#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
তিন
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
টগর যে বেশ কাজের মেয়ে তা মোটামুটি এক বেলার মধ্যেই বোঝা গেল । তবে মেয়ে বলা হয় তো উচিত হবেনা । মহিলাই বলা উচিত । মধ্য চল্লিশের ঘরে হয়তো বয়স হবে। তবু কোনো মহিলাকে মেয়ে বলতে এবং ভাবতে আমার ভালো লাগে। কেমন যেন তাতে করে নিজের বয়সটাও ধরে রাখা যায় । মুঠো গলে বেরিয়ে পালায় না । আমার থেকে ও পাঁচ ছ’ বছরের বড়ই হবে। অথচ সেও যদি মেয়ে হয়, তাহলে তো আমিও মেয়ে । দিব্যি একখানা মেয়ে। বাধা দিচ্ছে কে ? টগর হলো আমার এই টি এস্টেটের বাংলোয় এসে নতুন পাওয়া পরিচারিকা । ওর নামটাও এমন যে মেয়ে বলে ভাবতে ভালো লাগে । মনে হয় যেন এখনই পাঁচটা পাপড়ি মেলে ফুটে উঠবে । মনকে বাঁধে কে? মন নিজেই নিজের রাজা । এই মন নিয়ে কারিকুরি আমার চিরকালের অভ্যেস । আমার নিজের মধ্যে যে মনটা আছে, সে যে আজও তার কিশোরী বেলায় রাজহাঁসের মত ডানা মেলতে চায়। কেন যে কেউ তা আমার মুখ দেখে বোঝে না ? পাতলা হয়ে যাওয়া চুল, ছোপ দাগ পড়া গাল, পেটে , কোমরের চর্বি জমায়েত, এইসব দেখে বয়স নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। এই শরীরের মধ্যে আজও যে সেই একটা ষোড়শী বাস করে, সময় পেলেই যে রাজহংসীর মত দুখানা ডানা মেলে ধরবে-, এই পৃথিবীতে এত কোটি মানুষের ভিড়ে কোটির হিসেবে তার দ্বিগুণ চোখের তারায় কারোর চোখের মধ্যে কখনোই ধরা দেয়নি !
যাক গে , টগর ভারী কাজের মেয়ে। সেটা যদি আরো বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে বুঝতাম, তাহলে আজকের সারাদিনের হয়রানিটা অনেক কম হত । আমার সকালে টি এস্টেট এর বাংলোতে ঢুকেই যদি ম্যানেজার বাবুর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ওনার সাথে বেরিয়ে না গিয়ে, টগরের কথাটা শুনতাম, তাহলে সারাটা বেলা গড়িয়ে গিয়ে অন্তত আমার পিত্তি পড়তো না পেটে। প্রথমে ভেবেছিলাম, ম্যানেজার বাবু বেশ কাজের লোক । সেই জন্য সঙ্গে সঙ্গে এসেনসিয়াল কাজগুলো সেরে নিতে চাইছেন। তারপরে বুঝলাম , লোকটা আসলে মহা স্বার্থপর আর ধুরন্দর । ঠিক কতটা কি কাজ আছে চার্জ হ্যান্ডওভার করার জন্য, সেটা আমার জানার কথা নয় । কিন্তু উনি তো তার প্রথম থেকেই জানতেন । অথচ প্রথম এমন ভাব দেখালেন, যেন টুক করে মিনিট দশ পনেরো দূরে একটা অফিসে গিয়ে দু’চারটে কাজ করে ফেলতে পারলেই চার্জ হ্যান্ড ওভার হয়ে যাবে । আমিও সেই মতো ট্রেন থেকে নেমে জার্নি করে অতোটা পথ আসার পর কিছু না খেয়েই , কোনরকম ফ্রেশ না হয়েই ওনার কথামতো ওনার সঙ্গে ছুটলাম । গিয়ে দেখি , ও বাবা ! অফিসে এটা সেটা, এই ফাইল সেই ফাইল , দেখাশুনো , সিগনেচার, কম্পিউটারে এন্ট্রি করা, সে একেবারে একশো একটা কাজ ! সেখানে সময় লাগলো প্রায় ঘন্টা দুয়েক ।
তারপরে উনি আমাকে বললেন, আপনি একেবারে নতুন তো । তার ওপরে মহিলা । এখানে কোনোদিন আগে কোনো মহিলা ম্যানেজার আসেননি । এখানকার লেবাররা ঠিক কিভাবে আপনাকে নেবে -। দেখা যাক , চলুন আমার কাজটা তো আমি করে আসি । আপনাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিই।
আবার গাড়ি করে চললাম মেঠো পথে গড়াতে গড়াতে , ম্যানেজার বাবু যেখানে নিয়ে চললেন । দেখলাম, অফিস থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা জায়গায় খোলা চা বাগানের মাঝখানে এসে গাড়িটা থামল । সেখানে মেঠো রাস্তার দুই ধারে ভিড় করে আছে অনেকগুলো রোদ জল পাওয়া পেটুয়া কালো কালো নারী এবং পুরুষ। আমি এসে নামার সাথে সাথে ওদের মধ্যে উত্তেজনা টের পেলাম । এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু উত্তেজিত বাক্যবিনিময় করছে যে, তা আমি কিছুটা দূর থেকেও তা বুঝতে পারলাম । অবশ্য আমি কাছে যেতে ব্যাপারটা থিতিয়ে গেল । প্রত্যেকে উত্তেজনা মিশ্রিত কৌতুহলী চোখ মেলে আমাকে দেখতে লাগলো । ম্যানেজার বাবু বেশ তোড়জোড় করে, ঠিক যেমন করে পাড়ার ক্লাবে আগামী নির্বাচনে ক্যান্ডিডেট হয়ে যিনি দাঁড়াবেন, তাকে যেমন করে ইন্ট্রোডিউস করানো হয়, তেমন করে নাটকীয় ভাবে আমার সাথে তাদের ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিলেন । নিজের এমন কিছু কিছু অনাবিষ্কৃত গুণাগুণের কথা সেখানে উঠে এলো, যা ম্যানেজার বাবু আমাকে মাত্র গত দু’ঘণ্টা দেখেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন, অথচ এমন চমকপ্রদ আবিষ্কার আজকে এত বছরেও আমার খুব নিকট কেউও করে উঠতে পারেনি । আমি তো অবাক । বেমালুম বেবাক !
আমার সেখানে খুব একটা কিছু করার ছিল না যদিও, তবুও মূল গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স তো আমারই। বেশ কায়দা করে বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিমায় আমাকেও টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হল । এই পর্বটাও চলল মোটামুটি আধঘন্টার ওপর।
তারপর সেই পর্ব মিটতে, ম্যানেজার বাবু আমাকে বললেন, চলুন ম্যাডাম! এবার আপনাকে মোটামুটি আমাদের টি এস্টেটটার রেডিয়াস-টা বুঝিয়ে দিই।
আবার বেরোলাম। ঘুরতে ঘুরতে মোটামুটি কতখানি অঞ্চল জুড়ে আমাদের টি এস্টেটটা রয়েছে, বোঝাতে বোঝাতে চললেন তিনি । আমার তখন অলরেডি ক্লান্তিতে মাথা ঝিমঝিম করছে । অনেকক্ষণ পেটে কিছু না পড়ার জন্য গা’টাও কেমন যেন গুলোচ্ছে । একেবারে নতুন জায়গা। মানে, ঠিক নতুন না হলেও আপাতভাবে সম্পূর্ণটাই নতুন । নতুন মানুষজন । একবারও বলতে পারলাম না , আমার ইমিডিয়েটলি কিছু খাবার খেয়ে একটু ফ্রেস হয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর এভাবে ঘুরে দেখার মত অবস্থা হতে পারে । বারবার কথাটা ঠোঁটের ডগায় এল । প্রতিবারই গিলে নিলাম । অদ্ভুত কিন্তু লোকটা । একবারও আমাকে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করল না ,আমার কিছু রিফ্রেশমেন্টের প্রয়োজন রয়েছে কিনা ।
এস্টেট ঘুরে দেখা হতে, তারপরে উনি আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের টি এস্টেট-এর টি-ফার্মে । এখানেই আমাদের এস্টেটের সমস্ত চা পাতার প্রসেসিং হয় । আমাদের এস্টেটটা ছোট বলে এখনো নিজস্ব কোন ফার্ম হয়নি । সেখানকার ম্যানেজার অরিন্দম বাবুর সাথে আলাপ হল । কমবয়সী একটা ছেলে। বেশ চটপটে। উজ্জ্বল চোখ মুখ। আমার একটা গ্রস আইডিয়ার জন্য উনি ওনার টি ফার্মের ওভারঅল কাজকর্ম ঘুরিয়ে দেখালেন।
সমস্তটা শেষ হতে তখন প্রায় বেলা আড়াইটে বাজে । আমার তখন রীতিমতো মাইগ্রেন আরম্ভ হয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে । গা গুলোচ্ছে । অরিন্দম বাবু বোধহয় সেটা বুঝতে পারলেন।
বললেন, ম্যাডাম আর ইউ ফিলিং টায়ার্ড ?
শুকনো ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে বললাম, ইটস ওকে। অল রাইট ।
উনি বললেন , আমার প্রথমেই বোঝা উচিত ছিল । আপনাকে বেশ টায়ার্ড লাগছে ম্যাডাম । একটু রিলাক্সড হয়ে বসুন । আমি আপনার রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করছি।
দু একবার ক্ষীণ গলায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। জগতে শিষ্টাচার ব্যাপারটা এমনই , যে নিয়মগুলো রয়েছে সেগুলো শত দুঃসময়ে এসেও মেইনটেইন করে চলতে হয়। যাই হোক, উনি আমার কথায় বিশেষ কান দিলেন না। একখানা ডাব কোথা থেকে কাটিয়ে আনানোর ব্যবস্থা করে, সেই ডাবের জল আর চারটে মিষ্টি দিয়ে গেল আমায় সেখানকার একজন কর্মচারী। সেটাই তখন অমৃত মনে হলো। যদিও মিষ্টি আমার খুব একটা প্রিয় নয়।
আমি যখন খাচ্ছি ,তখন আমাদের এস্টেটের বিদায়ী ম্যানেজার এতটুকুও লজ্জিত হওয়ার কোন সম্ভাবনাটুকু মাত্র না দেখিয়ে আমার মুখের ওপর এসে বললেন, ম্যাডাম এবার আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর আমার সময় নেই । আপনাকে তো মোটামুটি সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছি । এরপর আপনি এডজাস্ট করে বুঝেশুনে থাকুন । যা অসুবিধা হবে আমাকে ফোন করবেন ।
আমি শুধু স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকালাম । ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বললাম না । অবশ্য, কিছু বলি কিনা শোনার জন্য উনি দাঁড়ালেনও না । সঙ্গে সঙ্গেই পা বাড়ালেন।
জগন্নাথ আমাকে যখন আলটিমেটলি আবার বাংলোর সামনে এসে নামালো , তখন পাক্কা সাড়ে তিনটে বাজে। দেখলাম, বাংলোর বারান্দায় শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে টগর। তখনো জানিনা যে ওর নামটা টগর , পরে একসময় জিজ্ঞাসা করায় বলেছে । তখন আমি কোনো প্রশ্ন করার অবস্থাতেই নেই । বহুক্ষণ ধরে ক্রমশ বাড়তে থাকা নিম্নচাপ চেপে রয়েছি কোনোমতে । মাঠে-ঘাটে , টি ফার্মে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। সেখানে কোথায় কি? ফার্মে হয়তো ছিল, কিন্তু সেখান থেকে আধঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বাংলোয় ফিরবো, জানতাম সেটাই শেষ ডেস্টিনেশন আজকের মত, তাই আর ‘টয়লেট কোথায়’ এই প্রশ্নটা করা হয়নি । মেয়েদের কি জ্বালা কম? পুরুষদের তো এসব কোন ঝামেলাতে পড়তেই হয় না । মাঠে-ঘাটে , প্রাকৃতিক যে কোন জায়গায় শুধু অল্প কিছুটা দূরত্বে চলে গিয়ে চেন খুলে বাগিয়ে ধরলেই হল ! আধ মিনিটেই রিলিফ । যাই হোক, আমি বাংলোতে ঢুকেই আগে ছুটে গিয়ে লাগেজ ব্যাগ থেকে গামছা আর একটা নাইটি বার করে নিয়ে টগরকে জিজ্ঞাসা করলাম, টয়লেটটা কোথায় ?
ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসেন ।
দুটো ঘর পেরিয়ে আমাকে টয়লেটটা দেখিয়ে , দরজা খুলে বললো , কইছিলাম আপনি কি মেম, দুটো মুখে কিছু দেইচেন? বেলা তো গড়াইলো। পেটে কিছু পড়েচে কিনা?
ওর কথাটা শুনে মনে পড়ল, আমি বেরোনোর সময় ফিসফিস করে, যাতে ম্যানেজার বাবু না শুনতে পান , এমন করে আমাকে বলেছিল বটে, মেম, একটু কিছু খেই যেতে পারতেন।
তখন ওর কথা শুনিনি । ভেবেছিলাম , অল্প কিছু কাজ আছে। তাড়াতাড়ি সারা হয়ে যাবে । তারপরে ফিরে এসে একেবারে ফ্রেস হব ।
বললাম, ওই টুকটাক।
বলে বাথরুমে ঢুকলাম ।
ও বলল, বেলা অনেক গড়াইচে। তাড়াতাড়ি নে নেন । আমি ভাত বাড়চি।
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বেরোলাম। টগর এসে জানালো ডাইনিং টেবিলের ওপর ভাত বাড়া আছে। গিয়ে দেখলাম বেশ গরম গরম ধোঁয়া ওঠা অল্প ভাত আর মুরগির ঝোল বেড়ে রেখেছে টগর । আমাকে দেখে বলল, আরো কিছু ভাজাভুজি চচ্চড়ি কইরেচি, তবে এত বেলা গড়িয়ে গেচে , কিনা ? ওসব আর খেতে হবে না।
ফ্রেশ হয়ে মাথাটা একটু ছেড়েছিল । ওর দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলাম। বুঝলাম মেয়েটা শুধু যে নিজে দেখে শুনে কাজ করবে, তাই না । আমাকেও দেখেশুনে রাখবে। পরিচালনা করবে। তা যদি পারে, তা ভালোই । আর একটা থালাতে দেখলাম ও নিজের জন্য ভাত আর মুরগির ঝোল বেড়ে রেখেছে।
আমি বললাম, একি! তুমি খাওনি? বসে ছিলে?
সলজ্জ হেসে বলল , তাই কি হয় মেম? আপনি টিরেন থেকে ঘেমে নে এলেন, এত কষ্ট করে । আবার বের হই গেলেন । আমি কিনা একা একাই খে নিব ?
খেয়েদেয়ে উঠে মাথা যন্ত্রণার একটা ওষুধ খেয়ে সটান শুয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যাবেলা । উঠে দেখলাম মা বেশ বার কয়েক ফোন করেছে । সাইলেন্ট করা ছিল , শুনতে পাইনি । সেই তো ! সারাটা দিনের ডামাডোলের মধ্যে, সেই যে এখানে জাস্ট পৌঁছনোর পর একবার মাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম , তারপর আর একবারও কথা বলা হয়নি। ফোন করলাম । যা দেখলাম , আমি ফোন রিসিভ না করায় মা খুবই ভয় পেয়ে গেছিল । বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যা বলার বললাম। বলেই দিলাম , আমাকে একবার কি দুবার ফোন করে যদি না পায় , তাহলে আর বারবার ফোন যেন না করে । আমি মিসড কল দেখলে আবার ঠিক ঘুরিয়ে ফোন করে নেব। কারণ , নতুন জায়গায় এসেছি, এখন কখন কি কাজের মধ্যে থাকবো, সবসময় হয়তো ফোন রিসিভ করতে পারবো না। সারাটা দিন আমি কি কি করেছি, সব মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানলো, কি খেয়েছি তাও । সবটা শুনে বেশ মুষড়ে পড়ল। বলল, এই এত এরকম যদি কাজের চাপ থাকে, তারপর একা একা থাকবো, খাব কি খাব না, কোনো তার ঠিক-ঠিকানা নেই । তার থেকে আমি কলকাতায় যে চাকরিটা করছিলাম সেটাই করতে পারতাম । তাতে অন্তত মা-বাবাকে এই এক্সট্রা টেনশনটা নিতে হতো না । কথাটা কি ঠিক ? নাকি , ভুল ? কে জানে । যে কোন কিছুই এত তাড়াতাড়ি বুঝে ওঠা যায় না , কি ঠিক কি ভুল । দেখি কেমন কি হচ্ছে । এখানে ঠিকঠাক লাগলে তো অসুবিধা নেই। তখন বাবা-মাকে না হয় কিছুদিনের জন্য এনে রাখা যাবে । কিন্তু পার্মানেন্টলি এখানে আমার কাছে রেখে দেওয়াও একটু মুশকিল আছে । কারণ হঠাৎ করে শরীর খারাপ করলে , তখনই মুশকিল ।
জিজ্ঞাসা করলাম, মা , বাবা কোথায় ?
— এইতো নিজের ঘরে বসে আছে। অন্ধকার করে । সন্ধ্যেবেলা যা করে ,তেমনিই-
বাবার ঘরের দেওয়ালে কাঠের একটা সরু সেল্ফ আছে। তার ওপর বাবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , স্বামী বিবেকানন্দ , ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, প্রত্যেকের একটি করে মাঝারি সাইজের বাঁধানো ছবি রাখা । বাবা সন্ধ্যেবেলা প্রতিটা ছবির সামনে একটি করে মোমবাতি জ্বেলে দেয় । তারপর নিজে চুপটি করে বসে থাকে । আত্মমগ্ন হয়ে ।
বললাম, বাবাকে একবার দেওয়া যাবে এখন ফোনটা ?
— সারাদিন ধরেই তো হেদিয়ে মরে যাচ্ছে লোকটা । আমার তনু মা কি করছে, না করছে, এই করে করে। ধর্ দিচ্ছি, কথা বলে নে –
মা ফোনটা বাবাকে দিল।
— বাবা !
— বল মা, কেমন আছিস বল তো-
— ভালো বাবা ।
বাবা আর কিছু বলল না । চুপ করে গেল । আমিও চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করল , কাঁদছিস মা ?
অবাক হয়ে গেলাম । সত্যিই অকারণে দুটো চোখ জলে ভরে এসেছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম, বাবার ঘরে আজকে এখন মোমবাতি জ্বললেও সেখানে অন্ধকার নেমে এসেছে । মেয়ে কাছে না থাকার অন্ধকার । বাবার খুব একা লাগছে । আমি মানস চোখে দেখতে পেলাম, মানুষটা বসে রয়েছে স্থির দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে । আমি এই সময়টা যাই বাবার ঘরে । গিয়ে চুপটি করে বসে থাকি । আজকে বাবা একা একা বসে আছে সেখানে। আমি বুঝতে পারলাম, বাবার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে । তবে সেটা আর বললাম না । তবে বুঝতে পারলাম । ঠিক যেভাবে বাবা পেরেছে।
তখন কটা হবে ? বোধহয় আটটা বাজবে । জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম শুক্লপক্ষ চলছে । বাইরে বেশ চাঁদের আলো । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজে পেতে ছাদের সিঁড়ির দিকে চললাম । টগর কোত্থেকে জানি ঠিক বুঝতে পেরেছে এবং বুঝতে পেরেই ছুটে এসেছে ।
বললো, মেম , কোতা যান ?
বললাম , ছাদে ।
— সে কি ! এই রেতের বেলা ছাতকে কি করবেন ?
— অসুবিধা কি? আর তাছাড়া এখন রাত কোথায়? সবে তো সন্ধ্যা।
— একনই একেনে রাত । আপনেদের শওরের মতো কিচু নয় কিনা ?
— আচ্ছা তাই না হয় হল, রাত । তাতে কি হয়েছে ? নিজের বাড়ির ছাদে উঠবো , তার আবার দিন রাত কিসের?
চোখ গোল গোল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বললো, দাঁইড়েন মেম । আমিও আইচি।
বুঝলাম টগর আমাকে কিছুতেই একা একা ছাদে যেতে দেবে না । ছাদে গেলাম । পিছন পিছন টগরও উঠে এলো । কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেলাম । চারিদিকে তাকিয়েই মনের মধ্যে যেন এক ঝলক বসন্তের হাওয়া বয়ে গেল। এ কি অসাধারণ দৃশ্য! যতদূর চোখ যায়, শুধু আমার বাংলোর গেটের কাছটা ছাড়া আর কোথাও কোনো কৃত্রিম আলো নেই । শুধু প্রাকৃতিক স্মিত একটা রুপোলি আভা । চা গাছ আর তার মাঝে মাঝে যে শেড-ট্রী’ , পাতার ফাঁকে ফাঁকে সেই রুপোলী আভা ঢুকে পড়ে চিকচিক করছে। তবে বেশিরভাগটাই অন্ধকারে ঢাকা । শুধু মাঝে মাঝে ছোট ছোট রুপোলি ছিটে । মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । সারাটা দিনের এত হেনস্থার পরেও এই দৃশ্য সত্যিই এক বিরল মানসিক শান্তির। যখন এখানে থাকতাম, তখন কলেজে পড়ি । ছোট মেয়ে আমি তখন। এইসব দৃশ্যের গভীরতা বোঝার মত মানসিকতা তৈরি হয়নি। নিজেকে, নিজের মন নিয়েই ব্যাস্ত থাকতাম ।
বিভিন্ন ধরনের শব্দ আসছে। ঝিঁঝিঁ , কখনও কখনও এক আধটা রাতপাখির ডাক। আর যে শব্দটা সবচাইতে প্রকট, সেটা হল নিরবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতার শব্দ ! গাড়ি-ঘোড়া নেই, আশেপাশের দশটা বাড়ির সিরিয়ালের শব্দ নেই, পলিটিক্যাল পার্টির মিছিল নেই, হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি নেই ।শুধু অনাবিল কোনো এক বুক ভরা প্রেম নিয়ে যেন প্রতিটা চা’গাছের পাতা তাকিয়ে রয়েছে চাঁদের দিকে। উন্মুখ। বেশ কিছুক্ষণ নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকার পর, বড় একটা শ্বাস টেনে পিছন ফিরে টগরের দিকে তাকালাম।
বললাম , তুমি এখানে কতদিন কাজ করছ?
— তা এক বচর হয়ে যাবে। ঠিক আগের বচ্চর রং’খেলার দিন কাজে ডুকচি কিনা-
— তুমি যে এখানে এই বাংলোয় সবসময় থাকো , বাড়িতে অসুবিধা হয় না? তোমার বাড়িতে কে কে আছে ?
–কে থাকবে মেম ? তিন ভাই কিনা? সেই তারা । তাদের দজ্জাল অনামুকো বউ কখান। একগাদা ছেলে-পিলে । উফ্! সারাটা দিন এ ওকে মারচে, পিষচে, কোন্দল করচে।
— তুমি তোমার ভাইদের সঙ্গে থাকো ? তোমার বর-?
একগাল হেসে টগর বললো, সে তো সেই কবেই ছাড়কে গেল। সে আর হাল খবর লয়না ।
— ও, তোমার বর তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে ? তা তোমার ছেলে-মেয়ে ?
— ছেলে রইচে একটা । সে তো সেই এককান মদ্দ জোয়ান হয়ে গেছে কিনা? একেনে সেকেনে ঘুরে বাইড়াবে , মায়ের খবর লবে নাকো । থাকতো নে কিনে আমার কাচে ?
— ও ! তাহলে তো এখানে কাজটা পেয়ে তোমার ভালই হয়েছে।
— হ্যাঁ, আমি বেশ রইচি।
এরপর কিছুক্ষণ ভেবে বলল, একটা কথা কই মেম ?
— হ্যাঁ কও-
— আপনি একা মে’ছেলে হয়ে একেনে –
সেই একই কথা ! এই নিয়ে তিনবার । এবার হাসি পেল ।
বললাম , কেন? আমি আসায় বুঝি তোমার ভালো লাগেনি ?
ভারী লজ্জা পেল টগর। মুখ নিচু করে বলল, কি যে বলেন মেম ?
ম্যাডাম থেকে ম্যাম থেকে মেম । অপভ্রংশ হয়ে টগরের মুখে এইরকম দাঁড়িয়েছে ।
বলতে গেলাম, তুমি আমাকে ম্যাম ম্যাম কোরো না । দিদি বলে ডেকো । তারপরে ভাবলাম , কটা দিন যাক। বুঝে শুনে নিই। প্রথমেই কাউকে নিজের মত করে কাছে টানার কোন প্রয়োজন নেই। আর কোন কথা বললাম না ।
ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখলাম শুক্লপক্ষের বাঁকা চাঁদটার দিকে আর একবার দেখলাম সেই চাঁদের রুপোলি আলো যে মেয়েটার সিঁথির ওপর পড়ে সেটাকে একটা সরু মাছের কাঁটার মত মেলে ধরেছে, সেই মূর্তিটার দিকে । কি অদ্ভুত! কি ভালোলাগা ! কি নৈসর্গিক পরিবেশ ! এই চাঁদের আলো , এই চা বাগান , নিস্তব্ধতার মাঝে এই ছুপছাপ শব্দ, শিরশিরে ঠান্ডা একটা হাওয়া , সবকিছু মিলিয়ে হঠাৎ মনে হল এই টগর যদি টগর না হয়ে পলাশ হত ? দুটোই তো ফুল, কিন্তু কি সুন্দর এক নিমেষে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে যেত । একজন পুরুষ এই রূপালী সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার থেকে তিন হাত দূরে। মাদল হাওয়ার সাথে একটা পুরুষালী গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে । আমি কি আর তবে এমনিভাবে কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম ? চিরন্তন প্রেমপিপাসু সেই নারীসত্তা কি আমার মধ্যে জেগে উঠত না? উন্মত্ত আবেগে কি আমি ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম না ? ও কি তখন আমার মুখটা তুলে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিত না? মুখ থেকে ক্রমশ ওর ঠোঁটটা কি আরও নিচের দিকে নেমে আসতো না ? এই সমস্ত কল্পনামাত্রই আমি আর তখন এখনকার এই ‘আমি’ থাকিনা । নিমেষের মধ্যে তখন আমি একজন অষ্টাদশ তরুণী- চিকন গাল, কোমর ছাড়ানো খোলা রেশমের মতো চুল, শরীরে গন্ধরাজ লেবুর গন্ধ, ঠোঁট দুটো রসালো, উন্মুখ। গায়ের ওড়না দামাল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেছে। চুড়িদারের বুকের কাছে নিজের গৌরবে মাথা তুলে রয়েছে দুটো উন্মুখ নারীদেহের চিহ্ন । আপন গৌরবে ফুটে রয়েছে তারা। এতগুলো বছর কেটে গেল , কই তেমন করে তো আর কেউ ছুঁয়ে দিল না ? এতগুলো বসন্ত অশোক বনের সৌরভ বয়ে আনলো, এতগুলো চৈত্রের আমের মুকুল ঝরে পড়লো, এতগুলো বর্ষা ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ ফোটার পর সে চিঠি পাঠিয়ে দিল গুরুগম্ভীর বর্ষণের সাথে সাথে, এতগুলো হেমন্তের শিশির টুপটুপ করে ভিজিয়ে দিলো শীতল ঘাস, এতগুলো বছরের হিমেল হাওয়া উত্তরে বয়ে নিয়ে গেল কত নিবিড় ফিসফিসানির শব্দ… এগুলো সবই আমার জীবন থেকে একটু একটু করে ঝরে গেল , ঠিক যেমন করে শরতের ভোররাতে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে শিউলি ফুল । এতগুলো দেবীপক্ষের শুরুতে ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে শুনলাম, – ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু / মাতলো যে ভুবন…তোমায় হারা জীবন মম/ তোমারই আলোয় নিরুপম’…
শুনেছি আর কেঁদেছি, কেঁদেছি আর শুনেছি । দেবীপক্ষ এসেছে , চলেও গেছে । আলোর বেণু বেজে ওঠে নি আমার জীবনে।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
ছবি : সংগৃহীত