হিংস্রপ্রেম পর্ব ২১+ ২২

0
342

Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ২১
লেখাঃ Israt Jahan
.

একে একে বুকের আর পিঠের সব দাগগুলোতে ঠোঁটের পরশ বুলাল মেহের।ফালাক কোনো কথা বলছেনা।চোখ দুটো বন্ধ করে প্রিয়তমার এত ভালোবাসা মাখা আদরের স্বাদ গ্রহণ করছে।এই দিনটার আশাতে ফালাক কতোই না অপেক্ষা করেছে রাতের পর রাত।আজ ওর সেই অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে।কিন্তু এত সুখ কি সত্যিই ফালাকের কপালে আছে?হঠাৎ মেহেরের আর কোনো স্পর্শ না পেয়ে ফালাক চোখদুটো খুলে তাকাল।মেহের ওর দিকে চেয়ে আছে।ফালাক চোখদুটো খুলে তাকালে মেহের ওর বুকের মাঝে মাথাটা রাখল।ফালাক বেশ বুঝতে পারছে মেহের এই মুহূর্তে এখন ওর বুকের মাঝখানটাতে মাথা রেখে শুতে চাই।বুকের মাঝ থেকে মাথাটা সরিয়ে ওকে নিয়ে ফালাক বিছানাতে চলে এল।তারপর মেহের নিজেই আবার ওর বুকের মাঝে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।দুজনেই নিশ্চুপ।কিছুক্ষণ পর মেহের মাথাটা উঁচু করে ফালাকের দিকে তাকাল।ফালাক চেয়েই ছিল ওর দিকে।আজ বোধ হয় মনেমনে দুজনেই শপথ করেছে।আজ কেউ মুখে কোনো কথা বলবেনা যা বলবে সব চোখে।চোখের ভাষা বুঝে নিতে হবে দুজনকে।অনেকসময় যে কথা মুখে বলে বোঝানো যায় না সে কথা চোখের ভাষাতে বোঝানো যায়।ওরা দুজন আজ সেই উপায়েই ওদের দুজনের মনের ভাষা বুঝে নিচ্ছে।ফালাকের চোখের দিকে তাকিয়ে মেহের উঠে এল।হঠাৎ করেই মেহের বিছানা থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়ে কান্না করছে নিরবে।এই কান্নার অর্থ ফালাক খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।ও উঠে মেহেরেকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার পেছনের চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে রাখল।
ফালাকঃ প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত, প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষাতে থাকি এই ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য।তোমার এই ভালোবাসাটুকু আমার খুব প্রয়োজন।দেবে না আমায় এই সুখটুকু?
মেহের আর পিছু ঘুরে থাকতে পারলোনা এই কথাগুলো শুনে।সামনে ঘুরেই ঝাপিয়ে পড়ল ফালাকের বুকে।খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। হু হু করে কেঁদে উঠল।আজ ফালাকও কাঁদছে নিরবে।কতসময় এভাবেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে থাকল।কোনো কথা না বলে ফালাক ওকে কোলে তুলে নিয়ে আবারো বিছানাতে চলে এল।
মেহেরকে শুইয়ে দিয়ে ওর খুব কাছে চলে এসেছে ফালাক।যখনই মেহেরের গোলাপি বর্ণের ওই নরম ঠোঁট জোড়াতে ফালাক নিজের ঠোঁট জোড়া এগিয়ে নিয়ে এল মেহের লজ্জাতে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল।এমনভাবে লজ্জা পেয়ে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল মেহের, সেই মুখটা দেখতেও ফালাকের আরো বেশি ভালো লাগছে।মুচকি হাসছে ফালাক।
এদিকে মেহের অধীর আগ্রহে আছে কখন তার স্বামী নামের মানুষটি তাকে আপন করে নেবে। কিছুসময় পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন মেহের সেই মুহূর্তটা আর পেলোনা তখন বাধ্য হয়ে চোখ দুটো খুলল।
মেহেরঃ এটা কি হচ্ছে উনি এভাবে হাসছেন কেনো?
ফালাকঃ কি দেখছো?
মেহেরঃ আপনি এভাবে হাসছেন কেনো?
ফালাক সেই হাসিটা মুখে এঁটে রেখে বলল-“এমনি।”
মেহের মুখটা কিছুটা গোমড়া করে ফেলল তারপর ওকে বলল-“এমনি না। আমি বুঝেছি।”
ফালাকঃ কি বুঝেছো?
মেহেরঃ আপনি এখনো হাসছেন?সরুন আমাকে ঘুমাতে দিন।
মেহের কথাটা শেষ করে ওপাশ ঘুরে যেতে লাগল। ফালাক মেহেরের বাহুটা ধরে আবার নিজের দিকে ঘুরাল।
মেহেরঃ কি হয়ে…..
মেহের কথাটা শেষ করার আগেই ফালাক মেহেরের সেই আকাংখিত মুহূর্তটুকু ফিরিয়ে দিল।মেহেরের ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে দিল নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে।এবারও মেহের চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল।
ভোর হয়ে গেছে।মেহের হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে আছে। ওর কোলের উপর মাথা রেখে ওর কোল জড়িয়ে ধরে উপুর হয়ে ঘুমিয়ে আছে ফালাক।একদম মেহেরের পেটের মাঝে মুখ ডুবিয়ে।আজ দুজনের ঘুমানোর উপায়টা দুরকম হলেও দুজনেই খুব নিশ্চিন্তে আর পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।ফজরের আজান দিচ্ছে আর মেহেরের ঘুমটাও ভাঙ্গল।চোখদুটো খুলেই ফালাককে এভাবে কোলের মাঝে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মেহেরের ইচ্ছা করছেনা ওকে রেখে উঠে যেতে।
মেহেরঃ যেভাবে কোল জুড়ে ঘুমিয়ে আছে মনে হচ্ছে আমি জেগে গেলে পালিয়ে যাবো।অবশ্য না পালালেও উঠতে তো হবে।
মাতাঃ ছিঃ মেহেরুন।তুমি যে এত বেপরোয়া এত নির্লজ্জ তা আমি ভাবতেই পারিনি।এতকিছু বোঝানোর পরও তুমি……..।আমার এখন তোমার সাথে কথা বলতেও অসহ্য লাগছে।
চাচিঃ আমার তো এখন মনে হচ্ছে মেহেরুনের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে।তুমি সম্রাট ফালাকের সঙ্গে গোপনে কোনো ষড়যন্ত্র করছোনা তো?
মেহেরঃ চাচিআম্মা! এমন সন্দেহ আপনি আমার উপর চাঁপাতে পারলেন?
চাচিঃ কি করবো?তুমি যা করছো তাতে আমার এমন চিন্তাধারা ছাড়া আর কিছু মাথায় এল না। তুমি বুঝতে পারছো, জানতে পারছো, দেখতে পারছো।তারপরও তুমি কি করে ওই মানুষের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলে?যার পাঁচদিন বাদেই মৃত্যু অনিবার্য।
মেহেরঃ আম্মাজান আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
মাতাঃ কি কথা বলবে তুমি?তোমার কোনো কথাই আমার আর শুনতে ইচ্ছা করছেনা।তোমার এইসব কার্যকলাপের জন্য তোমার পিতা রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।
মেহেরঃ আম্মাজান আপনারা যেমনটা আশঙ্কা করছেন ওনাকে নিয়ে।আমি বলছি উনি এমন কিচ্ছু করবেনা।
মেহেরের মাতা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
মাতাঃ শেষ পর্যন্ত এই কথাগুলো শুনতে হলো? তাও তোমার থেকে?
চাচিঃ আমি বলেছিলাম ভাবীজান।ওকে পুরোপুরি বশে নিয়ে নিয়েছে সম্রাট ফালাক।আপনার কন্যা কেবল এখন শুধু ফালাক তাজের স্ত্রী।আমাদের কেউ নয়।আর তাই সে আমাদের কথা চিন্তা না করে ওই শয়তানটাকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করছে।
এরই মাঝে মেহেরের চাচা কক্ষের সামনে এল। ওদের কথোপকথন শুনে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
চাচাঃ কি হয়েছে ?ভেতরে আসব ভাবীসাহেবা?
মাতাঃ হ্যা এসো আরব।
চাচাঃ কি হয়েছে?মেহেরুন এভাবে কাঁদছে কেনো?
চাচিঃ তার মনে এখন ওই শয়তান সম্রাট ফালাকের জন্য প্রেম উতলে উঠছে।তার মৃত্যুদন্ড ব্যাহত করার অনুরোধ করছে।
চাচাঃ কি?এই কথা কি আদৌ সত্য মেহের?
মেহের মাথা নিচু করে কাঁদছে।
মাতাঃ ওকে বোঝাও আরব।ও যা দেখছে যা শুনছে তা শুধুই ছলনা।ও ওই শয়তানের ছলনার জালে আটকে পড়ছে।
চাচাঃ আমি কিছু বলবো না আর আপনারাও ওকে কিছু বলবেন না।ওকে যা বলার ওর পিতা বলবে।
আরব গিয়ে জাভেদ খানের কাছে মেহেরের সম্পর্কে এই কথাগুলো জানাল।উনি মেহেরকে ডেকে পাঠালেন।অনেক কিছুই বললেন যেগুলো মেহের জেনেও ফালাকের প্রতি ওর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে।কিন্তু শেষে যে কথা গুলো বললেন তা শোনার পর মেহের হয়তো মরে গেলেও ফালাকের কাছে যেতে পারবেনা।জাভেদ খান ওকে বললেন-” আজ তুমি চাইলেই ওর সঙ্গে ওর রাজ্যে ফিরে যেতে পারো।হ্যা, তোমার জন্য ওর রাজ্য ওকে ফিরিয়ে দেব।কিন্তু এই রাজ্য অর্থ্যাৎ তোমার জন্মভূমি আজীবনের জন্য ত্যাগ করতে হবে।আর এই জন্মভূমি ত্যাগ করা মানে আমাদের সকলকে ত্যাগ করা।মানতে পারবে তো?”
মেহের অবাক হয়ে গেল পিতার কথা শুনে।কোনো কথাই এখন ওর মুখ থেকে বের হচ্ছেনা।দু চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে চেয়ে আছে পিতার দিকে।
পিতাঃ এই কথাগুলো শুনে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো, কাঁদছো। যখন চোখের সামনে নিজের পিতামাতার লাশ পড়তে দেখবে তখন কতোটুকু কষ্ট পাবে? ও তোমায় প্রাণে শেষ না করলেও অন্যান্য রাজ্যের রাজকন্যাদের মত দশা করবে তোমার।আর আমাদের সেইসব রাজ্যের সম্রাটদের মত তোমার চোখের সামনে মেরে শেষ করে দেবে।পারবে তো সহ্য করতে?
মেহেরঃ না পিতা।আমি পারবোনা…….পারবোনা আমি এমন দৃশ্য সহ্য করতে।
পিতাঃ মেহেরুন আমি কোনো নিরপরাধীর সাজা দিচ্ছিনা।আর সে এমন একজন অপরাধী যার শাস্তি কেবল মৃত্যুই।তুমি একবার এই চিন্তা করলেনা যে ও তোমাকে সত্যি স্ত্রী ভাবলে তোমার চাচা আর আমাকে কখনো আঘাত করতে পারতোনা।ধরে নিলাম আমাকে না হয় ও নিজের অজান্তেই সেদিন আঘাত করেছিল।কিন্তু তোমার চাচাজানকে ও কতোবার আক্রমণ করেছে তা তুমি নিশ্চই ভুলে যাওনি।আজই শেষ।এরপর আমি তোমাকে আর কিচ্ছু বলবোনা।বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত।আসতে পারো।
কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল মেহের।প্রাসাদের বাগানে গিয়ে বসে রইল।পুরো একটি মূর্তির ন্যায় বসে আছে।গতকাল রাত্রে মেহের ফালাকের হাত ধরে নিয়ে কক্ষে ঢোকার সময় ওর চাচিআম্মা সেই দৃশ্য দেখে।আর সকাল হলেই তা ওর মাতার কাছে বলেন তিনি।
আব্বাজানঃ কি ব্যাপার হয়েছে বলো তো?আজ আমার তাজকে এত খুশি লাগছে কেনো?
ফালাক হেসে উত্তর দিল-“কিছুনা আব্বাজান।”
আব্বাজানঃ কিছু তো আছেই।যাক সে কথা আমি আর শুনতে চাইছিনা।বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আমি।
ফালাকঃ আপনার শরীর ঠিক আছে তো আব্বাজান?আপনার কোনো কষ্ট হচ্ছেনা তো?
আব্বাজানঃ আমার তাজের মুখে আনন্দের ছায়া দেখছি।আমি তাহলে খারাপ থাকি কি করে?
কথাটা বলার পরই আব্বাজানের মুখটা মলিন হয়ে গেল।চোখের কোণে পানি চলে এল।
ফালাকঃ কি হয়েছে আব্বাজান?আপনি কাঁদছেন কেনো?
আব্বাজানঃ মেহেরুন মা পারবে তো তোমাকে তোমার সাজা থেকে মুক্ত করতে?
ফালাকঃ আপনার মেহেরুনের প্রতি কতটুকু ভরসা আছে আমি জানিনা তবে আমার ভালোবাসার উপর আমার সহস্রধিক ভরসা আছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল এখন অবদি ফালাক মেহেরকে এক নজর দেখতে পেলোনা।মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে ওর।কোনো একজন দাসীর কাছে ওর কথা জিজ্ঞেস করলো।কিন্তু সে ও বলতে পারলোনা।যখন সন্ধ্যা নেমে এল আর তাও মেহেরের দেখা পেলোনা ফালাক।তখন খুব দুশ্চিন্তা পড়ে গেল ও।কম করে হলেও পঞ্চাশবার ফালাক মেহেরের কক্ষে গিয়েছে কিন্তু দেখা পায়নি।সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে এলে তখন মেহের কক্ষে এল। ফালাক তখন ওর কক্ষেই বসে ছিল।মেহের কক্ষে ঢুকে ওর সঙ্গে কোনো কথা বললোনা।ফালাক রেগে উঠে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
ফালাকঃ সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?
মেহেরঃ (………)
ফালাকঃ আশ্চর্য! কথা বলছোনা কেনো?কি হয়েছে?
মেহেরঃ কিছু হলেই কি আপনাকে জানতে হবে?
ফালাকঃ এটা তুমি প্রশ্ন করছো?অবশ্যই জানতে হবে।
মেহেরঃ কেনো?
ফালাকঃ কি নির্বোধের মত প্রশ্ন করছো।কেনো আবার?আমি তোমার স্বামী।আমি জানতে চাইবো না তো কে জানতে চাইবে?
মেহের কথা বলছেনা।শুধু ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ফালাকঃ বুঝতে পারছিনা।কি হয়েছে তোমার? এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
মেহের এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে ওকে এড়িয়ে চলে যেতে লাগল।ফালাক ওর হাত টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এল।
ফালাকঃ এমন কেনো করছো তুমি?
মেহের চিৎকার করে বলল-” হাত ছাড়ুন। সবসময় এভাবে কাছে এসে হাত ধরে আমাকে স্পর্শ করে কথা বলেন কেনো? এই নোংরা স্বভাব কি আপনার কখনোই যাবেনা?
ফালাক মেহেরের এই অদ্ভুত ব্যবহারটা নিতে পারছেনা।ওর হাত ঝারি দিয়ে ফেলে বলল-” অসহ্য।আমি তোমার এই হঠাৎ হঠাৎ এত বিশ্রি ব্যবহার নিতে পারিনা।কেনো এমন করো তুমি? কি অসুবিধা?মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করো যেনো আমি স্পর্শ করলেই তুমি অপবিত্র হয়ে যাও।আমি কি বাহিরের পুরুষ যে এমন করো?”
মেহেরঃ আপনি আমার নিজের কেউ তা কি আমি একবারও বলেছি?
ফালাক ওর দিকে চেয়ে আছে।আর কোনো কথার উত্তর দিচ্ছেনা।ও ভাবছে-“নিশ্চই কেউ কোনো বাজে ভাবে আলোচনা করেছে আমাকে নিয়ে।যার জন্য রেগে গিয়ে এমন করছে।ঠিক আছে বেশি কথা বাড়ানো যাবেনা।মেজাজ ঠান্ডা হলেই নিজে থেকে ছুটে আসবে আমার কাছে।”
রাতে দুজন শুয়ে আছে এক সঙ্গে।কিন্তু মেহের সেই আগের মত মাঝে দূরত্ব রেখে শুয়ে আছে।ফালাক ওর দিকে বার বার তাকাচ্ছে।ওর দিকে উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে আছে মেহের।ফালাক কিছু বলতে গিয়েও পারছেনা বলতে।এভাবেই অনেক সময় কেটে গেল দুজনের মাঝে।কেউ কোনো কথা বলল না।মেহের একবার ওর দিকে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল ফালাক ঘুমিয়ে গেছে।উঠে বসে ওর দিকে চেয়ে সেই নিরবে চোখের পানি ফেলছে।ওর পায়ের কাছে গিয়ে পা টা ধরে ওই পোড়া দাগ গুলো দেখছে।
মেহেরঃ আজ আপনার পুরো শরীর জুড়ে শুধুই অত্যাচারের দাগ।কোথাও একটু জায়গা ফাঁক নেই। যখন এই দাগগুলো দেখেছিলাম তখন নিজের মনেই বলেছিলাম, এমন অমানবিক অত্যাচার কিভাবে করতে পেরেছিল আপনার সাথে।আর সেই আমি সেদিন তার থেকে কোনো অংশে কম আঘাত করিনি আপনাকে।আর মাত্র চারটা দিন বাকি।
তারপর কি সত্যি আমি আপনাকে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলব?
কথাগুলো বলে পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল।দাগ গুলোর উপরে হাত বুলিয়ে চোখের পানি মিশিয়ে সেখানে কয়েকবার চুমু খেলো মেহের। এতক্ষণে ফালাকের ঘুম ভাঙ্গলো।পায়ে মেহেরের ঠোঁটের উষ্ণ পরশ আর চোখের পানি পড়ে ভিজে যাওয়াতে ওর ঘুম ভেঙ্গেছে।উঠে বসল ফালাক। ওকে জাগ্রত হতে দেখে মেহের ওর পা ছেড়ে চোখের পানি মুছে বিছানা থেকে চলে যেতে লাগল।
ফালাকঃ মেহের দাঁড়াও।
ফালাক ওকে গিয়ে আটকে ধরল।ওর দুইবাহু ধরে ওকে বলল-” আল্লাহর কসম।কি হয়েছে আমাকে সত্যি করে বলো?তুমি এভাবে কেনো কাঁদছো আর কি ভেবে কষ্ট পাচ্ছো এত?”
মেহেরঃ কিছুই হয়নি।আমাকে ছাড়ুন আমি বাহিরে যাবো।
ফালাকঃ না।তুমি বাহিরে যেতে পারবেনা।আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
মেহেরঃ আমি বলতে বাধ্য নই।
ফালাকঃ তোমাকে আমি বাধ্য করছিনা।আমার অধিকার আছে তোমাকে এসব জিজ্ঞেস করার।
মেহেরঃ কিসের অধিকার?কোনো অধিকার নেই আপনার।আমি কোনোদিনও আপনাকে আমার উপর জেরা করার অধিকার দিইনি।
ফালাক এবার প্রচন্ড রেগে গেল।খুব শক্ত করে ওর দুই বাহু চেঁপে ধরল।মেহের খুব ব্যথা পাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেঁপে বলতে শুরু করল-” তোমার প্রতি আমার অধিকার আরো কয়েকমাস আগেই হয়ে গেছে। আর তুমি আমাকে অধিকার দেওয়ার কে?যেখানে তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী।সেখানে তুমি দিলেও আমার অধিকার আছে আর না দিলেও আছে।”
তারপর ওকে টানতে টানতে বিছানার উপর নিয়ে বসালো।
ফালাকঃ আমার দিকে তাকাও।পরিষ্কার করে বলো কি ভেবে তুমি এতো কষ্ট পাচ্ছো?আমি মরে যাবো বলে?
মেহের অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কেঁদে চলেছে।
ফালাকঃ একটা কথা মনযোগ দিয়ে শুনে রাখো। আমি মেহেরের ভালোবাসা পেয়ে গেছি।এখন ওই উপরওয়ালা ছাড়া আর কারো ক্ষমতা নেই আমাকে হত্যা করার।যে আসবে তাকে টুকরো টুকরো কুকুরের মুখে দিয়ে দেবো।সে যেই হোক।
শেষের কথাটা শুনে মেহেরের হৃদয় কেঁপে উঠল। ওর পিতার বলা কথাগুলো মনে পড়ল।মেহেরকে ওর সঙ্গে করে নিয়ে যেতে গেলে নিশ্চিত একটা যুদ্ধের সৃষ্টি হবে মেহেরের পিতার সাথে।আর তখন যদি সত্যি ফালাক ওর পিতার কোনো ক্ষতি করে বসে?মেহের তো ফালাকের রাগ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত।আবার পিতামাতাকে সারাজীবনের জন্য ত্যাগ করে ও পারবেনা ফালাকের সঙ্গে চলে যেতে।
ফালাকঃ এখনো চুপ করে আছো?আমার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে।আমাকে বলো তো, তোমাকে কে কি বলেছে?
মেহেরঃ যে যাই বলুক।তার জন্য আপনি তাকে হত্যা করতে চাইবেন?
ফালাকঃ চাইবোনা, করবো।সেই ব্যক্তির কথার জন্য তুমি যদি আমার থেকে দূরে সরে থাকো তাহলে তো আমি তাকে হত্যা করতে বাধ্য হবোই।
মেহেরঃ আর এর জন্যই আমি আপনার কাছে আসতে চাইনা আর কোনোদিন আসবো ও না
আপনার এই ভয়ানক ব্যক্তিত্বের জন্য।
ফালাকঃ কি বললে তুমি?
মেহেরঃ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে হবে শুনতে পাননি?
ফালাক শান্ত হয়ে ঠান্ডা মস্তিষ্কে থাকার চেষ্টা করছে।নরম সুরে মেহেরকে বলছ-” মেহের আমার কথা শোনো।আমি আর এমন থাকবোনা।যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকো।আর তোমার পরিবারের ও কোনো ক্ষতি আমি করবোনা যদি ওরা তোমাকে আমার সাথে যেতে বাঁধা না দেয়।আমি সত্যি বলছি। আমি আর তোমার পরিবারের সঙ্গে কোনো শত্রুতামি করবোনা।সবকিছু ভুলে যাবো যা হয়েছে আমার সাথে।”
মেহেরঃ আর বাঁধা দিলেই তাদের ক্ষতি করবেন আপনি তাইতো?আপনি নিজেই নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ভাবুন আপনি কেমন।
ফালাক খুব রেগে গিয়ে এইবার চিৎকার করে বলল-” তারমানে তুমি বলতে চাইছো ওরা আমাকে বাঁধা দেবে তাইনা?”
ফালাক মেহেরকে টেনে ওর বুকের কাছে নিয়ে এল।
ফালাকঃ আমি এতকিছু জানিনা আমার এতসব চিন্তা করার ধৈর্য নেই।আমার শুধু তোমাকে চাই। তোমাকে পেলেই আমার আর কোনো কিছু প্রয়োজন নেই।
মেহেরঃ আর আমি যদি আপনাকে না চাই তাহলে কি আপনি পূর্বের ন্যায় জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন?আমি যাবোনা আপনার সঙ্গে।আমার আপনাকে প্রয়োজন নেই।আমার শুধু আমার পরিবারকেই প্রয়োজন।ছেড়ে দিন আমাকে আর চলে যান এই কক্ষ থেকে।
ফালাক মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলল-“তুমি আবার সেই পূর্বের মত পাগলামী শুরু করেছো।তুমি আমাকে যথেষ্ট চাও আর আমার থেকেও বেশি।
আমি জানি।”
মেহের ফালাককে ধাক্কা দিয়ে উঠে গেল।
মেহেরঃ কি যন্ত্রণা আপনি সবসময় এমন করেন কেনো?সবসময় নিজের মতো করে ভেবে তা সাজিয়ে জোর করে আমার উপর চাঁপিয়ে দিতে চান।আমি কি একবারও বলেছি আপনাকে এই কথাগুলো নাকি আমার কোনো ভাবমূর্তি দেখে এমন কিছু প্রকাশ পেয়েছে?
ফালাক বিছানা ছেড়ে উঠে ওর কাছে এল।
ফালাকঃ প্রকাশ পায়নি?গত দুই দিন দুই রাত যা যা করেছো তুমি আমার সঙ্গে তাতেও বুঝি প্রকাশ পায়না?
মেহের এর প্রতিউত্তরে কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছেনা।
মেহেরঃ আমি আর কথা বাড়াতে চাইছিনা।আমি খুব ক্লান্ত আমার ঘুম প্রয়োজন।
ফালাকঃ ঠিক আছে আমি আর কথা বাড়াচ্ছিনা, এসো।
মেহেরঃ এসো মানে? আপনাকে আমি একবার বললাম না আপনি এই কক্ষ থেকে যান?
ফালাকঃ মেহের……
মেহেরঃ আপনি আর দয়া করে কথা বাড়াবেন না। আমি পারছিনা আপনার কথা শুনতে।
ফালাক কোনো উত্তর না দিয়ে কিছু মুহূর্ত মাথা নিচু করে রইল।আর মেহের অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফালাক গিয়ে ওর বাহু ধরে টেনে বিছানায় নিয়েলো।
ফালাকঃ আর কোনো কথা বলবোনা।এখন যা হবে সব চোখের সামনে।
ফালাক মেহেরের কাছে আসতে গেলেই মেহের ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নিজের কোমড় থেকে ছুড়ি বের করে নিয়ে উচ্চস্বরে বলল-” এভাবে জোর করে আমার কাছে আসার চেষ্টা করলে একদম শেষ করে দেবো নিজেকে।বেরিয়ে যান আমার কক্ষ থেকে।”
ফালাক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কর্কশ কন্ঠের কথাগুলো শুনে আর কিছু বলল না।সোজা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।কোনো একটি কক্ষের দেয়ালে খুব জোরে আঘাত করে চিৎকার করে উঠলো ফালাক।

Continue…….

Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ২২
লেখাঃ Israt Jahan

.
দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেল।মেহের আর ফালাক কাছাকাছি বা পাশাপাশি বসে কথা বলার সুযোগটুকু পায়নি।পায়নি বলতে মেহের দেয়নি সেই সুযোগ।দূর থেকে দাঁড়িয়ে যতটুক দেখতে পেয়েছে দুজন দুজনকে।রাতের আঁধারে মেহের বালিশে মুখ চেঁপে কাঁদে কিন্তু ফালাক মেহেরের মত আর কেঁদে দুঃখ হালকা করতে পারেনা।ওকে নিরবে সয়ে যেতে হচ্ছে এই যন্ত্রণাগুলো।এদিকে সন্তানের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসছে।মেহের পারলোনা এই কঠিন শাস্তি থেকে ফালাক কে মুক্ত করতে। এমনকি এই তিনদিনে মেহের আব্বাজানের কক্ষেও যায়নি।তিনি বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।আজই শেষ রাত ফালাকের জীবনের।
কোনোমতে পালিয়ে যেতে না পারে তাই আব্বাজানের কক্ষের চারপাশ প্রহরীতে ভরে আছে।ফালাক নির্ঘুম।আজ ওর সত্যিই মনে হচ্ছে যে এই রাতটাই ওর শেষ রাত।নিজের ভালোবাসার উপর ভরসাটুকু ওর হারিয়ে গেছে।কক্ষের দরজার ওপাশে কারো কথার আওয়াজ পাচ্ছে ফালাক।
মেহেরঃ তোমাদের কত বড় দুঃসাহস।আমি বলার পরও কক্ষের দ্বার থেকে সরে দাঁড়াচ্ছোনা?
প্রহরীঃ মাফ করবেন রাজকন্যা।মহারাজের হুকুম উনি বারণ করেছেন।
মেহেরঃ বারণ করেছেন মানে?কি বলেছেন পিতা?
প্রহরীঃ আপনি আসলেও যেনো কোনোভাবেই কক্ষের ভেতর ঢুকতে না দিই।
মেহের পুরো দিশেহারা হয়ে আছে।কি করে কক্ষের ভেতর ঢুকবে, ফালাকের সঙ্গে দেখা করবে?এর মাঝেই ফালাক কক্ষের দ্বার খুললো।মেহের ভেতরে ঢুকতে গেলে দুজন প্রহরী বাঁধা দিল।দুজন দ্বারের এপারে আর ওপারে দাঁড়ানো।কিছুসময় দুজন দুজনকে এভাবেই তাকিয়ে দেখছিলো।ফালাক মেহেরের সামনে থেকে চলে এল কক্ষের ভেতর। মেহেরের ইচ্ছা হলেও আর যাওয়ার উপায় নেই ওর কাছে।একবার ডাকতেও পারলোনা।চলে এল নিজের কক্ষে।সকাল হতেই ফালাককে নিতে এল কয়েকজন রক্ষী।আব্বাজান কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
একেই বলে সন্তান হারানোর আহাজাড়ি।নিজের বুকে নিজেই চাপড় দিতে আছে আর চিৎকার করে কাঁদছে।ফালাক নিশ্চুপ।ওর চোখে না আছে পানি আর না ওর মুখে আছে কোনো কথা।কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে আব্বাজানকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে তারপর কক্ষ থেকে বের হলো।
প্রাসাদের সামনে যে খোলা ময়দান সেখানে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে।সেখানে সবাই উপস্থিত শুধু মেহের ছাড়া। ফালাকের চোখদুটো সমানে মেহেরকেই খুঁজছে।রক্ষীরা ফালাকের চারপাশ ঘিরে আছে।এমনভাবে ঘিরে আছে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র জন্তুজানোয়ার কে আটকে রাখা হয়েছে।কোনোরকমে ফাঁক পেলে মনে হয় পালানোর চেষ্টা করবে অথবা কারো উপর আক্রমণ করে বসবে।কিন্তু ওরা জানেনা যে ফালাকের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করা। সবাই ওকে প্রাসাদের বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।ও কিছুটা অবাক হয়ে একজন রক্ষীকে জিজ্ঞেস করল-” আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?”
রক্ষীঃ গেলেই দেখতে পাবে।
ফালাক আর কোনো কথা বলল না।ওকে সমুদ্রের পারে নিয়ে আসা হলো।তারপর একটি বিশাল জলযানে উঠানো হল।জলযানে উঠার পরই ও মেহেরকে দেখতে পেলো।কিন্তু ওর মুখটা না শুধু ওর চোখদুটো।চোখদুটো দেখেই ও চিনতে পেরেছে মেহেরকে।মেহের ওর দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে আছে কিন্তু ফালাক সেই অশ্রু দেখতে পাচ্ছেনা।দুজনে শুধু দুজনের দিকে নিরবে চেয়ে আছে।জলযান চালকটি চিৎকার করে জাভেদকে বলল-” মহারাজ আমরা মাঝ সাগরে চলে এসেছি।”
জাভেদঃ যান থামাও।
মেহেরের হৃদয় কেঁপে উঠলো।এতক্ষণে ফালাক বুঝতে পারলো যে ওকে কি উপায়ে মৃত্যু দেওয়া হবে। হাতদুটো ওর পেছনে নিয়ে বাঁধা ছিল।
জলযানের এক পার্শ্বে ওক দাঁড় করানো হল।
তারপর পা দুটো ও একসাথে বেঁধে দিল ওরা।এই দৃশ্য দেখে মেহেরের নিজের প্রাণটা বেরিয়ে আসার মত অবস্থা হয়ে যাচ্ছে।
ফালাকঃ হে বিধাতা! এ কেমন মৃত্যু দিচ্ছো আমাকে।আমার মৃত দেহটি জানাজা করার মত উপায় ও রাখলে না।কারো প্রার্থনা নেওয়ার সুযোগটুকু পেলাম না।
আরবঃ রক্ষীগণ ওকে প্রস্তুত করা হয়েছে?
রক্ষীঃ না। কলসীটা এখনো বাঁধা হয়নি।
আরবঃ পানিভর্তি করে কলসীটা বেঁধে ফেলো।
মেহেরঃ কলসী?কলসী কেন বাঁধা হবে ওর গলাতে? চাচাজান আমি তো পিতাকে এমন কিছু বলিনি।
আরব মেহেরের কিছুটা কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।তাই সে রাগে কটমট করে ফিসফিসিয়ে বলছে-“তুমি বলোনি আমি বলেছি।আমাকে তুমি বোকা ভাবো? যখন আমি শুনলাম তুমি মহারাজকে ওর মৃত্যুর ব্যবস্থার উপায় বলছো আর তা মাঝ সমুদ্রে ফেলে মারার উপায় বলছো। তখনই আমার বোঝা হয়ে গেছে।ধরা পরে গেছে তোমার চালাকি।কি ভেবেছো আমি বুঝতে পারিনি যে ওকে বাঁচিয়ে রাখার ফন্দী এঁটেছো তুমি?ওকে এভাবে সমুদ্রে ফেলে দিলে ও সাঁতরে পারে চলে আসতেও পারে অথবা অন্য কোনো উপায়েও বেঁচে যেতে পারে।আর তা যাতে না পারে তার উপায় আমি মহারাজকে বলেছি।”
মেহেরঃ চাচাজান….?
আরবঃ চুপ থাকো একদম।আর কোনো কথা বলবেনা।
মেহেরের শেষ আশাটুকু ও পানিতে চলে গেল। এবার ওর বুক ফেটে কান্না আসছে।ওর ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তেই ফালাককে নিয়ে সমুদ্রে ঝাপ দিতে। কিন্তু তারও কোনো উপায় রাখেনি আরব।
কয়েকজন দাসীকে ও সঙ্গে করে এনেছে মেহেরকে সামলানোর জন্য।
আরবঃ মহারাজ আমাদের মেহেরুনের বুদ্ধির তুলনা নেই।কতো সুন্দর একটি পরিকল্পনা করেছে ওকে মারার।সমুদ্রে যাবে সামুদ্রিক মাছের খাদ্য হিসেবে।
মেহেরের রাগে ইচ্ছে করছে নিজের চাচার মাথাটা এক কোপে কেটে সমুদ্রে ফেলে দিতে।ও হাত দুটো ও নড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেনা।এমনভাবে দাসীগুলো ওকে ধরে রেখেছে।আরবের মুখে এই কথাটি শুনে ফালাক এতোটায় চমকে গেছে যা ওর জীবনে ও কোনোকিছুতেই এতো চমকাইনি।ও ধরেই নিয়েছে আজো পর্যন্ত ও মেহেরের মনে জায়গা করতে পারলোনা।
ফালাকঃ আমার একটা শেষ কথা ছিল।
আরবঃ চুপ কর শয়তান।তোর আর কোনো কথা শোনা হবেনা।সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করছিস আবারো?
জাভেদঃ আরব ওকে বলতে দাও।
ফালাকঃ কথাটি রাজকন্যা মেহেরুন কে বলতে চাই।
জাভেদঃ বলো সে তোমার পিছে দাঁড়িয়ে আছে।
ফালাককে দুজন রক্ষী চেঁপে ধরে রেখেছে।ও পিছে ঘুরে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল-” এতোগুলো দিনের ভেতর আমার স্ত্রীর হাসি মুখটা কখনো আমি দেখিনি।কখনো তাকে হাসতেই দেখিনি।
আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে তার হাসি মুখটা দেখতে। হাসলে তাকে কতোটা অপরূপ দেখাই তা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
কথাগুলো শেষ হতেই আরব ওর বুকে খুব জোড়ে লাথি মেরে সমুদ্রের মাঝে ফেলে দিল।
আরবঃ হাসিমুখ দেখার ইচ্ছা হয়েছে তোর? এখন গিয়ে দেখ।
মেহের চিৎকার করে উঠলো।এমন অবস্থা হয়েছে এখন ও নিজেই সমুদ্রে ঝাপ দিতে চাইছে।ওর পিতা আর দাসীরা মিলে ওকে আটকে রেখেছে। প্রাসাদে ফেরার পর মেহেরকে সামলানো দ্বায় হয়ে পড়েছে। চিৎকার করে কাঁদছে আর নিজেকে মেরে ফেলার উপায় খুঁজছে।চারপাশে দাসী ওর আম্মাজান, চাচি মিলে ওকে ধরে রেখেছে।উন্মাদের মত করছে ও। কখনো ওর আম্মাজান রেগে গিয়ে চড় মারছে আবার নিজেই আদর করে ওকে সামলাতে চাইছে।
সবসময় ওর কাছে চার পাঁচজন দাসীকে থাকছেই। রাত দিন সবসময় মেহের ফালাকের ওই কারাগারের মাঝে গিয়ে পড়ে থাকে।খাওয়া-দাওয়া নিজের যত্ন-পরিচর্যা করা এসব ভুলেই গিয়েছে ও।
এরই মধ্যে ফালাকের পিতা সন্তানের মৃত্যু শোকে অসুস্থ হয়ে মারা গেল।মৃত্যুর সময় উনি মেহেরের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করেছে।মৃত্যুর আগে সে মেহেরকে বলে গেছে তার কবর টা যেন ফালাকের রাজপ্রাসাদের মাঝে দেওয়া হয়।কিন্তু আরব তাতে খুব বাঁধা প্রয়োগ করেছে।জাভেদ খানের কাছে ও আবদার করেছে মোহননগর রাজ্য ও পরিচালনা করতে চাই।তবে মেহের তার প্রতিবাদ করে জোরপূর্বক তার করবটা ফালাকের রাজপ্রাসাদেই দেওয়ার ব্যবস্থা করে।একদিন মেহের রাজসভা থেকে বেরিয়ে নিজের কক্ষে আসছিল তখন মেহের শুনতে পেল আরব তার স্ত্রীর কথোপকথন।
আরবঃ যাই বলো বিবি শেরপুর রাজ্যের অধিপতি না হতে পারলেও ফালাকের রাজ্যের অধিপতিত্ব পাবো আশা করছি।
বিবিঃ কি করে? মেহেরুন থাকতে ওই রাজ্যের দায়িত্ব মহারাজ আপনাকে দেবেন কেনো?
আরবঃ আরে দেবে।তারা তো এখন মেহেরুনের বিবাহ নিয়ে চিন্তিত।তার জন্য রাজকুমারের খোঁজ চলছে।সারাজীবন তো আর তারা বেঁচে থাকবেনা ওকে দেখে রাখার জন্য।তাই তারা মেহেরুনকে সিংহাসনে বসানোর থেকে বেশি চিন্তা করছে ওর সুস্পষ্ট ভবীষ্যত।বিধাতার কি খেলা।শেরপুর নগরীর সিংহাসন দখল করার জন্য যে ফালাক তাজের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম আজ সেই ফালাক তাজকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়ে তার রাজ্য দখল করলাম।আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলি।এখন তুই কোথায় সম্রাট ফালাক তাজ?
মেহের আর এক মুহূর্ত দেরী করলোনা।কক্ষ থেকে তড়োয়ার নিয়েসে চাচাজানের কক্ষে ঢুকে তাকে আক্রমণ করতে গেল।আরব ওকে কোনোমত আটকে রেখে চিৎকার করে রক্ষীদের ডাকছে।ওরা এসে মেহেরকে আটকানোর চেষ্টা করছে।মেহের আর আরবের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জাভেদ আর তার স্ত্রী ছুটে এলো।মেহেরকে এভাবে চাচাকে মারার চেষ্টা করতে দেখে ওর গালে চড় মেরে বসল।
জাভেদঃ মেহেরুন কি করছো তুমি?তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেলে?নিজের চাচাজানকে এভাবে মারতে চেষ্টা করছো কেনো?
মেহেরঃ ও আমার চাচা নয় ও আমার শত্রু।এই রাজ্যের শত্রু ও আপনার শত্রু আর আমার স্বামীর। আপনি জানেন ওর কারণে সেদিন ফালাক এই রাজ্য আক্রমণ করতে পেরেছিল?ও সহযোগীতা করেছিলো।
চাচিঃ মেহেরুন তুমি উন্মাদ হয়ে গেছো নাকি?উনি তোমার চাচা হয় ও এই রাজ্যের শত্রু হবে কেনো?
আরবঃ মহারাজ মেহেরুন উন্মাদ হয়ে গেছে ফালাকের মৃত্যু শোকে।ওকে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
মেহেরঃ আমি উন্মাদ হইনি।আমি সব শুনেছি তোদের দুজনের কথা।
আরবঃ আপনি মেহেরুনের অবস্থা দেখুন।দিন দিন ওর শরীর আর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কখন কি ভাবছে ও নিজেও জানেনা।
এভাবেই হাজার কথার প্যাঁচে আরব কথা ঘুরিয়ে দেয়।আর মেহেরুনকে উন্মাদ প্রমাণ করার চেষ্টা করে।এই কথা গুলো জানার পর মেহের সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে আরবকে খুন করার জন্য।ওকে দেখলেই তেরে যায় ওর দিকে।এর মাঝে আরব জাভেদ কুমিরে কান্না করে আবদার করে ফালাকের সিংহাসনে বসার জন্য।এক পর্যায়ে নিজের ভাই বলে জাভেদ রাজি ও হয়ে যায়।স্ত্রী পুত্র নিয়ে ফালাকের রাজ্যে গিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করে।আর এদিকে মেহেরের জন্য তার পিতা বিভিন্ন রাজ্যের রাজপুত্র খুঁজতে আরম্ভ করে।কিন্তু কেউ-ই ওকে বিবাহ করতে সম্মতি জানাইনা। ওর পূর্বের বিবাহ সম্পর্কে তারা ফিরে যায়।বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় জাভেদ খান।একদিন হঠাৎ করে মেহের অসুস্থ হয়ে পড়ে।জাভেদ খান কবিরাজকে ডেকে পাঠায়।
কবিরাজ মেহেরকে বেশকিছুক্ষণ ধরে দেখে বলে-” রাজকন্যা মেহেরুন অন্তঃসত্ত্বা।উনি মা হচ্ছেন।”
জাভেদঃ কি বলছেন কবিরাজ সাহেব?আপনি ঠিকমত দেখেশুনে বলুন।
কবিরাজঃ আমি ঠিকমত দেখেশুনেই বলছি।উনি দুইমাসের অন্তঃসত্বা।এর জন্যই উনি এভাবে মাথা ঘুরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এই খবরটি শোনার পর কারো বুঝতে বাকি নেই যে মেহের ফালাকের সন্তান নিজের মাঝে ধারণ করছে।মেহের এই খবরটি শুনে যতোটা খুশি হয়েছে তার থেকে বেশি অখুশি হয়েছে ওর পিতামাতা।নিজেদের কক্ষে বসে দুজনে আলোচনা করছেন-“মহারাজ এখন কি উপায় হবে?এমনিতেই কোনো রাজা বা রাজপুত্র ওকে বিবাহ করতে চাইছেনা।তারউপর এই অবস্থা।কি হবে আমার কন্যার?”
জাভেদঃ কিছুই বুঝতে পারছিনা বেগমসাহেবা। কি আছে আমার কন্যার কপালে?
রানীঃ মহারাজ এই সন্তানের জন্ম দিলে ওকে যে আর কেউ-ই গ্রহণ করতে চাইবেনা।আমরা মরে গেলে ওর দ্বায়ভার কে বহন করবে?
মেহেরের মাতা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছেন।
জাভেদঃ কি হয়ে গেল আমার এত ফুটফুটে কন্যার জীবনখানা।
রানীঃ শেষ করে দিয়ে গেল ওই জানুয়ার টা।
জাভেদঃ আহ্ রানী! সে এখন মৃত।এখন অন্তত তাকে আর শাপ দিওনা।
রানীঃ পারছিনা তো নিজেকে সামলাতে।
ভেবেছিলাম ওর হাত থেকে মুক্তি পেলো আমার কন্যা।কিন্তু ও চলে গেলেও ওর কীট দিয়ে গেল আমার কন্যার মাঝে।
জাভেদঃ কি বলছো তুমি এসব?এখনো যে জন্মাতে পারলোনা তার সম্বন্ধে তুমি এসব কি বলছো?ওই শিশুর দোষ কোথায়?এসব কথা বন্ধ করো।আমাকে ভাবতে দাও আমার কন্যাকে নিয়ে।
মেহের এখন নিজের যথেষ্ট খেয়াল রাখে।ও নতুন করে আশা খুঁজে পেয়েছে সুস্থ জীবনযাপন করার।
এই খবর আরবের কানে পৌঁছালে আরব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।ও ভাবতে থাকে-” ফালাকের সন্তান জন্ম নেওয়া মানে এই রাজ্য ফালাকের সন্তানের।আমি আর পারবোনা এই রাজ্যে সম্রাট হয়ে থাকতে। আমাকে কোনো উপায় খুঁজতে হবে যাতে করে ওর সন্তান এই সিংহাসনে কখোনই বসতে না পারে।”
আরব অনেক বড় ষড়যন্ত্র করলো ফালাকের সন্তানের জন্য।শেরপুর রাজ্যে এলো।
আরবঃ মহারাজ আপনি অনুমতি দান করলে মেহেরুনের বিবাহ সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।
জাভেদঃ কি কথা আরব?
আরবঃ আমি মেহেরুনের জন্য একটা বিবাহের প্রস্তাব নিয়েসেছি।
জাভেদঃ এ তো খুশির সংবাদ।বলো কে সেই মহান ব্যক্তি?
আরবঃ সে আর কেউ নয়।আপনার সেনাপতি আমিন।
জাভেদ রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল-” আরব! তুমি আমার কন্যার জন্য সামান্য এক সেনাপতির প্রস্তাব নিয়েসেছো?তাও আমার সেনাপতি?এতবড় সাহস সেনাপতি আমিনের, আমার কন্যার দিকে চোখ তুলে তাকাই?”
আরবঃ ক্ষমা করুন মহারাজ।অন্তত আমাকে পুরো কথাটি বলার সুযোগ দিন।এতে সেনাপতির কোনো দোষ নেই।এই প্রস্তাব আমিই ওকে দিয়েছি।
জাভেদঃ কি এমন কারণ যার জন্য তুমি সামান্য সেনাপতিকে আমার কন্যার জন্য পছন্দ করেছো?
আরবঃ প্রথমত, মেহেরুনের জন্য কোনো রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা আর এখন পেলেও কেউ মেহেরুনের সন্তানসহ গ্রহণ করবেনা।আর যদি কোথাও ভাগ্যক্রমে বিবাহ হয়েও থাকে ওর।তারা ওর এই পূর্বের বিবাহের ইতিহাস জেনে ওর সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করবে তা আমি বা আপনি কেউ জানিনা।আমরা সবসময় অনেক দুশ্চিন্তার মাঝে থাকব।আর সেনাপতি সে আমাদের খুবই বিশ্বস্ত। দেখতেও সে মন্দ নয়।তার সঙ্গে বিবাহ হলে মেহেরুন সবসময় আমাদের সামনেই থাকবে।সেই একমাত্র ব্যক্তি যে ওকে ওর সন্তানসহ গ্রহণ করবে।আর চাইলে মেহেরুন অথবা সেনাপতি আমিনের হাতে এই রাজ্যের দ্বায়ভার তুলে দিতে পারবেন।আমার মতে এর থেকে ভালো পুত্র আমাদের মেহেরুনের জন্য নেই।এখন আপনি ভেবে দেখুন আমি খারাপ কিছু বলেছি কিনা।
জাভেদ খান আরবের কথায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।কিন্তু মেহেরুন এই মুহূর্তে খুন স্বীকার কিন্তু বিবাহ করতে রাজি নয়।সেনাপতি বলল-“মহারাজ আমাদের উচিত রাজকন্যাকে একটু সময় দেওয়া।এই সন্তান জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত ওনাকে কোনোমতেই বিবাহে রাজি করানো যাবেনা।”
জাভেদঃ তুমি ঠিকই বলেছো আমিন।ওকে আমরা সময় দিই।
আরব খুব রেগে গেল আমিনের উপর।ওকে আলাদা ভাবে ডেকে নিয়ে বলছে-“তোমার সাথে কি আমার এমন পরিকল্পনা হয়েছিল আমিন?তুমি কি বললে মহারাজকে?”
আমিনঃ এছাড়া আর কি উপায় আছে আপনিই বলুন।দেখতেই তো পাচ্ছেন যে মেহেরুন এখন কোনোক্রমেই এই বিবাহে রাজি নয়।
আরবঃ হুম।পরিকল্পনা এখন অন্য কিছুই করতে হবে।
আরব আর আমিন দুজনে তাদের পরিকল্পনা নতুন করে করল।দেখতে দেখতে সময় হয়ে গেছে মেহেরের সন্তান পৃথিবীতে আসার।ফালাক আর মেহেরের ভালোবাসার ফসল আজ পৃথিবীতে এসেছে।মেহেরের পুত্র সন্তান ওর কোল জুড়ে এসেছে।বেশ কিছুদিন পর যখন জাভেদ মেহেরের বিবাহ সম্পর্কে আমিনের সঙ্গে কথা বলল তখন আমিন বলল-” মাফ করবেন মহারাজ আমি এই বিবাহ করতে পারবোনা।”
জাভেদঃ সেনাপতি আমিন? তুমি কি বলছো? তুমি আমার প্রতারণা করতে চাইছো কিন্তু।এর পরিণাম ভালো হবেনা।
আমিনঃ মৃত্যু হতে পারে এর পরিণাম তবুও আমিও এই বিবাহ করবোনা।আমি বিবাহ করলে একটা শর্তেই করতে পারি।
জাভেদঃ কি শর্ত?
আমিনঃ ওই সন্তান ত্যাগ করতে হবে রাজকন্যাকে।
জাভেদঃ এ তুমি কি বলছো?তুমি তো এই সন্তানসমেত ওকে বিবাহ করতে চেয়েছিলে।
আমিনঃ ভুল করেছিলাম।এই সন্তান ফালাক তাজের। আর সে কি চরিত্রের আর কি প্রকৃতির ছিল তা আমরা সবাই জানি।আর তারই পুত্র সে কেমন হবে বড় হলে তা সম্পর্কে ভেবেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি রাজকন্যাকে বিবাহ করলে ওই সন্তান ছাড়া বিবাহ করবো।
আরবঃ মহারাজ আমিন কিন্তু ঠিকই বলেছে।ওই সন্তান যে ফালাকের চেয়েও দ্বিগুণ খারাপ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ওর শরীরে ওই ফালাকেরই রক্ত বইছে।
জাভেদঃ আরব ও শিশু।আর শিশু ফেরেশতা সমতুল্য।তোমরা এখনই ওর সম্পর্কে এমন বিবেচনা কিভাবে করতে পারলে?
আমিনঃ মহারাজ আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।আমার হাতে রাজ্য তুলে দিলেও আমি এই সন্তান গ্রহণ করতে পারবোনা।
জাভেদঃ মেহের যে ওই সন্তান ত্যাগ করবেনা।
আমিনঃ তাহলে এই বিবাহ হবেনা।
আরবঃ মহারাজ ওই সন্তানের ব্যবস্থা আমরা করতে পারি যদি আপনি চান।কিন্তু এ বিষয়ে মেহেরুন কিছু জানতে পারবেনা।
জাভেদঃ কি ব্যবস্থা?
ওই সন্তান আরব চুরি করে অন্য কোথাও সরিয়ে রাখার পরিকল্পনা জানালো।জাভেদ খান প্রথম অবস্থায় রাজি না হলেও পরে মেহেরের ব্যাপারে বিভিন্ন কথা বলে দুর্বল করে তুলল ওনাকে।জাভেদ কে বলেছিল আমিনের কোনো আত্মীয়ার কাছে ওই সন্তান রেখে আসবে।কিন্তু ওরা ভেবে রেখেছে ওই সন্তানকে হত্যা করে ফেলবে।একদিন রাত্রে মেহের ওর পুত্রকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে ঠিক তখনই আরব কোনো দাসীর দ্বারা ওর সন্তানকে চুরি করে।সকালে উঠে যখন মেহের ওর পুত্রকে দেখতে পেলোনা তখন ফালাককে হারানোর যেই আহাজাড়ি ও করেছিল আজও সেই একইভাবে চিৎকার করে কান্না শুরু করল।কারো কাছ থেকেই খোঁজ পেলোনা মেহের ওর সন্তানের।এবার হয়তো সত্যি মেহের পাগল হয়ে যাবে।সারাদিন কক্ষে ভাংচুর করতে থাকে জিনিসপত্র।এই দৃশ্য ওর পিতামাতা আর সহ্য করতে পারছেনা।মেহের এখন সারাদিন ঘরবন্দী হয়ে থাকে। রাত প্রায় গভীর, মেহের বসে ফালাকের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো নিজের মনে আওড়াচ্ছে। হঠাৎ করে কক্ষে একজন দাসী ঢুকল দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে।
দাসীঃ রাজকন্যা….রাজকন্যা আপনি এখনো বসে আছেন?দ্রুত কক্ষ থেকে বের হউন?
মেহেরঃ কেনো কি হয়েছে?তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো?
দাসীঃ প্রাসাদের দস্যুবাহিনী আক্রমণ করেছে। মহারাজ আর মহারানীকে তারা বন্দী করে ফেলেছে।
মেহেরঃ কি বলছো তুমি?
দাসীঃ জ্বী মহারানী এতো কথা বলার সময় নেই। আপনি দ্রুত বেরিয়ে আসুন।আমরা যে যেভাবে পারছি পালিয়ে যাচ্ছি।আপনাকে ছুটে খবরটা দিতে এলাম।
কথাগুলো একনিঃশ্বাসে শেষ করে দাসী কক্ষ থেকে দৌড়ে চলে গেল।মেহেরের মাথা কাজ করছেনা। এভাবে এমনধরনের একথা খবর শুনে।নিজের পিতামাতার বন্দী হওয়ার খবর শুনে ও কি করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছেনা।এভাবে তাদেরকে ফেলে ও কখনোই পালাতে পারবেনা।এসব ভাবতে ভাবতেই জানালা ভেঙ্গে একজন দস্যু ওর কক্ষে ঢুকে এল। মেহের পিছু ফিরে তাকানোর আগেই ওর মাথায় আঘাত করল সে।দস্যুগুলো এভাবে আক্রমণ করাতে জাভেদ বা সেনাপতি কেউ-ই তাদের মোকাবিলা করতে পারেনি।ভোর হওয়ার কিছু সময় পর মেহেরের চেতনা ফিরল।ভোরের আলো কেবল ফুটেছে।কক্ষে তখনো কিছুটা অন্ধকার বিরাজ করছে। চোখ মেলে তাকাতেই ও নিজেকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে।কক্ষে চারপাশে তাকাতেই ওর বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে।
মেহেরঃ এই কক্ষের চারপাশ যে আমার চেনা। এখানে কে নিয়েলো আমাকে?উঠে দাঁড়াতেই জানালার সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।তার শরীরে কোনো বস্ত্র নেই।একটি ঢোলাঢালা পাজামা পড়ে সে দাঁড়িয়ে আছে জানালার বাহিরে তাকিয়ে।ভয়ে ভয়ে তার কিছুটা কাছে যেতেই তার শারীরিক কাঠামো আর তার পিঠের অজস্র চাবুকাঘাতের দাগ দেখে ভয়ে আমার শরীরের কাঁটা দাঁড়িয়ে গেল।আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে সে আস্তে আস্তে আমার দিকে ঘুরে তাকাল।তার চেহারা, রক্তবর্ণ চোখ আর সারা বুকে আর মুখে রক্ত দেখে আমার চেতনা হারানোর উপক্রম।এ যে সেই মুখ আর সেই হিংস্র চোখ যা আমি এক বছর তিন মাস আগে দেখেছিলাম।
মেহেরের মুখ থেকে আপনা আপনি ভীতকন্ঠে একটি নাম বেরিয়ে এল-“ফালাক”। ফালাক ফিরে এসেছে আবার মেহেরের জীবনে।তবে হৃদয়ে সেই আগের মত অসম্ভব প্রেম নিয়ে নয়।হৃদয় ভরা ঘৃণা আর প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে ফিরে এসেছে।আস্তে আস্তে মেহেরের খুব কাছে এসে মেহেরের গলা চেঁপে ধরল।
ফালাকঃ চেনা যায় আমাকে, রাক্ষসী রাজকন্যা? চিনতে পেরেছো আমি সম্রাট ফালাক তাজ।
শেষের বাক্যটি কন্ঠে জোর এনে চিৎকার করে বলল।এ এক অন্য কোনো ফালাকের কন্ঠস্বর।যেই কন্ঠে কেবল খুনের আকুতি।কক্ষে দুজন দাসী এসে ফালাককে বলল-” সম্রাট সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।”
মেহেরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওদের বলল-” নিয়ে যাও।”
তারপর ওরা মেহেরকে ধরে কারাগারে নিয়ে গেল। যে কারাগারে মেহের একা সেখানে আর কেউ নেই। যাওয়ার সময় মেহের শুধু অবাক চোখে ফালাককে দেখতে দেখতে গেল।কারাগারের মাটি রক্তে ভিজে হয়ে আছে। চারপাশ রক্তে জর্জরিত।কারাগারে ঢোকার সময় মেহের ওর পিতামাতা কাউকে দেখতে পেলোনা।
মেহেরঃ আমার পিতা আম্মাজান ওরা কোথায়?
দাসীঃ তা কেবল সম্রাটই জানেন।
ফালাক অনেক সময় নিয়ে সরোবর থেকে গোসল করে কক্ষে ফিরল।কক্ষে আসার পর কিছু দাস ওকে নতুন করে রাজার বেশের পোশাক পরিধান করিয়ে দিচ্ছে।সবশেষে মাথার মুকুটটি পরিয়ে দিল ফালাকের নতুন সেনাপতি মিরাজ।জলদস্যু দলের সর্দার ছিল সে।আর আজ সে ফালাকের সেনাপতি।
মিরাজঃ আমার চোখ জুড়িয়ে গেল সম্রাট।কি অপূর্ব দেখাচ্ছে আপনাকে।
ফালাকঃ আর সবার মত এভাবে আমাকে অত্যাধিক সম্মান বাণী দিতে হবেনা।তুমি শুধু আমার সেনাপতি নও আমার পরম বন্ধু।যার সহায়তায় আজ আমি বেঁচে আছি।
মিরাজঃ এভাবে বলবেন না সম্রাট।সেদিন আল্লাহ্ পাক-ই আমাকে পাঠিয়েছিল।
ফালাকঃ তার অশেষ করুণা ছিল সেদিন আমার উপর।
এদিকে মেহের চারপাশে তার রাজ্যের সৈন্যদের উপর এমন মর্মান্তিক অত্যাচার আর একের পর এক লাশ দেখে মেহের অচেতন হয়ে যাচ্ছে।
মেহেরঃ আমি পারছিনা এত লাশ, এত রক্ত সহ্য করতে।আমাকে এখান থেকে মুক্ত করো।আমি পারছিনা আর এসব দেখতে।
কথাগুলো বলে মেহের চেতনা হারালো আবারো।
রক্ষীঃ সম্রাট?রাজকন্যা মেহেরুন কারাগারে চেতনা হারিয়ে পড়ে আছে।
ফালাকঃ পড়ে থাকতে দাও।তোমার কাজ তুমি করো।
সারাটাদিনে মেহের কতবার চেতনা হারিয়েছে চোখের সামনে এমন ভাবে অত্যাচারের দৃশ্য দেখে। অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও।মাটিতে শুয়ে দুর্বল শরীরে আস্তে আস্তে বলছে-“পানি খেতে চাই। কেউ একটু পানি দাও।”
কিন্তু কেউ পানি নিয়ে এগিয়ে এলোনা।আবার চেতনা হারিয়ে পড়ে রইল।সন্ধ্যা পার হয়ে কিছুটা রাত হলে মেহের নিজেকে ওদের সেই শয়নকক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করে।মাটি থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসে।তখন কক্ষ আলোকিত।একটু ঘুরে তাকাতেই দেখে ফালাক বিছানার একপাশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর ওর ওই প্রখর ভয়ানক চাহনি মেহেরের দিকেই ছিল।মেহেরের চেতনা ফেরার পর উঠে বসল।ওর চেতনা ফেরার অপেক্ষাতেই ছিল ফালাক।

Continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here