ক্যামেলিয়ান ১২+১৩

0
1280

#ক্যামেলিয়া
#পর্ব-১২+১৩
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

(৩০)
ঈশানের মুখে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল জাফরিন। তার কানে শুধু বাজতে থাকলো ঈশানের বলা কথাগুলো।

” সেই দশ লাখ টাকার সাথে আরও পাঁচ লাখ টাকা যুক্ত করে তোমার সম্মান কিনে নিয়েছে তোমার ইউভান।একবার তোমার বাবা দিয়েছে আবার ইউভান গতকাল। কী দামী তোমার সম্মান জাফরিন।এক সম্মান বাঁচাতে দুই জন কত কত টাকা দিয়ে দিলো।”

ফোন হাতে নিয়ে জাফরিন কল দিলো ইউভানকে। ইউভান তখন রান্নার জিনিসপত্র তদারকি নিয়ে ব্যস্ত। জাফরিনের কল পেয়ে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো সে। কল রিসিভ না করে ফোন পকেটে রেখে দিয়ে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে।বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল জাফরিন। ইউভানকে দেখেই সে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ফাঁকা ঘরে। দরজা আটকে দেওয়ার আগেই সেখানে ডেকে আনলো তার দুই বোন জামাই এবং মা কে। এরপর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি ঈশানকে টাকা দিয়েছো?”

“কেন?”

“যা জিজ্ঞেস করছি বলো।তুমি কি দিয়েছো?”

” হ্যাঁ।তাতে কি হয়েছে?”

“কেন দিয়েছো?আর বাবা টাকা দিয়েছে সেটা তুমি জানতে?”

“সেটা আমরা সবাই জানতাম।”

বড় আপার কথায় অবাক চোখে তাকালো জাফরিন।সে বাদ দিয়ে সবাই এই কথাটা জানে?রাগে ক্ষোভে সে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। স্বল্প সময় পার হয়ে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলো,

“কেন দেওয়া হয়েছিল টাকা?”

“আব্বা টাকা দিয়েছিল তোদের দু জনের ভিসা জনিত কারণে। যেহেতু তুই ঈশানকে পছন্দ করিস আর এখানে তোর যাওয়াটা জরুরি তাই যখন ঈশান টাকাটা আবদার করে তখন আর না করেন নি আব্বা।”

” কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না বড় আপা।
কিন্তু এখন তো আমি যাচ্ছি না।আর দাদাভাই তুমি?”

“বলতে পারিস তোর সম্মানকে চড়া দামে কিনে নিয়েছি।”

“কীভাবে?”

“সেদিন যখন তুই আমাকে জানিয়েছিলি দশ লাখ টাকার কথা। সেদিন রাতেই ঈশান আমাকে কল দেয়। আমি প্রথমে তাকে কিছুই বলিনি।কিন্তু সে একটা কথা বলে।তোর চাচাদের প্ল্যান সম্পর্কে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি।কিন্তু ঈশান বলেছিল এমনটাই হবে। ওর কথায় দুই মন দুই দশা করেও চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার স্ত্রীকে রাতটা থাকার অনুরোধ করা হয়, সাথে আব্বা আম্মাও থাকে।
যেহেতু ও বলেছিল এমন হতে পারে তাই ও আমার সাথে ডিল করে। যদি এমন হয় তবে আমি বিনিময়ে ওকে কি দিবো?
বলতে কোনো বাধা নেই যে ও টাকার জন্য কতটা লোভী একজন মানুষ। এজন্যই সে আমার সাথে ডিল করে লাখ পাঁচেক টাকার। এর বিনিময়ে ওদের সব প্ল্যান সম্পর্কে আমাকে জানাবে।”

“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না দাদাভাই।”

“হয়তো তোর কাছে ছিল না।কিন্তু আমার কাছে ছিল।না হলে এই সময় তুই ওর ঘরের বৌ থাকতি।”

“আইন বলতে কিছুই নেই?”

“গ্রামে কিসের আইন দেখাতি তুই? বুদ্ধি দিয়ে চলতে হয় এখানে। তোর আপন জন যখন শত্রু তখন তারা অবশ্যই জানবে তোর আঘাতের স্থান।তারা নরম জায়গায় আঘাত করতে চেয়েছিল।কতটা সফল হয়েছে সেটাও জানিস তুই।”

“তাই বলে টাকা দিয়ে দিলে?”

“টাকা আসবে যাবে কিন্তু তোর আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে তোকে হারিয়ে ফেলতে হতো।”

জোহরের আজানের শব্দ ভেসে আসছে। এখন আর তাদের ঘরে বসে থাকা যাবে না।কারণ নামাজের পরেই মানুষ খেতে চলে আসবে। একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও ইউভান পুনরায় ফিরে এলো।ফিরে এসে জাফরিনের মাথায় হাত রেখে বলল,

“তুই যতটা সহজ মনে করছিস জীবনটা এত সহজ নয়।প্রতিটি পদক্ষেপে এখানে লুকিয়ে থাকে বিশ্বাস ঘাতকতা। একটু স্বার্থপর না হলে যে সমাজে টিকে থাকাটা বড়ই কঠিন। মাঝে মধ্যে নিজের জেদ বা সম্মানের বাইরেও বেরিয়ে আসতে হয় কেবল মাত্র নিজেদের নিরাপত্তার জন্য।”

(৩১)

মাশহুদ গত তিন দিন যাবত রয়েছে তার দাদার বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে তার মোটেও ধারনা ছিল না।যেখানে তারা এত সুখে দিন পার করছে সেখানে এই দেশেই দুর্বিষহ দিন পার করছে তাদের পরিবারের একটা অংশ।এখানে এসে তাদের খোজ করতেই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল জীর্ণ
শীর্ণ একটি বাড়ি।বাড়ির সামনেত দেয়ালের রঙটা খসে পড়েছে অনেক আগেই। ভিতর বাড়িতে যখন খবর দেওয়া হলো যে বিদেশ থেকে লোক এসেছে তখন লাঠি ভর করে এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসেছেন সবার আগে। তার গায়ে সাদা রঙের শাড়ি।এই শাড়ি মাশহুদ চিনে। জাফরিনের মায়ের গায়ে এমন শাড়ি দেখেছে আজ সে।যতটা তাদের ভাষা থেকে বুঝেছে এটাই দাঁড়ায় যে এমন শাড়ি বিধবা নারী পরেন।
তাকে সালাম দিয়ে পরিচয় দেওয়া হলো যে সে ওমুকের নাতি।ভদ্র মহিলা চোখের চশমাটা ভালো করে মুছে আবার পড়লেন।বয়সের ভাড়ে তার দু চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
দোভাষী লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন কে সে?
পুনরায় জবাব পেলেন মাসুদ সাহেবের নাতী।
ভদ্রমহিলা এবার জিজ্ঞেস করলেন মাসুদ সাহেব জীবিত আছেন কি না?

ঠিক সে সময় গেট খুলে ভিতরে এলেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক।পঞ্চাশের কোঠা ছাড়িয়েছেন তিনি।আসার পর বৃদ্ধা লোকটাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন,

“মারুফরে এটা কি কয়? এই ছেলে না কি তোর বাপের নাতী।এত বছর পর তারা কি কয়?”

মাশহুদ অল্প স্বল্প ভাষা যা বুঝে তাতেই সে বুঝতে পারলো এখানে লুকিয়ে আছে তার পরিবারের আরেক অতীত।আর এই ভদ্রমহিলা তার দাদার প্রথম স্ত্রী সুরমা। এই রমনীকেই তার দাদা নদীর সাথে তুলনা করে এবং বলে অতীত জীবন তো সুরমা নদীর মতন।

তাদের সাথে কথা বলার পর সে জানিতে পারলো আজ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পূর্বে তার দাদা এই দেশ ছেড়ে চলে যায়। আর কখনো আসেনি। তখন মাঝে মধ্যে দুই একটা চিঠি দিতো কিন্তু এর পর সেটাও দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সবাই ভেবেছিল সে মারা গেছে এবং এই বৃদ্ধ মহিলা নিজেই একা হাতে মানুষ করে তার ছেলেকে।
সবটা শুনে মাশহুদ তাদের আশ্বস্ত করলো তাদের সব কিছুর দায়িত্ব এবার থেকে তার। খুব দ্রুতই তারা তার সাথেই যাবে তখন না হয় মুখোমুখি হয়েই মাসুদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে কেন এসব লুকোচুরি?

(৩২)

ভালবাসার সময় তো নেই
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।
ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছে পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।
কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।
নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।
তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কবিতাটা আবৃতি করে চলেছে কেউ একজন। মেয়েটার নাম জানা নেই মাশহুদের। শুধু সে জানে মেয়েটা সম্পর্কে তার চাচাতো বোন হয় এবং সে খুব ভালো রান্না জানে।

ল্যাপটপে বসে মেইল চেক করছিল সে। কবিতাটা শুনেই তার মনে হলো সেই মেয়েটার কথা।যাকে দেখলেই বুকের মাঝে পূর্ণ অনুভব হচ্ছে তার। ফোনের স্ক্রীন লক খুলে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল মাশহুদ।আচমকা তার কেমন তৃষ্ণা পাচ্ছিলো।অধর জোড়া যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।
এমিলিকে কল দিয়ে তার গাড়ি বের করতে বলল সে। গুগল ম্যাপের সাহায্যে গ্রামের মেঠো পথ ছাড়িয়ে যখন জাফরিনের বাড়িতে পৌঁছেছে তখন রাত নটা বাজে।
তাদের বাড়ি দেখা যায় এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে কল দিলো জাফরিনকে।কিন্তু কি বলবে সে?
অপর দিকে কল বার কয়েক রিং হওয়ার পর রিসিভ করেছে জাফরিন।কিন্তু হ্যালো আর বলা হলো না। মাশহুদের চোখের সামনেই হুট করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন।আর বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগলো দম বন্ধ করা আর্তনাদ।

চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৩

(৩৩)

ফোনকল রিসিভ করে নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জাফরিন।আজ পুরো দিন বাসায় অনেক মানুষ ছিল।চারিদিকে এখনো খাবারের গন্ধ। এঁটো খাবার গুলো যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানে কুকুদের একটা দল ঝগড়া বাধিয়েছে। কেউ একজন লাঠি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের মারতে। জাফরিন না করেছে। তাদের খেতে দিতে বলেছে সে। প্রতিটি প্রাণীর রিজিক নির্দিষ্ট থাকে। তাদের এখানে রিজিক আছে বলেই এসেছে।

বুড়ো লোকটা জাফিরিনের কথায় নিজের মুখটা বিক্রিত করলো।মনে মনে বিচ্ছিরি রকমের গালি দিয়ে সে মনে মনে বলল,

” বাপ মরছে কয়দিন তো, তাই এত আল্লাহ আল্লাহ করতাছোস, কুত্তার প্রতিও দরদ দেখাইতাছোস। যৌবনে যখন টান দিব তখন কুত্তার প্রতিও মায়া ফুরাবো।”

জাফরিন বুঝতে পারলো লোকটা তার কথাতে নারাজ। সেখান থেকে চলে এলো সে। কারণ কল কেটে গেছে।ঘরের বারান্দাতে আসতেই তার ফুপুর সাথে দেখা হলো।সে একটা বিচার নিয়ে এসেছে। আজ এত মানুষ খেয়েছে অথচ তার বড় মেয়ের জামাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের শালার বন্ধু এক টুকরো হাড়ের মাংস দিতে বলেছিল। কেন দেওয়া হয়নি তাকে?এই নিয়ে তার মেয়ের জামাই ভীষণ রাগ করেছেন। সে এখনো খায় নি।এত এত মানুষের সামনে তার মেয়ের জামাই ছোটো হলো না?
যদি অপমান করার ইচ্ছাই থাকে তবে কেন দাওয়াত করে আনা হয়েছে।

ফুপুর কথা শুনে তিন বোন বেশ কাতর চোখে তাকিয়ে রইল।তিন বোনের চোখেই পানি ছলছল করে উঠছে। নিশ্চয়ই তাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে বাবার বলা সেই কথাগুলো।

বছর দুয়েক পূর্বে তাদের বাবা যখন ছুটিতে এসেছিলেন তখন তার বোন ভাগ্নিদের সমেত সবাইকে দাওয়াত করে আনেন। কোরবানির ঈদে তাদের ভাগে পাওয়া সম্পূর্ণ মাংস চড়িয়ে দেওয়া হয় বড় বড় পাতিলে।ঈদের পর দিন থেকেই চলে অতিথি আপ্যায়ন। তখন সবাই কতই না সম্মান করতো জাফরিনদের। এই ফুপু চাচারাই তাদের মা ছাড়া কথা বলতেন না।
ফুপুরা আসার সময় কত কিছু নিয়ে আসতেন।কারোর বাড়ির গাছের আম বা কারোর বাড়ির নারিকেল।নিজ হাতে বানানো পিঠা কিংবা নানার ধরনের খাবার।
দাওয়াতের পর যখন সবাই যার যার মতন চলে গিয়েছিল তখন জাফরিনের বেশ মন খারাপ হয়েছিল। বাবার পাশে বসে বলেছিল,

“আব্বা আর দুই দিন ওদের থাকতে বলতেন।সবাই কত ভালো।”

বড় দুই বোন সায় দিয়েছিল কিন্তু আজমল সাহেব তিন মেয়েকে কাছে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিলেন তার পাশে।
হাসতে হাসতে বলেছিলেন,

“তোমাদের তিন বোনের দরদ তত দিন যত দিন আমি জীবিত আছি। আমার মৃত্যুর পর দেখতে পারবা দিন দুনিয়া কতটা কষ্টের। এই আত্মার আত্মীয়রা কতটা ভালো।
আরে মা এরা তো ওমন করবে যে আমার চল্লিশার দাওয়াতে এসে বলবে ওমুকে খায়নি তমুকে হাড্ডি খায় না তাকে হাড্ডি কেন দিলো কিংবা আমি দ্বিতীয় বার দই চাইলাম দিলো না।”

কন্যাত্রয়ী একে অপরের দিকে তাকালো।এখন অবধি তাদের খাওয়া হয়নি।তারা জানেও না কি হচ্ছে অপর দিকে। পুরো দিন বিভিন্ন মানুষ এসেছে তাদের স্বান্তনার বাণী শুনিয়েছেন তারা মাথা নিচু করে শুনেছে। অথচ কেউ তো জিজ্ঞেস করলো না তারা খেয়েছে কি না।বাড়ির গেটের দিকের ঘরটায় দই পাতা হয়েছে। মণ দুই দুধ কিনে এনে নিজ হাতে পাতা দই।দই যাতে দ্রুত হয় এজন্য খড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।ফুপুর অনুরোধে বড় আপা গিয়ে তার সেই দুলাভাইয়ের হাতে ধরে অন্যের পক্ষ হয়ে মাফ চাইলেন। জাফরিন বিষয় টা নিতে পারবে না বলেই মেঝ আপা তাকে কিছু জানায়নি।তারা দুই বোন আপাতত কোনো ঝামেলা বা কথা চায় না। এইটুক না করলে তার ফুপুও খাবে না অপর দিকে কথার পর কথা সৃষ্টি হবেই।ইউভান পাশে বসিয়ে জাফরিনের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে তার ফোনে কল এলে জনসমাগম এড়াতে সে কিছুটা দূরে চলে যায়।
সবাই খাবার টেবিলে বসার পর একজন কে পাঠানো হলো দই আনতে। সে দই নিয়ে ফিরে আসার মিনিট দশেক পরেই ঘরে জ্বলে উঠলো আগুন।
পুরো টিনের ঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে ভিতর থেকে।বিকট শব্দ হলো ঘরে। সাথে সাথে পুরো বাড়ির বিদ্যুৎ চলে গেল।আগুনের প্রকোপ থেকে মোটামুটি কেউ টিকতে পারলো না।সব থেকে বেশি আহত হলো জাফরিন। সে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের পাশটাতেই। আগুনের তাপে গায়ে থাকা জরজটের ওড়না পুড়ে তার হাতের চামড়ার সাথে লেগে গিয়েছিল। সে না বুঝেই হাত থেকে কাপড় সরানোর চেষ্টা করলে তার বা হাতের কনুইয়ের দিকের চামড়াটা বেশ খানি উঠে এলো।

নিজের আঘাতে ক্লান্ত জাফরিন এক পাশে পড়ে গোঙাতে লাগলো।ততক্ষণে হৈচৈ শুরু হয়েছে।বাড়ির পাশে থাকা বালি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা চলছিল।আশার বাবা সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো জাফরিন এক পাশে পড়ে আছে। কিন্তু ব্যাথায় কাহিল সে। কাউকে ডাক দিতে গিয়েও সে দিলো না। নিজ হাতেও তাকে ডাকলো না।এই মেয়ের প্রতি তার অনেক দিনের রাগ জমে আছে। এই রাগকে সে দমন করতে পারছে না। তার অবচেতন মন বার বার তাকে একটা আদেশ দিয়ে চলেছে। সে দুই মন দুই দশায় পড়ে রইল
।আর তার সম্মুখে ব্যথায় কাতর জাফরিন।

নিজের চোখের সামনে আগুন দেখে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মাশহুদ। এক সময় নিজ চোখের সামনে মানুষের শিরচ্ছেদ দেখেছে সে।মৃত্যুকে খুব কম ভয়। ওসবের তুলনায় সামান্যতম আগুন দেখে ভিতর ভিতর বেশ অস্থির হয়ে গেল সে। তার মনকে স্থির করতে পারলো না।সে এক বার ভাবছিল তার ভিতরে যাওয়া উচিৎ কিন্তু সে তেমন আঞ্চলিক বাংলা বুঝে না কাকে কি বলবে যদি তাকে কেউ চিনে ফেলে। আবার মনে হচ্ছে এই সময় তার ভিতরে যাওয়া উচিৎ।
অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো এক অস্থিরতা তাকে গ্রাস করে নিলো।মুহুর্তেই সম্ভিৎ ফিরে পেল সে। নেট ঘেটে নাম্বার বের করে কল দিলো ফায়ার সার্ভিসে।

পাঁচ মিনিট পার হলেও যখন আগুন খুব একটা আয়ত্তে এলো না তখন আর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।দ্রুত পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। গেটের কাছাকাছি যেতেই এমিলি পিছন থেকে ডাক দিলো তাকে। সাথে রয়েছে আরো কয়েক জন।
এমিলি বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মাশহুদকে।
কিছুটা দূরে এসে তাকে অনুনয়ের সুরে বলল,

“স্যার আমাকে ভুল বুঝবেন না কিন্তু এভাবে আপনার ও বাড়িতে যাওয়া উচিত হবে না।আমরা যে কাজের জন্য এসেছি এটাতেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।উনাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ব্যাপারে আমাদের হস্তক্ষেপ উচিৎ হবে না।”

এমিলির কথায় তার বেশ রাগ হলো।সে রেগে তাকে কিছু কথা শোনাতে চাচ্ছিলো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো এমিলির কথাটা ঠিক আছে। এখন রাত বেশ ভালো হয়েছে। এই মুহুর্তে সে বা তারা যদি বাড়ির ভিতরে যায় তবে সবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। হাতের মুঠ শক্ত করে সে দাঁড়িয়ে রইল দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে।
কিছু সময় পরও যখন দমকল বাহিনী এলো না তখন আর সে অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

পুরো বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার কারণে কে কোথায় আছে সেটা কেউ বুঝতে পারছিল না। শুধু মাত্র বাচ্চাদেরকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাফরিনের খবর তখনো কেউ নেয়নি।কিছু সময় পর আশার বাবা ফিরে এলো গেটের দিকটায়। ওদিকে থাকা জিনিসপত্রে তখব দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন।জাফরিনকে সেখানেই পড়ে থাকতে দেখে সে এবার আর পিছপা হলো না।সে এবার প্রায় জ্ঞানহীন জাফরিনকে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল জ্বলন্ত আগুনের দিকে।
অন্তত এই মুখটা কমলে কথা বলার বা প্রতিবাদ করার মুখ থাকবে না।এই এক আগুনে না হয় কিছুটা লাভ হোক।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here