হলদে প্রজাপতি পর্ব-১১

0
347

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

এগারো

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

যখন হুঁশ ফিরল, তাকিয়ে দেখি চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে । ওমা, একি ! এক্ষুনি ঝুপ করে সন্ধ্যে হয়ে গেলে, চা বাগানের বুক চিরে সরু সরু যেসমস্ত মেঠো রাস্তাগুলো চলে গেছে , সেগুলো ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায় । মাঝে মাঝে দু একটা আলো থাকলেও, সব রাস্তাই চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকে । তখন রাস্তা ঠিক করা খুবই মুশকিল । চেনা রাস্তাই তখন ঠিকঠাক চিনে যাওয়া যায় না । আর এ তো অচেনা রাস্তা । পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করে আসার সময় এসে পড়েছিলাম । তারপর অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে কখন নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছি । খেয়াল ছিল না । প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সূর্যের আলোর শেষ বিকিরণটুকুও মুছে যাবে। কি হবে? ফিরতে পারব তো ? তাড়াতাড়ি করে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ বসলাম । আসার সময় যে রাস্তায় এসেছি , সেই অনুযায়ী ধারণা করে করে গাড়ি চালাতে লাগলাম । এসব অঞ্চল অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মোটামুটি জনমানব শূন্য হয়ে যায়। মধ্যে কয়েকবার ভুল বাঁক ধরে গাড়ি চালিয়ে ফেললাম । ভাগ্যে দু-একজন মানুষজনকে পেলাম রাস্তায় । তাই কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করতে করতে শেষে চেনা রাস্তায় এসে পড়লাম । এবার আর আমার কোন অসুবিধা হবেনা । এখান থেকে আমি ফিরে যেতে পারবো বাংলোয় ।

তখনো প্রায় মিনিট কুড়ির রাস্তা বাকি । যেখান দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে কোথাও কোনো আলো নেই। গাড়ির হেডলাইটই ভরসা । দু’পাশে চা বাগান গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে । কেমন যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি! গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করে মনে হলো – সেই তো ! এক মাস হয়ে গেল এখানে রয়েছি। একদিনও সন্ধ্যার পর চা বাগানের মেঠো রাস্তার মধ্যে দিয়ে তো হাঁটতে বেরোনো হয়নি । বেরোতে হবে একদিন । ব্যাপারটা খুবই রোমাঞ্চকর হবে যে, তাতে সন্দেহ নেই । হঠাৎ করে যদি কোন হিংস্র জন্তু সামনে এসে পড়ে, কিংবা তার থেকেও আরও এক কাঠি ওপরে গিয়ে ভাবতে লাগলাম, যদি অশরীরী জাতীয় কিছু থেকে থাকে এখানে, হঠাৎ করে উদয় হয় এখন আমার সামনে ? কেমন হবে ? কল্পনাপ্রবণ মানুষদের এই এক অসুবিধা। সবসময় সমস্ত পরিস্থিতিতেই তারা আকাশকুসুম কল্পনা করতে থাকে । বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে গুলিয়ে ফেলে অনেক সময় ।

এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছি, হঠাৎ করে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। কিছুটা দূরে একটা অবয়ব ফুটে উঠল । গাড়ির আলোয় দেখতে পেলাম একটা বাচ্চা মেয়ে হবে । কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির উদ্দেশ্যে দুটো হাত নাড়ছে । হঠাৎ করে যেন রাস্তার মাঝ-মধ্যিখানে ভুঁই ফুঁড়ে উঠলো মেয়েটা । বেশ চমকে উঠলাম । ওরকম একটা অলৌকিক পরিবেশ, তার মধ্যে যে অলৌকিক চিন্তাভাবনা মাথায় আসছিল না একেবারে, তা নয় । তার মধ্যে ওইভাবে মেয়েটা হঠাৎ করে গাড়ির সামনে চলে আসায় চমকে ওঠার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি ব্রেক কষলাম । মেয়েটার থেকে কিছুটা দূরত্বেই গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড গাড়ির আলোয় মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। বাচ্চা মেয়ে । দশ-বারো বছর বয়স হবে। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত একটা হালকা রংয়ের ফ্রক পরেছে । এখানে সেখানে ধুলোর ছাপ । দেখলাম , মেয়েটা এগিয়ে আসছে আমার গাড়ির দিকে। লক্ষ্য করলাম, মেয়েটা ভালো করে হাঁটতে পারছে না । মনে হল যেন সে একটু খোঁড়াচ্ছে । মেয়েটা আমার গাড়ির উইন্ডোর পাশে এসে দাঁড়ালো। উস্কোখুস্কো চুল , খড়ের মতো । বিশেষ চিরুনি পড়ে বলে মনে হলো না । কপালের অর্ধেকটা আর বাঁপাশের চোখটা চুলে ঢাকা রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, কেমন যেন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হল । এইরকম জনমানব শূন্য অন্ধকার চা বাগান ! তার মধ্যে হঠাৎ করে এই মেয়েটা কোত্থেকে আমার গাড়ির ঠিক সামনে এসে পড়ল কে জানে !
মেয়েটা হাতে করে চুলগুলোকে কানের পাশে সরিয়ে নিয়ে রিনরিনে গলায় বললো , আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে ?
চুপ করে থেকে মেয়েটার মুখের দিকে দেখলাম কিছুক্ষণ । মুখের মধ্যে কেমন যেন ভয়ের ছাপ । তবে মুখটা ভারী মিষ্টি । চোখ দুটো বড় বড় , উজ্জ্বল।
বললাম , তোমার বাড়ি কোথায়?
— আমাকে গাড়িতে তুলে নাও । আমি আমার বাড়ি দেখিয়ে দেবো ।
অল্পক্ষণ ভাবলাম । মেয়েটাকে কি গাড়িতে তুলে নেওয়া উচিত হবে ? কি জানি বাবা ! আজকাল আবার নানারকম ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হচ্ছে তো। তারপরেই মনে হল, বাচ্চা একটা মেয়ে , এখানে এই অন্ধকারে চা-বাগানে একা দাঁড়িয়ে থাকবে , অথচ আমার গাড়িতে লিফট চাওয়া সত্ত্বেও আমি মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যাব, সেটা তো আর কোনোমতেই সম্ভব নয়।
তাই জিজ্ঞাসা করলাম , কতদূরে তোমার বাড়ি এখান থেকে?
সামনে দিকে হাত তুলে দেখালো সে ।
— এই সামনে গিয়ে ডানদিকে -, তারপর চল না -, আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি ।
গাড়ির ভেতরের লাইটটা অন করে, বাঁ হাত বাড়িয়ে ওপাশের দরজাটা খুলে দিলাম।
বললাম, এসো –
মেয়েটা গাড়িতে উঠে বসলো। লক্ষ্য করলাম , সে বাঁ পা’টা ফেলছে না । সিটের ওপর বসে সে ডান হাতে ধরে রাখা একটা হাওয়াই চটি তার সিটের নিচে ফেলল। দেখলাম , সে ডান পায়ে চটি পরে থাকলেও, বাঁ পা’টা খালি ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কি বাঁ পায়ে কিছু হয়েছে ?
আমার দিকে উজ্জল দুটো চোখ তুলে বললো , কাঁটা ফুটে গেছে একটা ।
— কই দেখি তোল একবার তোমার পা’টা।
সে বাঁ পায়ের চেটোটা ডান হাতে করে তুলে ধরে আমায় দেখাল। দেখলাম বেশ বড়সড় একটা কাঁটা ফুটেছিল । সেটাকে সে যদিও বার করে ফেলে দিয়েছে। তবে রক্ত জমে রয়েছে সেখানটায় । দেখে বোঝা যাচ্ছে কাঁটাটা কিছুটা গভীর পর্যন্ত ঢুকেছিল । আমি দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম ।
বললাম , এখানে এত সন্ধ্যাবেলা তুমি একা একা কি করছিলে ?
— আমি এখানে খেলা করি । আজকে খেলতে খেলতে পায়ে কাঁটা ফুটে গেল । বাড়ি ফিরে যেতে পারিনি ।
— তুমি এখানে খেলা করো ? কাদের সঙ্গে খেলো ?
— আমার তো কোনো বন্ধু এখানে থাকেনা । আমি একাই খেলি।
— তুমি একা একা খেলা করো?
— হুম ।
— তোমার পায়ে তো রক্ত বেরিয়েছে । বাড়িতে গিয়ে বোলো, বাবা-মা যেন ডাক্তার দেখান তোমায়।
— আমার বাবাই আমায় ওষুধ দিয়ে দেবে।
— তাই নাকি ? কি করেন তোমার বাবা ?
— আমার বাবা তো ডাক্তার ।
এখানে ডাক্তার থাকতে পারে ? থাকতে পারে কেন, নিশ্চয়ই থাকবে । প্রতিটা ব্লকেই তো ডাক্তার থাকেন। তবে এই মেয়েটির বাবা কিরকম ডাক্তার, কে জানে । মেয়েটি যেমন যেমন বলছিল , তেমন ভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম । অবশ্য রাস্তা আমার বাংলোয় ফেরার দিকেই । কাজেই আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না ।
কিছুক্ষণ পর একটা রঙ-চটা শ্যাওলাধরা বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে গাড়ি পৌঁছতে মেয়েটি বলল , এখানে দাঁড়াও । এটাই আমার বাড়ি ।
আমি গাড়ির ব্রেক কষে বাড়িটার দিকে তাকালাম । একতলা শ্যাওলা ধরা একটা সরকারি কোয়ার্টার মনে হল । ঠিক মনে হল কিনা অবশ্য জানিনা । গেটের কাছে ছোট একটা চৌকো টিনের পাতের ওপর নাম খোদাই করা আছে- ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী , এমবিবিএস ।

আমি হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলাম । মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে পড়ল । সিটের নিচ থেকে হাওয়াই চটিটা হাতে তুলে নিল ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি ?
বড় বড় উজ্জ্বল দুচোখ মেলে তাকালো আমার দিকে মেয়েটি । বলল , উপমা ।
নামটা শুনে বেশ আনকমন লাগলো । এমন নাম এ অঞ্চলে শুনতে পাবো আশা করিনি । ঠিকঠাক শুনলাম কিনা যাচাই করার জন্য ঘুরিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, কি নাম তোমার ?
— উপমা গাঙ্গুলী ।
বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো সে। ঢোকার আগে একবার পিছন ফিরে আমাকে হাত নেড়ে টা-টা করল । আমিও হাত নাড়লাম । একবার ভাবলাম তার বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা বলে আসবো কিনা। তারপর ভাবলাম , থাক আজকে বড় দেরি হয়ে গেছে । না হয় পরের দিন এসে একবার দেখা করে বলে যাব । বাংলো থেকে তো গাড়িতে বেশিক্ষণ টাইম লাগবে না । মিনিট পনেরো বড়জোর । ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলাম । বাকি রাস্তাটা বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গেলাম । অদ্ভুত লেগেছে আমার কয়েকটা ব্যাপার । মেয়েটার বাবা ডাক্তার । কোনো হাতুড়ে জাতীয় ডাক্তার নয় । এমবিবিএস ডাক্তার । অথচ মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় যেন সে তার বাড়িতে এতোটুকুও কেয়ার পায় না । সাজ-পোশাক , চেহারার মধ্যে কেমন একটা অযত্নের ছাপ । তারপরে, এইরকম সন্ধ্যাবেলায় অন্ধকার চা বাগানের মধ্যে মেয়েটা একা একা বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে কি করছিল ? পায়ে কাঁটা ফুটেছে , বাড়ীতে ফিরে আসতে পারেনি, কেউ তার খোঁজ করতে যায়নি কেন ? সমস্তটাই বেশ অদ্ভুত ধরনের গোলমেলে ব্যাপার । ভাবতে ভাবতেই বাংলোয় ফিরে এলাম ।

টগর দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল , মেম আজ ফিরতে দেরি হল?
আমি বললাম , ওই একটু দূরে গেছিলাম , তাই ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল। তুমি চা বানাও । মাথাটা ধরেছে। একটু বেশি করে দুধ দিয়েই বানিও । র’চা এখন খাব না। আদা দিয়ে দুধ চা করো । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ।

বলে আলনা থেকে নাইটি আর টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিলাম । বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে মাথা-গা ভিজিয়ে স্নান করলাম । সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে এসে প্রতিদিনই গা ধুই। তবে মাথা ভেজাই না । আজকে একটা ঘটনাবহুল দিন । এত বছর পর অতীতের মুখোমুখি দাঁড়ানো খুব চাট্টিখানি কথা ছিল না । তারপরে ফিরে আসার সময় যে ঘটনাটা ঘটলো, সেটাও আমাকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে । প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর বেরোলাম বাথরুম থেকে । ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। টগর খুব যত্ন করে পুরু দুধের চা বানিয়েছে । একটা কফিমগে প্রায় ভর্তি করে দিয়েছে চা। সাথে ভেজ পকোড়া । টগরের রান্নার হাত অসাধারণ । টুকটাক যাইবা বানাক, বড় যত্ন করে বানায় । গরম চায়ে চুমুক দিতে মাথাটা বেশ ফ্রেশ লাগলো ।

টগর চা খাচ্ছিলো আমার সামনে বসে । আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বলল, নেম আজকে বাংলা চিনেলে ভাল বই দিইচে ।
অল্প হেসে বললাম, কটা থেকে?
— নয়’টা ।
পাশে মুড়ে রাখা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে বললাম, দেখবে, তাইতো ? ঠিক আছে। রান্না বান্না সেরে রেখো । কোন চ্যানেলে বোলো, চালিয়ে দেব।
টগর খুব খুশি হয়ে বলল, রান্ধা তো আমার হই যাবে । বেশি টাইম নাগবে না । কাটন বাটন সঅব করি রেকেচি কিনা?
— ঠিক আছে । নটার আগে আমাকে একবার নক করো । না হলে ভুলে যেতে পারি ।
— ঠিক আছে মেম ।
তার দুচোখে আনন্দ উপচে পড়ছে । আমি অবাক হয়ে ভাবি, এদের কত অল্পেই আনন্দ হয় ।
বলল , পোসেনজিতের বই আমার খুব ভালো নাগে।

আমি কিছুক্ষণ কাগজটার এদিকে সেদিকে চোখ বুলিয়ে, তারপর , কাগজের ওপরেই চোখ রেখে টগরকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা ! এখানে এই কিছুদূর এগিয়ে একজন ডাক্তার থাকেন বুঝি ? জানতাম না তো ।
টগর চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল। বলল , ডাক্তার ! একেনে ডাক্তার –
তারপরেই খিলখিল করে হেসে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর কি!
বললো, আচ্ছা মেম, আপনি কি ইন্দোর ডাক্তারের কতা কইচেন ?
— ইন্দোর ডাক্তার !
— হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুর একটা ছুঁড়ি , মে’ আছে কিনা?
— হ্যাঁ একটা বাচ্চা মেয়ে আছে ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ মেম ওই ডাক্তারের কতাই বলচেন । আর তো কোন ডাক্তার একেনে থাকে না কিনা ?
— ও আচ্ছা ! ইন্দোর মানে বলছ ইন্দ্র ডাক্তার ? তাইতো ?
— হ্যাঁ , সেই-
— ডাক্তারবাবুর নামটা ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী বটে । তোমরা বুঝি ইন্দ্র ডাক্তার বল ?
আবার এক প্রস্থ হেসে কুটোপাটি টগর । বলল , ওই ডাক্তার তো পাগলা ডাক্তার।
— পাগলা ডাক্তার ?
— হ্যাঁ একেনে তো সক্কলে জানে কিনা। ওই ডাক্তার এক্কেরে পাগলা ডাক্তার ।
— পাগলা ডাক্তার মানে ? পাগল হলে ডাক্তারি করবেন কী করে? নাকি পাগলের ডাক্তার বলছো ?
হাসতে হাসতে বিকৃত গলায় টগর বললো , ও ডাক্তার এত রুগী দেকে যে.. এত্ত রুগী দেখে .. যে নিজেই পাগল হই গেইচে । আপনি দেকেননি কিনা । দেকলেই বুইতে পারতেন। এক্কেরে পাগলা ডাক্তার।
আমি চুপ করে রইলাম। এখন টগরকে কোনো প্রশ্ন করার মানে হয়না । ও হাসতে এত ব্যস্ত যে ওর কথা আমি ভালো করে বুঝতেই পারছি না । অপেক্ষা করে থাকলাম কখন ওর হাসি থামে । তারপরে না হয় প্রশ্ন করা যাবে । আমার মনেও বেশ কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছে বটে । বাচ্চা মেয়েটার ব্যাপার-স্যাপার আমার খুব একটা স্বাভাবিক লাগেনি। অবশ্য টগরের হাসি থামার পর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতেই হলো না । সে নিজেই গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করলো-

— পাগলা না হলে কোন ডাক্তারে ওই অত্ত কাঁড়ি কাঁড়ি রুগী দেকে মেম ? ও ডাক্তার তো রুগী দেকতে এমন মত্ত থাকতো কিনা, যে ওই অত্ত সুন্দরী বউটা পয্যন্তি একটা বকাটে ছুড়াকে বাগিয়ে নি কাট্টি দিলা –
— কি ! ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ওনাকে ছেড়ে চলে গেছেন?
— তবে আর কইচি কি মেম ? সে এক্কেরে ঢিঢি চাদ্দিকে । ডাক্তারবাবুকে তো একেনে সবাই চিনে কিনা ? শোদ্দা ভক্তিও করে । পাগলা ডাক্তার নিজের ভটভটিটা চালায়ে হুই শউরে যাবে । ঘর ভাড়া নিয়া আছে সেকেনে । পোচুর রুগী আসে হোতা । সব গরিবের গরিব , হদ্দ গরিবের দল । পালে পালে আসে গো । ডাক্তারবাবু হাসপাতলে কাজ করি বেইরে আসেই চিম্বারে বসে কত্ত রাত অব্দি রুগী দেকবা ।
হাতের পাঁচটা আঙ্গুল মেলে ধরে সে দেখালো, এই পাঁচ টেকা করি নিবে –
আবার হাসতে আরম্ভ করল টগর । কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে ঢোঁক গিলে বলল,
— ভাবেন মেম ! পাঁচ টেকা করি নিবে । তা, গ্যাদ্দা রুগী আইবেনা? কেশো, জ্বোরো, খোস-পাকলা ভত্তি সব রুগি দলে দলে আইবে । তাদের মদ্যি, যাদের ওষুধ দিই দিতে পারলে ভালো , না পারলে নিজের গেঁট থিকে বার করি টেকা দিবে ওষুধ-পথ্যি কেনার জন্যি। নিজে ওই একখানা ভাঙ্গা ফুটো ঘরে রইবে । আর রুগীর পিছে স’অব টেকা ঢালবে । মে’টা আচে । দেকার মোট্টে কেউ নেই । ইদিক-সিদিক খেলে বেড়ায় । মে’টাকে দেকেই কষ্ট হয় কিনা ? কেউ দেকার নেই যে । বুড়ি মা থাকে । বাতে নড়তে চড়তে পারে নেকো। তার কাছে ওই মে’কে রেকে, নিজে সারাটা দিন রুগি দেকে বেড়ায় । ফিরে আইবে সেই কোন রাত নয়টা, দশটা, এগারোটা, কোত্তাও কোনো ঠিক নেই । কোনো দিকে কোনো খোঁজ-খিয়াল নেই গো । কেবল রুগী দেকতে ব্যস্ত । মে’টা এদিক-সিদিক করে বেড়ায় , তা বেড়াবা না? বাড়ন্তের সময় যে, ঘরে কি তার অমনি মন টেঁকে নাকি ? দেকে কি মায়াটাই নাগে। দেকে বোঝাই যায় কেউ যন্ন-আত্যি করে নেকো । নোকে কয়, ডাক্তার নাকি গরিব মানষের ভগবান । কতাটা ভুল নয় অবশ্যি। কিন্তু , এমন করে বেড়ালে , বউটা তো পাইলিচে, মে’টার কি হইবে বলুন মেম ? তুমি রুগী দেকবে দ্যাকো। নিজের ঘরটাও তো দেকতে হইবে কিনা?

এই হচ্ছে এক ব্যাপার । এক ভীষণ ব্যাপার ! অর্থাৎ, ধরে নিয়ে আসতে বললে , বেঁধে নিয়ে আসা । ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করলে, একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়িতে চাল টিপে বলে দেওয়া চাল কতটা সেদ্ধ হয়েছে। উফ্, বাপরে বাপ ! কি প্রশ্ন করেছিলাম আমি ? – এখানে কোনো ডাক্তার থাকেন ? টগর যদি ডাক্তারবাবুর আগের জন্মের ইতিহাস জানতো, আমি নিশ্চিত সেটাও বলে দিত । যাইহোক, চুপচাপ শুনলাম । বুঝলাম মেয়েটার এইরকম ছন্নছাড়া ভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণ। টগর তার সম্পূর্ণ বক্তৃতার মধ্যে সুখ্যাতি-কুখ্যাতি যাই করুক , এটা স্পষ্ট যে ওই বাচ্চা মেয়েটার জন্য তার কোথাও একটা মায়া হয় । সেটা অমূলক নয় । ওই মেয়েটাকে আজকে ঐটুকু সময়ের জন্য মাত্র একবার দেখার পরে , এই কথাগুলো শুনে আমারও বড় মায়া হচ্ছে ।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here