#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
বাইশ
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
উনি বোধ হয় আমার এহেন অভিযোগে একটু অবাক হলেন । আমার কাছ থেকে হঠাৎ করে এমন অভিযোগ উনি আশা করেননি ।
বললেন , একচুয়ালি আমার সিডিউলটা তো আপনার ঠিক জানা নেই। আমার পক্ষে সময় বার করা খুবই মুস্কিল বুঝলেন কিনা।
কথাটা বলে ফেলেই আমার মনে হয়েছিল, কথাটা বলা আমার একেবারেই উচিত হলো না । কোথায় আমার তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কথা। তার জায়গায় আমি কি করলাম? না অভিযোগ করে বসলাম।
কোনরকমে মুখটাকে একটু হাসি হাসি করে বললাম, আসলে হয়তো আমারই আপনার কাছে যাওয়া উচিত ছিল । কৃতজ্ঞতা জানানোটা আমার জন্য এসেন্সিয়াল ছিল বটে ।
— কৃতজ্ঞতা ! কিসের কৃতজ্ঞতা ?
আমি বললাম , এখানে কি বসবেন, নাকি-
উনি এক সেকেন্ড ভাবলেন । তারপর অল্প হেসে বললেন, আজ চলুন বরঞ্চ ছাদে গিয়ে কথা বলা যাক । আপনার বাংলোর ছাদ থেকে আপনার জমিদারীটা কেমন লাগছে দেখাও হবে ।
তাঁর কথার ধরনে হেসে ফেললাম । বললাম , জমিদারিই বটে-
— হ্যাঁ তা জমিদারি বটে তো ! আমরা সবাই আপনার প্রজা ।
— আসুন ।
ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে তাঁকে একবার বললাম , চেয়ার নিয়ে যাব কি ? টগরকে আনতে বলবো ?
— না না , দরকার নেই । ঘুরতে ঘুরতে, ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে না হয় গল্প করা যাবে।
— আচ্ছা, সেই ভাল । আসুন –
ছাদে ওঠার আগে তাঁর চোখ পড়ল আমার ঠাকুরঘরের দিকে । তিনি প্রশ্ন করলেন, ঢুকে দেখতে পারি ?
— একদম ।
তিনি ঝুঁকে পড়ে ভালো করে আমার ঠাকুরকে দেখে বললেন, বাঃ, এ যে খুব সুন্দর পূজার আয়োজন আপনার । মা যশোদার কোলে ছোট্ট গোপাল । ভারি সুন্দর তো ।
বললাম , পুজো খুব একটা পান না আমার ঠাকুর। তবে তিনি থাকেন ।
তিনি বললেন , তিনি যে থাকেন, সেটাই বড় কথা । মানসিকভাবে আপনি রাখেন তাঁকে । তাই তিনি থাকেন । ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো সব সময় নাই বা পেলেন।
এই সময়টা আমার ফ্রি থাকলে আমি লনে চেয়ার নিয়ে বসে থাকি , আশেপাশে হয়তো একটু ঘোরাঘুরি করি , কখনো ছাদে উঠি না । আজকে ছাদে উঠে বেশ ভালো লাগলো । পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে সূর্য । প্রায় ডুবু ডুবু । কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে বিদায় নেবে। দিনের শেষের লাল আলোটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছে । সন্ধ্যারাগ পেয়ে বসেছে পশ্চিম আকাশটাকে । হালকা নরম আলোয় ভরে গেছে চারিদিক । কনে দেখা আলো বলে নাকি একে ! কথাটা মনে হতেই মনে মনে হাসি পেল। কনেই হলাম না, তার আবার কনে দেখা ! পশ্চিম দিকটা আমার লন থেকে একদমই দেখা যায় না । এটা আমার বাংলোর পেছন দিক । ছাদে উঠে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে মন ভরে উঠলো । জারুল গাছটা এদিকে আমার ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ঝাঁপিয়ে ফুল দিয়েছে । হালকা বেগুনি রঙের থোকা থোকা ফুলে ভর্তি । সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর তো । জারুল গাছের ফুলের থোকাগুলোর ওপরে নরম লাল সূর্যের আলো পড়েছে । ভারী সুন্দর লাগছে। আমি আনমনে একটা জারুলের থোকা হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম ।
কানে গেল ইন্দ্রাশিষ বাবু বলছেন, বাহ্ ভারী সুন্দর –
আমি ফুলের থোকাটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম, সত্যি ভারী সুন্দর সব মিলিয়ে।
উনি বললেন, আপনি যাকে সুন্দর বলছেন, আমি তাকে সুন্দর বলিনি ।
অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর দিকে, মানে ?
— আমি আপনাকে বলেছি , ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে !
আমার কেমন যেন একটা চমক লাগলো। আমি চমকে উঠে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম । সেখানে যে কোনো কৃত্রিমতা নেই , একবারে নিখাদ একটা কনফেশন এর ছবি লেগে রয়েছে তাঁর মুখে । তাঁর মুখ সাক্ষ্য দিচ্ছে তাঁর কথার সত্যতা । আমাকে সুন্দর লাগছে ! তাও আবার ভারী সুন্দর ! এ কিভাবে সম্ভব ? কুৎসিত আমি নই । অসুন্দরও না । তবে সুন্দর কোন ভাবেই নই। সুন্দরী মেয়েদের একটা সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচ থাকে । আমি সেই ধাঁচে একেবারে কোনভাবেই পড়ি না । তাই আজ পর্যন্ত জগতে আমায় কেউ কখনো সুন্দরী বলেওনি । আজকে এত বছরেও না । বাবা মাঝে মাঝে বলেছে বটে । পুজোয় বাবার দেওয়া নতুন জামাটা পরে যখন বাবাকে দেখাতে যাই প্রতিবার , বাবা বলে, আমার তরু মা’কে কি সুন্দর লাগছে ! কিন্তু অনাত্মীয় কোন পুরুষ আজ এত বছরেও এত সহজ সুন্দরভাবে কখনো বলেনি। ফ্লার্ট করার প্রয়োজনে দু একজন বলেছে বটে, তবে সেই সুর শুনলে বোঝা যায়। সোনু দা ? না সোনু দা’ও কখনো আমাকে সুন্দর দেখতে বলে নি। বরঞ্চ, এটা এমনটা হলে ভালো হতো, ওটা তেমনটা হলে ভালো হতো – এইসব অভাব অভিযোগ জানিয়েছে । কই কখনো তো সুন্দর বলেনি আমায় ? এই তুলনামূলক চিত্র যখনই আমার মনে ফুটে উঠল, তখনই আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম । একী! আমি হঠাৎ করে কোথাও কিছু নেই, সোনু দা’র সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাবুর তুলনা করছি কিভাবে? সোনু দা আমার ভালোবাসা । কিন্তু এনার সঙ্গে তো আমার তেমন কোনো -? তাহলে হঠাৎ কেন আমার মন এইভাবে তুলনা করে বসলো! এসব তো ভালো না ।
আমি চুপ করে আছি দেখে তিনি বললেন, কি হলো, কিছু ভুল বলে ফেললাম কি?
আমি বললাম , কিসের ভুল ?
— না মানে, চুপ করে রয়েছেন , অফেন্ডেড হলেন কিনা বুঝতে পারছিনা ।
হেসে বললাম , তাই কি হতে পারে? কোন মহিলাকে সুন্দর লাগছে বললে সে কি কখনো অফেন্ডেড হতে পারে ? এই কম্প্লিমেন্টস তো মেয়েদের খুব পছন্দের ।
উনি অল্প হেসে প্যান্টের দুটো পকেটে হাত চালান করে বললেন , একচুয়ালি সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে । এই নরম সূর্যের আলো, তার মাঝে আপনি ওই বেগুনি ফুলের গোছাটা হাতে করে দাঁড়িয়ে – সত্যিই খুব সুন্দর । আমার কোন রস-কস নেই তো , ছবি তুলতে পারি না, বুঝলেন কিনা ? যেকোনো ভালো ফটোগ্রাফার হলে আপনার ফটাস্ করে একটা ছবি ঠিক তুলে রাখতো। খুব সুন্দর উঠতো ছবিটা, সেটা কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
আমি অল্প হেসে বললাম , ছবি তুলতে পারেন, কি পারেন না জানি না । তবে রস-কস একদম নেই, সে কথা কিন্তু ঠিক নয় ।
— বলছেন ?
বলে একটা প্রাণ খোলা হাসি হেসে উঠলেন তিনি।
জারুলের ডাল ছেড়ে ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। একঝলক দেখলাম তাঁর দিকে । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন হাসি হাসি মুখে । একটা খুব ক্যাজুয়াল টি-শার্ট আর প্যান্ট , চুলটা এলোমেলো , মুখটা হাসি হাসি । এই ভঙ্গিমাতেই প্রায় প্রতিবার আমি তাঁকে দেখি। মানুষটার মধ্যে হয়তো সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তাঁর সহজতা। উনি আমার সামনাসামনি কোণের কার্নিশটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটোকে পিছনের কার্নিশের ওপর রেখে ভর করে দাঁড়ালেন , শরীরটাকে অল্প হেলিয়ে ।
বললেন , তারপর বলুন –
বললাম , আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আছে।
কৌতুক খেলা করে উঠলো তাঁর মুখে। বললেন, তাই নাকি? নিজের অজান্তেই করেছি তবে । তা কিরকম ষড়যন্ত্র শুনি?
— আপনি পাতা’কে আর পাঠাচ্ছেন না আমার কাছে –
— এ তো গুরুতর অভিযোগ দেখছি । আসলে পাঠাইনি আপনি কিরকম মানসিক অবস্থায় রয়েছেন সেটা বুঝতে পারছিলাম না, তাই ।
— বা রে, আপনি বুঝি এতদিনেও জানেন না যে পাতা আমার কাছে এলে পাতার আর আমার দুজনের মনই ভালো হয়ে যায় ?
— পাতার ভালো হয় জানি । আপনারও যে হয় সেটা জানলাম ।
— সে আবার কি ? আপনি কি বলতে চাইছেন, পাতার মণি এতটাই কিপটে যে সে পাতাকে এতদিনে এইটুকু ভালোও বাসেনি ?
আমার এই কথাটা শুনে তিনি যেন কেমন উদাস হয়ে গেলেন । মুখটা নামিয়ে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তারপর মুখ তুলে বললেন, পাতার ভাগ্য ভালো –
— এমন কথা কেন বলছেন ?
— কারণ আছে বৈকি । একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা পেয়েছে । সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়, মেয়ের দিকে যার কোন খেয়াল নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু ঠাকুমা। সেই ঠাকুমার ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতা নেই । আর মা তো-
কথা বলে চলার বেগে তিনি আরও কিছু যেন বলে ফেলছিলেন, হঠাৎ করে নিজের খেয়াল পড়তে থমকে গেলেন।
আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলাম। তবে কথা যখন বললাম, তখন নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । কারণ, ঠিক সেই প্রসঙ্গেই কথা বলে ফেললাম । এটা কি শুধুই নারীজাতির কৌতুহল ঘটিত, নাকি অন্য কোনো কারণও ছিল কে জানে!
বললাম , আমি টগরের কাছে শুনেছি আপনার স্ত্রী নাকি-
কিন্তু তারপরে আর কি বলবো ভেবে না পেয়ে চুপ করে গেলাম ।
তিনি বললেন, হ্যাঁ যা শুনেছেন ঠিকই শুনেছেন । পাতার মা পাতাকে ছেড়ে চলে গেছে ।
— মানে তিনি কি- ?
— হ্যাঁ, আপনার এত ইতস্তত করার কিছু নেই । অনিতা, আমার এক্স ওয়াইফ, সে আমাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে ঘর করতে গেছে।
— কিন্তু .. এমন হঠাৎ.. মানে না .. এমনি আর কি.. যাক গে বাদ দিন ..
অল্প হেসে তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , না না বাদ দেওয়ার কিছু নেই। আর দেখুন এই প্রশ্নগুলো আমাকে কমবেশি সকলেই করেন । আই নেভার মাইন্ড। একজন মানুষ, তার আমার সাথে ঘর করতে ইচ্ছা হয় নি। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট । তার অন্য একজনকে পছন্দ হয়েছে । সে তার সাথে চলে গেছে ।
বললাম , তিনি কি.. মানে আপনি .. ইয়ে .. মানে আপনাদের কি..
উনি বললেন, হ্যাঁ ডিভোর্সটা আমাদের হয়ে গেছে । এটাই কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলেন আপনি ? সেটা তাকে খুঁজে পেতে বার করে একরকম জোর করেই করতে হয়েছে , বলতে পারেন । তাও আজ বছর তিনেক হয়ে গেল। তবে সে তার মেয়েকে যখন ছেড়ে গিয়েছিল, তখন পাতা মাত্র বছর খানেকের মেয়ে । আমি সরকারি হেল্থ ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার তো, বলতে পারেন নিজের গরজেই জোর করে একরকম ডিভোর্সটা করা । কোন লিগাল ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে আমার তো প্রবলেম না ? তবে মিউচুয়াল ডিভোর্স পেতে অসুবিধা হয়নি । যেহেতু সে ছেড়ে গিয়েছিল, আর আমি তার আগেন্সটে কোন আ্যলিগেশন আনিনি । তারও কোনো অভিযোগ ছিল না অবশ্য। প্লেন আ্যন্ড সিম্পল ছিল ।
— তাহলে তো অনেক বছর হয়ে গেছে ?
— হ্যাঁ ।
— শুনেছি নাকি পাতার মা খুব সুন্দরী । পাতার মুখ দেখে অবশ্য বোঝা যায় , পানপাতার মতো ওর মুখটা ।
তিনি হেসে বললেন, সকলের চোখে সকলে সুন্দর হয় না । তবে হ্যাঁ, মেয়ে আমার সুন্দরী তো বটেই । একেবারে রাজকন্যা ।
আমিও হেসে উত্তর দিলাম, মেয়েরা তো সব বাবার কাছেই রাজকন্যা । আমি আজকে এই বয়সে এসেও আমার বাবার কাছে রাজকন্যা। তবে আপনার মেয়ে সত্যি করেই রাজকন্যা ।
হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন ঠোঁটের ডগায় চলে এলো আর আমি সেটা করেও ফেললাম । করে ফেলেই অবশ্য নিজে লজ্জিত হলাম মনে মনে । কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই । প্রশ্ন করা হয়ে গেছে ।
বললাম , তারপরে আপনি বিয়ে করেন নি কেন ?
উনি হেসে ফেললেন । বললেন , এ আপনার ভারী অন্যায় । নিজে যে কাজটা একবারও করেননি , সেটা অন্যকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন দু বার তিন বার করে করা হয়নি ?
— তিনবার তো বলিনি । সেকেন্ড টাইম এর কথাই বলেছিলাম । আমার কথা বাদ দিন । আমি তো সেটা করিইনি । কিন্তু , আপনি তো করেছিলেন । আর সেটা করার জন্যই তো পাতা এসেছে পৃথিবীতে । আপনি ওর বাবা, অথচ মেয়েটাকে মনের মতো করে মানুষ করার জন্য সেভাবে সময় দিতে পারেন কি ?
উনি আস্তে আস্তে কেটে কেটে বললেন , অভিযোগটা আপনার সঠিক । আমি মানতে বাধ্য, মেয়েটাকে আমি কিছুই দেখাশোনা করতে পারিনা । রোগী দেখে বেড়ানো আমার একটা নেশা । আমার বাড়ির দরজা সারারাত রোগীর জন্য খোলা থাকে। যে কোন সময় কোন অসুস্থ মানুষ এলে আমি কখনোই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না, জানেন তো ? ওই যে বললাম, নেশা ! তবে আমার মেয়েকে আমি ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে পারছি না বলে তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে একজন মানুষকে নিয়ে আসা- এই প্রয়োজনে কি কাউকে বিয়ে করা উচিত ? আপনার কি মনে হয় বলুন –
— শুনেছি নাকি , অমনি ঘর করতে করতে দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে যায় ।
— সে ভালোবাসা হবে কি হবে না, সেটা ভবিষ্যতের কথা । কিন্তু প্রয়োজনীয়তাটা তো মন থেকে অনুভব করতে হবে। আর সেই প্রয়োজনীয়তা কি কখনো শুধু পাতাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন মানুষ চাই- এইটা হতে পারে? এইরকম ভাবনা-চিন্তা করে একজন মানুষকে বিয়ে করলে সেটা কি তাকে অশ্রদ্ধা করা হয় না? কি মনে হয় আপনার ?
অল্পক্ষণ চুপ করে থাকে আবার তিনি বললেন , তাছাড়া ডাক্তারদের সব মানিয়ে গুছিয়ে উঠে জীবন শুরু করতেই বেশ অনেকটা টাইম লেগে যায় । আমিও বিয়ে করেছিলাম তিরিশ বেরোনোর পরে । তারপর ক’বছর আর পাতার মা ছিল ? বছর তিনেক হবে । আর আজকে এতগুলো বছর পরে আর এসব ভাবতে ভালো লাগে না ।
আমি একথার সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলাম না । বেশ অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম । এই মানুষটা ওপরে ওপরে দেখতে যত সাদাসিধেই হোক না কেন , মনটা বড় গভীর । যেকোনো বিষয়ে বড় গভীর ভাবনা চিন্তা । ফিলোজফি খুব স্ট্রং । জীবন সম্পর্কে যেভাবে তিনি ভাবেন, আমরা হয়তো সচরাচর ভাবতে পারিনা । সত্যি মানুষটার মধ্যে শ্রদ্ধা করার মত অনেক গুণ রয়েছে বটে । চুপ করে রইলাম , তাঁর কথার কোন উত্তর দিলাম না । তিনিও চুপ করে রইলেন । দুজনই চুপ । অস্তাচলগামী সূর্য কিন্তু চুপ করে বসে নেই । শেষ রক্তিমাভাটুকু ছড়িয়ে দিতে দিতে প্রায় বেশিরভাগ অংশটা ডুবে গেছে । যেটুকু জেগে রয়েছে , সেটুকু ডুবে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে ।
কিছুক্ষণ পরে উনি কথা বললেন ।
বললেন , এই টি এস্টেট এর মালিকদের কাছে খবর গেছে নাকি ? তারা কিছু বলছেন ?
— খবর তো গেছে । তবে ওনারা এটাকে নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি কিছু করেননি । আমার কাছ থেকে ছোট করে ব্যাপারটার কিরকম নিষ্পত্তি হয়েছে শুনে নিয়ে চুপচাপ আছেন । আসলে যে কোন ঝামেলাই তো মিটে যাওয়ার মধ্যে স্বস্তি না ? সেটাকে আবার কে খুঁড়ে খুঁড়ে জিইয়ে রাখতে চায় বলুন ?
— সে কথা ঠিক । তবে ব্যাপারটা সত্যি করেই অনেক দূর গড়াতে পারত । তেমনটা যে হলোনা , সেটা শুধুই আপনার কারণে। সত্যিই সে দিনের সকালটা ভাবলে এখনো আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে । আসলে যত যাই বলি, আফটার অল তো একটা প্রাইভেট চাকরি না ? হয়তো ভালো লাগে শুনতে, গালভরা নাম- ম্যানেজারের পোস্ট। আসলে তো সেই ভয়ে জুজু হয়ে থাকা । যদি কিছু বেগড়বাই হয়, এখনই গেল চাকরি। সরকারি চাকরির মত তো আর মজাদার হয়না ।
— সরকারি চাকরি মজাদার হয়তো সবক্ষেত্রে নয় । তবে চাকরি যাওয়া নিয়ে টেনশন করতে হয় না , সেই আর কি।
— কি আর করা যাবে বলুন ? সবার কপালে তো আর সরকারি চাকরি থাকেনা । সে সুখ ভোগও থাকে না ।
উনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞাসা করলেন , আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই বেটার অপশন খুঁজবেন ? এখানে এই ধ্যাধ্যারে গোবিন্দপুরে নিশ্চয়ই ভালো লাগছেনা ?
— কে বলেছে ভালো লাগছেনা ? ভালো না লাগলে আমি আসতাম এখানে ? একটাই শুধু চিন্তা হয়, বাবা মাকে নিয়ে আসতে পারিনি । যেকোনো ধরনের ট্রিটমেন্ট এর বিশেষ সুবিধা নেই তো , তাই । ওইটুকুই যা । তবে আমি এখানে খুব ভালো আছি ।
— তবে কি আপনি এই চাকরিতে থাকবেন ভাবছেন?
তাঁর গলার মধ্যে একটা উৎসুক ভাব রয়েছে।
আমি অল্প হেসে বললাম , সবই ভগবানের দয়া বুঝলেন ? এক্ষেত্রে ভগবান তো মালিক পক্ষ , বুঝতেই পারছেন । তাদের দয়া হলে থাকবো।
আবার দুজনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম । সূর্য ডুবে গেছে ।
আমি বললাম , আজকে কিন্তু আপনাকে কিছু খাওয়ানো হলো না । নিচে চলুন বরঞ্চ জমিয়ে চা আর স্ন্যাক্স খাওয়া যাবে । টগর খুব সুন্দর পকোড়া ভাজে।
— আজকে না। আজকে প্লিজ না ।
তিনি কব্জিটা উল্টে রিস্টওয়াচ দেখলেন। বললেন, আজকে আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে । আপনার সাথে কথায় কথায় খেয়াল ছিল না । একটু দেরি হয়ে গেছে ।
— সেকি ? এক কাপ চা’ও না খেয়ে চলে যাবেন ?
— আমি কথা দিচ্ছি, খুব শীগ্রি আসবো আর আপনার সাথে বসে চা খাব । একদম পাক্কা । কিন্তু আজকে আমাকে যেতেই হবে ।
— তাহলে আর কি বলব বলুন? তবে কাল থেকে কিন্তু পাতাকে পাঠিয়ে দিতে হবে । তা না হলে পাতার বাবার কিন্তু এখানে চা’ও জুটবে কিনা গ্যারান্টি দিতে পারছিনা ।
— এ বাবা ! এ তো রীতিমতো ব্ল্যাকমেইলিং –
— হ্যাঁ করছি । পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু পাতাকে ।
— সে আর বলতে! সে তো এ কদিন আসতে না পেরে তো একবারে হাঁপিয়ে উঠেছে । আসবে, আসবে । কাল নিশ্চয়ই আসবে ।
— অবশ্য আমারও মাঝের কটা দিন ওকে গিয়ে নিয়ে আসা হয় নি । সে দোষটা অবশ্য আমার । সবটা আপনার ঘাড়ে চাপালে চলবে না।
উনি অল্প হেসে ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন । আমি নিচে নেমে গেট পর্যন্ত ওনাকে এগিয়ে দিয়ে এসে আবার ছাদে উঠলাম ।
কি যেন বলছিলেন উনি ? তিরিশের পরে বিয়ে করেছেন ? মানে কি একত্রিশ বত্রিশ এরকম হবে ? আচ্ছা যদি তিরিশই ধরা যায় , তারপরে তিন বছর ওনার স্ত্রী ছিলেন ওনার সাথে । তারমানে তেত্রিশ। পাতার বয়স যখন বছরখানেক, তখন তার মা চলে গেছে। এখন পাতার বয়স দশ বছর হবে । মানে থার্টি থ্রি প্লাস এইট বা নাইন । মানে এখন ওনার এজ কত হতে পারে? ফর্টি ওয়ান ফর্টি টু’ এর কম নয় । তার কম কিছুতেই হবে না । মনে মনে এসমস্ত ক্যালকুলেশন করছিলাম । হঠাৎ করে মনটা সজাগ হয়ে উঠতেই চমকে উঠলাম । একী! আমি এসমস্ত কি ভাবছি । ওনার যতই এজ হোক, আমার কি তাতে ? কেন হচ্ছে এসব ? তবে মনের মধ্যে একটু যেন হালকা আমেজের সৃষ্টি হলো । তবে তো ওনার এজ আমার চেয়ে কম না । এইটুকুনি সন্তুষ্টি আমি মন থেকে বাদ দিতে পারলাম না ।
সূর্যাস্তের পর হালকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবিরের মতো রাঙা পশ্চিমাকাশ বেশ ভাল লাগল আমার চোখে । সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন একেবারে সব অন্ধকার হয়ে গেল , তখন আমার মনের মধ্যে আজকে আবার অনেকদিন পর হঠাৎ করে সেই মুচকি হাসি , সেই তাকানো, সেই স্পর্শ , সেই মুখটা ভেসে উঠলো- সোনু দা । অকারণেই আজ আবার আমার জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা ভাবতে ইচ্ছা করছে । নিমেষের মধ্যে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে গেলাম । চলে গেলাম আমি সেই .. সেই দিনে.. যেদিন আমি সোনু দার ঘরে গিয়েছিলাম .. সেদিন বাংলোয় ম্যানেজার কাকু ছিলেন না .. সোনু দা একাই ছিল..
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/
এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/
বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/
তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/
চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/
পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/
ষোল-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/
আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/
উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/
কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/
একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/
ছবি : সংগৃহীত