#Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ২৪
লেখাঃ Israt Jahan
.
মেহের শুধু ফালাকের এমন ব্যবহার তাকিয়ে দেখছে।কিভাবে ওর মনের না বলা সব কথা ব্যক্ত করবে ওকে?কি করে বোঝাবে ও ওদের সন্তানকে হত্যা করেনি?
মেহেরঃ ধরেই নিয়েছিলাম কোনোদিন আর আপনাকে ফিরে পাবোনা। আল্লাহর দরবারে হাজার শুকরিয়া আপনাকে অক্ষত অবস্থাতে দেখছি কিন্তু নিজের করে আর পেলাম না।আর কোনোদিন হয়তো পাওয়া ও হবেনা।তবু আপনার জন্য আমার তরফ থেকে শুভ কামনা থাকবে সর্বদা।
মিরাজঃ সম্রাট আমি কি কক্ষে প্রবেশ করবো?
মেহের মিরাজের কন্ঠ শুনে নিজের মুখটা ঢেকে নিল।ফালাক দরজার সামনে এগিয়ে গেল।
ফালাকঃ ঔষধ এনেছো?
মিরাজঃ হ্যা।সেগুলি দেওয়ার জন্য এলাম।
ফালাকঃ আচ্ছা আমাকে দাও।আর তুমি কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
মিরাজঃ আপনি ঠিক আছেন তো সম্রাট?
ফালাকঃ আমি ঠিক আছি মিরাজ।তুমি নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাও।
মিরাজঃ ঠিক আছে সম্রাট।
ফালাক ঔষধগুলো মেহেরের দিকে এগিয়ে ধরল। মেহের ঔষধ নেওয়ার পর ফালাক গিয়ে বিছানাতে শুয়ে পড়ল।
ফালাকঃ কক্ষের বাতি যেনো বেশি সময় জ্বলে না থাকে।
মেহের ঔষধগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে-” কি হবে নিজেকে সুস্থ রেখে?সবকিছু পেয়েও এখন আমি নিঃশ্ব।আর সবকিছুই বা পেলাম কই?স্বামীকে পেলে পিতা আম্মাজান তাদের হারায় আর তাদের পেলে স্বামীকে হারায়।নিজের সন্তানকেও খোয়িয়েছি।কিন্তু এখন তো আমার আর কিছুই নেই।ওনাকেও আর পাবোনা।”
ফালাক চোখ খুলে দেখল মেহের এখনো সেই পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
ফালাকঃ আমি কি মূর্তির ন্যায় খাড়িয়ে থাকতে বলেছি? বাতি দ্রুত নিভিয়ে দিতে বললাম না?
আর আজকের রাত্রিটুকুর জন্য এই কক্ষের মাটিতে ঠাঁই দিয়েছি।ভোরের আলো ফুটতেই এই কক্ষ ত্যাগ করবে।
মেহের আর একটা কথাও বললোনা।বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে কক্ষের বাহিরে চলে গেল।দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ফালাক তাকিয়ে দেখল ওর যাওয়া।প্রাসাদের দাসীগুলো যেই কক্ষে থাকে সেই কক্ষের দরজার কড়া নাড়ছে।কিন্তু সবাই ঘুমে বিভোর।ফালাক কক্ষের বাহিরে এসে মেহেরকে তাকিয়ে দেখছে।তিনবার কড়া নাড়ার পরও যখন কেউ দরজা খুললোনা তখন মেহের কক্ষের দ্বারের সামনেই বসে পড়ল।ফালাক হেঁটে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল।ওর রাগী দৃষ্টির দিকে তাকাতেই মেহেরের ভয় করছে।ফালাক উচ্চস্বরে বলল-“উঠো।”
মেহের দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
ফালাকঃ আমার প্রাসাদে সামান্য পোষ্য প্রাণীর ও আলাদা কক্ষে থাকার জায়গা দিই।আর মানুষ, তাদের ওই পোষ্য প্রাণীর চেয়েও বেশিকিছু প্রাপ্য। নিশি রাত প্রাসাদের প্রত্যেকেই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।দাসীগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়।দ্বার খুলে ওরা কি তোমার আশায় বসে থাকবে?আর থাকছে না বলেই আমার কক্ষে তোমার আশ্রয় হয়েছে। না হলে তোমার স্থান ঠিক এই কক্ষটিতেই হতো।
আমার ঘুমের আর কোনো ব্যাঘাদ ঘটানোর চেষ্টা করবে না।তার ফলাফল ভালো হবেনা।
ফালাক এই বলে সামনে হেঁটে যাচ্ছিলো কিন্তু মেহেরের পায়ের আওয়াজ না পেয়ে থেমে গিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাল।মেহের ভয়ে ওর পিছু আসতে শুরু করলো।চুপচাপ দুজনে কক্ষে প্রবেশ করে যে যার স্থানে চলে এল।শুয়ে পড়ার আগে ফালাক ওকে বললো-“ঔষধগুলো যেনো এমনি এমনি পড়ে না থাকে।” কথাগুলো শেষ করে শুয়ে পড়েছে ও।আর মেহের সে এই মাটিতে কি করে ঘুমাবে কোনো কাঁথা বালিশ ছাড়া?সেটাই ভাবছে মাটিতে বসে।হঠাৎ করে মুখের উপর বালিশ চেলে ফেলল ফালাক।মেহের চমকে উঠে ওর দিকে তাকাল।
ফালাকঃ নরম গদিতে শোয়ার ভাগ্য এই জীবনে আর হবেনা।তবে উপাধানটুকু দেওয়াই যায়।
মেহের মনে মনে বলছে-” এত নিকৃষ্ট ব্যবহারের যোগ্য আমি?এত নিম্ন চোখে দেখছেন?”
ভোরের আলো ফোটার কিছুসময় পরেই মেহেরের ঘুম ভাঙ্গলো।ঘুম থেকে জেগে কক্ষে ফালাককে দেখতে পেলোনা।ওর পূর্বেই সে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছে।মেহেরের শরীর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে আছে।পুরো একটা দিন একটা রাত সে অনাহারে আছে।তার আর উঠতেও ইচ্ছা করছেনা।কিন্তু না উঠেও তো উপায় নেই।ফালাক যে ওকে আদেশ করেছে ভোর হতেই কক্ষ ত্যাগ করতে।ধীর গতিতে হেঁটে মেহের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো।ওকে দেখে দুজন দাসী ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল-” রাজকন্যা মেহেরুন সম্রাট আমাদের কাছে কিছু বার্তা দিয়ে গেছেন।”
মেহেরঃ কি বার্তা?
১ম দাসীঃ আপনি আজ থেকে এই প্রাসাদে কিভাবে দিন যাপন করবেন, কি কি করণীয় এইসব ব্যাপারে।
মেহেরঃ বুঝতে পারলাম না।
২য় দাসীটি মুখটা মলিন করে ওর দিকে চেয়ে বলছে-” আপনাকে আজ থেকে আমাদের মত করে চলতে হবে।আমরা যেভাবে থাকি আর আমাদের যে কাজের জন্য এখানে রাখা হয়েছে সেই সবকিছু আপনাকেও করতে হবে।এর থেকে বেশি বিশ্লেষণ করে বলতে পারছিনা।”
মেহেরঃ দাসী?
২য় দাসীঃ জ্বী রাজকন্যা।
মেহেরঃ রানী বলতেও তোমাদের বারণ করে দিয়েছে বুঝি?
১ম দাসীঃ তেমন কিছুই আদেশ করা হয়েছে আমাদের।
মেহের মাথা নাড়িয়ে ওদের কথার সম্মতি জানাল। ভাবছে-” প্রাণেও মারতে চাইছেন না।তবে আমার জন্য আপনার বরাদ্দকৃত শাস্তির পরিকল্পনা সত্যি অতুলনীয়।রাজকন্যা হয়ে জন্ম নিয়ে আপনার রানী হয়েও সেই দাসীদের ন্যায় দিন যাপন করতে হবে।ভাগ্যে সুখ লিখন না থাকলে যা হয়।যতই রাজার কন্যা আর রাজপুত্রের রানী হই।”
মেহেরঃ আমাকে তোমরা কিছু আহারের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?ভীষণ খুদা পেয়েছে।
১ম দাসীঃ প্রাতঃভোজনের জন্য পাক চলছে।
এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।আপনি ফল গ্রহণ করতে পারবেন?
মেহেরঃ যথেষ্ট পারবো।শুকরিয়া।
দাসীদের থেকে কয়েক টুকরো আঙুর, একটি কলা আর অর্ধেক পরিমাণ আপেল খেয়ে নিল।তারপর নামাজ আদায় করলো।দুর্বল শরীরে নামাজ আদায় করতেও কষ্ট হচ্ছিল ওর।এখন আর মেহেরের রূপে সেই আগের মত ঝলাকানি নেই। যে ঝলকানি দেখে ফালাক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।আর ওর ও ইচ্ছা হয়না নিজের রূপ লাবণ্য নিয়ে ভাবতে।
ফালাক ভোর বেলাতে নামাজ আদায়ের পর আব্বাজানের কবর জিয়ারত করে তার পাশেই বসে আছে।মিরাজ ওকে দেখে ওর কাছে এগিয়ে এলো।
মিরাজঃ সম্রাট?
ফালাকঃ সেনাপতি যে, এখানে এসে বসো আমার পাশে।
মিরাজঃ সম্রাট আমাকে সেনাপতি না ডেকে আমার নামটা ধরেই ডাকুন না?
ফালাকঃ কেনো?
মিরাজঃ ওই নামটার মর্যাদা আমি এখনো অর্জন করিনি।
ফালাকঃ কে বলেছে করোনি?তুমি তা অনেক আগেই অর্জন করেছো।আর তাই তোমাকে আমি নির্দ্বিধায় এই উপাধিতে আখ্যায়িত করেছি।তুমি যা করেছো তার জন্য যে সারাজীবন ঋনী আর চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
মিরাজঃ আপনি সেই ঋণ যে শোধ করে দিয়েছেন আমাকে এমন একটি সম্মান প্রদান করে, আর আমার স্ত্রী পুত্রের ভবীষ্যৎকে সুন্দর সুনিশ্চিত করে।
ফালাকঃ আচ্ছা এসব কথা এখন রাখো।আজকে তোমার অনেক কাজ আছে।
মিরাজঃ কি কাজ? আদেশ করুন আমাকে।
ফালাকঃআব্বাজান একজন আরবী শিক্ষার শিক্ষকদাতা ছিলেন।জীবিত থাকাকালীন তার ইচ্ছা ছিল রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে ইসলাম শিক্ষাপ্রদানের শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।কিন্তু তখন সেদিকে আমার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিলোনা।আজ সে বেঁচে নেই।তবু এখন তার মনের আশা পূরণ করতে চাই তার রুহুতে শান্তি প্রদানের জন্য।তার নামানুসারে এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলো উৎসর্গ করতে চাই।মন্ত্রী থাকবে তোমার সাথে কিন্তু এই কাজের পুরো দায়িত্বটি তোমাকেই দিতে চাই।আর আমার রাজ্যের সীমানাবর্তী এমনভাবে ঘিরে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে যাতে করে বাহিরের রাজ্যের কোনো বাসিন্দা অনুমতি ছাড়া আমার রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
মিরাজঃ সীমানা তো ঘিরে দেওয়া আছে সম্রাট।
ফালাকঃ আরো কঠোর উপায়ে ঘিরে দাও।
মিরাজঃ ঠিক আছে।আর কিছু?
ফালাকঃ প্রাসাদের ভেতর চলো তারপর বলছি।
ফালাক মিরাজের সামনে অনেকসংখ্যক মোহরের একটা থলে ওর হাতে দিল।
ফালাকঃ এখান থেকে একশত মোহর প্রত্যেক গামবাসীকে দান করবে।যদি সংকট পড়ে তাহলে আবার আসবে আমি দিয়ে দিব।
মিরাজঃ হঠাৎ করে মোহর দান করবেন কেনো সম্রাট?
ফালাকঃ যা দান করার তা এতোকাল দান না করে পুঁজি করে রেখেছি নিজের ভান্ডারে।আমি সুখে থেকে প্রজাদের কে কষ্টে রেখেছি।আর ওই আরব ও ওদের সাথে অনেক অন্যায় অবিচার করেছে।
আমার থেকেও বেশি।প্রাপ্য ফসলটুকু তো পায়নি-ই বিপরীতে শেষ ভাগের থেকেও অর্ধেক কেড়ে নিয়েছে।এগুলো রেখে আমার আর ফায়দাও নেই। এখন যা আসবে তার দুই তৃতীয়াংশ বিলীয়ে দেব ওদের মাঝে।এর মাঝেই আমার অন্তরের সুখ নিহিত।
মিরাজঃ সম্রাট আমার একটা কথা ছিল।
ফালাকঃ এত সংকোচবোধ করছো কেনো? বলো কি কথা?
মিরাজঃ আমার একজন ভগিনী আছে।ওকে আমার গ্রামেই রেখে এসেছি।কিন্তু একা থাকে তো। কখন কি অসুবিধাতে পড়ে বলা যায়না।আপনি যদি অনুমতি…….
ফালাকঃ অনুমতি দেওয়ার কি আছে?তুমি, তোমার স্ত্রী পুত্র এখানে তাহলে তোমার ভগিনী ওখানে একা থাকবে কেনো?তুমি ওকে নিয়েসো।
মিরাজঃ অনেক অনেক মেহেরবানী সম্রাট।আসছি তাহলে।
ফালাকঃ হ্যা যাও।
ফালাক নিজের কক্ষে এসে দেখে মেহের সত্যি আর কক্ষে নেই।অনেকটা সময় নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু চিন্তা করলো।মেহের ওদিকে দাসীদের বিভিন্ন কাজ করা দেখছে।ও কি থেকে শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।একজন দাসীকে জিজ্ঞাসা করলো-” আমাকে কি করতে হবে তোমরা কিছু বলছোনা কেনো?সব তো তোমরা নিজেরাই করছো।”
দাসীঃ আসলে রাজকন্যা আপনি যতোই দাসী হন কিন্তু একসময় এই রাজ্যের রানী সম্রাটের বিবি ছিলেন।কেমন যেনো বিবেকে বাঁধছে।
মেহেরঃ বা রে…..আমি রানী হই আর রাজকন্যা হই এখন আমি তোমাদের মতোই একজন।তাহলে এসব ভাবলে চলবে?পাকঘরেতে ও তো অন্যরা পাক করছে।আর এদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের কাজ তোমরা করছো।তাহলে আমি কি করবো বলো?
ফালাক মেহের কি করছে তা দেখার জন্যই নিজের কক্ষের বাহিরে এসেছে।বাহিরে আসার পরই মেহের আর দাসীদের কথোপকথন শুনতে পেলো।
এতসময় মেহের যা যা বলল তা সবই শুনেছে ফালাক।মেহেরের কথা শেষ হতে ফালাক পেছন থেকে বলে উঠল-” প্রাসাদে কাজের ঘাটতি পড়েছে নাকি?কাজের পরিমাণের জন্য শ শ দাস-দাসী পুষতে হচ্ছে।আর সেখানে কাজ খুঁজে পাওয়া যাবেনা?”
ফালাকের কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে দাসীগুলো কথা বন্ধ করে কাজে মন দিল।আর মেহের মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ফালাক আবারো বললো-” ঠিক আছে, তোমাকে কাজ দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব না হয় আমিই নিচ্ছি।আমার কক্ষে এসো।আর তার আগে এই নোংরা ছেড়াছোটা পোশাক পরিবর্তন করো।আমার প্রাসাদের দাসীরা এতো নোংরা অবস্থাতে থাকেনা।তোমাদের বলছি, ওকে কিছু জামা-কাপড় ধার দাও।পরবর্তীতে না হয় তোমাদের তা ও ফিরিয়ে দেবে।” এই বলে ফালাক চলে গেলো।
দাসীঃ হায়রে বিধাতা! কি করুণ দশা দেখতে হচ্ছে রানীর।শেষ পর্যন্ত আমাদের মত দাসীদের পোশাক পড়তে হবে আপনাকে।
মেহেরঃ এরকম করে বলোনা আমার যে কষ্ট লাগে।এগুলো আমার কর্মের ফল, আমার ভাগ্যে আছে তাই হচ্ছে।
মেহের পোশাক পরিবর্তন করে ফালাকের কক্ষে এলো।ফালাক ওকে দেখে তাকিয়ে রইল।
ফালাকঃ কি অবস্থা আজ তোমার।কতোগুলো দিন আগেও এই ফালাক তোমাকে জোর করে হিরা মুক্তার গহনা পরিয়ে দিয়েছে।আর আজ সেই তোমার শরীরে দাসীদের পোশাক, গায়ে কোনো ভারী গহনা ও নেই।উপহাস করার মত অবস্থা হয়েছে তোমার।
মেহেরঃ এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?কতোটা অসহায় আমি তাই দেখছেন?রানী থেকে আজ আপনার দাসীতে পরিণত হয়ে গিয়েছি।আপনি আমাকে দাসী ভাবলেও আমি তো আপনাকে আমার স্বামী-ই ভাবি আর সারাজীবন তাই ভাববো।হয়তো স্ত্রীর মর্যাদা আজ আর দেবেননা আমায়।
মেহের ওর আপন মনেই কথাগুলো ভাবছে।ফালাক বলল-” এখন তুমি আমার দাসী হলেও একসময় আমার স্ত্রী ছিলে।তাই তোমাকে আমার কাজের করার দায়িত্ব ও দেবো।আর তার পাশাপাশি তো রাজমহলের কাজ করবেই।”
মেহেরঃ ঠিক আছে কি কাজ করবো বলুন?
ফালাক রাগীস্বরে বলল-” আমি তোমাকে বলে বলে দেবো তুমি শুধু সেই কাজগুলোই করবে?”
মেহেরঃ আমি একজন দাসী।আর দাসী কর্মের মাঝে যা পড়ে আমি তাই-ই করবো।
ফালাকঃ হুম।
ফালাক ভাবছে-” কি কাজ আছে আমার, যা তোমাকে দিয়ে করানো যায়?যা আছে তা মাত্র আমার স্ত্রীরূপেই করতে পারবে।কিন্তু সেই অধিকার তো আমি তোমাকে আর দেবোনা।” ফালাক ওকে দিয়ে কোনো কাজ করানোর মত কিছু খুঁজেই পেলোনা।তাই বলল-” ঠিক আছে তুমি যাও।আমার যখন প্রয়োজন হবে তখন ডেকে নিব।”
মেহের নিচে তাকিয়ে কিছুটা মৃদু হেসে ফেলল আনমনেই।সেই হাসি আর ফালাকের চোখ এড়ালোনা।ওর হাসি দেখে হতবুদ্ধি অবস্থার মাঝে পড়ে গেছে।যা দেখে মেহেরের উপর ওর রাগটা এবার সত্যিই চড়ে গেল। মেহের খেয়াল করেনি যে হাসিটা ফালাক দেখতে পেয়েছে।ফালাক ধমক দিয়ে বলল-” তোমার এত বড় স্পর্ধা তুমি আমার কথাতে হাসছো?”
মেহেরঃ এখন কি হাসির জন্য ও শাস্তি পেতে হবে?
মেহের মনেমনে ভাবছে।ফালাক ওর কাছে গিয়ে ওকে ধরে বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বলল-” যাও ওই সরোবর থেকে পানি নিয়েসো আমার গোসলাগারে।আজ তুমিই নিয়ে আসবে ওই পানি।”
মেহের কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।এভাবে ও বাহির থেকে পানি নিয়ে আসবে?ফালাক রাগের মাথায় ভুলে গেছে যে ও বাহিরের পুরুষের সামনে যায়না।আর সরোবর থেকে পানি আনতে গেলেই সেখানে অনেক রক্ষী বা প্রহরী ওর মুখ দেখতে পাবে।তবুও মেহের চুপ থেকে সেখান থেকে চলে এল।ফালাক জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে মেহের নিজের পর্দা মেনেই সরোবর থেকে পানি তুলে আনছে।এক পাত্র পানি আনার পরই ফালাক এক দাস কে পাঠিয়ে দিলো সরোবার থেকে পানি তুলে আনতে।আর মেহের কে বারণ করে দেওয়া হলো।মেহের ফালাকের গোসল শেষে ওর কক্ষে সকালের খাওয়ার নিয়ে এলো।যা মেহেরের কাছে মনে হচ্ছে যে ও স্ত্রী রূপেই ওর স্বামীর সেবা করছে। সকালের পর থেকেই মেহেরের জীবনটা আর সব দাসীদের মতই হয়ে গেছে।প্রাসাদের অন্যান্য দাস দাসী,প্রহরী,রক্ষী যারা বসবাস করে তারা প্রত্যেকেই এ নিয়ে অনেক সমালোচনা করছে।প্রাসাদের বাহিরেও এই খবর চলে গেছে।তবে কিছু মানুষের কাছে তা অবাক করার মত বলে কোনো খবর মনে হয়নি।তারা একে অপরের সঙ্গে বলাবলি করছে যে এ সম্রাটের জীবনো নতুন কিছু নয়।এর পূর্বেও সে কত রাজকন্যাদের দাসীরূপে প্রাসাদে রেখেছে। তাদেরকে কত রক্ষী আর সেনাপতি নিয়ে গেছে নিজেদের রক্ষিতা হিসাবে।এমন ধরনের আলোচনা সেনাপতি মিরাজের কানে এলো।রাতে মিরাজ ফালাকের সঙ্গে কথা বলছে-” সম্রাট আপনাকে কিছু তথ্য দেওয়ার ছিল।অবশ্য আপনি জানেন কিনা তা আমি জানিনা।”
ফালাকঃ কি তথ্য?আর কি বিষয়ে?
মিরাজঃ রাজকন্যা মেহেরুনের বিষয়ে।
ফালাকঃ কি হয়েছে?
মিরাজ বিস্তারিত বর্ণনা দিলো যে সবাই মেহের কে নিয়ে এখন কেমন ধরনের সমালোচনা করছে।ফালাক তো ভীষণ রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো-” কার এতো বড় সাহস মেহেরের সম্পর্কে এমন কথা বলেছে?নাম বলো তার। আমি তার এমন পরিণতি করবো…..”
মিরাজঃ সম্রাট শান্ত হউন।আপনি কতোজনকে শাস্তি দিবেন?কারণ এরূপ সমালোচনা একজন দুইজন নয় প্রায় প্রত্যেকেই করছে।রাজপ্রাসাদের এমন খবর রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনা।আর তা ছাড়া উনি আর সব দাসীদের মতোই চলা ফেরা করছে, কাজকর্ম করছে আবার দাসীদের সঙ্গেই থাকছে।আর এ কারণেই সবাই বেশি সমালোচনা করছে।
ফালাক কক্ষে একা বসে এই কথাগুলো ভাবছে।ও নিজে মেহেরের সঙ্গে আর যাই কিছু করুক।কিন্তু বাকি সবাই ওকে নিয়ে এমন বাজে সমালোচনা করবে তা ও মানতে পারবেনা।অনেকরাত পর্যন্ত এই কথাগুলো চিন্তা করলো।তারপর দাসীদের কক্ষের সামনে গেল।দুবার কড়া নাড়তেই মেহের কক্ষের দ্বার খুললো।মেহেরের চোখে ঘুম নেমে এসেছিল খুব।ঘুম ঘুম চোখেই দরজাটি খুলে ফালাককে দেখে অনেক অবাক হয়ে গেলো।কোনো শব্দ না করে ফালাক ওকে হাত ধরে টানতে টানতে নিজের কক্ষে নিয়ে এলো।কক্ষে নিয়ে আসার পর কোনো কথা বলছেনা ও।মেহের জিজ্ঞেস করলো-” কিছু বলবেন?” ফালাক ওর না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলো-” এইখানে ঘুমাতে হবে তোমাকে।নিচে শুয়ে পড়ো।”
মেহের মনেমনে বলছে-” আমি ভাবলাম হয়তো আমাকে ছাড়া ওনার ঘুম হচ্ছেনা তাই টেনে নিয়েলো।অথচ টেনে নিয়েসে সেই মাটিতে থাকার কথা বলছে?এর থেকে তো দাসীদের কক্ষতেও আরামে ঘুমাতে পারতাম।গতকাল রাত্রে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি এত পরিমাণ শীত করছিলো।আজ আবার?পারবোনা ওনার হুটহাট কথা শুনতে।”
মেহের কিছু না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ফালাক তা দেখে ওকে আবারো হাত ধরে টেনে এনে ধাক্কা দিয়ে বিছানার উপর ফেলে দিলো।
ফালাকঃ তুমি আমার কথা অমান্য করে কক্ষের বাহিরে চলে যাচ্ছো?
মেহেরঃ মেঝে খুব শীতল।আমার ওখানে ঘুম হয়না।আমি দাসীদের কক্ষেই ঠিক আছি।
ফালাক বিছানা থেকে কাঁথা বালিশ নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-” এগুলো নিয়ে শয্যা করে এখানেই ঘুমাতে হবে।আর কোনো শব্দ আমি শুনতে চাইনা।”
ফালাক গিয়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লো।আর ওর এই কাজগুলো মেহেরের পুরো মাথার উপর দিয়ে গেলো।নিজের কাছে তো থাকতে দিচ্ছেনা।তাহলে একই কক্ষে থাকার মানে কি?ফালাক সবার সামনে এটা দেখাতে চাই যে মেহের দিনশেষে ওর স্ত্রীরূপেই ওর কাছে থেকে।যাতে কেউ ওর নামে কটূক্তি করতে না পারে।এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে যাচ্ছিলো। তবে একই দুজনে আলাদা থেকে কারোরই ঘুমটা ঠিকমত হতে চাইনা।মনে রাগ,ক্ষোব, অভিমান থাকলেও এই মেহেরকেই ও ভালোবেসেছে।মন চাইলেও ওর কাছে যায়না।তখন নিজের সন্তান হত্যার কথা মনে পড়ে ওর, ওকে স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কথা মনে পড়ে।ও ভাবে মেহের তো ওকে কখনোই নিজের স্বামী ভাবেনি।দূরত্বটা এভাবেই চলতে থাকে ওদের মাঝে।একদিন সন্ধ্যার পর পূর্ণিমার রাত উপভোগ করার জন্য আর মন থেকে এসব বেদনাদায়ক স্মৃতি কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকতে সরোবারের পাশে দিয়ে হাঁটাচলা করছিলো।কিন্তু এখানে এসেও মেহেরের সাথে কাটানো সেই রাতটার কথা মনে পড়ে গেলো যে রাতটা ওরা দুজন কিছুসময় এই সরোবরের পাশে কাটিয়েছিলো। সরোবরের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে সেই স্মৃতিগুলো মনে করছিলো।ওই সময়ে ফালাকের চোখে পড়লো সরোবর থেকে এক যুবতী কন্যা উঠে আসছে।এইসময় এভাবে কোনো কন্যাকে উঠে আসতে দেখে ফালাক প্রথমে চমকে যায়।তারপর স্পষ্টভাবে তাকে দেখার জন্য কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ভেজা শরীরে কন্যাটি উঠে আসলো।
ফালাক উচ্চকন্ঠে বলল-” কে তুমি?” সে ভয় পেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।এমন ভেজা শরীরে একজন নারী এভাবে কোনো পুরুষের সামনে আসতে পারে তা ফালাকের ধারণার বাহিরে ছিল। চাঁদের আলোতে তার মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বেশ রূপবতী কন্যাটি।ফালাককে উত্তর দিলো সে-” আমি সেনাপতি মিরাজের ভগিনী ইরানি।”ফালাক আজই প্রথম ওকে দেখলো।এতদিনে ইরানি কখনো ওর সামনে আসেনি।ফালাক কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে প্রশ্ন করলো-” এইসময় তুমি এখানে গোসল করতে এসেছো কেনো?”
ইরানিঃ সরোবরের পানিটুকু খুবই স্বচ্ছ।দেখে আর এই সরোবরে গোসল করার লোভ আর সামলাতে পারলাম না।কখনো এমন সুন্দর সরোবর দেখিনি তো।ভেবেছিলাম এখন এ সময় কেউ বাগানে থাকবেনা তাই গোসল করতে নেমে পরেছিলাম। মাফ করবেন আমাকে।
ফালাক কিছু না বলে আর দাঁড়িয়ে না থেকে ওখান থেকে চলে এল।ইরানি কিছুটা লজ্জাবোধ করছিল তাই ও সেই লজ্জা আর বাড়াতে চায়নি।
ইরানিঃ ইনিই তাহলে সম্রাট ফালাক তাজ?দেখতে তো মাশাআল্লাহ্ ভারী সুন্দর।
প্রথমদিনেই ফালাককে দেখে ইরানির কিছুটা মনে ধরেছে ওকে।এতোদিন শুধু ফালাকের গল্পই শুনেছে।কখনো সামনে যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠেনি।আজ ফালাকের কোমল ব্যবহার পেয়ে সেই ভীতি কেটে গেছে ওর।রাতে ফালাক বিছানাতে শুয়ে আছে।ঘুমানোর চেষ্টা করছে খুব।কিন্তু ঘুম আসছে না।তারউপর মেহের এখন পর্যন্ত কক্ষে আসেনি।সেই অস্থিরতাও মাঝে কাজ করছে। অস্থিরতার চোটে যখন শোয়া থেকে উঠে বসল তখন মেহের কক্ষে এলো।মেহের আজ কাল ওর চোখের দিকে তাকানোর সাহস পায়না।সবসময় ওর দিকে কেমন ভয়ানক চাহনিতে তাকায়।এখনো ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে আছে।ফালাক ভাবছে এত দেরী করে আসার কারণটা জানতে চাইবে নাকি। পরক্ষণে ভাবলো-” কি প্রয়োজন।ও যা খুশি যেখানে খুশি সময় কাটাক তাতে আমার আর কিছু যায় আসেনা।” মেহের কক্ষের দ্বার বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আর ফালাক আজ যেনো ওর উপর থেকে চোখের পলক সরাতে চাইছেনা।মেহের ভাবছে-” না জানি আবার কি দোষ করলাম যার জন্য এভাবে তাকিয়ে আছে।” ফালাকের পাশেই ওর কাঁথা বালিশ রাখা।ও সাহস ও পাচ্ছেনা সেখান থেকে ওগুলো আনার।কিন্তু কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?তারপর মনে সাহস জুগিয়ে ওর সামনে এগিয়ে এসে ওকে কিছু না বলে ওর পাশ থেকে কাঁথাটা নিতে গেলে ফালাক তখন ওর হাত চেঁপে ধরল।মেহের ওর চোখের দিকে তাকাতেই বললো-” এটা আমার কাঁথা।” মেহের ভালো করে দেখার পর বুঝতে পারে হ্যা ওটা ফালাকের কাঁথা ছিল।ভয়ের কারণে ভালো করে তাকিয়েও দেখেনি।মেহের চুপচাপ ওর কাঁথা বালিশ নিয়ে নিচে গিয়ে শুয়ে পড়লো।তারপর ফালাক ও শুয়ে পড়লো।মেহের খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে।সারাদিন নানান কাজ করার পর শরীরটা এমনিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিছানাতে শুতেই ঘুম চলে আসে।ফালাক বাগানের দিকে মুখ করে যে জানালাটি তৈরি করেছে সেটা কখনোই বন্ধ করেনা।কারণ ওই জানালা দিয়েই সকালের মিষ্টি রোদ আর পূর্ণিমা রাতের জ্যোৎস্না এসে প্রবেশ করে।চাঁদের পুরো আলোটুকু মেহেরের মুখে এসে পড়েছে।ফালাক শুয়েই ওর মুখের সৌন্দর্যটুকু দেখছে।যেমনটা আগে দেখতো।বিছানা থেকে উঠে ওকে সামনে থেকে তাকিয়ে দেখছে। তারপর কি ভেবে ওখান থেকে চলে আসলো নিজের শয্যাতে।হঠাৎ করে দরজার ওপাশে নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেলো ফালাক।বেশকিছুক্ষণ ধরেই শুনছে।তাই বাধ্য হয়ে উঠে দেখার জন্য কক্ষের দরজা খুলে বাহিরে বের হলো।এক কন্যা হেঁটে যাচ্ছে যার পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে শুধু।চুল গুলো ছেড়ে লাল রঙের একটি শাড়ি পড়া সে।
***আজ খুব ব্যস্ততার মাঝে গল্প লিখেছি। কিন্তু কি লিখেছি নিজেও ঠিকমত পড়ে দেখিনি।কিছুটা ছন্দহীন মনে হতে পারে। কাল থেকে চেষ্টা করবো সুন্দর করে সাজিয়ে লেখার।আর নাইস,নেক্সট মন্তব্যকারীদের বলছি,
এখন আপনারা যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তার উত্তর আমি আগেই দিয়ে দিচ্ছি।ফালাকের সন্তানকে মেরে দিয়েছি এটা সত্যিই এক মর্মান্তিক কাজ।কিন্তু দুটো কারণে এটা করতে বাধ্য হয়েছি।প্রথম কারণ ফালাক নিজে একসময় অনেক পিতামাতার সামনে সন্তান হত্যা করেছে যদিও তারা রাজপুত্র বা রাজকন্যা ছিল কিন্তু সন্তান ছিলো কারো।তাই তাদের আর্তনাদের অভিশাপ ওর সঙ্গে ছিল। এমনকি মেহের নিজেও ওকে অভিশাপ করেছিল যে একদিন ফালাক ও সন্তানহারা হবে।আর সেই অভিশাপ পূরণ হয়েছে।ও তা নিজেই বুঝতে পেরেছে।শুধুমাত্র এইটুক বোঝানোর জন্য এমন একটি কাজ করা।ইচ্ছা করলে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম কিন্তু কোনো সন্তানহারা পিতামাতার অভিশাপ বিফলে যায়না।আর দ্বিতীয় কারণটি সামনের পর্বগুলোতে পাবেন।***.