বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_১

0
1616

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_১
সচারচর ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙে না আমার ঘুম ভাঙে বেলা করে,বুবুরও পরে,আমাদের বাড়িতে সবার ৫ টার দিকেই ঘুম ভেঙে যায় কেমন অলিখিত নিয়মের মতো,আমার আর বুবুর ঘুম ভাঙে দেরি করে,ক্লাস না থাকলে বুবু নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে ওঠে দেরি করে, আম্মার কাছে এর জন্য তাকে কম কথা শুনতে হয় না অবশ্য।৬ টার দিক ঘুম ভাঙার পর আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারি নি অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঠিকই উঠে পড়েছি,এক কাপ চা খাওয়া দরকার ভেবে রান্নাঘরে গেলাম…. আম্মাকে পেয়েও গেলাম রান্নাঘরে তিনি এখন কি করছেন কে জানে হয়তো গোছানো তাক আবার গোছাচ্ছেন কিছু মানুষ খুব গোছালো হয় আমার আম্মা তেমনই একজন মানুষ, চমৎকার একজন মানুষ আমার আম্মা। নিজের মা বলে বলছি না নোবেল পুরষ্কার আমার আয়ত্তে থাকলে, আমার বাবার সাথে সংসার করার জন্য, আমাদের চার ভাইবোন কে সহ্য করার জন্য এই পাগল খানাকে সংসার বানানোর জন্যে আমি নোবেল টা তাকেই দিতাম।কিন্তু আলফ্রেড নোবেল আগে জন্ম নেওয়ায় তার সাথে সখ্যতা টা হয় নি তাই নোবেল টা আর পাওয়া যাচ্ছে না,রান্না ঘরের সামনে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করতেই আম্মা বললেন
—চা খাবে বাবু?
আমি মুচকি না হেসে পারলাম না, এই মহিলা আমাকে এত ভালো বোঝেন, একবার আমার বসন্ত হয়েছিল,সাথে খুব জ্বর,কিচ্ছু খেতে পারতাম না এই সময় নাকি মিষ্টি খেতে হয় আম্মা ৫ পদের মিষ্টি আনিয়ে রেখেছিলেন আমার ঘরে বরাবরই আমি চুপচাপ স্বভাবের মনের কথা মুখ ফুটে কখনোই বলি না আম্মা হুট করে আব্বাকে বললেন এক্ষুনি বাজারে গিয়ে যেন বেদানা কিনে আনেন,অদ্ভুত ভাবে তখন আমার বেদানাই খেতে ইচ্ছে করছিল।
—খেতে পারি এক কাপ, আপনি এত সকালে রান্নাঘরে কি করছেন?
মনে হলো একটা ভুল করে ফেললাম এবার নিশ্চয়ই আম্মা বুবুকে বকবেন আর শুরু হবে তার সহজ বাংলায় বলতে গেলে প্যাচাল।এই হলো ওনার সবচেয়ে বড় দোষ একবার যদি কথা বলতে শুরু করে তবে আর থামেন না।শুধু তাই না তার গলার স্বর বেলার সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে এবং সবটা দোষ শেষ কালে গিয়ে পড়ে বুবুর ঘাড়ে,আম্মার চেচামেচিতে আমার বিশেষ অসুবিধা হয় না কিন্তু ওই যে কথা বুবুকে শুনতে হয় এটাই আমার অপছন্দের, এজন্য আমি চেষ্টা করি পারতিমানে আম্মার সাথে কথা না বলার অথচ আম্মা আমাকেই সবচেয়ে বেশি স্নেহ করেন,মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান তবে ঐ যে ভালোবাসা বোঝা যায়।
—আমার কি আর সেই কপালরে বাবু?কে বলবে আমার বাড়ি ২৩ বছর বয়সী বিয়ের যোগ্য একটা মেয়ে আছে, না না যার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, আজ বাদে কাল যার বিয়ে সে নাকি ঘরের কোনো কাজ পারে না ওঠে বেলা ১০ টায় নবাব নন্দিনী তো, জমিদার কন্যা ওর বাবা ৪/৫ টা বান্দী রাখছে কাজ করার জন্য
উহুহ আর শোনা সম্ভব না, ছাদের দিকে যাওয়া যেতে পারে এখন আর চা খেতে ইচ্ছে করছে না
—চা খাবে না বাবু?কোথায় যাচ্ছ?
—খেতে ইচ্ছে করছে না আম্মা বাসি মুখে কেমন বমি পাচ্ছে
—সে কি বমি পাচ্ছে এসিডিটি নাকি বাবু?ওষুধ খাবে, নবাব নন্দিনী কে ডেকে বলোতো তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে দেখে দিক,কাম কাজ না করুক পড়ালেখায় তো ষোল আনা শুনে আসো ওষুধ খেতে হবে কি না।
—আহা আম্মা সবসময় আপনি বুবুকে নিয়ে এভাবে বলবেন না….আমার খুব খারাপ লাগে।
মুহূর্তে আম্মার মুখটা কালো হয়ে গেলো তিনি চুপ হয়ে গেলেন,আরেকটা ভুল করে ফেললাম আম্মা আবার আমার একটু কড়া কথা সহ্য করতে পারেন না আজ সারাদিন তিনি এরকম চুপচাপ থাকবেন একপদের নিরামিষ রান্না করবেন তা আবার বুবু খেতে পারবে না সব মিলিয়ে আবার সেই কষ্ট টা বুবুই পাবে আর এর কারণ টা আমিই হবো। এখন আম্মার সাথে কথা বলে লাভ হবে না তিনি মুখে বলবেন রাগেন নি কিন্তু আসলে তিনি অভিমান করে আছেন।
আমি ছাদের দিকে পা বাড়াতে যাবো তার আগেই দেখলাম ঘর থেকে বুবু হাই তুলতে তুলতে বের হচ্ছে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে বলল,
—তোমার খারাপ লাগছে নাকি সাহিত্য?
আমি যত দ্রুত সম্ভব মাথা ঝাকিয়ে বললাম
—না না বুবু একটুও না কি যে বলো!বুবু তুমি এতো সকালে ঘুম থেকে উঠলে যে আজ!ক্লাস আছে নাকি?
—ঘুম থেকে উঠি নি, কারণ ঘুম থেকে উঠতে হলে ঘুমুতে যেতে হয়,আমি এক কাপ চা খেয়ে ঘুমুতে যাবো।তুমি চা খাবে?
আমি একটু ভয়ে ভয়ে বললাম,
—জ্বী বুবু আমি চা খাবো,বুবু তুমি কি আমার সাথে ছাদে বসে চা খাবে?
—তুমি যাও আমি আসছি।
আমি ছাদের দিকে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম,আকাশপাতাল অনেক কিছুই ভাবতে লাগলাম আমার বুবুটা ঠিক কি রকম!কত চমৎকার! তার ব্যাক্তিত্ব এত সুন্দর! সে আমার একমাত্র আদর্শ।এই পৃথিবীতে বুবু একমাত্র মানুষ যার কথা মতো আমি সব করতে পারি সব। বুবু যদি বলে সাহিত্য তুমি এই মুহুর্ত থেকে গান গাওয়া ছেড়ে দাও আমি আর একদিনের জন্যেও গান গাইবো না কোনোদিনও না অথচ গান ছাড়া আমি আমার জীবন কল্পনাও করতে পারি না। এই ২১ বছরের জীবনে একমাত্র গানই আমার মন খারাপের সঙ্গী। আমার অবশ্য আরো একজন মন খারাপের সঙ্গী আছে এখন ছাদে উঠলে কি তার দেখা পাওয়া যাবে?তার তো খোলা আকাশ খুব পছন্দের সকাল বেলার আকাশ সন্ধ্যের আকাশ কি অদ্ভুত করে সে আমার কাছে আকাশের গল্প শোনায়!একদম ছেলে মানুষি করে।ছাদের দরজায় দাদাই এর সাথে দেখা হয়ে গেলো দাদাই কেমন মুখ শুকনো করে নেমে গেলেন কি হলো! দাদাই তো এমন না,আমি আনমনে আমাদের তিনতলার শ্যাওলা পড়া ছাদে হাটতে হাটতে একদম কোণার দিকে দাড়ালাম আমাদের ছাদটায় কোনো রেলিং নেই মাঝে মাঝে এই দিকটায় আসলে ভয় লাগে যদি পা পিছলে যাই!পাশের ছাদ থেকে শোনা গেলো,
—ঝাপ দেবে নাকি সাহিত্য?
বলেই কাচভাঙা শব্দে হেসে উঠলো হাসিটা আমার পরিচিত আমি জানি এইটা তুলন, আমি চশমাটা খুলে গেঞ্জিরে এক কোণা দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম
—আমার বুবু বলে আত্মহত্যা মহাপাপ তুলন।
—এটা শুধু তোমার বুবু বলে না এটা সবাই বলে, তোমার সাথে একটা বাক্যের কথা বলতে গেলে সেখানে তিনটে শব্দই থাকে তোমার বুবুক্র নিয়ে কেন বলোতো!সারাদিন এত বুবু বুবু করো কেন?

আমি তুলনের সামনে থেকে সরে এলাম এখন ওর সাথে আমার আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না, তুলনকে আমার সব দিক দিয়েই ভালো লাগে শুধু ও বুবুকে নিয়ে কিছু বললে আমার সহ্য হয় না, ও মাঝে মাঝ্র বুবুর মুখের উপর ও কথা বলে ফেলে! কতবড় সাহস ওইটুকু মেয়ের!এক্ষুনি বুবু চা নিয়ে আসবে ওর সাথে কথা বাড়ালে দেখা যাবে ও আবার বুবুর মুখে মুখে তর্ক করবে,তার চেয়ে থাক তার আকাশের গল্প না হয় আমি অন্যদিন শুনব…

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here