এভাবে পাওয়ার কথা? আমার বুবুর কি এরকম কঠিন হওয়ার কথা ছিল কখনো! আমার বুবুও তো স্বাভাবিক ছিল একদম স্বাভাবিক আমার বুবুর সাথেই কেন এমন হলো!
চলবে….
সামিয়া খান মায়া