#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
দশ
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস।
একেবারে ব্রহ্মতালুতে ঢুকিয়ে নিয়েছি।
কখনোই ভুলবো না।
কিছুতেই ভুলবো না।
সেদিন ফিরে এসেই আগে বই থেকে খুঁজে বার করে চা’গাছের সাইন্টিফিক নামটা মাথার মধ্যে গেঁথে নিয়েছি । ছি ছি ছি ! কি লজ্জার কথা ! আমি বোটানি অনার্সের স্টুডেন্ট হয়ে কিনা চোখের সামনে সর্বক্ষণ যে সবুজের মেলা দেখছি, সেই চা গাছগুলোর সাইন্টিফিক নামটা যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তখনই বলতে পারলাম না? মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। এ লজ্জা রাখি কোথায় ? তবে সোনু দা জিজ্ঞাসা না করে, অন্য কেউ যদি জিজ্ঞাসা করত, তখন যদি আমি সাইন্টিফিক নেম’টা না বলতে পারতাম, তখনও কি এতটাই লজ্জা পেতাম? জানিনা । মনে হয় যেন পেতামনা । সাইন্টিফিক নামটা বলতে না পারা – তার চেয়েও বড় লজ্জার হয়ে দাঁড়ালো সোনু’দা আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করল, তার মধ্যে প্রায় কিছুই আমি উত্তর দিতে পারলাম না ? এমন কেন হলো ঠাকুর ? তুমি আমায় এতোখানি লজ্জা কেন দিলে ? সেই সময়ের জন্য মাথাটা একেবারে ব্ল্যাংক কেন করে দিয়েছিলে? কি ভাবল ও ? আমি কিছুই জানিনা ? আমি একটা হাঁদা ক্যাবলা? এমনিতেই নিজের জড়তার কারণে প্রথমদিন থেকেই আমি ওকে অ্যাভয়েড করে চলতাম । সেদিনের পর থেকে রীতিমতো ভয় পেতে আরম্ভ করলাম। বান্টি বিকেলবেলা বেরোনোর সময় আমাকে ডাকলেও, প্রতিদিনই কিছু না কিছু বাহানায় আমি এড়িয়ে যেতাম। বাংলো থেকে আর বেরোতামই না। শুধু কলেজ যেতাম আর আসতাম । সামনাসামনি পড়লেই আবারো যদি ঐরকম ধরনের কিছু প্রশ্ন করে, আমি যদি আবারো না পারি ! মোটের ওপর কথা, বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না মোটেই বটে , তবে মনটা সর্বক্ষণ তার প্রতিই পড়ে রয়েছে। কি ভেবেছে আমার সম্পর্কে? কি ধারণা হলো? কতখানি বাজে স্টুডেন্ট ভাবলো আমায় ? এই সমস্ত তোলপাড় করে ভেবে চলেছি।
এদিকে বান্টি আমার কাছে গল্প করতো , জানিস তো তরু দিদি , তুই তো আর বেরোস না আমার সঙ্গে এখন । সোনু দাদা তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল –
এই একটা কথা শোনা মাত্রই আমার কান খাড়া হয়ে যেত। আমি বান্টির সঙ্গে বেরোচ্ছি না বলে, আমাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে, সে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে ? মনের ভেতরটা ছটফট করত জানার জন্য কি বলেছে। কিন্তু, বাইরে কোনো আগ্রহ দেখাতাম না। চুপ করে থাকতাম । দেখতাম, বান্টি নিজেই কথাটা শেষ করে কিনা । আর কিছু ও না বললে, তখন খুব নির্লিপ্ত গলায় বলতাম , কলেজ থেকে ফিরে এসে মাথাটা খুব ধরেছিল রে । তা, কি বলছিল ?
‘জিজ্ঞাসা করছিল তোর কিছু হয়েছে কিনা, ঠিক আছিস কিনা তুই। বিকেলে বেরোস না কেন ?’
কোনরকমে দায়সারা গোছের উত্তর দিতো । তারপরেই বলতো, তরু দিদি , তুই আজকাল আর আমার সঙ্গে বেরোস না । ভালো লাগে না আমার। কালকে বেরোবি?
বলতাম, দেখি কাল কলেজ থেকে ফিরে শরীর ঠিক থাকলে বেরোবো ।
সে সময়ের জন্য মনে একটা আলাদা শক্তি পেতাম । ভাবতাম , কালকে ঠিক বেরোবো । একদিন ওরকম প্রশ্ন করেছে বলে কি সবসময় করবে ? কি করে দেখাই যাক না । কিন্তু , তারপরে যেই পরের দিন বিকেলবেলাটা আসতো , তখনই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো । কল্পনায় দেখতে পেতাম, ও আমাকে অজস্র প্রশ্ন করে চলেছে , একের পর এক, আমি একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছিনা । ব্যাস্। বেরোনোর ইচ্ছে উবে যেত । আমি আবার কোন একটা এক্সকিউজ খাড়া করে বলতাম, আজকে হচ্ছে নারে বান্টি । কালকে যাব ।
তবে মনটা অকারণেই ম্যানেজারের বাংলো , আর তার বিশেষ বাসিন্দাটির দিকেই পড়ে থাকতো । দেখতাম সে সকালে আর বিকেলে বেশ কিছুটা সময় ধরে চা বাগানে ফিতেয় করে কি সব মাপছে । তারপর ট্রাইপডের মত একটা স্ট্র্যান্ড এর ওপরে কি একটা যন্ত্র রেখে কি সব দেখছে । আর খচাখচ করে প্যাডের ওপর সঙ্গে সঙ্গে কি সব লিখে নিচ্ছে। আমাদের বাংলোর কাছাকাছি চা বাগানগুলোতে, আবার কখনো কিছুটা দূরে গিয়েও এসব মাপামাপি করে আসতো । আমি কলেজ যাওয়া-আসার পথে দেখতে পেতাম । সে সব দেখেশুনে আমার ভেতরের ভয় ভয় ভাবটা আরো বেশি করে জাঁকিয়ে বসতো । কি জানি বাবা , কত কিছু জানে ! কত পড়াশুনো করে! আমি যে ওর কাছে কতখানি তুচ্ছ , কোন তুলনাতেই আনতে পারতাম না ।
এমনি ভাবে প্রায় সপ্তাহ দুই তিন কাটলো । রাত্রি তখন ন’টা হবে । আমি নিজের ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শরৎচন্দ্রের ‘পরিনীতা’ পড়ছিলাম । ঘরের লাইট বন্ধ ছিল। বিছানার ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প নিয়ে, তার নিচে বই রেখে পড়ছিলাম। বরাবরই রোমান্টিক গল্প, উপন্যাস আমার খুব ভালো লাগে । তবে আজকাল পড়াশুনোর সময় থেকেও কেটেছেঁটে বাদ দিয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে কিছু কিছু বিশেষ উপন্যাস দুবার চারবার ছ’বার করে পড়তে ইচ্ছা করে । কিছু গল্পের বই আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম । নিজের যেগুলো খুব প্রিয় । ভামিনী কাকিমার সংসারে বুকশেলফে কত্ত বই থরে থরে সাজানো । এতটাই নতুন আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে হাত দিতে ভয় হয়। তাই সেইসব বুকশেলফের দিকে শুধু জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম । সেখান থেকে বই নিয়ে আর পড়া হতো না । নিজের আনা দশবার করে পড়া সেই উপন্যাসগুলোই বারবার করে পড়তাম । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ – বিগ্রহপালের সেই হঠাৎ করে আড়াল থেকে এসে রাজকুমারীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখা, উফ্! কিম্বা , ‘ন হন্যতে’র মির্চা ইউক্লিডের অমৃতাকে হঠাৎ করে কাছে টেনে নিয়ে তার ঠোঁটে কামড়ে একটা ছোট্ট দাগ করে ছেড়ে দেওয়া- এসব পড়তে পড়তে কি যে হয়, কি বলবো ! আগে রোমান্টিক গল্প পড়তে শুধু ভালো লাগত। এখন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হয় । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। খেয়াল থাকে না।
— কি রে তরু দিদি ! কি করছিস ? তোকে ডাকলাম শুনতে পেলি না ?
বলতে বলতে হুড়মুড় করে দরজা খুলে একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে বান্টি। আমি এতটাই গল্পের মধ্যে বুঁদ হয়েছিলাম যে, এই জগতে আর ছিলাম না । ও হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে আসায়, চমকে উঠে তাকালাম । তাকিয়ে যা দেখলাম , তাতে ভীষণভাবে চমকে উঠলাম ।
বান্টি একমুখ হেসে বলল , দেখ, কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি তোর ঘরে ।
এদিকে আমার অবস্থা তখন সাংঘাতিক রকমের সঙ্গীন । ধড়মড় করে উঠে বসতে বসতে খেয়াল হল নাইটিটা কখন প্রায় জঙ্ঘার কাছে উঠে এসেছে । আমি উপুড় হয়ে হাতের ওপর থুতনি রেখে দুটো পায়ের পাতা ওপরের দিকে করে দোলাতে দোলাতে নিজের মনে বই পড়ছিলাম । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতে করে নাইটিটা নামিয়ে নিয়ে উঠে বসলাম । তবে সোনুদার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। ইস্, কতটা উঠে গেছিল নাইটিটা ? মানস চোখে দেখতে পেলাম , সোনু’দা ঘরে ঢুকেই আমার নগ্ন পা দুটো দেখেছে। কতখানি দেখেছে ? হাঁটুর ক’ ইঞ্চি ওপরে ছিল ? এভাবে একজন পুরুষ আমার অনাবৃত পা দেখে নিল ? কি হবে এবার? মা বলে, আমার পুরুলিয়ার বন্ধুরাও বলতো , বিয়ে হওয়ার আগে কোন পুরুষ কোনভাবে কখনো যেন মেয়েদের শরীরের যা-কিছু পোশাকে ঢাকা থাকে, তার কোন অংশ দেখে না ফেলে । দেখে ফেললেই নাকি সেই মেয়ের চরিত্রের দোষ হয় । আমার কি তবে আজকে চরিত্রের দোষ হয়ে গেল ? মাথার মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে ! সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে ওই বান্টিটার ওপরে । কি বেআক্কেলে মেয়ে রে বাবা ! ‘তরু দিদি’ , ‘তরু দিদি’ করে যখন তখন তুই নিজে চলে আসিস বলে আজকে সোনু দা’কে সঙ্গে নিয়েও একইরকম ভাবে দুম করে ঢুকে পড়বি? একবারও নক করবি না ? দরজা হাট করে খুলে তো আর রাখিনি । ভেজানো ছিল ।
দুটো কান গরম হয়ে উঠলো । অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত নাইটিতে ঢেকে বসে রইলাম।
বান্টি বলল , এই তরু দিদি , আজকে তো সোনু দাদা আমাদের সঙ্গে ডিনার করবে ।
ক্ষীণ গলায় কষ্ট করে একটু হেসে বললাম, আচ্ছা তাই ?
— হ্যাঁ। তাই সোনু দাদা কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছে । এতক্ষণ তো আমরা নিচে বসে গল্প করছিলাম । তোকে ডাকলাম কয়েকবার । তুই শুনতে পেলিনা । নে দ্যাখ্ । সোনু দাদা তোকে কি জিজ্ঞাসা করছে । উত্তর দে।
আমি তবুও তার দিকে তাকালাম না। শরীর যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে । মুখটাকে আরও একটু নিচে নামিয়ে খোলা বইয়ের পাতার ওপর চোখ রেখে বসলাম। তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম সে গুটিগুটি পায়ে আমার বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে ।
আমি তাও তার দিকে তাকাচ্ছি না..
তাকাচ্ছি না কিছুতেই..
না ..
কিন্তু সে আমার দিকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বান্টি তোমার তরু দিদি কি দেখতে পেয়েছে আমি তার ঘরে এসেছি?
এইবারে আর না তাকালেই নয় । পৃথিবীর সব লজ্জা ভিড় করেছে আমার দু’চোখে । মাথার ওজন মনে হচ্ছে যেন কয়েক মণ। সেটাকে কোনমতেই আর ওপরের দিকে আমি তুলতে পারবো না। তবুও সে সমস্ত বাধা অতিক্রম করতেই হল । জোর করে মুখটা ওপরের দিকে তুলে তার মুখের দিকে তাকালাম । একরকম অদ্ভুত ধরনের ছেলেমানুষি মাখা দুষ্টু-দুষ্টু একটা হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে । আলো-আঁধারি খেলা করছে তার মুখে। কৌতুক মাখা দুচোখে আমার মুখটা যেন জরিপ করছে সে।
আমি মরলাম !
সেই ছেলেমানুষি মাখা হাসি আর দুষ্টুমি ভরা দুটো চোখের সামনে আমার দুনিয়া দুলতে লাগল । ওই চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন বিদ্যুতের শক্ লাগে আমার । সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলেও, শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের ক্রিয়াকর্ম শুরু হয়ে গেল ।
আমি সেদিনই মরেছিলাম ।
কিন্তু তখন বুঝিনি এই ‘মরা’ কেমন ‘মরা’ ।
এইসময় বান্টি হঠাৎ ‘যাই মা ‘ বলে ঘর থেকে চলে গেল । ভামিনী কাকিমা ওকে যে কখন ডাকলেন, সেসব আমি কিছুই শুনতে পাইনি। বিশেষ অনুভূতি যখন শরীর-মন জুড়ে পেয়ে বসে, তখন অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
বান্টি চলে যেতে ও আরেকটু ঝুঁকে পড়ে আমার বইয়ের খোলা পাতাটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, কি করা হচ্ছে? এখন না তোমার পড়াশোনা করার সময় ?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, সব সময় আমি পড়িনা। অনেক সময় গল্পের বই পড়ি ।
— কি গল্পের বই পড়া হচ্ছে শুনি ?
এইবার পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, বা রে ! দেখতে পাচ্ছেন না ?
— অমনি একটা পাতা দেখে বোঝা যায় বুঝি ?
— বাহ্, এমন সব গল্প, এরকম সব উপন্যাস, আমি তো একটা লাইন দেখেই বলে দিতে পারব কোন উপন্যাস ।
শুনে ওর দুটো চোখে দুষ্টু বুদ্ধির ঝিলিক খেলে গেল । তারপর হঠাৎ করে বইটা আমার বিছানার ওপর থেকে তুলে হাতে নিয়ে দু-একটা পাতা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিয়ে আবার সেটা সেখানে রেখে দিয়ে কৌতুক মিশ্রিত গলায় বলল, ‘পরিণীতা’! হুম, বুঝলাম।
বলে আমার বিছানার অন্য কোণে গিয়ে ঝপ্ করে বসে পড়ে বললো , দেখো আজকে কিন্তু আর তোমার পারমিশন নিলাম না ।
বলে মুচকি হেসে বলল, তা পরিণীতা যে পড়ছো , ‘পরিণীতা’ মানে কি বলতো ?
আবার প্রশ্ন !
এবার আর প্রশ্নের উত্তর দিলাম না । যদিও উইথ কনফিডেন্স উত্তরটা খুব ভাল করেই জানা ।
বললাম, আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুন তো ? আমি স্কুলে পড়ি না, কলেজে পড়ি।
এবার হো হো করে কয়েক সেকেন্ড হাসল ও । এই প্রথম আমি ওকে প্রাণ খুলে হাসতে শুনলাম। গায়ে কাঁটা দিতে লাগলো ।
হাসি থামিয়ে ও বলল, কিন্তু তুমি যে কলেজে পড়ো সেটা তো বোঝার উপায় নেই ।
অবাক হয়ে বললাম, কেন ?
— বা রে ! যে সমস্ত মেয়েরা কলেজে পড়ে, তাদের তো দুটো করে ডানা গজায়। উড়ে বেড়ায় তারা । তোমার ডানা কই ?
কথার কোন উত্তর দিলাম না। মুখ নিচু করে বসে রইলাম।
মিটমিটে দুষ্টুমি মাখা গলায় ও বলল, আমি তো প্রতিদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি ।
জিজ্ঞাসু চোখে একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।
ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল । আমি যদি কোন প্রশ্ন করি -।
কোন প্রশ্ন করলাম না দেখে বলল , আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি তো, কখন তুমি উড়ে উড়ে এসে আমার ঘরের সামনের বারান্দায় বসবে।
এবার বুঝতে পারলাম কত বড় ভুল করেছি । কলেজে পড়লে কি কেউ সেটা ওভাবে বলে ? ‘আমি স্কুলে নয় কলেজে পড়ি’? এটা কি একটা বলার বিষয় ? লজ্জায় সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে এল। কেন যে এই ছেলেটার সামনে আমি একটা কথাও ঠিকঠাক বলতে পারি না, কে জানে? সব সময় কি ভুল করতেই হয় ? অথচ কলেজের কথা আলাদা , কলেজে এখনো সেভাবে কারো সাথে সেরকম বন্ধুত্ব হয়নি। খুব যে গল্প করি তা নয়। তবে স্কুলের বন্ধুরা আমায় বলতো, আমি নাকি খুব সুন্দর কথা বলি । তবে এই ছেলেটা সামনে থাকলেই কেন আমার মাথাটা গুলিয়ে যায়?
এবার সে অল্প একটু ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , কই , দেখি তাকাও আমার দিকে ।
আমি চোখ তুলতে পারলাম না ।
— কি হলো ? তাকাও !
তার কথার মধ্যে যেন একটা অর্ডারের সুর রয়েছে । এবার চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলাম ।
আমি তাকাতে সে ছদ্ম গাম্ভীর্যের সুরে বলল, সেদিনের পর থেকে বিকেলবেলা আর বাইরে বেরোও না কেন ?
আমার একসঙ্গে দুটো অনুভুতি হলো প্রশ্নটা শুনে। এক, অসম্ভব বুক ধড়ফড় করতে লাগলো । এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না । তবে তার সাথে মাথার মধ্যে একটা রিনরিনে সুর বেজে উঠল । সেই সুর সারাটা শরীরে যেন অদ্ভুত একটা আমেজ ছড়িয়ে দিলো । ও জানতে চাইছে আমি বিকেলবেলা আর বেরোচ্ছি না কেন । তার মানে, আমি বেরোলে ওর ভালো লাগে । ভালো না লাগলে , আমি বেরোচ্ছি , কি বেরোচ্ছি না , ওর ভারী বয়েই যেত। জিজ্ঞাসা করতো নাকি ? জিজ্ঞাসা করছে মানে নিশ্চয়ই আমি বেরোলে ভালো লাগে ।
আমি আমতা আমতা করে বলতে আরম্ভ করলাম, আমি .. ওই .. কলেজ থেকে কিরে শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ-
আবার ওর ঠোঁটের হাসিটা ফিরে এলো । বললো, তুমি একেবারে মিথ্যে বলতে পারো না । তাই চেষ্টাও কোরো না ।
— মিথ্যে ? মিথ্যে কেন বলব ?
— মিথ্যে কেন বলবে ? সত্যিটা বলতে পারছ না , তাই মিথ্যে বলছো ।
— মিথ্যে হবে কেন ?
— সত্যিটা আমি বলব কি ?
— কি সত্যি?
— আমি সেদিন তোমাকে কয়েকটা কোশ্চেন করেছিলাম । তুমি উত্তর দিতে পারো নি । তাই আর বেরোচ্ছো না । বেরোলেই যদি আমি আবার প্রশ্ন করি, আবার যদি উত্তর দিতে না পারো, তাই ।
যেন আমার সামনে বসে আমার মনটা ও গড়গড় করে পড়ছে আর বলে যাচ্ছে । একি ! আমার মুখে কি মনের কথাগুলো সব দেখা যাচ্ছে নাকি আজকাল ? নাকি , ও মন পড়তে পারে ? অদ্ভুত ছেলে তো ! কোথাও কোনো জড়তা নেই । একবারও ভাবে না, কোনটা বলা উচিত , কি নয় । গড়গড় করে সব কিছু বলে যায় । বলে দিল বেমালুম? আমার মুখের উপর বলে দিল, আমি ওর করা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে আর যাচ্ছি না ? কিন্তু, যা বলেছে, তা তো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি । আমি মুখ নামিয়ে বসে থাকলাম । বিছানার চাদরে ডান হাতের তর্জনীতে করে আঁকিবুকি কাটতে লাগলাম। মুখে কোন কথা বললাম না ।
— হুম ঠিক ধরেছি তবে । সেই জন্যেই তুমি আর যাচ্ছ না । তুমি কি আমাকে তোমার কলেজের স্যার ভেবেছো নাকি? যে প্রশ্নের উত্তর না বলতে পারলে আমি তোমাকে বকে দেবো ? তাছাড়া , সবাইকে কি সব কিছু জানতে হবে ? বলতে পারতে হবে ? এমন অনেক কিছু তো তুমিও জানো, যেটা আমি জানিনা । এখনই প্রশ্ন করলে বলতে পারবো না ।
ও কথাগুলো বলছিল, আর আড়চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিল ।
কথা শেষ করে আমার মুখে দিকে তাকিয়ে কথাগুলোর রিআ্যকশন বোঝার চেষ্টা করল ।
তারপর বলল , ঠিক আছে । আমি আর কোন প্রশ্ন করবো না । তাহলে আশা করি বেরোবে তুমি বিকেলবেলা ? আগে যেমন বেরোতে ?
আমি একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। বললাম , প্রশ্নের সঙ্গে কি আছে ? আমার কলেজ থেকে ফেরার পর শরীরটা-
— ঠিক আছে , ঠিক আছে । বুঝেছি । যা বললাম সেটা শুনবে। কাল থেকে বিকেলবেলা যেন বান্টির সঙ্গে তোমাকেও দেখতে পাই । কেমন ?
বলে আমার দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো । বলল , ঠিক আছে দেন । তুমি এখন –
প্রথমবার যেমন ঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে বান্টি ঢুকে পড়েছিল , আবারও ঠিক তেমনটাই করল ।
ঢুকেই বলল , কিরে তরু দিদি ? নিচে চল । বাপি মা ড্রইংরুমে ওয়েট করছে । ডিনার করার টাইমও তো হয়ে এলো ।
আমার ঘরে যে ওয়াল ক্লকটা ঝোলানো রয়েছে , সেটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ন’টা পনেরো বাজে ।
বললাম , তোরা যা বান্টি । আমি আসছি এখনই ।
— আয় , এস সোনু দা – ।
বলে বান্টি আর সোনু দা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । ইস্ , ঢিলেঢালা একটা ফতুয়া মার্কা নাইটি । ভেতরে অন্তর্বাস নেই । কেমন যেন লাগছে । এই নাইটিটা পরে কি নিচে যাব? যদি চেঞ্জ করি , তাহলে ও কি ভাববে ? ও এসেছে বলে আমি শুধু ডিনার করতে যাওয়ার জন্য আবার ড্রেস চেঞ্জ করেছি? কিন্তু , এভাবে ক্ষ্যাপার মতো যাওয়া যায়? গুটিসুটি মেরে নিজের বিছানায় খাটের ওপর বসেছিলাম, সেটা একরকম। না , এভাবে কিছুতেই ওর সামনে যাওয়া সম্ভব নয় । ওয়াল আলমারিটা খুলে হাতের সামনে একটা নেবি ব্লু কালারের চুড়িদার পেলাম । ঝটপট চেঞ্জ করে নিলাম। অবশ্যই অন্তর্বাস পরলাম । না হলে কেমন যেন বিশ্রী লাগে । আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো না লাগলে, কি করে একটা ছেলের আমাকে দেখে ভালো লাগবে?
ভালো লাগতেই হবে কেন ?
এটা একবারও ভাবলাম না ।
ওর আমাকে ভালো লাগতে হবে কেন ?
এই ধরনের চিন্তা আমার মাথায় আসছেই বা কেন ? নিজের অজান্তেই আসছে । নিজের অজান্তেই আমি অগোছালোভাবে গার্ডার জড়িয়ে রাখা চুলটা মুক্ত করে দিলাম । দু’বার ব্রাশ করলাম চুলে । ভামিনী কাকিমার দাক্ষিণ্যে আমার সেই লম্বা চুলটা এখন জাস্ট কাঁধের কিছুটা নিচে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে । একটা ছোট্ট মেরুন টিপ পড়লাম দুটো ভুরুর মাঝখানে । প্রথম কোন একজন পুরুষকে কেন্দ্র করে, শুধুমাত্র তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে বলে সাজলাম ।
এরপর কত সাজ সেজেছি শুধু ওর জন্য । কতবার সেই সাজ ও ঘেঁটে দিয়েছে –
ঠিক ন’টা পঁচিশে ডিনার টেবিলে গিয়ে বসলাম । বাকিরা আগেই বসেছিল । একবার চোরা চোখে তাকালাম ওর দিকে । দেখলাম ও আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে আছে । ওর চোখে অ্যাপ্রিসিয়েশন । চোখ নামিয়ে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে । সেদিন ডিনারে অনেক কিছু আয়োজন ছিল। বাসন্তী পোলাও, মটন কষা, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ক্ষীর, আইসক্রিম। বুঝলাম সবই আজ এই বিশেষ অতিথিকে নিমন্ত্রণ করার কারণে বিশেষ আয়োজন । সবকিছুই খেলাম খুব অল্প অল্প করে। তবে কোনো কিছুরই কোন স্বাদ পাচ্ছিলাম না ।
তখন আমার সমস্ত অনুভূতিটুকু জুড়ে শুধু একজন!
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
ছবি : সংগৃহীত