হিংস্রপ্রেম পর্ব ২৩

0
421

#Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ২৩
লেখাঃ Israt Jahan

.
আলোকিত কক্ষে আলোর মাঝে ফালাককে দেখে মেহেরের এতক্ষণে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে ফালাক ওর স্বামী সত্যি ওর সামনে।ফালাককে দেখে ও যতোটা খুশি হয়েছে ঠিক ততোখানি ভীতিও কাজ করছে ওর মাঝে তখন ফালাককে ওই রূপে দেখে। কি বলবে, কি থেকে শুরু করবে মেহের কিছু বুঝতে পারছেনা।শীতল চোখে চেয়ে আছে ফালাকের দিকে।ফালাক বিছানা ছেড়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।মুখোমুখি কথা বলার জন্য ওর বাহু ধরে টেনে মেহেরকে ওর সামনে দাঁড় করালো।স্বাভাবিক নয়নে স্থির কন্ঠে বলতে শুরু করলো-” বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি রাজকন্যা মেহেরুন?আর কতোসময় লাগবে এই ঘোর কাটতে। নতুন কিছুর জন্য যে বিস্মিত হতে হবে।দ্রুত এই ঘোর থেকে বেরিয়ে এসো।আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা কোথা থেকে শুরু করবো সবকিছু।
তবে তার আগে তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করেই থাকতে পারছিনা।কি নিঁখুত পরিকল্পনা ছিল আমাকে মেরে ফেলার।এত বড় বুদ্ধিমতীর পরিচয় দেবে তুমি তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। ফালাক তাজকে সমুদ্রে ফেলে হত্যা করা পরিকল্পনা করেছিলে?তোমার ধারণা আছে সমুদ্রের গভীরে গিয়েও আমি কতোটুকু সময় নিঃশ্বাস সঞ্চালন না করেও থাকতে পারি?এই রাজ্য যখন আজগরের হাতে ছিল তখন তাকে খতম করার জন্য নিজেকে কতোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তুমি জানো?আব্বাজান আমাকে সবরকম উপায়ে নিজেকে রক্ষা করার উপায় শিখিয়েছিলেন।ওই সমুদ্রের গভীরেও আমি সময় পরিমাপের ষাট ভাগের দশ ভাগ সময় নিঃশ্বাস ছাড়াই থাকার প্রশিক্ষণ পেয়েছি।আর সেই আমাকে সমুদ্রের গভীরে ফেলে মেরে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলে?”
মেহেরঃ আমি তো আব্বাজানের কাছ থেকে আপনার শৈশবের এমন সব গল্প শুনেই এই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম পিতাকে।
ফালাকঃ সত্যি?তাহলে ভর্তি কলসীটা গলাতে বেঁধে দিয়েছিলে কি পানিতে ভেসে ওঠার জন্য?
মেহেরঃ এই পরিকল্পনাটি ছিল চাচাজা……
ফালাকঃ চাচাজান….?আরব খান তাইনা?আমি তো ভুলেই গিয়েছি ওর কথা।তোমার পরম স্নেহের চাচাজানের সাথে তুমি দেখা করতে চাওনা?এসো এসো আগে তোমার চাচাজানের সঙ্গে মুলা-কাত করিয়ে দিই।এসো….
ফালাক মেহেরকে টানতে টানতে প্রাসাদে বাগানের পেছন দিকে যে ঝোপটা আছে সেখানে নিয়ে এলো।
ফালাকঃ দেখবে না তোমার চাচাজান কোথায়? চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখো ঠিক খুঁজে পাবে।
মেহের ফালাকের দিকে চেয়ে আছে।ধমকের সাথে
ফালাক বলল-“আরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?সামনে পেছনে তাকিয়ে চাচাজানকে খোঁজো।”
মেহের ভয়ে চারপাশ তাকিয়ে দেখছে কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পাচ্ছেনা।ও ভাবছে রাগের মাথায় ফালাক উল্টাপাল্টা বকছে।ফালাকের চোখের দিকে তাকালো।
ফালাকঃ কি দেখতে পেলে না কোথাও?কোনো গন্ধ পাচ্ছোনা?গন্ধটা এত দ্রুত বের হবে কি করে?শুধু ওপরে ওপরে চোখ দুটো দিলে হবে নিচে তাকাও। আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
ফালাক মেহেরকে হাতের আঙুলের ইশারায় মাটিতে কিছুটা সামনো দেখালো।যেখানে দুটো মাথা খন্ড হয়ে পড়ে আছে কিন্তু সেই মুখ দুটোতে কোনো চোখ নেই।চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।আর তার পাশে খন্ড হয়ে পড়ে আছে চারটে হাত পা যা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন।শরীর দুটোর উড়ু থেকে নিচে নেই আর গলা থেকে নেই।এমনভাবে মানুষ হত্যা শুধু দস্যুরাই করতে পারে।তাহলে কি ফালাক সত্যি কোনো দস্যু হয়ে গেছে?দস্যুদের মাঝে তিল পরিমাণ দয়া মায়া থাকেনা।এমনভাবে মানুষ হত্যা মেহের ওর জীবনে কখনো দেখেনি।চিৎকার করে উঠল মেহের।এ সময়ে হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে।প্রাসাদের কক্ষে শীতের তাপ কম লাগলেও বাহিরে কিছুটা টের পাওয়া যায়।সেই মৃদু শীতের মাঝেও মেহেরের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। শরীর,হাত-পা রীতিমত কাঁপছে।এবারও বোধহয় ওর চেতনাটা হারানোর অবস্থা।কোনো কথা বলতে পারছেনা।
ফালাকঃ চেনার উপায় নেই না?তুমি প্রশ্ন করলেনা এখানে দ্বিতীয় ব্যক্তির লাশটা কে?
মেহের কাঁপা স্বরে তুতলিয়ে বলছে-” আমি এই দৃশ্য দেখতে পারছিনা।আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন দয়া করে।”
ফালাকঃ সহ্য তো করতেই হবে।তোমার যে অনেক কিছু জানার বাকি আছে।ওই দ্বিতীয় লাশটা তোমার ভাবিস্বামী সেনাপতি আমিন।একবার প্রশংসা করবে না এত নিঁখুত করে অতি দক্ষতার সাথে হত্যা করা হলো যে।এমন দক্ষতার কাজ আমার দ্বারা কখনো সম্ভব ছিলোনা।এই অতি দক্ষতার কাজটি সম্পন্ন করেছে আমার খুব বিশ্বস্ত প্রিয় মানুষ।আমার সেনাপতি মিরাজ।এই না হলে দস্যুদলের সর্দার।কতো অভুক্ত জন্তুদের খাদ্যে পরিণত করেছে।
মেহেরের কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে।তাকাতে পারছেনা ওই লাশদুটোর দিকে।চোখ দুটো এঁটে বন্ধ করে আছে।
ফালাকঃ আর বাকি রইল তোমার পিতামাতা আর চাচিআম্মা।ওদের কথা শুনবেনা?
মেহের ওর পিতামাতার কথা শুনে চোখ খুলে তাকালো।
মেহেরঃ ওনারা কোথায়?কোথায় রেখেছেন ওনাদের? ওনাদের কোনো ক্ষতি করেননি তো? পিতা আম্মাজান ওনারা নির্দোষ, ওনারা বৃদ্ধ। ওনাদের এত কষ্ট দিবেন না।
ফালাকঃ আমি যার উপর একবার অনুতপ্ত হই তার সাথে কোনো কঠোরতা দেখাতে পারিনা।তবে সে ও আমার সঙ্গে অবিচার করেছেন।তাই শাস্তি যে তাকেও পেতে হবে।হয়তো এমনভাবে সে শাস্তি পাবেনা।কিন্তু শাস্তি সে পাবে।
মেহেরঃ এমন করবেন না।ওনারা এই বৃদ্ধ বয়সে আর সহ্য করতে পারবেন না।
ফালাকঃ শাস্তি তো ওনাদের শরীরে উপর দিয়ে যাবেনা।যাবে মনের উপর দিয়ে।প্রতিদিন একমাত্র কন্যার কষ্টে ব্যথিত হতে হতে জর্জরিত হয়ে যাবে। এর থেকে বড় শাস্তি ওনাদের জন্য আর নেই।
মেহের ওর কথার অর্থ বুঝতে পারছে।এবার অত্যাচারটা হয়তো ওর সাথেই হবে।কিন্তু ওর কি অন্যায়?কি অন্যায়ের শাস্তি ওকে পেতে হবে?হ্যা অন্যায় ও করেছে।নিজের স্বামীকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে।তাকে স্বামীর মর্যাদা দিতে পারেনি।এমন কিছুই ভাবছে মেহের।
ফালাকঃ তোমার জানার পালা শেষ।এখন আমার জানার পালা।
মেহের ফালাকের দিকে তাকিয়ে ভাবছে-” কি জানতে চাই ও?”
ফালাকঃ আমার পুত্র কোথায়?
মেহের হাসি-দুঃখ মিশ্রিত কান্নাস্বরে ফালাককে প্রশ্ন করলো-“আপনি জানতেন আমাদের পুত্র সন্তান হয়েছিল?”
ফালাকঃ একদম চুপ।যা জানতে চাই তার উত্তর দাও।কোথায় আমার পুত্র?
মেহেরঃ আমি জানিনা।কোথায় আমার মানিকরাজ আর কোন জালিম আমার সন্তানকে আমার থেকে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।ও আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাও আমি জানিনা।
মেহের কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছে।ফালাক সহ্য করতে পারছেনা এই কথাগুলো।শরীরের রক্ত গরম হয়ে আছে ওর।মেহেরের কান্নাস্বর আর সহ্য করতে না পেরে ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
ফালাকঃ মায়া কান্না বন্ধ করো।সহ্য করতে পারছিনা তোমার এই ছলনাকর ভাব।
মেহেরঃ ছলনা?
ফালাক চিৎকার করে বলল-“হ্যা ছলনা।তুমি জানোনা আমার সন্তান কোথায়?ওই দুইজন শুয়ার আমার সন্তানকে সরিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবী থেকে। আর তা ওই সমুদ্রের গভীরে ফেলে।”
মেহেরঃ না……
ফালাকঃ হ্যা তাই হয়েছে।কি করে পারলে নিজের গর্ভের সন্তানকে ওদের হাতে তুলে দিতে?শুধু আমাকে ঘৃণা করে, ওর শরীরে আমার রক্ত ছিল তার জন্য?
মেহেরঃ আপনি ভুল ভাবছেন।আমি নিজের সন্তানকে কেনো খুন করবো?
ফালাকঃ সুখের সংসার পাততে পারছিলে না। যে নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে পারেনা সে কেমন মা?সে মা হতে পারেনা।আমার সন্তানকে হত্যা করে ওই জালিমকে আমার সিংহাসনে বসিয়েছিলে।কত বড় দুঃসাহস দেখিয়েছো তোমরা।
মেহেরঃ আমার সন্তানকে ওরা এভাবে হত্যা করেছে?আমি কি পাপ করেছি?এতবড় শাস্তি বিধাতা আমাকে কেন দিচ্ছে?
ফালাকঃ বিধাতা তোমার জন্য কি শাস্তি তুলে রেখেছে জানা নেই।কিন্তু আমি তোমার জন্য যে শাস্তি তুলে রেখেছি তা তো এখনি দেখতে পাবে।
ফালাক কোনোখান থেকে রশি নিয়ে এসে ওকে বড়গাছের নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে গাছের সাথে পেঁচিয়ে শরীর আর হাত বেঁধে দিল।
মেহেরঃ কি করছেন সম্রাট?আমাকে এভাবে বেঁধে রাখছেন কেনো?
ফালাকঃ সারারাত এই জালিম দুটোর লাশের সঙ্গে থাকবে।চোখের সামনে দেখবে ওদের ওই টুকরো টুকরো শরীরের অংশ।
মেহের চিৎকার করে বলল-” না সম্রাট।আমি একা রেখে যাবেন না।আমি পারবোনা এখানে থাকতে। সহ্য করতে পারবোনা ওই লাশদুটো।মরে যাবো আমি।সম্রাট আমাকে একা ফেলে যাবেন না।”
মেহের চিৎকার করে বলছে কিন্তু ফালাক ওর কোনো কথাতে কান না দিয়ে হেঁটে চলে গেল প্রাসাদের ভেতর।একবারের জন্য ও পিছু ফিরে দেখলোনা।কক্ষ আঁধার করে কপালের উপর হাত রেখে সোজা হয়ে শুয়ে আছে ফালাক। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।
ফালাকঃ ভালোবাসা না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছো আমায়।উন্মাদের মত তোমার ভালোবাসা চেয়েছি।ভিক্ষাস্বরূপ ও আমাকে দান করোনি তা। মৃত্যুকে সামনে রেখেও তোমার হাসিমুখটা দেখতে চেয়েছিলাম।অভিমান জমা হলেও ভালোবাসা কমা ছিলোনা।শেষ পর্যন্ত আশায় ছিলাম আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।সেই সুখটুকু নিয়েই মরতে চেয়েছিলাম।কি দিয়েছো আমায়?যখন শুনলাম আমার পুত্র সন্তান তোমার কোল জুড়ে এসেছে।কি যে আনন্দ হয়েছিলো!দেখতে না পেলেও শুনতে পেয়ে নিজের প্রাণ জুড়িয়েছিলাম।আর সেই সন্তানকে তুমি ওদের হাতে তুলে দিলে।তুমি তো আমার থেকেও হিংস্রতার পরিচয় দিয়েছো।ভাবতে অবাক লাগছে আমি এই মেহেরকে উন্মাদের ন্যায় চেয়েছি।তোমার শাস্তি তো ওই আরব আর আমিনের মত হওয়া উচিত ছিল।কিন্তু বার বার নিজের দুর্বলতার কাছে হেরে যাচ্ছি।পারছিনা তোমার শরীরে তড়োয়ারের আঘাত করতে।এই তোমাকে ভালোবেসেই প্রতিটা নারীর শরীরে আমি আঘাত করা ত্যাগ করেছি।নতুন করে নিজেকে সাজিয়েছি।পূর্বের সেই ফালাকের সত্তা আমার মাঝে থাকলে তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম এই দুনিয়া থেকে।কিন্তু আফসোস তুমি আমার বড্ড দুর্বল স্থান দখল করে আছো।আজ এটাও প্রমাণ হলো প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল ভোগ করে।আমিও তাই ভোগ করছি।এই হাতে কত পিতামাতার সামনে তাদের সন্তানকে হত্যা করেছি।আজ আমিও বুঝতে পারছি সেদিন তাদের কোথায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো।আমাকেও আজ সেই শাস্তি পেতে হলো।
আজও ফালাক চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগে মুছে নিল।সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহ্ ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।জাভেদ খানের জলযানের থেকে কয়েক গজ দূরে ছিল জলদস্যুদের যান।ওদের জলযান দেখে এগিয়ে আসছিল আক্রমণ করার জন্য।ওদের চোখের সামনেই ফালাককে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে।তা দেখে দস্যুদল থেমে যায়। তারপর আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ফিরে আসে জাভেদ খান নিজের রাজ্যে।সমুদ্র থেকে ওরা ফিরে আসার পরই দস্যুদলের সর্দার কি মনে করে ফালাকের প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে দেখে ওর সঙ্গীদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ওকে উদ্ধার করে।
ততোক্ষণেও ফালাকের দেহে প্রাণ থাকাতে ওরা খুব অবাক হয়ে যায়।ওর চেতনা ফিরিয়ে আনার পর ওকে সুস্থ করে ওর থেকে সবকিছু শুনে মিরাজ। তা শোনার পর আল্লাহ্ পাক মিরাজের হৃদয়ে আরো বেশি দয়ার সৃষ্টি করে।ও বলে-” আপনি চাইলে আমরা আপনাকে সহযোগীতা করতে পারি আপনার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।”
ফালাকঃ কি হবে রাজ্য দিয়ে?যে রাজ্যে রাজার রানী থাকবেনা সেই রাজ্য আমার আর চাইনা। আমাকে বরং তোমরা তোমাদের সঙ্গেই রেখে দাও।
মিরাজঃ আমাদের কাজ তো জানেনই।এমন কাজ আপনি করতে পারবেন?
ফালাকঃ একসময় তোমাদের থেকে কম ও ছিলাম না।তবে সেই জীবনে আমি আর যেতেও চাইনা। তোমাদের সাথে তোমাদের কাজ না করতে পারি তাই বলে কি থাকতেও পারবোনা?
মিরাজঃ আমাদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যস্থান নেই। যখন যেখানে প্রয়োজন তখন সেখানে আখড়া গাড়ি।
ফালাকঃ আমিও সেখানেই থাকবো।
মিরাজঃ ঠিক আছে।আমরা এখন এই শেরপুর রাজ্যতেই আছি।
এভাবেই ফালাক ওদের সঙ্গ পায়।মেহেরের যখন সন্তান জন্ম নেয় তখন সেই সংবাদ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।ফালাকের কানেও সেই সংবাদ যায়।কিন্তু মনে সাহস পায়না নিজের স্ত্রী পুত্রকে দেখতে যাওয়ার।কারণ ও তখন জানতে পারে সেনাপতি আমিনের সাথে ওর বিবাহ ঠিক করেছে জাভেদ।দূরে থেকেই ওদের জন্য প্রার্থনা করে।যখন মেহেরের সন্তান চুরি হয়ে যাওয়ার সংবাদ রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন ফালাকের ও শোকে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল।ও ঠিক করে সেদিনই প্রাসাদে যাবে।ওর কাছে মনে হয়েছিল এমন কাজ মেহেরের পরিবারের সদস্যদেরই।আর সেদিন রাতেই দস্যুদলের এক যুবক দেখতে পায় আরব আর আমিনকে সমুদ্রে আসতে।আর এ ও দেখতে পেয়েছিল কোনো এক শিশুকে সমুদ্রে ফেলে দিতে।সঙ্গে সঙ্গে সেই যুবক ফালাক আর মিরাজকে এই খবর জানায়।ওদের আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে ওই সন্তান ফালাকেরই ছিল।ফালাক ক্ষিপ্ত হয়ে ওইদিনই প্রাসাদে যেতে চাই।কিন্তু মিরাজের পরামর্শে নিজেকে আরো শক্ত করে তৈরি করে ফালাক।আর তারপরই ওরা রাতের গভীরে রাজপ্রাসাদে গিয়ে হামলা করে।কিন্তু তার পূর্বে আরব আর আমিনকে হত্যা করে ফালাক।রাজ্য ফিরে পাওয়ার পর ফালাক মিরাজ আর সঙ্গী-সাথীদের এই কাজ থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করে।নিজের সেনাপতি বানিয়ে নেয় মিরাজকে।ফালাক প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে।হঠাৎ ঘুমের মাঝে কারো উচ্চকন্ঠের চিৎকার শুনে ও ব চমকে উঠে।শোয়া থেকে উঠে বসে।
ফালাকঃ কে চিৎকার করলো?শেয়ালের হাঁক ও শোনা যাচ্ছে বাগানের ওপাশ থেকে।মেহের?
ফালাকের খেয়াল হলো বাগানের পেছন পাশে ও মেহেরকে রেখে এসেছে।কতোরকম জন্তু জানোয়ার ওখানে আসে।আর আজ তো ওখানে মৃতদেহ পড়ে আছে।তা দেখেই শেয়ালগুলো ওখানে দৌড়ে এসেছে।ফালাক আর বসে না থেকে হাতে তোড়ায়ার টা নিয়ে দৌড়ে গেল মেহেরের কাছে।শেয়ালগুলো তো মৃতদেহ ভক্ষণ করছেই আর সাথে মেহেরকে ও আক্রমণ করেছে।ওকে বাঁধা অবস্থাতে পেয়ে আরো সুবিধা হয়েছে শেয়ালগুলোর।তড়োয়ার আর হাতে আগুন নিয়ে ফালাক শেয়ালগুলোর দিতে তেড়ে যায়।দুই/তিনটা শেয়াল তড়োয়ারের আঘাতে মরেও গেল।মেহের জ্ঞান হারিয়েছে।ওকে দ্রুত কাঁধে তুলে নিল ফালাক।আর বাকি শেয়ালগুলোকে এক হাতে তড়োয়ারি নিয়েই ওদের আঘাত করে তাড়িয়ে দিল।কক্ষে এসে ওকে বিছানাতে শুইয়ে দিয়েছে। হাত পা শরীরের বেশ কিছু জায়গায় কামড় আর আচড় ও লেগেছে মেহেরের।ফালাক এই মুহূর্তে কবিরাজকে ডাকার অপেক্ষা না করে নিজে যতোটুকু পারছে ওকে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছে।সর্বপ্রথম ওর চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করছে।
ফালাকঃ মেহের?মেহের চোখ খোলো।
ওর কোনো সাড়া না পেয়ে পানির ছিটা দিতে থাকলো তবুও চেতনা ফিরে এলোনা।ক্রমাগত বুকে চাঁপ দিতে শুরু করলো।তাতেও কোনো কাজ হচ্ছেনা।বুকে হাত দিতেই ফালাক বুঝতে পারলো প্রচন্ড গতীতে হৃদপিন্ড ওঠানামা করছে।অতিরীক্ত ভয়ে চেতনা হারিয়েছে।আর এই মুহূর্তে চেতনা না ফেরাতে পারলে বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।যদি হৃদস্পন্দন থেমে যায় সেই ভয়ে ফালাক দ্রুত মেহেরের মুখে নিজের মুখ দিয়ে শ্বাস দিতে শুরু করলো।অনেকক্ষণ ধরে দিয়ে চলেছে অবশেষে মেহেরের চোখের পাতা নড়তে দেখে শ্বাস দেওয়া বন্ধ করে।এর মাঝে কক্ষে মিরাজ ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে।
মিরাজঃ সম্রাট কি হয়েছে?আমার বিবি আপনাকে নাকি কাউকে কাঁধে নিয়ে আর তড়োয়ার দেখে কক্ষে আসতে দেখেছে।
ফালাকঃ মিরাজ কক্ষের বাহিরে থাকো ভেতরে এসোনা।
মিরাজ কক্ষের ভেতরে এক পা রেখেই ওর বারণ শুনে পা পিছে নিয়ে বাহিরে দাঁড়ায়।কক্ষে মেহের আছে আর ওর শরীরের বেশ কিছু স্থান থেকে জামা ছিড়ে শরীর দেখা যাচ্ছে অনেকখানি আর কোনো পর্দাও নেই।তাই ফালাক ওকে কক্ষে ঢুকতে বারণ করে।
মিরাজঃ ঠিক আছে সম্রাট ভেতরে আসছিনা।কিন্তু কি হয়েছে?
ফালাকঃ পরে বলছি। তুমি দ্রুত কবিরাজের থেকে পশুর আঘাত পাওয়া ক্ষত স্থানের চিকিৎসার জন্য ঔষধ আনতে পাঠাও কোনো প্রহরীকে দিয়ে।
মিরাজঃ সে তো কবিরাজকে ডেকে পাঠালেই হয়।
ফালাকঃ আহ্ মিরাজ বুঝতে চেষ্টা করো।এত রাত্রে সে এখন এতদূর কষ্ট করে আসবে।তার থেকে আপাদত ঔষধ নিয়ে আসতে বলো আর কাল সকালে যেনো উনি দ্রুত চলে আসে রাজমহলে।
মিরাজঃ ঠিক আছে সম্রাট।
মেহের আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখছে ফালাককে।ফালাক কোনো এক দাসীকে বলল উষ্ণ গরম পানি নিয়ে আসতে।তারপর সেই পানিতে কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে ওর ক্ষতস্থান মুছে দিচ্ছে। মেহের তা তাকিয়ে দেখছে।ক্ষতস্থানগুলো মোছা হলে ফালাক গাম্ভির্যভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।মেহের আস্তে কন্ঠে বলল-” একটু পানি খেতে চাই।”
ফালাক চুপচাপ গিয়ে পানপাত্র নিয়ে ওর সামনে আসলো।মেহের ভেবেছে পানিটুকু ওকে নিজেই খাইয়ে দেবে।কিন্তু না, ফালাক তা করলোনা।ওকে বাহু ধরে টেনে উঠিয়ে বসালো।তারপর ওর সামনে পানপাত্র এগিয়ে দিল।মেহের কোনো কথা না বলে নিজহাতে পানি খেলো।মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই ফালাক ওকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে আনল।
ফালাকঃ নিচে বসে থাকো।ঔষধ আনা হলে শরীরে লাগিয়ে নেবে।

Continue….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here