#ঈংরেজ সাহেবের বাঙালী বধূ
#লেখিকা : সামিয়া ইমাম নূর
#পর্ব : ৬+৭+৮
৬
রাহা – এই একদম আমার ব্রোকে নিয়ে ভুলভাল বকবি না। তুই যেমন টা ভাবছিস ব্রো মোটেই তেমন নয়। হ্যাঁ এটা ঠিক যে সে বাংলাটা খুব ভালো পারে না আর কেন পারেনা এটাও নিশ্চয়ই তুই বুঝতে পারছিস? আর বাংলা পারেনা বলে যে সে কিছুই পারেনা এমনটা ভুলেও ভাবতে যাস না। জানিস ব্রো কত শিক্ষিত আর Brilliant একটা ছেলে? জানলে তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হবে তোর।
মাধূর্য এক গালে হাত দিয়ে কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
মাধূর্য – ওহ হো, তাই? তাহলে বলে ফেল দেখি। জেনে নিয়ে আমিও একটু আকাশ থেকে পড়ি???
রাহা – হাসছিস তো? ঠিক আছে শোন তাহলে, ব্রো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন এবং পিএইচডি কমপ্লিট করে এখন সেই ইউনিভার্সিটিরই একজন প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে। জেঠুর কাছ থেকে শুনেছি অক্সফোর্ড ইইউনিভার্সিটির সব মেয়েরা নাকি ব্রোর জন্য পাগল। অনেক মেয়ে তো নাকি প্রপোজও করে দিয়েছে ব্রোকে এমনকি অনেকে তো হুমকিও দিয়েছে নাকি যে ব্রোকে না পেলে মরে যাবে আরও ব্লা ব্লা.. কিন্তু ব্রো নাকি কাউকেই পাত্তা দেয় না।
মাধূর্য গাল থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
মাধূর্য – বাব্বাহ! তাহলে তো দেখছি তোর ব্রো একেবারে লন্ডনের হিরো। তা প্রফেসর না হয়ে হিরো বা মডেল হয়ে গেলেই তো পারত।
রাহা – হ্যাঁ, ব্রো তো এইসবের অফার পেয়েছিলই কিন্তু তার নাকি এই সব ভালো লাগে না। তাই সে এই প্রফেশনটাই বেঁছে নিয়েছে।
মাধূর্য – বুঝলাম কিন্তু যাই বলিস, তোর ঐ ব্রিলিয়েন্ট ইংরেজ ভাইটাকে কিন্তু আমি এই কয়দিন প্রচুর জ্বালাব। কেন জানিস?
রাহা – কেন?
মাধূর্য – কারণ ওটা একে তো ইংরেজ তার উপর আবার প্রচুর তেজ। যখন তখন রেগে ফায়ার হয়ে যায় দেখলাম। আর রাগলে একেবারে চোখমুখ লাল টমেটোর মতো হয়ে যায়। এই সব মানুষদের রাগাতেই তো মজা। তার উপর ভালো করে বাংলা বুঝে না। তাই তিনটা বললে একটা বুঝবে আর আমিও ইচ্ছেমত জ্বালাতে পারব একে। ব্যাটা বাঙালী বাবার ছেলে হয়েও ইংরেজদের মতো শুধু ফেচফেচ করে। এতই যখন ব্রিলিয়েন্ট তোর ভাই তাহলে ভালো করে বাংলাটা শিখতে পারে না কেন বল তো?
রাহা – আরে স্টুপিড, ওরা তো বেশিরভাগ সময় ইংলিশেই কথা বলে আর বাড়িতে থাকলে জেঠুর সাথে টুকটাক বাংলায় কথা হয়। তাই বাংলাটা ভালোভাবে আসেনা ওদের। এটাই তো স্বাভাবিক তাই না। যেমন আমরা ইংরেজি জানলেও ওদের মতো করে ইংরেজি শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারিনা কারণ আমাদের আশেপাশে সবসময় কেউ ঐরকমভাবে ইংরেজি বলে না তেমনি ওরাও বাংলা জানলেও আমাদের মতো স্পষ্ট এবং শুদ্ধভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারে না। কারণ ওদের আশেপাশের মানুষরা হাতে গুণা কয়েকজন বাদে বাকি সবাই-ই সারাক্ষণ ইংলিশেই কথা বলে। আর যে যেটা শুনে আর বলে অভ্যস্ত সে তো সেটাই ভালো পারবে। তাই না?
মাধূর্য – হুম, তা ঠিক। আচ্ছা বাদ দে, আমি খুব টায়ার্ড বুঝলি। অনেকপথ জার্নি করে এসেছি। আমি এখন একটু ঘুমোবো। একদম ডিস্টার্ব করবি না কিন্তু আমায়।
রাহা – এখন ঘুমোবি? কিছু খাবিনা?
মাধূর্য – না খিদে নেই, একেবারে দুপুরে লান্ঞ্চ করে নেব।
রাহা – আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়। আমি একটু দেখে আসি মা রান্নাবান্নার কি আয়োজন করছে।
মাধূর্য – ওকে যা। আর দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে যাস। নইলে আমি ঘুমোনোর সময় ভিতর থেকে দরজা লাগালে আবার তোকে বারান্দায় নাহয় রান্নাঘরেই কাটাতে হবে আমার ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত।
রাহা – হুম জানি, যাচ্ছি আমি। আর কিছু লাগবে তোর?
মাধূর্য – না তুই যা তো।
রাহা – আরে বাবা যাচ্ছি তো।
বলেই রাহা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে ঘরের দরজাটা আটকে দিয়ে চলে গেল তার মায়ের কাছে।
দুপরে সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসেছে খাবার খেতে। এদিকে আরিয়ান আর মাধূর্য টেবিলের দুইপাশে একে অপরের মুখোমুখি বসেছে যদিও এটা কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে। টেবিল ভর্তি প্রচুর খাবার আইটেম আর তার উপর সবগুলোই তেল মশলাযুক্ত দেখে আরিয়ান একটা শুকনো ঢুক গিলে বলল,
আরিয়ান – Oh no! what are these?
আমান বলল,
আমান – কেন, কি হয়েছে আরিয়ান?
আরিয়ান নাকমুখ কু্ঁচকে উত্তর দিল,
আরিয়ান – এখানে মানুষ এত খাবার খায়? তাছাড়া এত Oily food থোমরা কিভাবে খাও আঙ্কেল? Health খারাপ হয় না? থোমরা বেঁছে আছ খিভাবে এই সব খেয়ে?
৭.
রায়হান বলে ওঠল,
রায়হান – আরে কিচ্ছু হবে না, এই দেশের মানুষ তো এইসবই খায় আর এই খেয়েই তারা দিব্বি আছে। তুমিও খেয়ে দেখ ব্যাটা, একদম হাত চাঁটতে থাকবে।
মোনালিসা এবার বলে ওঠল,
মোনালিসা – ওহ রায়হান! থোমাকে না আমি বলেছিলাম আমার প্রিন্সের খাবার-দাবারের যেন কোনো প্রবলেম না হয়? থাহলে খেন তুমি এখন এইসব বলছ? থুমি জানো না আমার প্রিন্স এই ধরনের খাবার খখনো খায় না?
রাশেদা সাথে সাথে বলে ওঠল,
রাশেদা – ওমা সে কি? আরিয়ান এইসব খাবার খায় না? ভাই আপনি আমাদের আগে কেন বলে দেননি? তাহলে তো আমি আরিয়ানের পছন্দমতোই খাবার বানিয়ে রাখতাম। এখন ছেলেটা কি খাবে বলুন তো? বাবা আরিয়ান! তুমি কি খাবে বাবা আমায় বলো তো? আমি এক্ষুনি দ্রুত গিয়ে বানিয়ে আনছি। ইশ! ছেলেটা এখন না খেয়ে বসে থাকবে?
মোনালিসা সাথে সাথেই বলল,
মোনালিসা – থোমার ভাইয়ের তো এঠাই সমস্যা। আমার ছেলেখে খিভাবে খষ্ট দেয়া যায় সেই ছিন্থাই ওর মাথায় থাখে।
রায়হান রেগেমেগে বলে ওঠল,
রায়হান – কি বললে? আমি তোমার ছেলেকে কষ্ট দেয়ার চিন্তায় থাকি? আরিয়ান কি শুধু তোমার ছেলে? সে কি আমার ছেলে নয়? আমি আমার ছেলেকে কষ্ট দেয়ার চিন্তা করি এই কথাটা তুমি ভাবলে কিভাবে?
রায়হানের কথায় মোনালিসা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এদিকে ওদের এই কথা কাটিকাটি দেখে মাধূর্য আর রাহাসহ বাকিরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। আরিয়ানও বুঝতে পারল ব্যাপারটা বাজে দিকে চলে যাচ্ছে। তাই ব্যাপারটা যেন আর না বাড়ে তার জন্য তার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠল,
আরিয়ান – It’s okey mom-dad, it’s okey. থোমরা দুজনই শান্ত হও please। আমাখে নিয়ে থোমাদের আর ঝগড়া খরার need নেই। আমি এই খাবারগুলোই খাব। Aunt please, আমাখে খেতে দাও।
মোনালিসা দ্রুত বলে ওঠল,
মোনালিসা – But prince!
আরিয়ান হাত উঁচিয়ে তার মাকে থামতে বলে চোখের পলক ঝাপটে আস্বস্ত করে বলল,
আরিয়ান – Mom don’t worry. আন্ঠি যখন আজ রান্না খরেই ফেলেছে then আমি নাহয় আজ এই খাবারই খাব। তাছাড়া এখন নথুন খরে রান্না খরতে গেলে উনার খষ্ঠ হবে and i think, থোমারও আজ আন্ঠির cook খরা এই খাবারগুলো test করা উছিথ। y
You should also taste these food.
আরিয়ানের কথায় আরিয়ানের মা বাদে বাকি সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠল। মাধূর্য এবার কিছুটা মুগ্ধ হল আরিয়ানের ব্যবহারে। সে বুঝতে পারল, বিদেশি হলেও আরিয়ানের মনটা মোটামুটি ভালোই। যাই হোক, রাশেদা আর আমান সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগল। সবার প্রথমে রাশেদা আরিয়ানকে খাবার বেড়ে দিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল খাওয়ার সময়। আরিয়ান শুধু যে ওয়েলি ফুড খায় না তা-ই নয়, সে ঝাল খাবারও খায় না। ইনফেক্ট ঝাল খাবার তাকে কখনো খেতেও হয়নি। সবসময় লাইট খাবার খেয়েই অভ্যস্ত সে। যার ফলশ্রুতিতে, এখানে এক চামচ পোলাও আর মাংসের ঝোল মুখে নিতেই চোখমুখ লাল হয়ে এলো তার। কান দিয়ে যেন ধুয়া বের হতে লাগল। আর মোনালিসা তো শুধু খাবার নাড়াচাড়াই করে যাচ্ছে। এদিকে আরিয়ান অনেক কষ্টে মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে সামনে থাকা পানির গ্লাসটা একচুমুকে খালি করে ফেলল। গ্লাসটা রেখেই আরিয়ান মিথানিচু করে দুচোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল। আর এই ব্যাপারগুলো মাধূর্যের নজর এড়ায়নি। আরিয়ানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে যেটা মাধূর্য ছাড়া আর কারোই নজরে পড়েনি। মাধূর্য দ্রুত পুরো টেবিলটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাশেদার উদ্দেশ্যে বলে ওঠল,
মাধূর্য – রাশেদা আন্টি আপনাদের বাড়িতে মিষ্টি জাতীয় কিছু নেই?
রাশেদা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
রাশেদা – থাকবে না কেন? আছে তো। দেখেছ! আমি একদমই ভুলে গেছিলাম দই মিষ্টির কথা। ভালো করেছ তুমি মনে করিয়ে দিয়ে। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি গিয়ে।
মাধূর্য – হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন প্লিজ।
রাশেদা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
রাশেদা – হ্যাঁ হ্যাঁ আনছি।
বলেই তিনি দ্রুত চলে গেলেন কিচেনে দই মিষ্টিগুলো আনার জন্য। এদিকে আরিয়ানের অবস্থা খারাপ। সে না পারছে খাবার ছেড়ে ওঠতে আর না পারছে কাউকে কিছু বলতে। এরমধ্যে রাহা মাধূর্যের পেটে খুঁচা মেরে বলল,
রাহা – কি রে, তুই আবার এত মিষ্টি পাগল হলি কবে থেকে যে মিষ্টি খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছিস?
৮.
মাধূর্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
মাধূর্য – Stupid! মিষ্টি আমার জন্য চাইছি না। ঐদিকে দেখ তোর বিলেতি ভাই ঝাল খেয়ে বিলেতি বেগুনের মতো লাল হয়ে গেছে।
ঐদিকে আমান রাহা আর মাধূর্যের কাছাকাছি থাকায় সেও শুনে ফেলে মাধূর্যের কথা। আমান আর রাহা দ্রুত আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই আরিয়ানের মুখ লাল হয়ে আছে আর সে খেতেও পারছে না, শুধু চামচ হাতে নিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে। আমান উত্তেজিত হয়ে বলল,
আমান – আরে আরিয়ান তোমার কি হয়েছে বাবা? খুব ঝাল লেগেছে? এই রাশেদা তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে এসো, আরিয়ানের ঝাল লেগেছে।
সবাই চোখ তুলে আরিয়ানের দিকে তাকাল। রায়হান দ্রুত আরিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,
রায়হান – কি হয়েছে প্রিন্স, তোমার কি ঝাল লেগেছে? আমাদের বলোনি কেন? দ্রুত পানি খাও।
বলেই রায়হান তার সামনের পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই রাশেদা একপ্রকার দৌঁড়ে মিষ্টি নিয়ে হাজির হল আরিয়ানের সামনে। মোনালিসা খেপে গিয়ে রায়হানের উদ্দেশ্যে বলল,
মোনালিসা – হয়েচে থোমার শান্তি? এঠাই ছেয়েচিলে থ থুমি? My son, খুব কষ্ট হচ্ছে না তোমার?
আরিয়ান ঝালের জন্য কিছুই বলতে পারছে না কাউকে। রাশেদা বলল,
রাশেদা – বাবা আরিয়ান! তুমি মিষ্টিটা খেয়ে নাও দ্রুত। তাহলেই ঝালটা কেটে যাবে।
আরিয়ান চোখ তুলে মিষ্টির বাটিটার দিকে তাকাল। সাথে সাথেই অস্থির হয়ে পরপর ঘপাঘপ কয়েকটা মিষ্টি পুরে দিল মুখে। তারপর স্বস্তির দম নিল সে। সবার মুখে খানিকটা হাসি ফুটে ওঠল। মোনালিসা আবার আরিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
মোনালিসা – Prince my son, থোমার ঝাল লেগেচে থা থুমি আমাখে খেন বলোনি বলো থো?
আরিয়ান – It’s okey mom, i am fine now.
রায়হান – ফাইন তো এখন কিন্তু এতক্ষণ তো কষ্টটা পাচ্ছিলে। আমাদের বলতে পারতে তো। ভাগ্যিস তোমার চাচা তোমার দিকে খেয়াল রেখেছিল, নইলে তো এখনো কষ্ট পেতে।
আরিয়ান তার চাচার দিকে তাকিয়ে বলল,
আরিয়ান – Thanks uncle.
আমান – আরে না না বাবা, thanks আমাকে নয় বরং মাধূর্য মামনিকে দাও। আসলে ঐ-ই তো প্রথমে খেয়াল করেছিল তোমার ঝাল লেগেছে আর তার জন্যই তখন ও তোমার চাচাীকে মিষ্টি আনতে বলেছিল।
আরিয়ান মাধূর্যর দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
আরিয়ান – Thanks.
মাধূর্যও মৃদু হেসে বলল,
মাধূর্য – It’s okey.
রায়হান আর মোনালিসাও মাধূর্যের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাল। রায়হান মাধূর্যের উদ্দেশ্যে বলল,
রায়হান – ধন্যবাদ মামনি। তোমার জন্যই আজ আমার ছেলেটা কষ্ট থেকে বাঁচল।
মাধূর্য ভদ্রতার সাথে বলল,
মাধূর্য – It’s okey uncle. এই সামান্য কারণে এত ধন্যবাদ দেয়ার কি আছে?
চলবে-