হলদে_প্রজাপতি পর্ব-৩৩

0
209

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

তেত্রিশ

( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

বাবা বরাবরই ভোরবেলা উঠে পড়ে । সেদিন রাতে বলেই দিয়েছিল , পরের দিন এক্কেবারে ভোরবেলায় মর্নিং ওয়াকে বেরোবে । নতুন জায়গায় ভোরের নরম আলো কিভাবে আস্তে আস্তে সোনালী ঝকঝকে রোদে রূপান্তরিত হয়ে, ঘাসের ডগায় , চা গাছের পাতায়, সোনার কুঁচি ছড়িয়ে দেয়, তাই দেখবে একেবারে ঘুম ভাঙা চোখে । বাবার কথাটা আমার ভারী মনে ধরেছিল । সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছিল। কিশোরী তরু একটা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাবার হাত ধরে নাচতে নাচতে ভোরবেলা মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে । শরৎকালে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে, মন্ডল কাকুদের বাড়ির শিউলি গাছতলা শিউলি ফুল পড়ে সাদা হয়ে থাকতো, মিষ্টি একটা গন্ধ, তার সাথে পুজো পুজো গন্ধ, সেই ফুল ফ্রকের কোঁচর ভরে তুলে নিচ্ছে কিশোরী মেয়েটা .. । এইসব ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিগুলো মনে পড়লে যেমন আনন্দ , তৃপ্তি হয় , তেমনি একটা ছোট দীর্ঘশ্বাসও পড়ে তার সাথে।
‘ দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি..’
সত্যি যদি সোনার দিনগুলো, সোনার মুহূর্তগুলো, সোনার ক্ষণগুলোকে সোনার খাঁচায় বন্দী করে আজীবন ধরে রাখা যেত ! তা যায়না । শুধু স্মৃতি রয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়ার সময়, হারিয়ে ফেলা নিজেকে , আর হারানো মানুষের ভিড়ে , স্মৃতির ঝুলি ক্রমশ ভারি হয়ে ওঠে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । পুরুলিয়ায়, আমাদের গ্রামে যতদিন ছিলাম, আমার শৈশব ছিল । আমার কৈশর ছিল । গ্রাম ছেড়ে শহরে এলাম , বেশ কিছুটা বয়স যেন বেড়ে গেল একধাপে । তারপর কলেজে উঠে হুস্ করে যে কি কি হারালাম, আর কি কি পেলাম, সে হিসেব কষা আমার আজও চলছে ।

মাঝের অনেকগুলো বছর আর বাবার সাথে প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো হয়নি । এই মাঝের এতগুলো বছরে মানসিক গ্লানি আর ক্লান্তি জমা করে তুলেছি শুধু থরে থরে । আজ এতগুলো বছর পর আবার ঠিক যেন সেই কিশোরীবেলার তরু চোখ মেলে ভোরের পাখির কিচির-মিচির , ভোরের নরম আলো, ভোরের স্নিগ্ধতা, প্রাণ ভরে নিয়ে বাবার পাশে পাশে হেঁটে চলল। শৈশবের তরু বাবার হাত ধরে হাঁটতো ,আর এখন এতগুলো বছর পরে এসে যখন বাবার ব্লাডসুগার , ব্লাডপ্রেসার, রয়েছে , তার সাথে অল্প পারকিনসন্স , মাঝে মাঝে হাত-পা তিরতির করে কাঁপে, তাই আমি মাঝে মাঝে বাবার সেই কাঁপা কাঁপা হাতটা ধরে নিচ্ছিলাম । বাবা প্রকৃতি-পরিবেশের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে । একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে যায় । শিশুসুলভ একটা হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে । আমারও অদ্ভুত ভালো লাগছিল। গাছগুলো যেন সব সদ্য স্বপ্ন দেখে উঠে ঘুম ভাঙা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে , সতেজ , স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ । এই গরমকালেও ভোরের দিকটা বেশ ঠান্ডা । ঠান্ডা বলতে, এখন যেরকম উৎকট গরম চলছে , তা মোটেও বোঝা যায় না । এতদিন হল এখানে রয়েছি , অথচ এমন নরম ভোরে কোনদিন উঠে চারপাশটা দেখা হয়নি। কতবার ভেবেছি দেখব । অথচ হয়নি। আজকে আমার সেই না-দেখা’টুকু পূরণ হয়ে গেল । আমি আমার চা বাগানে ঘেরা কর্মক্ষেত্রকে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে দেখেছি , উপভোগ করেছি । কিন্তু , এই সদ্য ঘুম ভাঙা ভোরে মেঠো পথ বেয়ে হাঁটা আজ এই প্রথম ।

বাবা মাঝে মাঝেই কিছু দেখে, কিছু শুনে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছিল । ভাল করে দেখছিল , বুঝছিল । তারপর আবার পায়ে-পায়ে এগোচ্ছিল । ছোটবেলায় বাবার হাত ধরেই আমার প্রকৃতির বর্ণপরিচয় । আজও বাবাকে ছোট ছোট প্রশ্ন করে চললাম ।
— বাবা , এটা কোন পাখির ডাক বলতো?
— ওইটা কি পাখি? ওই যে ওই দ্যাখো ওই পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ?
— দ্যাখো বাবা এই ফুলগুলো ঝোপেঝাড়ে ফুটে থাকে, এটার নাম জানিনা । কি ফুল বলতে পারবে ?
এমন নানাবিধ প্রশ্ন। বাবা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না । যেগুলোর না পারে, সেই বিষয়ক কিছু না কিছু দিশা ঠিক দেখায় । আস্তে আস্তে সোনালী রোদ এসে ছুঁয়ে দিল উঁচু গাছগুলোর পাতা । তারপর ছোট ছোট গাছ, ঘাসের ডগায় এসে পড়ল সোনালী গুঁড়ো গুঁড়ো রোদ। হঠাৎ একটা অদ্ভূত কথা মনে হলো – এই রোদ এইমাত্র ছুঁয়ে দিল আমার দেশের কোণায় কোণায় , শহরে , গ্রামে , মাঠে-ঘাটে , জঙ্গলে , সাজানো বাগানে , ছুঁয়ে দিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে, ছুঁয়ে দিল ভারত মহাসাগরের ঢেউগুলোকে , ছুঁয়ে দিল এই গোলার্ধের যত্রতত্র, এইমাত্র কিছুক্ষণ আগেই সে প্রথম ছুঁয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর। কতদিন হয়ে গেল, কত বছর হয়ে গেল মাঝে , এদিকে আর আসিনি । কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই রাজার মতো সোনার মুকুট পরে সেজে ওঠা সূর্যের প্রথম স্পর্শ – কতদিন দেখা হয়নি দু’চোখ ভরে । দু তিনটে দিন পর পর ছুটি বাগাতে পারলে একদিন টুক করে বাবা-মাকে নিয়ে দার্জিলিং ঘুরে এলে হয় । কত কিছুই না জানি পরিবর্তন হয়ে গেছে দার্জিলিংয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন জনের পোস্ট দেখলে, দেখতে পাই। যদিও আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব একটা অ্যাক্টিভ নই। তবে মানুষজনের, বন্ধু-বান্ধবদের, বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেখতে বেশ লাগে ।

প্রায় সাতটা বাজে । পায়ে পায়ে বাড়িতে ফিরে এলাম । কিছুটা দূর থেকে ছাদের ওপরে ঝাঁকড়া হয়ে থাকা জারুলগাছের ডালপালা দেখা যায় । বেগুনি থোকা থোকা ফুলগুলোয় সূর্যের সোনালী রোদ পড়েছে । লাগছে বেশ। এইসব ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে যোগ করলে মনে হয় যেন জীবন বড় সুন্দর ! স্মৃতির ভারটুকু মুছে ফেলতে পারলে, বর্তমানটা যদি বেশ চলনসই হয়, তবে জীবনটা বেশ লাগে একরকম-

একটু বেলার দিকে পাতা এল । জগন্নাথদাই ওকে নিয়ে এলো। আমি ইন্দ্রাশিষ বাবুকে ফোন করেছিলাম দুপুরে আমাদের সাথে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য । কিন্তু, উনি জানালেন আজকে ওনার ভীষণ চাপ । দুপুরে খেতে আসা হবে না । তবে বিকেল-সন্ধ্যের দিকে একবার অবশ্যই উনি আসার চেষ্টা করবেন। যদিও জানতাম উনি আসতে পারবেন না , তবুও একটু রাগ হল মনে মনে। সবসময় কি এত কাজ ? কাজ একটুও কি কাটছাঁট করা যায় না ? একটু রেগেই বিরক্ত সহকারে ফোনটা কেটে দিলাম । তারপরে নিজেরই মনে হল , আমি কি অভিমান দেখিয়ে ফেলছি? কিন্তু অভিমান যে অভিমান দেখানোর সম্পর্ক ছাড়া দেখানো যায় না , এ বোঝার বয়স কি আমার এখনো হয়নি ? তবুও , রাগই হোক , বা অভিমান, সেটা বুকের ভেতর খচখচ করতেই থাকলো ।

পাতা এসে দুজন নতুন মানুষকে পেয়ে খুব খুশি । পাতার এখন এগারো বছর বয়স । এগারো বছরের ছেলেমেয়েরা আজকাল খুব পাকা হয়েছে । বাচ্চাদের মধ্যে শৈশব , কৈশোরকাল এখন বেশ কাটছাঁট হয়ে এসেছে । আমাদের সময়ে তার স্থায়িত্ব বেশি ছিল । এখন যেন হঠাৎ করে আসে, কর্পূরের মত উবে যায় । ছেলেমেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায় মানসিকভাবে । বড় হতেই চায় তারা । কিন্তু পাতার মধ্যে এই ব্যাপারটা একেবারেই নেই । হয়তো ওর তেমন বন্ধু নেই বলে , বা যে কারণেই হয়ে থাক , ও এখনও শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণেই ঘুরপাক খাচ্ছে । পুরোপুরি কিশোরী হয়েও উঠতে পারেনি। রূপকথার, রাজা-রানীর , গাছপালার , পশুপাখির , পুতুলখেলার , খেলনাবাটির , মেলার নাগরদোলা চাপা’র , জগত তার এখনো । কাজেই সে নতুন দুজন মানুষকে পেয়ে , আবার একজন গল্পদাদুকে পেয়ে খুবই খুশি হবে, সেটাই যে স্বাভাবিক ।

বাবার সঙ্গে পাতার বন্ধুত্ব হতে আধঘন্টাও সময় লাগলো না । দেখলাম দুজনে মিলে বসে অনর্গল বকবক করছে । আমার কিছু কাজ ছিল । অফিশিয়াল কাজও কিছু বটে , তাছাড়া ঘরকন্নার কাজও কিছু ছিল । যদিও ঘরকন্না টগরই সব সামলে দেয়, তবু আমার একান্ত নিজস্ব কিছু টুকটাক কাজ থাকেই। হাতের কাছে দরকারি জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখা , জামা-কাপড় আয়রন করা , ইত্যাদি । সেগুলো করার ফাঁকে ফাঁকেই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখছিলাম, বাবার নতুন শ্রোতাবন্ধুটি সামনের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে অসীম আগ্রহ সহকারে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ।
কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা শুনতে পাচ্ছিলাম । যেমন ,
— জিরাফ কত লম্বা ! ওরা কত দূর পর্যন্ত দেখতে পায় , বল দাদু ?
— তা বটে । দেখতে পায় , খেতেও পায় । লম্বা লম্বা গাছ থেকে পাতা খায় ।
খিলখিল করে হেসে উঠল পাতা । বুঝতে পারলাম , এই হাসির কারণ জিরাফের খাদ্যবস্তুর সঙ্গে ওর নিজের নামটা মিলে যাওয়া।
ওর হাসি থামতে বাবা বলল , জিরাফের অত লম্বা গলা হওয়ার জন্য ওদের অনেক অসুবিধাও হয় , সেটা কি জানো তুমি ?
— কি অসুবিধা দাদু ?
— জঙ্গলের মধ্যে ওরা যখন জল খায়, নদীতে বা কোন জলাশয়ে, তখন তো মুখ নামিয়ে খেতে হয় । তখন ওরা চারটে পা ফাঁক করে শরীরটাকে বেশ কিছুটা নামিয়ে এনে ব্যালেন্স করে মাথাটাকে নামায় খুব আস্তে আস্তে । বেশিক্ষণ নামিয়ে রাখতে পারেনা ।
— কেন ?
— ঝুপ করে মাথা নামালে শরীরের সব রক্ত মাথায় গিয়ে জমা হবে । এখন তো তুমি ছোট, সবটা বুঝতে পারবে না । তবে এরকমটা হলে জিরাফ মারা পর্যন্ত যেতে পারে । তাই ওদের খুব সাবধানে মাথা নামাতে হয় ।

আবার কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলাম টপিক চেঞ্জ হয়ে গেছে বটে , তবে জঙ্গল আর জীবজন্তুর মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে ।
বাবা বলছে , কিছু কিছু কচ্ছপ হায়নার পটি খেয়ে নেয় , জানো কি তুমি?
— উঁ .. ইহহ্.. !
বলে নাকটা দুটো আঙ্গুলে চেপে ধরে পাতা বলল , এ বাবা ! ছি ছি! সত্যি দাদু?
— হ্যাঁ, হায়নার পটি খাওয়া ওদের শরীরের জন্য ভালো , তাই খায় ।
— এ বাবা ! পটি আবার কখনো ভালো খাবার হয় ?
— হ্যাঁ হয় । ওদের জন্য হয় । ওদের পিঠের ওপর গোল যে শক্ত মতো খোলাটা থাকে, সেটা ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি । হায়না যখন জীবজন্তুকে খায়, তখন তার হাড় পর্যন্ত কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেয়ে নেয় । তাই হায়নার পটি দিয়ে হাড়ের গুঁড়ো বেরোয় । হাড়ের মধ্যে থাকে ক্যালসিয়াম । তাই হায়নার পটি খেলে ওদের ওপরের খোলসটা শক্ত মজবুত হয় ।
— ইস্, দাদু তুমি কত কিছু জানো গো । আমাকে রাজা শিবাজীর গল্প বলবে দাদু? ঐ যে, একটা বাঘনখ দিয়ে -! বলবে সেই গল্পটা ? গল্পটা জানো তুমি ?
— জানি বৈকি! তুমিও তো জানো দেখছি ।
— আমি একটু একটু জানি । আমাকে তাও গোটাটা বলো না , দাদু-
— বলবো । এখন না । চান করে, খাওয়া-দাওয়া করে নাও, তারপরে বলবো।
— ঠিক বলবে তো ?
— বলেছি যখন, ঠিক বলব ।
বুঝলাম দাদু নাতনির বন্ধুত্ব এরই মধ্যে বেশ গভীর হয়ে গেছে।

বিকেল হয়ে গেল । সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই । আমি, বাবা আর মা লনে বসে আছি চেয়ার নিয়ে। পাতা টগরের সঙ্গে কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে । বাবা-মার সঙ্গে সাধারণ দু-একটা কথা হচ্ছে । কিন্তু , আমি জানি কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার মন পড়ে আছে একটি মানুষের দিকে । যে আগন্তুকের আসার কথা, অথচ সে এখনো এসে পৌঁছায়নি । কেন যে বারবার নিজের অজান্তেই লন পেরিয়ে মেঠো রাস্তাটা যতদূর দেখা যায়, সেদিকে চোখ চলে যাচ্ছে জানিনা । আমি কি অস্থির হয়ে পড়ছি তিনি এখনো আসেননি বলে ? মন হাতড়ে দেখলাম , শুধু অস্থির নয় , আমার রাগ হচ্ছে। অভিমান হচ্ছে । ফোন করে দুপুরে খেতে আসার কথা বললাম, তখন কাজের অজুহাত দিয়ে আসা হলো না। এখনো তিনি এলেন না । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল । আর কি আসবেন ? আসবেন না । আসবেন না তো আমার কী? আমার ভারী বয়েই গেছে । সত্যিই কি বয়ে গেছে ? ডানপায়ের বুড়ো আঙুলে করে লনের ঘাসগুলোর ওপরে কিছুটা আক্রোশ দেখালাম , খুঁড়ে খুঁড়ে কয়েকটা ঘাসকে তুলে ফেললাম । রাগ হচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছে । আমার কথা কি এভাবেই অবহেলা করার মতো !

সন্ধ্যা হয়ে আসছে । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে যাবে । খামোখাই রাগ গিয়ে পড়ল চেয়ারগুলোর ওপরে । কি করতে যে চেয়ার পেতে এখনও লনে বসে আছি, কে জানে । এক ঝটকায় উঠে পড়লাম ।
বললাম , যাই , চেয়ারগুলোকে ঢুকিয়ে দিতে হবে । টগরকে বলি গিয়ে ।
বাবা বলল , কেন বেশ তো লাগছে । এখনো তো সন্ধ্যা হয়নি । আর সন্ধ্যে হলেই বা কি ? তোরই বাংলো, তার সামনের লন । এখানে যতক্ষণ খুশি বসে থাকা যায় ।
মুখ গোমরা করে বললাম , তোমরা বসে থাকো । আমার কাজ আছে। আমি উঠি ।
চেয়ারের ব্যাক সাইডের হ্যান্ডেলটার মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে চেয়ারটাকে তুলে নিলাম। এগিয়ে চললাম বাংলোর দিকে । ওখানে বসে থাকতে বেশি বিরক্তি লাগছে । মনে হচ্ছে যেন আমি একজনের প্রতীক্ষায় বসে আছি। সে আসবেও না , আর আমি অপেক্ষা করতেই থাকব ।
দরজার কাছে চলে এসেছি, হঠাৎ করে পেছন থেকে বেশ উঁচু গলায় পরিচিত স্বর শুনতে পেলাম ,
— উঁহু, পাতা ! ওদিকে কি করছিস ? ঝোপের মধ্যে ঢুকিস না , বেরিয়ে আয়-
গলা শুনে মাথার মধ্যে কে যেন আলগোছে সুড়সুড়ি দিয়ে গেল । তিনি এসেছেন তা বুঝেও, আমি আমার চলা থামালাম না । চেয়ারটাকে নিয়ে দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম বারান্দায় ।
নিজেকে শাসন করলাম , বুড়ো বয়সে কি তোর ভীমরতি ধরেছে ! মাথা থেকে এসব ফালতু চিন্তা বাদ দে তরু !
যেন কিছুই জানিনা , কিছুই শুনতে পাইনি , এমন ভাব করে ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে। তারপরেই অবশ্য বাবার ডাকে বেরিয়ে আসতে হল । আমি জানি বাবা কেন ডাকছে । আমি জানি ইন্দ্রাশিষ বাবু এসেছেন। আমি জানি উনি এখন লনে বসবেন , একটা চেয়ার লাগবে । আমি এও জানি, আমিও এখন লনে বসে থাকবো । আরো একটা চেয়ার লাগবে ।
কিন্তু অম্লানবদনে যেন কিছুই জানিনা এমন ভাব করে অলস পা’য় বেরিয়ে এসে বাবাকে বললাম, কি হয়েছে বাবা ? ডাকছো কেনো আবার ? বললাম না , আমার একটু কাজ আছে ।
— সে কাজ পরে করবি । এখন দ্যাখ কে এসেছেন । ডাক্তারবাবু এসেছেন । ওনার বসার ব্যবস্থা কর ।
আমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, তিনি বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন । পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন । এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে ।
শুনতে পেলাম বাবা বলছে,
— বড় আশা করেছিলাম আজকে আপনি আমাদের সঙ্গে দুপুরবেলা চারটি খাবেন ।
— আজকে পারলাম না মেসোমশাই । তবে খুব শিগগিরই একসাথে বসে আমরা সবাই মিলে খাব একদিন । কথা দিচ্ছি আপনাকে ।
— সেটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে ।
— আমার বাড়িতে হলে অসুবিধা কোথায়?
— অসুবিধের কথা কোথায় বলেছি? অসুবিধা মোটেও নয়। তবে প্রথমে এখানে । আমার তরু মায়ের সংসারে হোক একবার । তারপর না হয় আপনার –
মাঝপথে বাধা দিয়ে ইন্দ্রাশিষ বাবু বললেন , মেসোমশাই আমাকে ‘তুমি’ বলুন । আপনার মত মানুষরা ‘আপনি’ বললে বড্ড অস্বস্তিতে পরি।
বাবা অল্প হেসে বলল , আমাদের মত’ মানুষ বলতে, বুড়ো হয়ে গেছি বলে বলছো তাইনা ? আচ্ছা তাই হবে ।
— আপনাদের মত মানুষ বলতে আমি আপনাদের মত সত্যিকারের মানুষের কথা বলেছি মেসোমশাই । আপনাদের মত মানুষ আজকের পৃথিবীতে কতজন আছেন ?
— বা রে ! আমি কেমন মানুষ, তুমি বুঝলে কি করে ? এইতো প্রথম দেখছো আমায়!
— আপনাকে আমার দেখা হয়ে গেছে । আপনার মেয়ের চোখ দিয়ে দেখেছি ।
আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অল্প হেসে তিনি বললেন , ম্যাডামের সাথে গল্প হয় মাঝে মাঝেই । ওনার জীবনের কতটা জুড়ে যে আপনি, ওনার সত্তায় মিশে রয়েছেন । আপনাকে আজকে প্রথম দেখলাম বটে, তবে অনেকদিন ধরে চিনি আপনাকে।
বাবা অল্প হাসলো । তৃপ্তির হাসি । গর্বের হাসি । আনন্দের হাসি ।
সেই ছিল বাবার সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাকুল প্রথম আলাপ। সেদিন লনে বসে ঘন্টাখানেকের ওপর দুজনে গল্প করল । নানান গল্প, কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা । আমিও সেখানে ছিলাম । তবে খুব একটা যোগদান করিনি । শুনছিলাম চুপচাপ । যেটুকু বুঝেছিলাম দুজনেরই দুজনকে বেশ ভালো লেগেছে । বাবার যে বিশেষ করে ভাল লেগেছে, সেটা সেদিন উনি পাতাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে আমি বাবার সঙ্গে যখন ছাদে উঠলাম , তখন বাবার অন্যান্য কথাবার্তায় ফাঁকে ফাঁকে বারেবারে ঘুরেফিরে ইন্দ্রাশিষ বাবুর প্রসঙ্গ তোলা এবং ঘাড় নেড়ে প্রায় দু’ডজন বার বলা, যে, ‘ডাক্তারবাবু ভারী ভালো’, ‘ভারী ভালো ছেলে’, ‘খুব ভালো লাগলো আমার’ , ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে খুব সহজেই বোঝা যায়। সত্যি কথা বলতে কি, বাবা যতবার ইন্দ্রাশিষ বাবুর প্রসঙ্গ তুলছিল, আমার সেই সুগন্ধি চায়ের মত হালকা , আবার কুঁচফলের লালের মত রাঙা লজ্জা সারাটা শরীর বেয়ে চলে যাচ্ছিল যেমন , তেমনই বেশ ভালো লাগছিল এই মানুষটার প্রশংসা বাবার মুখে শুনতে । কেমন যেন মনে হচ্ছিল, নিজের প্রশংসা শুনছি।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/

একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/

বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/

তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/

চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/

পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/

ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/

সাতাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1038754843581246/

আঠাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1046967802759950/

উনত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1048831039240293/

ত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1051696202287110/

একত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1053606998762697/

বত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1060747584715305/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here