#ঈংরেজ সাহেবের বাঙালী বধূ
#লেখিকা : সামিয়া ইমাম নূর
#পর্ব : ৯+১০
৯.
রাশেদা এবার মিষ্টি হেসে বলল,
রাশেদা – সত্যিই মাধূর্য, তুমি তাহলে এই জন্যই তখন আমাকে মিষ্টির জন্য পাঠিয়েছিলে? দেখেছ! আমরা তো কেউ খেয়ালই করিনি আরিয়ানের যে ঝাল লেগেছে। আসলে আমারই ভুল হয়েছে, আরিয়ানকে তখন এই খাবারটা দেয়াই উচিত হয়নি। বাবা আরিয়ান, তোমাকে আর এইসব খাবার খেতে হবে না। বিশ্বাস কর, আমি যদি আগেই জানতে পারতাম তুমি এইসব তেল ঝাল খাবার খেতে পারো না তাহলে আমি আগে তোমার পছন্দের খাবারটাই রেডি করে রাখতাম। ঐদিকে দেখ, তোমার মাও এখনও না খেয়েই বসে আছে। তুমি চাচীকে বলো তো তুমি কি খাবে? ভাবী তুমি বলো তুমি আর আরিয়ান কি খাবে? আমি দ্রুত গিয়ে সেগুলো বানিয়ে নিয়ে আসছি।
আমান – কিন্তু এতক্ষণ ওরা না খেয়ে বসে থাকবে?
রাশেদা – তাও তো কথা, সব দোষ আসলে আমারই। আামরই আগে জেনে নেওয়া উচিত ছিল আরিয়ানদের পছন্দ- অপছন্দ।
রায়হান বলল,
রায়হান – না বউ মা, আসলে দোষটা আমারই হয়েছে। আমিই যদি আগে থেকে এই বিষয়গুলো সিরিয়াসলি নিতাম আর তোমাদের জানিয়ে দিতাম তাহলে এখন তোমাকেও এত কষ্ট করে আবার রান্না করতে যেতে হত না আর আমার ছেলেটাকেও এতটা সাফার করতে হত না।
আরিয়ান তার বাবার দিকে শান্তচোখে তাকিয়ে বলল,
আরিয়ান – It’s okey dad. I feel better now.
তারপর রাশেদার উদ্দেশ্যে বলল,
আরিয়ান – আর আন্ঠি, থুমি আমাখে নিয়ে এত ভেব না। আমি এখন আর খিচু খাব না। I’d like to take a break. আমি কিচুক্কণ বিশ্রাম নিথে ছাই।
আমান দ্রুত বলে ওঠল,
আমান – সে কি, তুমি কিছু খাবে না? তাহলে তো শরীর খারাপ করবে তোমার বাবা।
মোনালিসাও বলল,
মোনালিসা – He is right my son. থুমি না খেয়ে থাকলে থো থোমার health খারাপ হবে।
আরিয়ান – No mom, আমার খিচুই হবে না। Didn’t you see how many sweets I ate?
রাশেদা – কিন্তু বাবা, এই দুটো মিষ্টি খেয়ে তুমি সারাদুপুর কিভাবে থাকবে? আমি নাহয় একটু ফল কেটে দেই?
মোনালিসা দ্রুত বলে ওঠল,
মোনালিসা – Yeah, you are right. রাশেদা থুমি বরং এখঠু fruit salad খরে দাও প্রিন্সের জন্য।
রাশেদা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
রাশেদা – হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসছি। আরিয়ান তুমি একটু বসো হ্যাঁ? ভাবী তুমিও বসো আমি তোমার জন্যও ফ্রুট সালাদ বানিয়ে আনছি।
বলেই দ্রুত চলে গেল আবার রাশেদা কিচেনে।
দুপুর পেড়িয়ে বিকেল এলো। বাড়িতে আস্তে আস্তে আত্নীয়স্বজনরাও একে একে অনেকেই আসতে লাগল। বিয়ের একসপ্তাহ আগে থেকে অনেক মেহমানরা একে একে আসা শুরু করে দিয়েছে কারণ রাহাদের বাড়িতে যে কারো বিয়েশাদীর আয়োজনই অনেক ধুমধাম করেই করা হয়। রাহার বেলায়ও তাই। পুরো এক সপ্তাহ জোড়ে বিয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রাম চলবে। আর এই ব্যাপারগুলো যাতে আরিয়ান ইনজয় করতে পারে তার জন্যই এক সপ্তাহ আগেই আরিয়ান আর মোনালিসাকে নিয়ে দেশে চলে আসে রায়হান খান। যাই হোক, বাড়িতে এখনো সব আত্নীয়স্বজন এসে পৌঁছায়নি। তবে আজ রাহার এক মামা আসার কথা। লোকটা পুরোই জোঁকার টাইপ। সে যেখানেই যায় সেখানেই হাসির রোল পড়ে যায়। আর সেই জন্যই রাহা আর মাধূর্য ওয়েট করে আছে তার আসার জন্য। নইলে যে বিয়ে বাড়ির আনন্দটাই জমবে না। মাধূর্য কখনো রাহার মামাকে দেখেনি কিন্তু রাহার কাছে তার মামার অনেক মজার মজার গল্প শুনেছে সে। যার কারণে লোকটাকে সরাসরি দেখার জন্য বেশ কৌতুহলি হয়ে আছে সে। রাহা মাধূর্যের সাথে ঘরে বসে বসে এতক্ষণ তার মামার ব্যাপারেই গল্প করছিল আর হাসাহাসি করছিল। এক পর্যায়ে মাধূর্য বলল,
মাধূর্য – রাহা চল একটু বাগানের থেকে ঘুরে আসি।
রাহা – ঠিক আছে চল।
তারপর রাহা আর মাধূর্য দুজনে বাগানে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নিলেই হঠাৎ রাশেদা সামনে পড়ল।
রাশেদা – কি রে কোথায় যাচ্ছিস তোরা?
রাহা – মা মাধূর্য বলছিল একটু বাগানে যাবে হাঁটতে। তাই ও’কে নিয়ে বাগানে যাচ্ছি।
রাশেদা – হ্যাঁ ভালো কথা। আচ্ছা শোন!
রাহা – কি মা?
রাশেদা – আরিয়ানকেও তোদের সাথে নিয়ে যা না? ছেলেটা সেই আসার পর থেকেই একা একা। কতক্ষণ আর রুমে বসে থাকা যায় বল? এখানকার কিছু তো ও চিনেও না যে একটু ঘুরবে-ঘারবে আর না আছে এখানে ওর কোনো সঙ্গি সাথি। তাই তোরাই বরং ও’কে নিয়ে গিয়ে একটু ঘুরিয়ে আন।
রাহা – দারুন বলেছ মা, আমি এক্ষুনি গিয়ে ডেকে আনছি ব্রো’কে। কিন্তু জেঠু আর জেঠিমনি কোথায় মা?
রাশেদা – তোর জেঠু তোর বাবার সাথে গেছে বাজার সদাই করতে আর তোর জেঠিমনি ঘুমোচ্ছে মনে হয়।
রাহা – ওহ আচ্ছা, তাহলে আমরা গিয়ে ব্রো’কে ডেকে নিচ্ছি। এই মাধূর্য চল আমার সাথে।
মাধূর্য – আমি গিয়ে কি করব? তুই-ই বরং গিয়ে উনাকে নিয়ে আয়, আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।
রাহা – আচ্ছা ঠিক আছে।
বলেই রাহা দৌঁড় লাগাল আরিয়ানের ঘরের দিকে। রাশেদা বেগম মিষ্টি হেসে বললেন,
রাশেদা – দেখেছ মাধূর্য, এই মেয়েটার নাকি কয়েকদিন পর বিয়ে। অথচ এখনো কতটা বাচ্চা স্বভাবের রয়ে গেছে মেয়েটা।
মাধূর্য – জ্বী আন্টি, একদম ঠিক বলেছেন। আর ওর এই বাচ্চাসুলভ আচরণ গুলোই আমি বেশি মিস করব।
রাশেদা চোখের কোণে জমা জলটা মুছে বলল,
রাশেদা – তা মাধূর্য, তোমার বাবা-মা’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসতে পারলে না?
মাধূর্য – আসলে আন্টি বাবার খুব কাজের চাপ তাই এখন আসা সম্ভব নয় তবে রাহার বিয়ের দিন অবশ্যই আসবে ইনশাল্লাহ।
রাশেদা – আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তাহলে অপেক্ষা কর রাহাদের জন্য। আমি একটু রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছি কেমন?
মাধূর্য – জ্বী আচ্ছা।
দরজায় নক পড়তেই ল্যাবটপ থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে আরিয়ান বলল,
আরিয়ান – Who is this?
রাহা – ব্রো আমি রাহা। দরজা খুলে বেরিয়ে আসো।
আরিয়ান – Oh! just wait a minute.
বলেই আরিয়ান ল্যাপটপটা বন্ধ করে হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে নিজের চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই রাহা মিষ্টি হেসে আরিয়ানকে বলল,
রাহা – ব্রো চলো আমরা বাইরে যাব।
আরিয়ান – বাইরে খোথায়?
১০.
রাহা – আসলে আমি আর আমার বান্ধবী মাধূর্য মিলে বাগানের দিকে যাচ্ছিলাম আর তখন মা বলল তোমাকেও সাথে নিয়ে গিয়ে একটু ঘুরিয়ে আনতে। তুমি তো আসার পর থেকে আর বাড়ির ভিতর থেকে বের হওনি। চলো তোমায় পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাব।
আরিয়ান খুশি হয়ে বলল,
আরিয়ান – Oh really? খুব বালো, চলো থাহলে।
রাহা – হ্যাঁ চলো।
ঐদিকে মাধূর্য রাহাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘটে গেছে আরেক ঘটনা। রাহার মা যখন মাধূর্যের সাথে কথা বলে কিচেনরুমের দিকে চলে যায় তার ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই আরবদের পোশাক গায়ে শেখদের মতো দেখতে এক লোক এসে হাজির হল মাধূর্যের সামনে। মাধূর্য প্রথমে তাকে দেখেনি কারণ তখন মাধূর্য ফোনে স্ক্রোল করছিল। লোকটি মাধূর্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটা লম্বা করে সালাম দিল মাধূর্যের উদ্দেশ্যে। মাধূর্য চমকে ওঠে সামনে তাকাতেই লোকটাকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তার সালামের জবাব দিয়ে বলল,
মাধূর্য – কে আপনি? I mean who are you?
লোকটা কিছুটা ভাব নিয়ে আরবদের মতো করে বলল,
লোকটা – ইয়া হাবিবাতি! I am Mr. Kismat from Dubai.
মাধূর্য – ও আচ্ছা। তা এখানে কি চাই মিস্টার কিশমিশ আই মিন, কিসমত ফ্রম দুবাই?
কিসমত – ইয়া হাবিবাতি! আমি এখানে আমার একমাত্র ভগ্নিপতির একমাত্র স্ত্রীর একমাত্র মেয়ে মানে আমার একমাত্র আদরের ভাগ্নীর বিয়েতে এসেছি। কিন্তু, আপনি কন হে ইয়া হাবিবী?
মাধূর্যর আর বুঝতে বাকি নেই এটাই রাহার সেই সুপার কমিডিয়ান মামা কিশমিশ। আসলে রাহারাও তার মামাকে মজা করে কিশমিশ মামা বলেই ডাকে। মাধূর্য মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে কিসমতের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই পিছন থেকে রাহা আর আরিয়ান এসে হাজির। রাহা তার মামাকে দেখেই উত্তেজিত কন্ঠে ওঠল,
রাহা – কিশমিশ মামা!
মাধূর্য আর কিসমত দুজনেই রাহার দিকে তাকাল। রাহা দৌঁড়ে তার মামার কাছে এলো।
রাহা – কিশমিশ মামা তুমি চলে এসেছ? কখন এলে আর আমাদের ডাকনি কেন?
কিসমত – ইয়া হাবিবাতি! মাই ডিয়ার ভাগ্নী। কাইফা হালুকা?
রাহা – হ্যাঁ?
কিসমত – ওহ সরি মাই ডিয়ার ভাগ্নী, তুমি তো আমার এরাবিক বুঝ না। আমি বলছি যে তুমি কেমন আছ?
রাহা – অনেক ভালো মামা, তুমি এসে গেছ তাই এখন আরও বেশি ভালো লাগছে। খুব আনন্দ হবে এবার।
কিসমত এবার মাধূর্যের দিকে ইশারা করে রাহাকে জিজ্ঞেস করল,
কিসমত – তা মামা! এই হাবিবা কে তো চিনতে পারলাম না?
রাহা – ওহ মামা তোমাকে আমার বেস্টফ্রেন্ড মাধূর্যর কথা বলেছিলাম না? এই হচ্ছে সেই মাধূর্য।
কিসমত – ও আচ্ছা, আচ্ছা। কাইফা হালুকা ইয়া হাবিবাতি?
মাধূর্য মিষ্টি হেসে জবাবা দিল,
মাধূর্য – আলহামদুলিল্লাহ মামা, আপনি কেমন আছেন?
কিসমত – আমি অলওয়েজ ঝাকানাকা থাকি।
কথাটা বলেই কিসমতের চোখ গেল আরিয়ানের দিকে। আরিয়ান এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আর বুঝার চেষ্টা করছে এইখানে কি হচ্ছে। কিসমতও প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে রাহাকে বলল,
কিসমত – রাহা মামনি! এই লম্বাচওড়া ভিনদেশী দেখতে জনাব কে তো চিনলাম না?
রাহা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
রাহা – ওহ ব্রো তুমি এখনো ঐখনে কেন দাঁড়িয়ে আছ? এদিকে এসো। আর মামা! এটা তো আমাদের আরিয়ান ব্রো, বড় জেঠুর ছেলে। লন্ডন থেকে আজই এসেছে।
রাহার কথার মাঝেই আরিয়ান এসে রাহাদের কাছে দাঁড়াল। কিসমত আরিয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
কিসমত – আচ্ছালামু আলাইকুম ইয়া হাবিবী। কাইফা হালুকা?
আরিয়ান কিসমতের সালামের অর্থটা বাদে আর কিছুই বুঝতে পারল না। তাই সে কিসমতের সাথে হ্যান্ডশেক করে শুধু সালামের জবাব দিল।
রাহা বলল,
রাহা – মামা আরিয়ান ব্রো আরবি বুঝে না, তার সাথে বাংলায় নাহয় ইংলিশে কথা বলো।
কিসমত – ওহ আচ্ছা আচ্ছা। How are you Mr. Ariyan? Do you know me? I am Mr. Kismat and Raha’s uncle. Raha is my niece.
আরিয়ান – Oh really? Then you are also my uncle. right?
কিসমত – Yeah! Yeah!
রাহা – তোমরা কথা বলো আমি মা’কে ডেকে আনছি।
কিসমত দ্রুত বলে ওঠল,
কিসমত – না না ভাগ্নী, তোমার মা’কে না ডেকে বরং আমাকে বলে দাও তোমার মা-বাবা কোথায় আছে। আমি তাদের সারপ্রাইজ দিতে চাই।
রাহা – ওহ তাই? কিন্তু মামা, বাবা তো বাজারে গেছে আর মা মনে হয় রান্নাঘরে কিংবা তার ঘরে।
মাধূর্য বলল,
মাধূর্য – আন্টি রান্নাঘরেই আছে মামা। রান্নাঘরটা চিনেন তো?
কিসমত – অবশ্যই চিনি মামনি এবং ধন্যবাদ তোমাকে ইনফরমেশনের জন্য। তাহলে তোমরা থাকো, আমি বরং গিয়ে আপাকে সারপ্রাইজ করে আসি। ইয়াং ম্যান, দেখা হচ্ছে তাহলে আবার।
আরিয়ানের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল কিসমত। আরিয়ান মিষ্টি হেসে বলল,
আরিয়ান – Yeah, sure.
কিসমত রাহাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তার বোনকে সারপ্রাইজ দিতে রান্নাঘরের দিকে। আর এদিকে রাহা মাধূর্য এবং আরিয়ানকে নিয়ে বাগানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল।
চলবে-