হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ২০)

0
1993

হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ২০)
#নাহার
·
·
·
আজ তিনদিন নিরা কলেজে যায় না। মনমরা হয়ে রুমে বসে থাকে। রাফিনের সাথেও তেমন একটা কথা বলে না। বাসায় কারো সাথেই তেমন কথা বলে না। কেমন যেনো হয়ে গেছে নিরা। কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে না। রাফিন শুধু নিরার আচরণ দেখছে। আজকে সন্ধ্যায় বাসায় এসেই প্রথমে রাফিন নিরার রুমে যায়। না নিরা রুমে নেই। রাফিন কিছু একটা ভেবে ছাদে যায়। নিরা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে আনমনা হয়ে। রাফিন ধীর পায়ে নিরার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নিরা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরে দেখে রাফিন। দুই পকেটে হাত ভরে নিরার পেছনে দাঁড়িয়ে নিরার মাথায় থুতনি রেখে রাফিন নিরাকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে আমার লজ্জাবতীর? আজ তিনদিন ঠিকমতো কথা বলছে না, দুষ্টামি করছে না কেনো? আমার লাজুকলতার কি হয়েছে শুনি?

— কিছু না।

রাফিন নিরাকে নিজের দিকে ঘুরায়। নিরার একটু কাজে গিয়ে দুই গাল আকঁড়ে ধরে চোখে চোখ রেখে রাফিন আবার বললো,
— দেখো তোমার চোখ দেখলে আমি বুঝি কিছু হয়েছে। বলো এবার। আমার কাছে লুকাবে না।

নিরার চোখ ছলছল করছে। রাফিনের বুকের ভেতরে মোচড় দেয়। হঠাৎ কি এমন হলো নিরার যার জন্য এতোটা চুপচাপ হয়ে গেছে? রাফিন আবার জিজ্ঞেস করলো,
— প্লিজ বলো আমাকে। তোমার চোখে পানি আমার সহ্য হচ্ছে না নিরু।

নিরা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো,
— আমি আর বাসা থেকে বের হবো না। এলাকার কিছু মানুষ আমাকে দেখলেই বলে “আমি অনেক খারাপ। বিয়ে ভেঙে গেছে। এখন আবার নতুন নাটক শুরু করছে। নতুন নাগর জুটিয়েছে”।

কথাগুলো বলেই নিরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাফিন নিরাকে দোলনায় বসায়। নিরার চোখের পানি মুছে দেয়। নিরার মনে কথাগুলো কতটা আঁচড় কেটেছে তা বেশ বুঝতে পারছে রাফিন। নিরাকে সান্তনা দিবে না আজ সে।

এটা শুধু নিরার সমস্যা নয়। নিরার মতো হাজার মেয়েদের সমস্যা। সমাজে মাথা উঁচু করে বাচঁতে গেলেই নানান কটু কথা শোনায়। বিয়ে ভেঙে গেছে এখানে মেয়েটার দোষ কি? ছেলে পক্ষেরও তো দোষ থাকতে পারে তাই না? কিন্তু সমাজ সেটা দেখে না শুধু মেয়েদের দোষটাই দেখে। আর নিরা যে কাজ করেনি সেটার জন্যও তাকে কথা শুনতে হচ্ছে। সমাজের মানুষ তো যাচাইও করে না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে।

নিরাকে নিজের শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে লড়তে হবে। কেউ এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য করে না। বরং একজন মানুষ উঁচুতে উঠলে তাকে কিভাবে টেনে নিচে নামানো যায় সেটার চিন্তা করে। তাই নিজের স্থান নিজেকেই ধরে রাখতে হবে।

রাফিন নিরার মুখটা উঁচু করে ধরে। তারপর বললো,
— কিছু কথা বললো এবং জিজ্ঞেস করবো সঠিক ভাবে উত্তর দিবে এবং পজেটিব ভাবে মাথায় ঢুকাবে। ঠিকাছে?

— হুম।

— আচ্ছা বলো তোমার কলেজে যাওয়ার সময় কোনো ডাস্টবিন পড়ে?

নিরা কিছুক্ষণ বেকুবের মতো রাফিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বললো,
— হুম।

— খুব বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায়?

নিরা এবার একটু হেসে দেয়। রাফিনকে বললো,
— ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে না তো কি সুগন্ধি ছড়াবে?

— তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দাও।

— হ্যাঁ অনেক দুর্গন্ধ ছড়ায়।

— এখন আসি আসল কথায়। ডাস্টবিন এর এই দুর্গন্ধ -এর কারণে তুমি কি কলেজ যাওয়া বন্ধ করবে?

— না। কখনোই না।

— কলেজে যাওয়ার সময় কি ডাস্টবিন – এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি অন্য কিছু করবে?

— দাঁড়িয়ে থাকবো কেনো? এরিয়ে চলে যাবো।

— হ্যাঁ। গুড ডিসিশন। তুমি ডাস্টবিনের গন্ধের জন্য বাসায় বসেও থাকবে না এবং ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়িয়েও থাকবে না। আমাদের জীবনে যেসব কুরুচিপূর্ণ মানুষ আসে দে আর লাইক এ ডাস্টবিন। গট ইট?

— হুম।

— এই যে তুমি দুর্গন্ধের কারণে বাসায় বসে থাকবে না। এটার মানে হচ্ছে কুরুচিপূর্ণ মানুষের কারণে তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিবে না। আর এই যে ডাস্টবিনের সামনে বা পাশে দাঁড়িয়ে না থেকে এরিয়ে চলে যাবে এর মানে হচ্ছে কুরুচিপূর্ণ মানুষের সামনে বা আশেপাশে না থেকে তাদেরকে এরিয়ে চলে যাবে। দেখো আমাদের আশেপাশে ডাস্টবিন এর মতো দুর্গন্ধ ছড়ানো মানুষ বেশি। তারা তাদের কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা দিয়ে তোমার মতো যারা নিজের মতো করে বাচঁতে চায় তাদের দমিয়ে রাখতে চায়। তুমি ডাস্টবিনের ময়লা পরিষ্কার করতে গেলে সেই ময়লায় নিজেও নোংরা হবে। তাদের সাথে লাগতে গেলে তাদের বাজে মনোভাব এবং কথাবার্তায় তোমাকে দাবিয়ে রাখবে। তাই তাদের ভয়ে বাসায় বসে থাকবে না এবং তাদের সামনেও দাঁড়িয়ে থাকবে না। তুমি মাথা উঁচু করে বাচঁবে। এগিয়ে যাবে। এবং সফল হবে।

নিরা কিছুক্ষণ এইসব নিয়ে ভাবলো। রাফিন দোলনায় হেলান দিয়ে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। হুট করে নিরা রাফিনকে ঝাপটে ধরে। নিরার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা। রাফিন রসিকতা করে বললো,
— এই সামান্য কথায় প্রেমে পড়ে গেলে?

— হুম।

— ওরেহ আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম।

নিরা হেসে দেয় রাফিনের কথায়। রাফিনের কাধে মাথা রেখে এক প্রশান্তির হাসি দেয়। মাথা তুলে কিছুক্ষণ রাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে রাফিনের কাধে জোরে কামড় দেয়। রাফিন “আহ্” করে শব্দ করে। নিরা হেসে কুটিকুটি। রাফিন কামড়ের জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কি হলো? আমি এতো ভালো কথা বললাম আর আমাকে কামড়ে দিলে কেনো? কেনো কেনো কেনো?

— এটা হচ্ছে আদর। হিহি।

নিরা উঠে দৌড় দেয়। রাফিন একটু অবাক হয়। মনে মনে বললো,
— মেয়েটা আদরও বুঝে। কিন্তু আদরটাকে ভুলভাল এপ্লাই করছে। তবে দাড়াও লাজুকলতা আমিও তোমায় বুঝাই আদর কি।

রাফিনও উঠে দৌড়ে আসে নিরার পেছনে। ছাদের এপাশ ওপাশ দৌড়াদৌড়ি করে তারা। একটু পরই রাফিন নিরাকে ঘাপটি মেরে কোমড় পেচিয়ে ধরে। নিরা ছুটাছুটি করে আর বললো,
— প্লিজ ডাক্তার ছাড়ুন। নাহলে কিন্তু আবার কামড়ে দিবো।

— আচ্ছা তাই। আমিও করি আদর।

নিরা রোবটের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাফিনের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। নিরা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয়। রাফিন নিরার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,
— আমাকে এতো ভাগাও কেন তোমার পেছনে?

দুইজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। নিরবতা ভেঙে নিরাই বললো,
— আচ্ছা ডাক্তার আমি যদি জীবনে চলার পথে এভাবে বারে বারে হোচঁট খাই তখন কি হবে? কে সামলাবে আমাকে?

রাফিন মাথা তুলে নিরার দিকে তাকায়। কপালে চুল সরিয়ে নিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি আছি সবসময় তোমার সাথে। যখনই হোঁচট খাবে আমি তোমাকে উঠে দাঁড় করিয়ে দেবো। তোমার পেছনে আছি আমি ছায়ার মতো। সবসময়। যখনই ভেঙে পড়বে আমি তোমাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবো। তোমার মেইনটেনর এবং প্রোটেক্টর হিসেবে সবসময় তোমার পাশে আছি।

কথা গুলো বলেই রাফিন নিরার নাকে নাক ঘষে দেয়।

——————————————————————————–
আজ বুধবার,

নিরা এবং রাফিনের ঘুরতে যাওয়ার জন্য আর মাত্র একদিন বাকি। বাড়িতে সবাইকে জানানো হয়েছে। সবাই রাজি। কৌশিক তো খোচা মেরে বললো,
— বাহ্ এখন তো তোমার ডাক্তার সাহেব আছে তাই এখন আর আমাদের খবর নেয় না কেউ।

নিরা গাল ফুলিয়ে কৌশিকের গালে চিমটি দেয়। কৌশিক গালে হাত বুলাতে বুলাতে রাফিনকে বললো,
— তোমরা বুঝি এমনে রোমান্স করো?

রাফিন হেসে গড়াগড়ি। নিরা উঠে চলে যায়। বাড়ির ভাই বোন মুরব্বিরা সবাই মিলে আজকে চিপস পার্টি দিচ্ছে। সবাই সবার পছন্দের চিপস নিবে আর সাথে কমন যেকোনো একটা চিপস নিবে। যে যার যার মতো লিস্টে এড করে দিয়েছে নাম। কৌশিক এবং নাঈম গিয়ে বস্তা ভরে চিপস কিনে আনলো। সবার আগে নিরা গিয়ে তার পছন্দের চিপস নিয়ে নিলো। সবার পছন্দ মিস্টার টুইস্ট আর নিরার পছন্দ আলুজ। তাদের সবার কমন চিপস হলো সান চিপস। যে যার যার চিপস হাতে নিয়ে নিলো।

নিরা আগে ভাগে ওর চিপস খেয়ে ফেললো। এখন চুপিচুপি নাঈমের পেছনে গিয়ে একটানে নাঈমের সান চিপস নিয়ে নিলো। নাঈম এক হাতে মিস্টার টুইস্ট গালে পুড়ছে আর নিরার পেছনে দৌড়াচ্ছে। নিরা তার বড় চাচার পেছনে বসে চিপসের পেকেট খতম করে দিলো। এবার ভাই বোন সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে চিপস খাচ্ছে। নিরা ফকিরের মতো হাত পেতে তাদের দ্বারেদ্বারে ঘুরছে চিপসের জন্য। সবাই একটা একটা করে ওর হাতে দিলো। নিরার কান্ডে সবাই মুখ টিপে হাসছে। প্রকাশ্য হাসলে নিরা জঙলি বিল্লির মতো খামছে দেয়।

নিরার সান চিপস খুব প্রিয়। তাই সে যেকোনো ভাবে যেমনে পারে চুরি চামারি করে বা মারামারি করে হলেও ভাইবোনদের থেকে চিপস নিয়ে নেয়। ওর সামনে শান্তিতে কেউ সান চিপস খাবে। অসম্ভব! নিরা এবার তার চাচা, মা, চাচি সবাইকে ফুসিয়ে ফাসিয়ে দুই পেকেট চিপস সাবার করেছে। এবার আর কেউ চিপস দিচ্ছে না নিরাকে। নিরা ছলছল চোখে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সবাই ভেঙছি মারছে।

নিরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় রাফিন সান চিপস খেতে খেতে ড্রয়িং রুমে আসছে। একহাতে চিপসের প্যাকেট ধরে রেখেছে। অন্যহাতে মোবাইল কানে ধরে কথা বলছে। নিরা উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বত্রিশ পাটি দাত বের করে হাসি দিয়ে রাফিনের হাত থেকে ছো মেরে চিপসের পেকেট নিয়ে উপরে দৌড় দেয়।

এহেম কান্ডে রাফিন হা হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো। রাফিনের ষষ্ট ইন্দ্রিয় যেনো বন্ধ হয়ে গেলো।উপস্থিত সবাই রাফিনের দিকে তাকিয়ে একসাথে সবাই ঘর কাপিয়ে হাসে। এবার রাফিনের ষষ্ট ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে নিরা তোর চিপস নিয়ে ভেগেছে তুই ওর পিছনে ভাগ। রাফিন মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে নিরার পেছনে ছুটে। নিরা উপরে উঠতে উঠতে চিপস সাবার করে দিয়েছে। ছাদের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে ধপাস করে সিড়িতে পড়ে যায়।

রাফিন তাড়াতাড়ি করে উপরে এসে দেখে নিরা চুপচাপ বসে আছে সিড়িতে। রাফিন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়। যখন বুঝতে পারে নিরা পরে গেছে রাফিন হাসতে হাসতে নিরার সামনে বসে। হাসিয়ে থামিয়ে রাফিন নিরাকে জিজ্ঞেস করে,
— ব্যাথা পেয়েছো?

রাফিনের কথাটা শেষ হতেই নিরা ভ্যা করে কেদে দেয়। রাফিনের হাসি যেনো আরো বেড়ে গেছে। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে নিরাকে বলে,
— আমার চিপস চুরি করার শাস্তি এটা বুঝলে

নিরা আরো জোরে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। রাফিনের পেট ব্যাথা হয়ে যায় হাসতে হাসতে। হাসি থামিয়ে নিরাকে কোলে উঠিয়ে রুমে নিয়ে যায়।

অন্যের জিনিসে হাত দিলে এভাবে শাস্তি পেতে হয়। মনে রাখবেন। হাহা।
·
·
·
চলবে…………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here