#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
বারো
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
ভেবেছিলাম পরেরদিনই গিয়ে মেয়েটির বাবা বা ঠাকুমা যিনি ঘরে থাকেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে সেদিন সন্ধ্যার ঘটনা বলে আসবো । আর, সেদিন যে তাড়াহুড়োতে দেখা করে যেতে পারিনি সেটাও বলে আসবো । একটা বাচ্চা মেয়েকে ঐরকম ফাঁকা জায়গা থেকে পিক আপ করে বাড়ির বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসা রীতিমতো অশিষ্ট আচরণের মধ্যে পড়ে। এমনকি নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক করে পালন করা বলেই না সেটাকে। সেই খুঁতখুঁতানিটা রয়েই গেছিল । এমন কিছু তাড়া তো সেদিন ছিল না, বা সেরকম কিছু দেরিও হয়ে যায় নি বাংলোয় ফিরতে । যে, পাঁচটা মিনিট আমি সেখানে নামতে পারতাম না । কিন্তু , সমস্তটাই মুডের ওপর নির্ভর করে । সেদিন কেন যে মুড ছিল না , কে জানে। যাইহোক, তারপরে সেটা আমাকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে । তারপরের কয়েকটা দিন কাজের কিছু বেশি চাপ ছিল। তাছাড়াও মা ফোন করে বলেছিল, বাবার শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছে। সেটা নিয়ে দু তিনটে দিন ভালো রকম টেনশনে কাটলো । মাঝে মনে হচ্ছিল, হয়তো বা আমাকে দু তিনটে দিন সিএল নিয়ে যেতে হবে বাবা-মার কাছে। সেই রকম অনুযায়ী মেন্টাল প্রিপারেশনও নিয়ে ফেলেছিলাম । সবে মাত্র চাকরীতে জয়েন করার এক মাসের মধ্যেই ছুটিগুলো নিতে চাইছিলাম না । তবে এমার্জেন্সি প্রয়োজনে তো ছুটি নিতেই হবে । যাইহোক , ছুটি নেওয়ার আর প্রয়োজন পড়েনি। দুটো দিন পরেই মা জানাল বাবার শরীর ঠিক আছে অনেকটা । আপাতত আমার সেখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই সমস্ত কাজ আর টেনশন নিয়ে সপ্তাহটা কাটলো । শনিবার মা-বাবা দুজনের সাথে কথা বলে মনটা খুব হালকা লাগছিল । বুঝতে পারলাম , বাবা এখন যথেষ্ট ভালো আছে । মাথার মধ্যে চিন্তা থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত হয় । গোটা সপ্তাহ তাই আমি খুব ভালো করে ঘুমোতে পারিনি । তবে শনিবার রাতের ঘুমটা একেবারে জম্পেশ হয়েছিল। এক ঘুমে সকাল ।
রাতে ঘুম ভালো হলে সকাল সকাল ঘুম ভেঙেও যায়। আমারও তাই হল । রবিবার ভোর ছটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ে গেল আজ রবিবার। কর্ম ব্যস্ততা নেই । অগোছালোভাবে দিনটা কাটানো চলবে । তাই ঘুম ভেঙেও বিছানাতেই শুয়ে থাকলাম। আমার বেডরুমটা দক্ষিণের দিকে । বড় বড় দুটো জানালা রয়েছে। হু হু করে হাওয়া ঢোকে । দক্ষিণের হাওয়া । শরীর জুড়িয়ে যায় । এপ্রিল মাসের শেষ দিন আজকে। বাপরে বাপ ! এই সময় কলকাতার গরম ভাবলেও ভয় করে। কালবৈশাখী ঝড়-জল না হলে তিস্টোনো দায়। এসি না চালিয়ে বাবা-মা একটা দিনও দুপুরে বা রাতে ঘুমোতে পারছেনা। আমি সেখানে, সন্ধ্যেবেলা বাংলোয় ঢুকে পড়ার পরে দক্ষিণ খোলা এই ঘরটায় নিজের শরীরটাকে এনে একবার বিছানায় ফেলে দিতে পারলে- আহা, আহা ! কি শান্তি ! হু হু করে হাওয়া দেয়। ঠান্ডা হওয়া। কোথায় গরম? একটু রাত বাড়ার সাথে সাথে আলতো করে গায়ের ওপর একটা চাদর টেনে নিয়ে শুতে হয় ।
ডান পাশ ফিরে শুয়ে দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম । ঠিক আমার বাউন্ডারির বাইরে একটা পেয়ারা গাছ হয়েছে। নিশ্চয়ই পাখির ঠোঁটে করে বয়ে আনা বীজ পড়ে হয়েছে । তাই সেই গাছটার ওপর এখনও সম্পূর্ণ স্বত্বাধিকার একমাত্র প্রকৃতির । কোন মানুষ গাছটাকে এখনো নিজের অধিকারে নিতে পারেনি । যদিও গাছটার অঘোষিত মালিক আমিই। এখনও সমস্ত শাখা প্রশাখা মেলে পূর্ণাঙ্গ গঠন পায়নি বটে। মাটি থেকে দেড় মিটার উচ্চতা হয়েছে গাছটার । এই জানলাটা থেকে চোখ মেললে এই গাছটাই সর্বপ্রথমে নজরে আসে। তবে, গাছের ডালগুলো বেশিরভাগ আমার বাংলোর বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকে এসেছে। কয়েকটা ছাতারে পাখি অনবরত এ’ডাল সে’ডাল ওড়াউড়ি করছিল । তার সাথে কিচ কিচ , খিচ খিচ , কিচিরমিচির , ঝগড়াঝাঁটি, হই-হট্টগোল। কিছুক্ষণ পর তারা দল বেঁধে উড়ে গেল । একটা মৌটুসী পাখি এসে খানিক ওড়াউড়ি করে বাংলোর সামনের দিকে উড়ে গেল । বোধহয় ফুল গাছগুলোর দিকে। কিছু পরে দুটো ফিঙে এল কোথা থেকে। কিছুক্ষণ আমার সামনে লেজ নাচিয়ে তারাও উড়ে পালালো । সকাল থেকে এই প্রকৃতির মাঝে তাকিয়ে বসে থাকলে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় খেয়াল থাকে না । কোন ক্লান্তি আসে না । চোখ, প্রাণ, মন, শরীর সব জুড়িয়ে যায় । ঘন্টাখানেক ওইভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম পাখিদের কিচিরমিচির বেশ কিছুটা কমে এসেছে। একেবারে ঘুম ভাঙা ভোরে পাখিরা যতটা স্বক্রিয়তা দেখায়, বেলা বাড়ার সাথে সাথে সে সক্রিয়তা কমে আসে ।
তখন কটা হবে, সকাল সাতটা কি সাড়ে সাতটা বাজে । শুনলাম , সদর দরজার কাছ থেকে বেশ কিছুটা শোরগোলের শব্দ আসছে। ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। একটি পুরুষ কন্ঠ, আরেকটি নারী কন্ঠের সম্মিলিত ঝগড়া। টগর আবার কার সঙ্গে ঝগড়া লাগালো? ওহো , দুদিন হল আমার বাংলোয় আবার একজন গেটকিপার কাজে জয়েন করেছে- যদু মল্লিক । অনেক ইম্পর্ট্যান্ট নথিপত্র থাকে আমার কাছে, তাই মালিকপক্ষ একজন গেটকিপার রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদু ছেলেটি বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা , তাগড়াই, দশাসই চেহারা। পাহারা দেওয়ার যোগ্য বটে । তবে মুখে বেশি কথা বলে না, চুপচাপ থাকে। ওর তো এভাবে টগরের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার কথা নয়। যে কারণেই বা ওরা ঝগড়া করুক, আমার সকাল বেলার শান্তি ভঙ্গ হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝগড়া থামলো বটে । তবে সুন্দর যে রেশটা শরীরে-মনে লেগেছিল ভোরবেলা থেকে, সেটা আর রইল না। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাথরুমে গিয়ে প্রাতঃকর্ম সেরে মুখ হাত ধুয়ে বেরিয়ে এলাম । বাইরের লনে নরম সোনালী রোদ পড়ে প্রতিটা ঘাস ঝকঝক করছে। হারানদা মুখ বুজে কাস্তে হাতে আগাছা সাফ করছে।
আমি বেরিয়ে আসতেই , আমার নতুন দারোয়ান যদু ছুটে এসে আমাকে নালিশ করল, দিদিমণি ওই হতচ্ছারী টগর এখানে থাকলে আমি কাজ করতে পারবোনা।
আমি এক ঝলক ওর মুখের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে অন্যমনে হারান দা’র কাজ দেখতে দেখতে বললাম, তবে কি কাজ ছেড়ে দেবে বলছো?
চমকে উঠল যদু। সে কোথায় টগরের নামে খানিক নালিশ করার ধান্দায় ছিল, ভাবতে পারেনি আমি এক বাক্যে তাকে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলব।
হাত কচলাতে কচলাতে মুখ নামিয়ে আমতা আমতা করে সে বলল, ন্নাহ .. দিদিমণি তা বলিনি । তবে ওই টগরকে আপনি একটু খেয়াল করে রাখবেন । ভালো মেয়েছেলে নয় ।
আমি ভেতরে ভেতরে বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেও মুখে তার প্রকাশ না করে শুধু কেটে কেটে বললাম , মেয়েছেলে কথাটা আমার সামনে আর কোনদিন বলোনা যদু । শুধু মেয়ে বলবে । ঠিক আছে ? এখন যাও। সাত সকালে উঠেই নালিশ আমার ভালো লাগেনা । তোমার কিছু বক্তব্য থাকলে পরে শুনবো ।
যদু একেবারে নিভে গেল । সাততাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচল সে । আমি লনের ওপর বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলাম । টগর ঠিক দুটো চেয়ার আর একটা টুল এই সময় লনে এনে রাখে। কিছুক্ষণ পরে সে এলো , গরম ধোঁয়া ওঠা দু কাপ চা নিয়ে। সাদাটা আমার, লালটা হারানদার। চায়ের কাপ দুটো টুলের ওপর রেখে ট্রে’টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, গেল না।
আমি তার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম , কিছু বলবে নাকি ?
ঠোঁট ফুলিয়ে নালিশ করার ভঙ্গিতে সে বলল, মেম , ওই দারোয়ানটা হেব্বি বদমাশ । ও থাকলে আমার কাজ করতে পোবলেম হবে ।
আমি শান্ত গলায় বললাম , নিজের কাজ করো গে যাও। সকালবেলা এই সমস্ত কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না । আর হ্যাঁ , এইরকম সাতসকালে ঝগড়া কোরো না । বিশ্রী লাগে। কথাটা মনে রেখো । এরকমভাবে তোমাদের ঝগড়া শুনে যেন কখনো ঘুম থেকে উঠতে না হয় । যাও এখন । খবরের কাগজটা এখানে এনে দিয়ে যাও ।
টগর বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে চলে গেল ।
এভাবেই শুরু হল একটা ছুটির দিনের । কয়েকটাই মাত্র ছুটির দিন পেয়েছি জয়েন করার পর থেকে । তবে, ছুটির দিনগুলো মোটামুটি একই রকম কাটে । ব্রেকফাস্টে টগর বেশিরভাগ ছুটির দিনেই লুচি-আলুরদম বানায় । বাঙালি খাবার দিয়ে দিন শুরু । লাঞ্চে থাকে পাতলা করে মটনের ঝোল, সাদা ভাত , তার সাথে টুকটাক , শেষপাতে দই , এইরকমই কিছু।
দুপুরবেলা ঘন্টাখানেক গড়িয়ে নেওয়ারও সময় পাই সপ্তাহে এই একটা দিনই। ভালো করে বেশ অনেকক্ষণ সময় ধরে স্নান করি । চুলে শ্যাম্পু-ট্যাম্পু করি । টগর প্রতিদিন চান করার ঘন্টাখানেক আগে রান্নাবান্না সমস্ত সেরে উবু হয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় তেল লাগায় । ওর মাথা ভর্তি কালো চুল। পাছা ছাড়িয়ে নেমে গেছে । চুলের গোছ এখনো যা, একহাতে কষ্ট করেই ধরতে হবে। ভাবা যায় ! এই ছুটির দিনটাতে আমি ওর অনেকক্ষণ ধরে তেল মাখা দেখি । ও পেছনদিকে মাথাটা হেলিয়ে আঙ্গুলের ডগায় অল্প অল্প করে তেল নিয়ে মাথায় সিঁথি করে চুলে তেল লাগায় । ধীরেসুস্থে । অনেকক্ষণ ধরে ।
আজকে আমি ওর চুলে তেল মাখা দেখছি যে, তা দেখে টগর বললো, মেম, আপনাকে তেল লাগিয়ে দিব ?
অল্পক্ষণ ভাবলাম। তারপর বললাম, আচ্ছা দিও ।
ও নিজের তেল মাখা হতে, অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথা মেসেজ করে করে তেল লাগিয়ে দিল । বহুদিন হলো মাথায় তেল মাখার পাট চুকিয়ে ফেলেছি। সেই যে ভামিনী কাকিমা মাথায় তেল লাগানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তারপর থেকেই বলা যায়। যখন পুরুলিয়ায় থাকতাম, তখন ছোটবেলায় ঠাকুমা , পরে কিছুটা বড় হওয়ার পরে মা, সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে মাথায় তেল লাগিয়ে দিত। তবে তারা মেসেজ করতে জানতো না। টগরের মেসেজ করার হাতটা অসাধারণ। সকালবেলায় টগর আর যদুর ঝগড়াটুকু বাদ দিলে, সারাটা দিন বেশ ভালোই কাটলো।
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে উঠে কিছুটা ভাতঘুম দিলাম । বিকেল বেলায় একটা বেতের চেয়ার নিয়ে লনে বসেছিলাম । চারিদিকে সবুজে সবুজে ছয়লাপ। সোনালী রোদ কিছুক্ষণ পরে গোধুলী রঙের সাজে সেজে রাঙিয়ে দেবে প্রতিটা ঘাসের ডগা, গাছের পাতা, ফুলের পাপড়ি । তারপরে একসময় ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। পাখিদের কলকাকলি থেমে গিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ঝিঁ-ঝিঁ ডাক শুনতে পাওয়া যাবে ।
আজকে বিকেলে হালকা প্রসাধন করেছিলাম । ইচ্ছে ছিল চারপাশে একটু ঘুরে বেড়ানোর । প্রসাধন বলতে কিছুই নয় , ঘরের নাইটিটা ছেড়ে একটা আয়রন করা পেঁয়াজ রঙের কুর্তি, সাদা লেগিন্স, দুটো ছোট ছোট ঝুমকো পড়েছিলাম কানে । শ্যাম্পু করা চুলটা আঁচড়ে ছিলাম যত্ন করে । খোলা ছিল। বাঁধিনি । একটা সময় কোমর ছাড়ানো চুল ছিল । তখন ভামিনী কাকিমা চুল কাটানো করিয়েছিলেন । সেদিন কষ্ট হয়েছিল। আর আজকে চাইলেও চুল রাখার উপায় নেই । চুলের গোছ সরু হয়ে গেছে । সরু বিনুনি দেখতে বিশ্রী লাগে। চারপাশটা ঘোরার ইচ্ছা থাকলেও শেষমেষ আর কোথাও যাইনি। লনেই চেয়ার নিয়ে বসেছিলাম।
টগর বাংলোর সদর দরজার সিঁড়ির কাছে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে । লম্বা চুলটাকে দু’ভাগে ভাগ করে ডানদিক বাঁদিক যত্ন করে ধরে ধরে আঁচড়াচ্ছে । শরীরটাকে দুলিয়ে কখনো চুলের গোছাকে ডানদিকে নিয়ে আসছে , কখনো বাঁদিকে । ওর শরীরের অসম্ভব বাঁধুনি । আমার থেকে বয়সে হয়তো দু তিন বছরের বড় হবে। কিন্তু, ওর বয়স না জানলে কারোর পক্ষে সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয় । কালো চিকন চামড়ায় যেন কুঁদে বসানো একটা মূর্তি । যেমন সুগঠিত বুক, তেমন কোমরের খাঁজ, তেমন নিতম্বের গড়ন। আটপৌরে করে শাড়িটা পরে একেবারে আঁটোসাঁটো করে গাছকোমর আঁচলটা গুঁজে ছুটে ছুটে যখন কাজ করে বেড়ায়, তখন তাকে দেখে যেকোনো পুরুষ বলবে ‘সেক্সি’ । মহিলারাও বলবে বটে। তবে, মহিলাদের বলার সঙ্গে কামনা থাকবে না । কিন্তু, বেশিরভাগ পুরুষ এই ধরনের একটা নারী-শরীর কামনা করে বসতেই পারে । ওর চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গিমার সাথে সাথে দেহে যেরকম হিল্লোল উঠছে, তা দেখেও সেই একই কামনার বশবর্তী হওয়া যায় বটে । হঠাৎ করে কেমন যেন একটা অনুভুতি হল । এই অনুভূতিটা যেকোন মেয়ের একটা স্বতঃসিদ্ধ অনুভূতি । তারা তার নিজের দিকে বা কাছে থাকা কোন মহিলার দিকে কোনো পুরুষ যদি লুব্ধ দৃষ্টি দেয়, তা কেমন করে যেন বুঝতে পারে। চোখের সামনে না দেখলেও বুঝতে পারে । আমার এই অনুভূতি থেকেই সেই অস্বস্তিটা হলো । পিছন দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম, লনের ওপাশে গেটের ঠিক পাশটাতে টুলের ওপর বসে বসে যদু একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে টগরের দিকে। দৃষ্টিতে লুব্ধতা । দেখে কি ঈর্ষান্বিত হলাম আমি ? আমিও মহিলা, টগরও মহিলা । অথচ , টগর আজও পুরুষদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে । আমি কি তবে –
ইস্! এসব কি ভাবছি আমি ? মনটাকে এত ছোট হতে দেওয়া উচিত নয় ।
ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে আশেপাশে তাকালাম। মানুষ আর তার ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডির বাইরে চোখ রাখাই ভালো । চারিদিকে শুধু চা-গাছ আর চা-গাছ । দিগন্তরেখা ছুঁয়েছে । এই চা বাগানের সঙ্গে আমার যে সত্যিকারের সম্পর্ক কি, তা বুঝতে পারিনা । শত্রুতা নাকি বন্ধুত্ব । কত কিছু দিয়েছে জীবনে , কত কিছু কেড়েও নিয়েছে ।
কিছুটা আনমনে বিভিন্ন পাঁচমিশালী ভাবনাচিন্তা আসছিল মনের আঙিনায় । হঠাৎ করে দেখলাম, একটা স্কুটার ভটভট্ করে শব্দ তুলে এসে দাঁড়ালো আমার বাংলোর লনের গেটটার সামনে । স্কুটারটা থেকে একজন ভদ্রলোক নামলেন । তার সাথে একটি মেয়ে । আরে, এ তো উপমা !
দুজনে গেটের সামনে স্কুটার থেকে নামতে , যদু এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো । তারপরে খুব সম্ভবত ওদের ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমি সবটাই দেখেছি , কিন্তু কোন ব্যস্ততা দেখাই নি ।
যদু আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, দিদিমণি একজন ডাক্তার বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ।
আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, নাম কি বলেছেন?
–কি যেন –
মাথাটা চুলকিয়ে নিয়ে বললো, ইন্দ্র না কি যেন একটা –
–বুঝেছি । ওনাদের এখানেই নিয়ে এসো । আর টগরকে গিয়ে বলো, ও যেন দুটো চেয়ার দিয়ে যায় এখানে ।
— আচ্ছা দিদিমনি ।
যদু ওদের কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই দেখলাম উপমা আমাকে দেখতে পেয়েছে । দেখেই তাড়াহুড়ো করে প্রায় ছুটে আমার কাছে আসতে গেল । কিন্তু দু’চারটে পা ফেলেই ‘উফ্!’ বলে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এল আমার দিকে। বুঝলাম ওর পা-টা এখনো সম্পূর্ণ সারেনি । ছুটতে গিয়েছিল , তাই পায়ে লেগেছে ।
দেখলাম , আজকে ওকে বেশ ফ্রেশ লাগছে । উপমাকে এর আগের দিন সন্ধ্যায় অন্ধকারে ঢাকা চা বাগানের মধ্যে দেখেছিলাম । সেখানে ধুলোমাখা উপমাকে দেখে একেবারেই ভাল লাগেনি । আজকে বেশ ভালো লাগলো । বড় বড় দুটো উজ্জ্বল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আমার একেবারে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল ও । আমি ওকে আজ প্রথম দিনের আলোয় দেখলাম। বাহ্, ভারী মিষ্টি তো মুখটা ! শুধু চোখ দুটোই নয় , মুখের প্রত্যেকটা অংশই ভারী সুন্দর, কাটা কাটা । মনে পড়ল টগর বলেছিল বটে , ওর মাকে খুব সুন্দর দেখতে । তবে ও যে ওর মাকে পায় না, ওর মায়ের যত্ন ভালোবাসা পায় না, অযত্নে অবহেলায় বড়টি হচ্ছে , তার ছাপ এর আগের দিন ওর চেহারায় থাকলেও, আজকে নেই । বুঝলাম মধ্যে এই দু তিনটে দিন সে তার পায়ে ব্যথা লাগার কারণে বাড়ি থেকে বেরোতে পায়নি। তাই হয়তো তার ঠাকুরমা তাকে বেশ মানিয়ে গুছিয়ে রেখেছে ঘরে । ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার দিকে । বয়স হয়তো ন’-দশ বছর হবে । মাজা মাজা গায়ের রং । হাইটটা একটু শর্ট বলে মনে হল বয়সের তুলনায় । অবশ্য আমার দেখার ভুলও হতে পারে । এখন তো বাড়ার বয়েস । ঠিক হয়ে যাবে । তবে উচ্চতা কম হওয়ায় তার চেহারার মধ্যে একটা পুতুল পুতুল ভাব রয়েছে । ঘাড় পর্যন্ত চুল আজকে মাঝে সিঁথি করে দুদিকে দুটো ঝুঁটিতে বাঁধা । তার মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁটি দুটো যেনো কলকল করে হেসে উঠছে । ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে । পরনে একটা ফ্রিল দেওয়া, ঘটি হাতা কমলা রঙের ফ্রক । বেশ অনেকটা ঘের । পিছনে বেল্ট বাঁধা ।
সে আমার দিকে তার কালো কালো চকচকে দুটো মণি তুলে বললো, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো ?
আমি তার প্রশ্নের উত্তরে অল্প হেসে তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তখন ‘নমস্কার’ শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, তার সঙ্গের ভদ্রলোকটি কখন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন , এবং দুটো হাত জোড় করে ‘নমস্কার’ করার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে নমস্কার’টি জানিয়েছেন। আমি বুঝলাম, ইনিই ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী । টগরের ভাষায় ‘ইন্দোর ডাক্তার’ বা ‘পাগলা ডাক্তার’ । যদু আগেই এসে পরিচয় দিয়ে গিয়েছিল, তবে না দিলেও বুঝতে পারতাম । আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি-নমস্কার জানালাম।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/
এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/
ছবি : সংগৃহীত