হলদে_প্রজাপতি পর্ব-২০

0
236

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

কুড়ি

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

সন্ধ্যাবেলা নিকষ কালো অন্ধকার চা-বাগানের বুক চিরে গাড়িতে করে এগিয়ে চলা যে ঠিক কতখানি রোমাঞ্চকর অনুভূতি, তা বলে বোঝানোর নয়। একবার , দুবার দশ বার, শতবার ভ্রমণেও এর মধ্যে নিহিত রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা কখনো থিতিয়ে পড়ে না । মনটাও বেশ ফুরফুরে ছিল । সারাদিন ধরে বেশ অন্য রকম কাটলো তো । মনে পড়ছিল পড়ন্ত বিকেলের সেই পালাগানের গ্রাম্য সুর । মাঝে মাঝে গুন গুন করে উঠছিলাম । জগন্নাথ দা’ও গ্রামটা ঘুরেছে নিজের মতো করে । দুপুরবেলায় টগরদের বাড়িতেই ভাত খেয়েছে । পালাগানও দেখেছে । সেসব নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল ।
প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি, জগন্নাথ দা’র বাঁ হাতে বেশ অনেকগুলো সেলাইয়ের দাগ। তাছাড়া হাতটা একটু ব্যাঁকা মত । আঙ্গুলগুলো পুরোপুরি সোজা হয় না । কোন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বুঝতে পারি । কিন্তু কোনদিনই জিজ্ঞাসা করা হয়নি ।
আজকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম । বললাম , জগন্নাথ দা , তুমি কি কোনদিন অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাতে চোট পেয়েছিলে ?
— ঐ গল্প বুঝি আপনাকে কোনদিন করিনি দিদিমণি?
— না , কই আর করেছ ? আমি অনেকবার ভেবেছি তোমাকে জিজ্ঞাসা করব। তারপরে আর জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি ।
সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জগন্নাথ দা বলল , সে এক বিশাল বড় কাহিনী !
— কিরকম ? তোমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বুঝি?
— না দিদিমণি, দুঃখের কথা আর বলবো কি । আমি এত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি , আমার নিজের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে আমার কিছু হয়নি । হয়েছিল লোকের গাড়িতে ।
— কিরকম ?
— আর বলেন না দিদিমণি । সেবার , তাও বছর চারেক হবে , বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিঘা যাচ্ছিলাম। আমাদের ওদিকে পাড়ার অনেকেও যাচ্ছিল । কিছু করে টাকা তুলে আমাদের পাড়ার ওই মন্টুটাই সব ব্যবস্থা করেছিল । এত বড় একটা টুরিস্টদের বাস ভাড়া করা হলো । সেই বাস ছাড়লো দুর্গাপুজোর পরে একাদশীর দিন রাতে । সে তো আমাদের খুবই ভালো লাগছে । মজা করতে করতে গেলাম। দুদিন থাকলাম ওখানে , বুঝলেন তো ? আমাদের খুব বেশি ঘোরা বেড়ানো হয় না বুঝলেন দিদিমণি, বেড়ানোর বড় সাধ হয় । আমি তো গাড়ি চালিয়ে টুরিস্ট নিয়ে গেছি, কিন্তু বৌ-ছেলে-মেয়ের ঘোরা হয় না। ওদের সাথে আমার যাওয়া হয় না কোথাও। আমাদের যেমন-তেমন, বাড়ির সব মেয়ে বৌ’দের হুটোপাটি একদম দেখার মত। তাদের সে কি আনন্দ , সমুদ্দুরের ঢেউতে নেমে ! সে একবার করে নামছে আর নায়িকা মনে করছে নিজেদের। আর যাচ্ছে না পাড়ে, মনে হচ্ছে ওখানে এখন ওই সমুদ্দুরের মধ্যেই বসে থাকবে । সে যাই হোক , মজা তো অনেক হলো । এবারে হয়েছে কি , ফিরে আসার দিন আবার সেই আমরা সবাই রাত্রিবেলা চেপেছি বাসে। বাস স্টার্ট দিয়েছে । ছুটছে , বেদম ছুটছে । এবার, আমরা সব খেয়াল রেখেছিলাম বুঝলেন কিনা, বাসের ড্রাইভার হেল্পার কেউ যাতে সে রকম কিছু খেয়েটেয়ে না নেয়। তা দুদিন ওখানে ছিলি, যা খেয়েছিস খেয়েছিস , আবার না হয় এখানে বাস থেকে সব টুরিস্ট নাবিয়ে দিয়ে, যা করতিস করতিস । তা না, কখন সব একগলা করে গিলেছে । তারপর বুঝলেন কিনা, সে ওখানে একটা রাস্তায় এই রাউন্ড একটা পাক ছিল । সে তো খুব স্পিড তখন তুলে দিয়েছে । আর সামলাতে পারেনি । না কি করেছে কে জানে, সে একেবারে একটা মাঠের ধারে খাদ মত ছিল , তারই পারে বাস একদম উল্টি । চাকাগুলো ওপরে । সেকি দৃশ্য ! না দেখলে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না । কে যে কোথায় পড়েছে, কার ঘাড়ে যে কি পড়েছে সে একেবারে যা-তা অবস্থা! আমার তো বউ ছেলেমেয়ে তখন কোথায় কে জানে। খানিকটা অজ্ঞান মত হয়ে গিয়েছি । হঠাৎ করে মনে হল কি যেন একটা হিড়হিড় করে টানছে আমায় । সে আমার তখন হাতে কি বেদনা ! মনে হচ্ছে পুরো এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে । কোথায় ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়েছি , কি ঢুকেছে হাতের মধ্যে, ক’খানা কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারছিনা। যে আমাকে টানছিল সে আমাকে টেনে বার করে একটা খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলল । আমি তাকিয়ে দেখি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, খোলা ! রাতের অন্ধকারে । তা’ও আবার এই কালো একটা মেয়ে ! আমি তখন ভাবছি কি জানেন দিদিমণি , আমাকে মা কালী বাঁচালো । পেন্নাম করতে যাচ্ছি হাত তুলে। কিন্তু সে পারব কেন ? হাত তো একবারে তখন আমার ভেঙে যাচ্ছে ! সে তার পরে সেখানে কতক্ষণ পড়েছিলাম কে জানে । সেখানকার আশেপাশের সব লোকাল লোকজন আমাদের যাকে যা হয় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল । হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরতে তখন বুঝতে পারলাম, সেই মেয়েটা ছিল আমাদের পাড়ার নেত্য । আদিবাসী মেয়ে একটা । তার জন্যই বেঁচে গিয়েছিলাম , জানেন ? ওদের গায়ে তো ক্ষমতা খুব । কোথায় পড়েছিলাম , হাতের মধ্যে কি গেঁথেছিল , কে জানে । কোথা থেকে বার করলো আমাকে । এ-এই টেনে বার করেছিল জানেন মেয়েটা ? যাই হোক, সে হাসপাতাল তো বলে হাত বাদ দিতে হবে কনুই থেকে । একবারে কতগুলো জায়গায় রড ঢুকে যখম হয়ে গেছে। হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো । সে তো ভাবছিলাম হাতটা বুঝি গেল । তারপরে কলকাতায় গেলাম । সে যাই হোক , সেখানে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারবাবু বললেন পাত লাগিয়ে সেট করে দিতে পারবেন। অপারেশনের পরে অনেকদিন হাত নাড়াতে পারিনি । বছরখানেক গাড়ি চালানো বন্ধ ছিল । তারপরে আবার একটু একটু করে চালাতে চালাতে এখন একদম সেট হয়ে গেছে । হাত কোন দিকে কোন ভাবে নাড়াতে ব্যালেন্স করতে আর কোন অসুবিধা হয় না।
— আর তোমার ছেলে-মেয়ে, বৌ? তাদের কারো কিছু হয়নি তো ?
— না ভগবানের দয়ায় শুধু একটু আধটু মুচকে , কেটে-ছড়ে গেছিল । তেমন কিছু হয় নি । তবে আবার বাসের মধ্যে অনেকেই ছিল , তাদের সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক কান্ড , অবস্থা ! যাইহোক , মরেনি কেউ, এটাই যা।
— যাক গে, এত বড় অ্যাক্সিডেন্টে যে শুধু হাতের ওপর দিয়ে গেছে, এটা জানবে তোমার খুব ভাগ্য ভালো ।
— এটা আপনি ঠিক বলেছেন দিদিমণি । তবে কি জানেন তো, এত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি, নিজের হাতে স্টিয়ারিং ধরে আজ পর্যন্ত কোনো অ্যাক্সিডেন্ট করিনি , জানেন? লোকের গাড়িতে চাপলাম একবার । সে কি অবস্থা হয়ে গেল ।
— সে আর কি করবে ? সবকিছুতেই নিজের দুর্ভাগ্যের কথাটা ভাববে যেমন, ভাগ্যের কথাটাও ভাববে । যেরকম অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বলছো, তাতে করে কি না কি হতে পারত । সে তুলনায় কিছুই হয়নি ।

গল্পে গল্পে এগিয়ে এসেছি অনেকটা রাস্তা । মাঝে মাঝে রাস্তায় আলো রয়েছে বটে, তবে বেশিরভাগ রাস্তাই অন্ধকার । গাড়ির হেডলাইটের ভরসায় চলেছি। দু’পাশে জমাট কালো অন্ধকারে মাথা দোলাচ্ছে চা বাগান । শিরশিরে একটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে গাড়ির জানালা দিয়ে । মনে হচ্ছে যেন হাল্কা একটা চাদর থাকলে ভাল হত ।

টগরদের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পাক্কা এক ঘন্টা কুড়ি পঁচিশ মিনিট হবে, পাতাকে ড্রপ করে দিলাম ওর বাড়িতে । তারপর পৌঁছে গেলাম নিজের বাংলোয়। কিন্তু বাংলোর গেটের কাছে ঢোকার কিছুটা আগে উত্তেজিত ভাবে হাত দেখিয়ে আমাদের গাড়িটা দাঁড়াতে বলল যদু । তার গাড়ি দাঁড় করানোর ধরনে সত্যি কথা বলতে কি একটু অবাকই হলাম। প্রচন্ড উত্তেজিত সে । গাড়ি দাঁড়াতে , তাকে গাড়ির উইন্ডো থেকে হাত বার করে সামনে ডাকলাম । সে সামনে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে কি সব যে বলতে লাগল , মাথায় খুব ভালো করে ঢুকলো না।
আমি বললাম, এত কথা না বলে ছোট করে বল কী বলছ ।
সে বাঁ হাতটা তুলে মোটামুটি উত্তর-পশ্চিম কোন করে একটা দিক নির্দেশ করে বলল, ওইখানে -, ওইদিকে কি কান্ড হয়েছে দিদিমণি । আপনি যান । আপনার চা বাগানের মধ্যে পড়ছে যে। আপনাকে যেতে হবে ।
— কিন্তু হয়েছেটা কি ?
— বাঘ পড়েছে , বাঘ !
— বাঘ ! কি বলছ কি!
ধমকে উঠলাম প্রায় যদুকে , বাঘ মানে ?
— আমি যাচ্ছি চলুন দিদিমণি । আপনাকে ওরা যেতে বলে গেছে ।
বলে গাড়ির সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লো সে।
— কিন্তু যাব কোথায় ?
— আমি বলছি দিদিমনি । ওই যেখানে বাঘ পড়েছে –
প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি । কি বলছে কে জানে লোকটা । কিন্তু তারপরে ওর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে সত্যি করেই বাঘের কোন একটা ব্যাপার ঘটেছে । সে আবার কি ? চা-বাগানে বাঘ! কি বাঘ, কেন , কোত্থেকে এলো , কি বৃত্তান্ত ! সত্যি কথা বলতে কি, এবার যথেষ্ট ঘাবড়ে গেলাম । চা বাগানে মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও বাঘ এসে পড়ে শুনেছি। তবে তা যে একেবারে আমার টি এস্টেটের সীমানার মধ্যে হয়ে যেতে পারে, ভাবতে পারিনি । যদুর কথামতো জগন্নাথদা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলল । মোটামুটি মিনিট পনেরো থেকে কুড়ি । তারপরে একটা জায়গায় এসে গাড়িটা থামল । দেখলাম সেখানে বেশ জটলা হয়েছে । সত্যি কথা বলতে কি , বুকে কিছুটা কাঁপুনি ধরেছিল । বাঘটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও আছে । এভাবে ওপেন জায়গায় বাঘ আর আমি , একসাথে! বাপ্ রে ! এরকম ঘটনা ঘটতে পারে জীবনে কখনো ভাবি নি । গাড়িতে আসতে আসতে যদু যেটুকু বলেছে , তা এই রকম –
আশেপাশের জঙ্গল থেকে একটা চিতাবাঘ নাকি সন্ধ্যার মুখে মুখে ঢুকে পড়ে আমার টি এস্টেটে। তাকে দু-একজন ফিরতি চা শ্রমিক দেখতে পায় । তারপরেই ঢিঢি পড়ে যায় চারদিকে। খবর ছড়িয়ে পড়ে হু হু করে । অনেক লেবার আবার ফিরে এসে সেখানে , জটলা করে । তার সাথে আশেপাশের স্থানীয় কিছু লোকজন যোগ দেয় । তারা সব লাঠিসোঁটা , ড্রাম , এইসব নিয়ে জড়ো হয়ে দূর থেকে বাঘটাকে তাড়ানো চেষ্টা করে । তবে বাঘটা নাকি এখনো যায়নি । ওখানেই কোথায় ঢুকে বসে রয়েছে ।

গাড়ি থেকে নামলাম । টগর তো সেসব শুনে গাড়ি থেকে নামা দূরের কথা, গাড়ির জানালার কাঁচগুলোকেও তুলে দিয়ে ভেতরে বসে রইল। যদু আর জগন্নাথ দা অবশ্য নামল দুজনে । সত্যি কথা বলতে কি, বুক ধুকপুকুনিটা চারগুণ বেড়ে গেল । এই একই মাটির ওপরে খোলা আকাশের নিচে আমি আর এখানেই কোথাও একটা লুকিয়ে রয়েছে চিতাবাঘটা । এইরকম অকল্পনীয় একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে ভাবা যায় ! জটলাটার দিকে এগিয়ে গেলাম । দেখলাম কম করে হলেও জনা পঁচিশ তিরিশ লোক জড়ো হয়েছে । তাদের হাতে বড় বড় বাঁশের লাঠি, দু’চারটে ড্রামও নিয়ে এসেছে, কয়েকজনের হাতে মশাল জাতীয় কিছু , আগুন জ্বলছে । আমাকে দেখেই তারা উত্তেজিত হয়ে সমস্বরে অনেক কিছু বলতে লাগলো । তাকিয়ে দেখলাম আমার টি এস্টেটের লেবার রয়েছে প্রায় দশ বারোজন । তাদের বক্তব্যের সারাংশটুকু আগেই আমার শোনা । এখন তাদের হাতের নির্দেশ লক্ষ্য করে যা বুঝলাম, সেখান থেকে প্রায় তিনশো কি চারশো মিটার দূরে চা গাছের ফাঁকের মধ্যেই একটা পূর্ণাঙ্গ চিতা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। আরও একটা নতুন তথ্য যা পাওয়া গেল, সেই চিতাবাঘটি একা নয়, সে একটি মা চিতা এবং সঙ্গে তার শাবক রয়েছে। কাছাকাছি ওই নদীর ধারের জঙ্গল থেকে এসে পড়েছে নিশ্চয়ই এখানে । বন্যপ্রাণীদের দেখা পাওয়া গেলেই স্থানীয় মানুষজন এত ভিড় করে ফেলে না? সেটাই মুশকিল । হয়তো এই মা আর শাবক কোন কারনে এখানে এসে পড়েছিল । আবার কাল সকাল হওয়ার আগেই হয়তো খুঁজে খুঁজে নিজেদের ডেরায় বনের মধ্যে ফিরে যেত । কিন্তু এখন চারপাশে লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি, ড্রামের শব্দ, এইসব দেখে শুনে, মা আর তার শাবককে নিয়ে চা বাগানের আড়াল থেকে বেরোনোর ভরসা পায়নি । সন্তানের সুরক্ষার কারণে যে কোন বন্যপ্রাণী সদা সতর্ক থাকে ।

আমাকে আসতে দেখেই জমায়েত করা মানুষগুলোর মধ্যে একটা অস্থিরতা বাড়লো। এতক্ষন তারা দূর থেকে লাঠিসোঁটা, ড্রামের আওয়াজ করে, বাঘটাকে ওখান থেকে তাড়াতে চাইছিল । তবে টি এস্টেটের ম্যানেজারের পারমিশন না নিয়ে খুব একটা কাছাকাছি যেতে পারছিল না । আমাকে আসতে দেখেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওরা যা বলতে চাইল, তা হল- যেখানে চিতাবাঘটা তার শাবককে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে, সেখানে তারা লাঠিসোঁটা সাথে যা আছে, তার সাথে দু-একটা বর্শার ফলার মতো অস্ত্রও হাতে রেখেছে দেখলাম , সেগুলো নিয়ে মশালে আগুন জ্বেলে এগিয়ে গিয়ে বনের দিকে চিতাবাঘটাকে তাড়াতে চায় । এখানে এই চা বাগানের মধ্যে বসে থাকলে আশেপাশে যে দু-একটা বসতি আছে, তাদের জন্য ভয়ের। আবার যে চা শ্রমিকরা কাল সকাল থেকে কাজ করতে আসবে, তাদের জন্যও বটে। আমার টি এস্টেটের মধ্যে যেহেতু পড়ছে, সেহেতু আমার পারমিশন না পাওয়া পর্যন্ত ওরা বেশি এগোতে পারেনি । আমি পারমিশন দিলেই ওরা এগিয়ে যাবে। কিন্তু, আমি এমন পারমিশন দিই কি করে ? এই দলটার মধ্যে যেকোন কাউকে বাঘে আক্রমণ করে ফেলতে পারে । আর তা যদি নাও হয় , এদের হাতে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অস্ত্র রয়েছে, বাঘটাও জখম হতে পারে , কিংবা তার শাবক। এভাবে বনদপ্তরকে খবর না দিয়ে, নিজেরা কিছু করতে গেলে উভয়পক্ষের যেকোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা । আমি তাদের যথাসম্ভব বোঝাতে লাগলাম, তারা নিজেরা কিছু না করে যেন বনদপ্তরকে খবর দেয়। প্রথমটায় তারা মানছিল না আমার কথা । কিন্তু তারপরে অনেক করে বোঝাতে তারা রাজি হল । আমি ব্যাপারটা বনদপ্তরকে ফোন করে জানালাম । তারা আসার আশ্বাস দিল ।

তারপর প্রায় মিনিট দশেক সময় কেটে গেছে। আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তাদের ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা তাদের নিজেদের জন্য খুবই রিস্কি। তারা যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়ে জায়গাটা ফাঁকা করে দিলে আমি সেখানে গাড়ির মধ্যে বসে থেকে বনদপ্তরের লোকজনের এখানে আসার জন্য অপেক্ষা করবো । তারপর তারা এসে যা করার করবে। কেউ কেউ বুঝলো, তবে বেশির ভাগই বুঝলো না । তারা দেখে যেতে চায় কি হলো বাঘটার । মানুষের এই অহেতুক কৌতুহল ব্যাপারটাই বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষার জন্য হানিকর সবচেয়ে বেশি । কথা কাটাকাটি হতে লাগল তাদের সঙ্গে । ইতিমধ্যে যখন সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যস্ত, তখন আর বাঘের দিকে নজর করা হয়নি । হঠাৎ করে কে একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, বাঘটা নাকি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে এসেছে । ওখানে গাছগুলোর মধ্যে সে তাকে দেখেছে । কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ । একেবারে সমস্ত শোরগোল যেন নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল । তারপরেই ওই দলটার মধ্যে পাঁচ-ছ’ জন অহেতুক কৌতূহলে কিছুটা এগিয়ে গেল । মুখ থেকে বিভিন্ন বিচিত্র শব্দ বার করছে তারা । আমি বারণ করাতে কোন কাজ হলোনা । সেই ক’জনের দেখাদেখি বাকি দলটাও যে যার মত এগোতে লাগল তাদের সঙ্গে ।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার । তিরিশ কি চল্লিশ সেকেন্ড হবে । তারা হয়তো হাত দশেক এগিয়েছে । ওই সমস্ত বিচিত্র শব্দের মধ্যে বাঘের নড়াচড়ার কোন শব্দ আর পাওয়া যাচ্ছে না । সে যে ঠিক কোথায় রয়েছে, তা কিছু বুঝতেও পারছিনা ।
এমন সময় ! এমন সময় এক হাড় হিম করা দৃশ্য ! মুহুর্তের মধ্যে আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠল । হিমশীতল একটা তড়িৎ স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে । দেখলাম , উল্কার বেগে একটা হলুদ রঙের মাংসপিণ্ড ঠিক যেন উড়ে এসে পড়ল দলটার মধ্যে । সাথে বুকের অন্তস্থল পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলা এক ভয়ানক গর্জন!

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323

সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here