#স্মৃতির_পাতা (শেষ পর্ব)
#ফারহানা_শিফা
উঠোন ভর্তি মহিলারা তার মাঝে একটা ছেলে। ছেলেটাও আবার ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে ওই কুড়ে ঘরের বারান্দায়। লোকে কি বলবে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।
হেমন্তের বিকেল।
আকাশের মলিন রৌদ টুকু এসে যেনো এই উঠনেই আছড়ে পড়েছে। ঠিক শাহাদাত এর উপর দিয়ে ওই মেহেদী গাছটা পর্যন্ত তির্যকভাবে। শাহাদাত এর বাদামি রঙের চোখদুটো যেনো আরো স্পষ্ট জ্বলজ্বল করে উঠলো। ছেলেটার এমন সৌন্দর্যের দিক থেকে গুটিকয়েক মহিলারা তো চোখ সরাতে ও পারলনা। কিন্তু ওর চিন্তায় কি চলছে?
সামনে বারান্দায় মাথা নুইয়ে হলদে শাড়িতে , হলুদ মাখা মুখে বসে আছে কেয়া। মাত্রই ফুয়ারা বেগম ও হলুদ হাতে ওর মুখ রাঙিয়ে এলেন। এ যেনো এক অবিশ্বাস্যদৃশ্য। হটাৎ শাহাদাত এর হাতে হ্যাঁচকা টান পড়লো। ওর জাগতিক সব ধ্যান ভাঙলো। শিউলি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কেয়ার সামনে।
“কিয়া আপা” বলে ডাকতেই কেয়া চোখ তুলে চাইলো। কিন্তু হয়তো ও এই অবস্থায় এখানে শাহাদাত কে আশা করেনি। ওর চোখদুটো ডুমুরের ফলের মতো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। কেয়ার মা হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে এক খানা পীড়ী এনে শাহাদাতকে বসতে দিলেন “ওগো বাজান। বসো বসো। আমার তো কপাল খুলে গেলো। ভাবি আইছে, সাথে তোমরাও আইছো। বসো” বলে মহিলা আবারো ঘরের ভেতরে দ্রুত চলে গেলেন।
ফুয়ারা বেগম যতই হোক, শাহাদাত এর মা। চোখ দেখে বলে দিতে পারেন ছেলের মনে কি চলছে। কিন্তু আপাতত তিনি কোনপ্রকার ঝামেলা করতে চাচ্ছেন না এখানে। তাই পীড়ীটা তিনি নিয়ে নিজের পাশে রাখলেন “বাবা, এইখানে বসো। আসো”
আকস্মিক এমন একে অন্যকে দেখে হয়তো দুজনেই সইতে পারছেনা। কে জানে? কেয়া নিজের হাত পা কিছুটা গুটিয়ে নিল, আর মুখটা আবারো কাচা মাটির দিকে নুইয়ে নিলো। শাহাদাত ও চক্ষু সংযত করে গিয়ে মায়ের পাশে বসে পড়লো। শিউলি গিয়ে যোগ দিলো উঠোনে সকল মহিলার রং খেলার সাথে। মহিলারা ও আড়চোখে শাহাদাতকে দেখা বাদ দিয়ে আবারো রং খেলায় মেতে উঠেছে। চারদিকে কেমন আনন্দের মুহুর্ত চলছে।
তখনি কেয়ার মা নিজের দুহাতে দুই পিরিচ সেমাই নিয়ে এসে ফুয়ারা বেগম আর শাহাদাতকে ধরিয়ে দিলেন “ভাবি, ঘরে সেমাই চিনি ছাড়া কিছুই নাই। মুখ ফিরাইয়া নিয়েন না। বাবা একটু মুখে দাও। ওরে শিউলি। তুই খাবি? তুই তো আবার মিষ্টি কম খাস” বলে উনি শিউলিকে ডাকলেন।
কিন্তু শিউলি ওদিকে উঠোনের রঙের মাঝে বিলীন। ওকে আর সন্ধ্যার আগে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
ফুয়ারা বেগম সেমাই এর পিরিচ থেকে এক চামচ নিয়ে এগিয়ে কেয়ার সামনে ধরলেন। শত অনিচ্ছা সত্বেও কেয়ার জোরপূর্বক খেতেই হলো। কিন্তু শাহাদাত এর গলা দিয়ে তা নামলো না। ফুয়ারা বেগম উঠে ঘরে চলে গেলেন। কেয়ার মায়ের কাছে।
“কিয়ার মা”
“আরে ভাবি। আমি আইতাছি তো। বাইরে বসেন। ঘরে দেহেন না পালঙ্ক ও নাই”
“আরে না, ওইসব বাদ দাও। ধরো” ফুয়ারা বেগম একশো টাকা তার আঁচলের গিট খুলে বের করলেন “রাখো এইডা। মাইয়ার লেগা দিসি। না করবা না একদম। ”
কেয়ার মা নিতে না চাইলেও উনি জোর করেই ধরিয়ে দিলেন “শোনো। কোনো সাহায্য লাগলে অবশ্যই আমারে জানাইবা। শত হোক কিয়া তো আমাগো ও মাইয়া। একটা ভালো পোলার লগে ওরে দিতে পারলে ওর জিবনটা অনেক সুন্দর হইবো। অনেক। দেইখো”
কেয়ার মায়ের চোখ খুশিতে ভিজে এলো। এই কথাটা অবশ্য সত্য। ফুয়ারা বেগম কখনোই তাকে বিপদ আপদে ফিরিয়ে দেননি। হোক সেটা টাকা পয়সার সাহায্য, হোক ফসলের, হোক অন্য কিছু। ফুয়ারা বেগম সবসময়ই তার সাহায্য করেছেন। এমনকি এই দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের মতনই। তাই কেয়ার মা আর টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন না “ভাবি দোয়া করো। ছেলেটা যেনো আমার মাইয়ারে ভালো রাখে। এই জিবনে আর কি চাই কও?”
“হুম। আল্লাহ চাইলে হইবো”
________
এদিকে ফুয়ারা বেগম ঘরের ভেতরে যেতেই শাহাদাত সেমাই পিরিচ পাশে মাটিতে রেখে দিল। আর কেয়ার দিকে তাকালো “এই কারণেই কি নিষেধ করেছিলে?”
কেয়া কিছু বললোনা। শাহাদাত পুনরায় প্রশ্ন করলো “কেনো বলোনি? বললে কি আমি কোনো বাঁধা বিপত্তি তৈরি করতাম?”
কেয়া মৃদু হাসলো “তোমার সখির বিয়া। তোমার চাইতে বেশি খুশি মনেহয় না কেউ হইছে”
শাহাদাত চুপ করে গেলো। কেয়া ও কিছু বললো না। খানিকক্ষণ বাদে শাহাদাত জিজ্ঞেস করলো “ছেলে কী করে?”
“শুনছি রাজাপুর গ্রামে বাড়ি। অনেক জমি জমা আছে। কৃষক হইলেও ভালো। নিজের জমি নিজে চাষ করে নিজের অর্থ। মায় কয় ভালোই রাখবো আমারে ”
“শুনেছো মানে? ” শাহাদাত ভ্রুকুটি করলো “নিজে তাকে দেখনি?”
কেয়া আবারো মলিন হাসলো “মাইয়াগো কি সেই অনুমতি আছে? আব্বা আম্মা দেখছে। তারাই কইলো পোলা তাগো পছন্দ হইসে। আমার আর আপত্তি করার শক্তি কই?”
শাহাদাত এর বুকে কেমন যেনো এক ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো “তার মানে এই না যে তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। নিজের মতামত টুকুও জানাতে পারবে না। ”
কেয়া এবারে ওর দিকে মুখ তুলে তাকায় “যে বাড়ি নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেইখানে মেয়ের ভাতের দায়িত্ব কয়দিন নিবো বাপে? হয়না। গত মাসেই পোলারা কথা পাকা কইরা গেসিলো। আগামী পরশু উঠায় লইয়া যাইবো। ”
“মেয়ের সুখের চাইতে, অভাব বড়ো হয়ে গেলো?” শাহাদাত বিস্মিত স্বরে বলল।
“হাহা, নাহ। কে কইলো সুখে থাকমু না। পোলা এতো বড়োলোক, এতো বড়ো বাড়ি, গোলা ভরা ধান, নিজের জমি। আর যাই হোক খাওয়ার কষ্ট তো পামুনা” কেয়ার কণ্ঠে স্পষ্টত কষ্ট ফুটে উঠছে ।
শাহাদাত বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর আর কিছুই যে বলার নেই। কেনো বলবে? কি কারণে ওর খারাপ লাগছে? কোনো কারণই তো নেই। নাকি আছে? কেয়া অনুভূতিহীন চোখে তাকালো উঠোনের দিকে। কত খুশির আমেজ। ভাবা যায়! আজ ওর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। কেয়া সত্যিই চায়নি আজ শাহাদাত ওর সামনে আসুক। পারবে না সইতে। কিন্তু নিয়তি!
______________
হাতপাখাটা পড়ে আছে বিছানার উপরে। অন্ধকারে ঘরটা ঘুটঘুটে হয়ে আছে। হারিকেনে পর্যাপ্ত তেল থাকতেও জ্বালানো হয়নি। টিনের দরজাটা বন্ধ করে জানালার আড়ালে দাড়িয়ে বাহিরের চাঁদের আলোয় ঝলমলে নারিকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে শাহাদাত। কি যেনো একটা ভেবেই চলেছে। কি ভাবছে ও জানেনা। জানতেও চায়না। হয়তো ভাবছে কেয়ার কথা। নয়তো ওর বরের কথা।
না জানে ভদ্রলোক কতখানি ভালো হবে? কেয়া কি সে বাড়িতে সুখে থাকবে? নাকি সারাটাদিন ধান সেদ্ধ করে করে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলবে সেখানে? নাকি অন্য কিছু চলছে শাহাদাত এর মনে? চারিপাশ অতিমাত্রায় নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। রাত ও গাঢ় হচ্ছে। বাড়ির সকলেই যে ঘুমে বিভোর এতে কোনো সন্দেহ মাত্র নেই। আজ ভরা পূর্ণিমার রাত। গোল চকচকে চাঁদটা আজ আলো ছড়িয়ে রেখেছে দুর মাঠের শেষ কিনারা অবধি। আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাশের বাড়ির তেতুল গাছটার নিচে শায়িত আব্দুর মিয়ার কবরটার উপরেও। আজ আলোর যেনো অন্যই রূপ দেখা যাচ্ছে বাহিরে।
এটা হলো গ্রাম বাংলার আরেক সৌন্দর্য। পূর্ণিমার রাতগুলো এতটা মধুর হয়। চারিদিকে দিনের আলোর মতই চাঁদের আলোয় ফকফকা সাদা হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় মনেই হবেনা যে কোনো জ্বীন পরীও দেখা দেবে। সচরাচর তাদেরকে অন্ধকারেই তাদের আগমন হয়। কে জানে চাঁদের আলো তাদের পছন্দ কিনা? এই রাতগুলোতে বাঁশঝাড় কে দেখে এক জীবন্ত পাহারাদারের মতন মনে হয়। ইয়া লম্বা চওড়া ঝাড়। ভয়ের থেকে বিস্ময়ের কারণই বেশি। শাহাদাত পাঠ্যবই এ পড়েছে , বাঁশ হলো ঘাসেরই এক প্রজাতি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে ঘাস থাকে মাটিকে আঁকড়ে ধরে, এইদিকে বাঁশ চায় আকাশ ছুতে। এটা কি মহত্বের প্রতিযোগিতা? হয়তবা।
সবুজ রাঙা পুকুরগুলোর পানিও এই রাতে ঝলমল করে। সে কতই না আকর্ষণীয় দৃশ্য হয়। ফসলি মাঠের যতদূর চোখ যায় ততদূর দাড়িয়ে থাকা একটা মানব আকৃতিও স্পষ্ট হয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় উজ্জ্বল নীল দিগন্ত। চাঁদের চারপাশে আলোর ঝলকানি। চাঁদটাকে ও অনেকটাই বড়ো দেখা যায় অন্য দিনগুলোর তুলনায়। এই বেলায় উঠোনে চাটাই পেতে ভাই বোনে মিলে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। সে যে কি আনন্দ। শুকনো থন্থনে উঠোন। মাঝখানে চাটাই, তার উপর কতগুলো সমবয়সি ছেলেমেয়ে , সাথে কিছু হাসি আড্ডা। একেবারেই চমৎকার রাত হবে সেটা। নিঃসন্দেহে ।
রাত কয়টা ঠিক জানা নেই। কেয়া বসে আছে ঘরের বারান্দায়। আনমনেই বাঁশের খুঁটির সাথে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। ভেতরে বাবা মা ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। মেয়ের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে সেই নিশ্চিন্তে। কিন্তু মেয়ে কি চায় এটা হয়তো তারাও জানেনা। ঘুম আসছেনা। ভালো ও লাগছেনা। গ্রামের দুরন্ত মেয়ে রাত বিরাতে ঘরের উঠোন ভরে হাঁটতেও ওর কোনো অসুবিধে হবেনা। তার উপর জোছনা রাত। সবই তার চোখে দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় অদৃশ্যের প্রতি ভয় কি জিনিস সে জানবেও না।
এমনি হাজারো চিন্তার মাঝে হটাৎ তার কাছে মনে হলো উঠোনের পাশের মেহেদী গাছটা একটু নড়ে উঠলো। পাতাগুলো একটা আরেকটার গায়ে ঘষা লাগায় একটা খোষখস আওয়াজ শুনতে পেলো কেয়া। সে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো। আর সাথে সাথেই কেউ তার মুখ চেপে ধরলো। সে আচমকা চমকে উঠলো। ছোটাছুটি করবে তার আগেই সামনের ব্যক্তির মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো ওর সামনে। সে ফিসফিস করে বললো ” চিৎকার করবে না। চলো ওঠো”
শাহাদাতকে হটাৎ এখন দেখে কোনোভাবেই যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেয়া। ওর কথামত কেয়া কিছু না বলে উঠে দাড়ালো। আর ওর সাথে সাথে হেঁটে কোথাও যেতে লাগলো। শাহাদাত ওকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে একগাদা গাছ গাছালির পেছনে গিয়ে দাড়ালো। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই ওর। কি বলে কথা শুরু করবে ও জানেনা। কেয়া নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ওর থেকে একপা দূরে সরে গেলো “এই সময় এমন ভূতের মতন ঘুইরা বেড়ানোর মানে কি?”
শাহাদাতের কাছে কোনো উত্তর নেই। কেয়া আশপাশে কোনো লোকজন আছে কিনা দেখে নিয়ে আবারো বললো “দেখো , অনেক রাইত হইসে।বাড়ি যাও। শিকদার চাচা জানতে পারলে সমস্যা হইবো। ”
“আমরা কিছুক্ষন একটু কথা বলি?”
শাহাদাত এর কণ্ঠস্বর থমথমে। চোখ আকাশের দিকে। এমন একটা আবদার করে বসলো ও যার পরিণতি খুব খারাপ ও হতে পারে। কিন্তু মনকে মানানো খুবই কঠিন। কেয়া তা জানে।
“পাঁচ দশ মিনিট? ” কেয়া সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো।
শাহাদাত প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো “আশপাশে খালি কোনো জায়গা নেই? যেখানে নির্ভয়ে একটু সময় কাটানো যায়?”
কেয়া একটু ভেবে নিলো। তারপর শাহাদাতের হাত ধরে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে কোথাও যেতে লাগলো। শাহাদাত জানেনা কোথায়। ওর জানবার প্রয়োজন ও নেই। এক বিশ্বস্ত হাত যে ওর হাতখানা ধরে রেখেছে।
হাটতে হাটতে একসারি আম আর কাঠাল গাছের এক বাগানে এসে দাড়ালো কেয়া।
“এইখানে কেউ আইবো না” কেয়া শাহাদাতের হাত ছেড়ে ঘুরে দাড়ালো “এই বাগানের আশপাশে তেমন বাড়িঘর নাই। সমস্যা ও হইবো না। ” বলে কেয়া আশপাশে কি যেনো খুঁজতে লাগলো।
চাঁদের আলো গাছের মাঝারি আকৃতির পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছিল। যথেষ্ট আলো রয়েছে এই এতগুলো গাছের মাঝেও। অন্য রকম অনুভুতি। কেয়া চারপাশ তাকানোর পর একটা বড়ো মোটা কাঠাল গাছের সামনে গিয়ে দাড়ালো। গাছটার শিকড় গুলো উপরের দিকে রয়েছে । আর অনেক মোটা মোটা শিকড় রয়েছে আসলে। কেয়া তার একটাতে বসে শাহাদাতকে ডাকলো “এইখানে বসো। ”
শাহাদাত একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে ওর মুখোমুখি গিয়ে একটা শিকড়ের উপরে বসে পড়লো।
” বলো কি বলবা?” কেয়ার প্রাণে যেনো এক উত্তেজনার জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের যতটা ছটফটানি তার থেকে বেশি আগ্রহ নিয়ে সে শাহাদাতের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহাদাত মাথা নাড়লো “কাল বাদে পরশু তো বিয়ে”
“হুম” কেয়ার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। ও হয়তো অন্য কিছু শোনার আশায় ছিলো। শাহাদত ও এটা বলতে চায়নি। কিন্তু মুখ ফস্কে চলে এলো। আবারো পিনপতন নিরবতা।
গাছের ডালে হয়তো এক দুটো পেঁচাও বসে আছে। তাদের গুরুগম্ভীর বিচিত্র ডাকে পরিবেশটা আরো থমথমে হয়ে আছে। শাহাদাত খুব আবেগী ছেলে। আবেগ এর তাড়নায় হয়তো একপলক কেয়াকে দেখতে এই রাত পেরিয়ে ছুটে এসেছে। কিন্তু বুক ফাটলেও ওর মুখ ফোটে না। এতো গভির নিস্তব্ধতা যেনো কেয়ার ভালো লাগছেনা। ও বসা থেকে উঠে দাড়ালো। শাহাদাত ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো।
“অনেক বছর অপেক্ষা করসি। জানো। অনেক। ”
শাহাদাত চমকে উঠলো। কেয়া এবার ওর দিকে ঘুরে তাকালো। গাছের ডালের পেঁচা জোড়াও হয়তো এই কথোপকথনে কান পেতেছে।
“ছোটো থাকতে কাটানো প্রত্যেক মুহুর্ত আমার মনে গাইথা আছে। ছিলাম বন্ধু। এর বেশি কখনোই ভাবিনি। এইটা তুমিও জানো। কিন্তু যখন চইলা গেলা, সেদিন শেষ দেখাটাও পাই নাই তোমার। মাঠে ছিলাম। খবর পাই তোমারে নাকি শহুরে লইয়া যাইতাসে। দৌড়াইয়া গেসিলাম শেষবার তোমারে দেখার লিগা। কিন্তু আমার যাওয়ার আগেই তোমাগো ভ্যান ছাইড়া দিসিলো। সেইযে পনেরোটা বছর! ” কেয়া থামলো।
শাহাদাত নিশ্চুপ শ্রোতা আজও। ওর কাছে যে কিছুই বলার নেই। ওর স্মৃতি যে ওকে সাহায্য করছেনা আজও। কেয়া আরেকপা পিছিয়ে গেলো
“তোমারে ওইদিন ঘাটে দেখতে গেসিলাম। হয়তো তোমার মনে নাই। কিন্তু আমার মনে আছে। তুমি ছোটো কালে আমারে একখান কথা দিসিলা। তুমি কইছিলা তুমি যদি শহরে যাও কোনোদিন, আমার লিগা এক মুঠ রেশমী চুড়ি লইয়াইবা। জানোই তো আমার চুড়ি কত পছন্দের। আমি সেই আশায়ই গেসিলাম। ভাবছিলাম আমি যেমনে তোমারে ভুলি নাই , তুমিও আমারে ভুলবা না। হাহ। কিন্তু…….”
শাহাদাত ও বসা থেকে দাড়িয়ে পড়লো “কেয়া….”
“কেয়াকুমারি। তুমি আমাকে এই নামটা দিসিলা। আমার যখন রাগ হইতো তুমি এই নামে আমারে ডাকতা আর আমার রাগ ভাইঙ্গা যাইতো। জানো তোমার মত কইরা আমারে কেউ ডাকেনা। কেউনা” কেয়ার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো।
“আমি সত্যি জানিনা কেনো আমি আমার অতীতের এই মুহুর্ত গুলো মনে করতে পারিনা। বিশ্বাস করো” শাহাদাত এগিয়ে গেলো “আমি খুব চেষ্টা করি। কিন্তু আমার শহুরে যাওয়ার পরের ঘটনাগুলো ছাড়া আর কিছুই মনে আসেনা”
“আইবো ও না ” কেয়া হাসলো “ঐযে কইসিলাম অপ্রয়োজনীয় জিনিস গুলা মানুষ এমনিই ভুইলা যায়। কিন্তু যারা ভুলতে চায়না তারা আজীবন মনে রাখতে পারে”
“কেয়া তুমি বিয়েতে না করে দাও” শাহাদাত আচমকাই বলে বসলো।
কেয়া হাসলো “ক্যান না করলে তো আমারই কপাল পুরবো । তুমি নিজেও তো আমারে বিয়া করবা না।”
প্রতুত্তরে শাহাদাত কিছু বলতে পারলোনা। ওর মস্তিষ্কে যেনো বাক্যের অভাব ভরে গেলো। ঠিক কি বলে ও এই কথার প্রতিক্রিয়া করবে ও জানেনা। কেয়ার মনটা হয়তো মুচড়ে গেলো “কি আমারে বিয়া করবা?”
শাহাদাত মলিন মুখে বলল “আমি কি তোমার যোগ্য?”
কেয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিল “এটাই তো কথা। আমার মত গরীবের মাইয়া তোমার যোগ্য কিনা”
“কেয়া!”
“আরে রাগে ক্যান। যা সত্যি তাই কইলাম। আচ্ছা বাদ দাও। জানো আমি ভাইবা পাইনা আমার মনটা কখন কি চায়” কেয়া অন্য দিকে মুখ ফেরালো ।
“তুমি ছিলেনা। গ্রামের লোকজন ও আমারে দেখতে পারতো না। আমি তোমার লগে ঘুরতাম দেইখা। ভাবিনাই ওগো কথা। একা একাই ঘুরতাম ফিরতাম। যখন যেই পাড়ায় মন চাইতো যাইতাম। লোকজনের কথা শোনার সময় বা বয়স কোনোটাই ছিলনা। আস্তে আস্তে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। তোমার ফেরার নাম নাই। ফুয়ারা চাচীরে জিগাইলে কইতো তোমার চিঠি আসেনাই। জানো কতটা কষ্ট লাগতো। এমনিও চিঠি পত্র ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই খবর নেওয়ার। তারপর তুমিও নাকি চিঠি দাওনা। ভাবতাম তোমার কোনো বিপদ হইলো নাকি। মাঝে মাঝে দুই তিনমাস পরপর চাচী কইতো তোমার চিঠি আইসে। তুমি নাকি ভালো আছো। এইটুকুই লিখছো। আমি ভাবতাম আমারে নিয়া ও কিছু লিখবা। হাহা। গাধার মত চিন্তা ভাবনা। ”
শাহাদাত যেনো পুনরায় বিস্মিত হলো।
“তবুও তুমি ভালো আছো শুইনা ভাললাগত। বলতে পারুম না ঠিক কবে থিকা আমি অদ্ভুত হইতে শুরু করছি। একা একা থাকতে থাকতে তুমি আমার মাথাটাই খাইসিলা। তোমারে কল্পনা করতাম। নিজের লগে সবসময় তোমারে নিয়া হাঁটতাম। একা একা বকবক করতাম। তোমারে ভাইবা। রোজ নদীর পাড়ে আইতাম । এই চিন্তায় যে হয়তো তুমি আইবা আইজ। কিন্তু তুমি আইতা না। ”
কেয়া আকাশের চাঁদটার দিকে তাকালো “ধীরে ধীরে কবে যে মনের মধ্যে তোমারে গাঁইথা নিসি আমি নিজেও জানিনা। খুঁজতাম, নিজের সুখ খুঁজতাম। নিজেরে ভালো রাখার জন্য সব করতাম। অনেক মাইয়াগো সখি বানাইছি। রোজ তাগোরে সময় দিতাম। কিন্তু , কোনো এক জায়গায় দিনশেষে আমি একাই”
শাহাদাত ঠায় দাড়িয়ে রইলো। ওর কাছে কোনো বাক্য নেই। কোনো শব্দ নেই। কোনো উত্তর নেই। শুধু আছে অজানা এক কষ্টের পাহাড় জমা অন্তর।
কেয়া আবারো বললো “অনেক চেষ্টা করতাম খোঁজ নেওয়ার তোমার। এর মধ্যে আবার আমার বিয়ার তোড়জোড় শুরু করতো সবাই। কোনমতে ঠেকায় রাখতাম। এই আশায় যে হয়তো এখন বিয়া করাটা ঠিক হইবো না। আরো পরে বিয়া করুম.।
জানো , জানিনা ক্যান তবে আমি তোমার আসার অপেক্ষায় থাকতাম। এই পাত্র দেখতে আসার আগেরদিন পর্যন্ত ও মনে প্রাণে দোয়া করসি একটা বার তোমারে দেখমু। শেষবার হোক। তবুও। তুমি যদি আরো কয়মাস আগে গ্রামে আইতা তাইলে হয়তো…….”কেয়া থেমে গেলো। সাই সাই করে বাতাস এই বাগানটা ভেদ করে চলে গেলো। পেঁচা দুটো এতক্ষণ শান্ত থেকে ওদের কথা শুনলেও এবারে আবারো উচ্চস্বরে হাঁকিয়ে উঠলো। শাহাদাত স্তব্ধ হয়ে গেলো।
কেয়া হেসে উঠলো “যাকগে। তাও ভালো তুমি আইসো। আল্লাহ আমার ডাক শুনছে। তোমার লগে তিনটা দিন কাটাইতে পারছি আমি এতেই খুশি। খুব ইচ্ছা ছিল তোমারে নিয়া ঘুরমু। আগের মতন। পূরণ হইসে। আর কি কও?” কেয়া শাহাদাতের দিকে তাকালো।
কিন্তু লজ্জায় শাহাদাত নিজের মাথা নুইয়ে নিলো। কিসের লজ্জা? জানেনা। হয়তো চোখ মেলানোর ভয়। কেয়া সেই ভয় সরিয়ে ওর হাত ধরলো “আজকের এই রাতটা আমি আরো আগে থেইকা চাইতেছিলাম। তোমার লগে চাঁদ দেখমু ভাবতাম। চলো ওইপাশে যাই” বলে ও শাহাদাতকে টেনে নিয়ে গেল বাগানের বামে একটা শান বাঁধানো পুকুরের পাড়ে। নেমে গেলো সিড়ি ধরে। এক সিড়ি পানিতে পা ভিজিয়ে দুজনে মুখোমুখি তাকালো “পিছলা সিড়ি। পড়ে যাইও না আবার” বলে কেয়া হেসে উঠলো।
পুকুরের পানিতে বালির মতন চিকচিক করছে চাঁদের আলো। দেখে অদ্ভুত এক টান সৃষ্টি হচ্ছে ওদের মনে। কেয়া বললো “একটা গান শুনবা? শিউলি আমার শিখাইছিল.”
শাহাদাত মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। কেয়া ক্ষীণ কণ্ঠে সুর তুললো “তুমি যখন ছিলানা তখন গাইতাম ওই ডোবার পাশে বইসা”
“উমমম…. তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না……”
ধ্বনিতে মেতে উঠলো পরিবেশটা।
_____________
জোছনা বিলাস শেষে কেয়া উঠে দাড়ালো “চলো বাড়ি ফিরি। কেউ দেখলে বিপদ”
আরো কিছু কথা বলতে বলতে কেয়া সিড়ি বেয়ে পাড়ে উঠে গেলো।
“তো শোনো এখন তুমি বাড়ি…..” বলে ঘুরে দাড়াতেই আচমকা শাহাদাত ওকে জড়িয়ে ধরলো। কেয়া চমকে উঠলো। শাহাদাত ভারী কণ্ঠে বললো “বিয়েটা করো না। না করে দাও”
হঠাৎই কেয়ার চোখজোড়া ভিজে গেলো। মনটাও তো তাই চাচ্ছে। কিন্তু এ কি সম্ভব? শাহাদাত আবারো বললো “চলো আমার ভুলে যাওয়া তোমার আঁকড়ে ধরা অতীতকে আমরা আবারো জীবন্ত করে তুলবো। তোমাকে আর কষ্ট দেবোনা। লাগলে আমরা দূরে চলে যাবো। কিন্তু তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও। কেয়া”
কেয়ার চোখের দুফোটা জল গাল গড়িয়ে পড়ল। সে পাথর সেজে আছে যেনো “ক্যান? তুমি তো আমারে চিনলা মাত্র তিনদিন। এতেই এতো টান? আর আমার কথা চিন্তা করো এতগুলো বছরের মায়া?”
শাহাদাত ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো “ভুলে যাওয়া মানুষের জন্মগত স্বভাব। হতে পারে ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই আমরা ভুলে যাই। কিন্তু তাতে পথচলা থামেনা। নতুন একটা সূচনাও সম্ভব। সবকিছু এভাবে শেষ করে দিওনা”
কেয়া মাথা নাড়লো “আমার হাতে কিছুই নাই। আর আবেগ দিয়া তো আর পেট ভরেনা। পরিবারের মান ইজ্জতের কদর তুমিও করো আমিও করি। তাগো মনে কষ্ট দিয়া সুখ খুজবা। এ কি সম্ভব?”
শাহাদাতের হাত আলগা হয়ে এলো। কেয়া ওকে নিজের থেকে সরিয়ে ঘুরে দাড়ালো “ব্যাপার মুখ ছোটো করতে চাইনা। উমমম। বাদ দাও। বিশ্বাস করো তোমারে আমি আপন কইরা নিতে চাইনা। এসব উল্টা পাল্টা চিন্তা আমি করিনা। তুমিও ভাইবো না আমি অমন।আমার মার মুখের দিকে চাইয়া আমি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। সেসব খারাপ চিন্তা। ছি ছি।
খালি আমার বিয়ার পর পালকিতে ওঠা পর্যন্ত একবার একটু তোমারে দেইখা বিদায় নিতে পারলেই আমি খুশি” কথাটা বলে নিজের চোখের জল লুকিয়ে হাটতে শুরু করলো কেয়া। শাহাদাত ও বুকের কষ্টটা চাপা দিয়ে দিল।
কেয়ার বাড়ি এসে গিয়েছে। এতক্ষণ একপ্রকার জোর করেই কেয়ার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে হাঁটছিলো শাহাদাত। হয়তো মনে মনে ভাবছিল এই পথ যদি না শেষ হয়! যদি কোনো গন্তব্যতেই না পৌঁছোয় তারা? তবে এই অনন্ত পথ ধরে হাটতে পারবে শাহাদাত।
“কিহলো হাত ছাড়ো”
কেয়ার কথায় ওর ধ্যান ভাঙলো। শাহাদাত নিজের হাতের মুঠো খুলতে নারাজ। সম্ভব না ওর দ্বারা। কেয়া আস্তে আস্তে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে লাগলো। কিন্তু ও তবুও কেঁয়ার হাতটা শেষ অবধি আকড়ে ধরে ছিলো। তালু থেকে তালু সরে যায়, আঙ্গুল থেকে আঙ্গুল। শেষ আঙ্গুলের স্পর্শ ও যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন দুজনের চোখদুটো একত্রিত হয়ে যায়। কি যেনো বলতে চাচ্ছে। তবুও বলতে পারছেনা। কি যেনো মুখে বেঁধে আছে। কিন্তু কথায় প্রকাশ পাচ্ছেনা। কি যেনো পিছুটান। তবে তাদের ধরে রাখতে পারছেনা।
“বাড়ি চইলা যাও। সাবধান। পরশুদিন একবার একটু দেখা দিও?” কেয়া ছলছল চোখে তাকালো।
শাহাদাত আর কিছু বলতে পারলো না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার মুখের বুলি কেড়ে নিয়েছে। কেয়া তা জানে। তাই সে আর শাহাদাতের উত্তরের আশা করলো না। ঘুরে সোজা নিজেদের ঘরের কাঠের দরজাটার ছিকল খুলে ঘরে ঢুকে গেলো। একটিবার ও ঘুরে তাকালো না। বুকের অজানা ব্যথার ভার সহ্য করতে না পেরে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়লো শাহাদাত। কথায় বলে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। কাঁদতে পারেনা। কিন্তু আজ এই চিরন্তন সত্যের অন্য রূপের সাক্ষী হয়ে রইলো রাতের জোছনা। সাক্ষী হয়ে রইলো চাঁদ, সাক্ষী রইলো শাহাদাতের পায়ের তলার অশ্রুজলে ভিজে ওঠা মাটি। সাক্ষী রইলাম আপনি আর আমি।
______________
গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলছে একটা সুন্দর লাল রাঙা পালকি। সামনে চারজন। পেছনে চারজন। মোট আট পায়ে এগিয়ে চলছে এই সুসজ্জিত পালকি। বাহিরে বাচ্চাকাচ্চা ছেলে মেয়ে গ্রামের মহিলারা গীত করছে। গ্রামীণ বিয়ের গীত। মুখে মুখে উচ্চস্বরে গীত করছে আর গ্রাম বাসীকে জানান দিচ্ছে যে দেখো , বধূ বেশে কেয়ার পালকি যাচ্ছে ওই গ্রামের পথে। দেখো, গ্রামের চিরচেনা মেয়েটা আজকে পর হয়ে যাচ্ছে। দেখো।
ওরে পালকি চলে দুর পথেতে
সাথে মাইয়া আমার নিয়া
কোন দুয়ারে ঠেকবে গো সখি
কোন দুয়ারে গিয়া?
দামানে ভালো রাইখো মাইয়া আমার
দিলাম তোমারে সোপে
চারদিকে চাইয়া ও মাইয়া আমার
কান্দে মুখ লুকায়ে।
পালকি চলে যায় দুর পাড়াতে
একখান দিও খোঁজ
মাইয়া আমার ভাইঙ্গা না পড়ে
সোহাগ দিও রোজ
মহিলাদের মুখে চিরচেনা সেই বিয়ের গীতি শুনেও আজ তেমন আনন্দ লাগছে না কেয়ার। বউ সেজে যে পালকিতে চড়ে বসেছে তা যে ওর কাম্য ছিলনা। হায় আফসোস। আর কিছুটা দিন যদি ওর সখার সাথে কাটাইতে পারতো। ভাবতেই বুকটা ফেটে আসে। অজানা এক কারণে সে পালকির পর্দা সরিয়ে বাহিরে উকি দেয়। সামনে পেছনে উকি দেয়। সে কি আজও শেষবারের মতন একটাবার দেখবেনা শাহাদাতকে। আজকের এই বিদায় টাও কি সেই পনেরো বছর আগের বিদায়ের অনুরূপ হবে?
ভাবতে ভাবতেই একটা লম্বা খেজুর গাছের গোড়ায় চোখ আটকে যায় কেয়ার। গাছের গোড়ায় দাড়িয়ে সে কেয়ার রূপ পর্যবেক্ষণ করছে। কেয়ার দৃষ্টি সেথায় আটকে রইলো। কাজলকালো চোখদুটো ছলছল করে উঠলো আবারো।
দাড়িয়ে থাকা প্রিয় মানুষটা তার চেহারার দিকে হাতের ইশারায় দেখলো তাকে খুব সুন্দর লাগছে। কেয়া মাথা নাড়লো “নাহ”
শাহাদাত মাথা নাড়লো “হুম” দুজনের দুরত্ব যতই হোক। একে অন্যের ঠোঁটের কথা পড়তে খুব বেগ পেতে হলোনা। কেয়ার কান্না সে কোনমতে চেপে রেখেছে। গলাটা ধরে আসছে ওর।
শাহাদাত আবারো মাথা নড়ল আর ওর চোখের জল মুছতে বললো । কেয়া কিছু বললোনা। দেখতে দেখতেই পালকিটা চোখের আড়ালে চলে গেলো। মহিলাদের গিতের শব্দ ও মিলিয়ে যেতে লাগলো। তারা চলে গেলো তার ঠিকানায়। খেজুরের ছায়ায় সাদা পাঞ্জাবি পরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার চোখের কোণে জমে উঠলো পানি।
সে নিজেই নিজেকে বিড়বিড় করে বললো “খুব সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে। কাঁদিস না। খুব ভালো থাকবি। আর যদি কষ্ট পাস আমাকে নাহোয় একটা খবর পাঠাস। তোকে সেই কষ্ট থেকে দূরে নিয়ে আসবো”
খা খা রোদ। ফাঁকা জনশূন্য মাঠ। এক শাহাদাত , দ্বিতীয় তার কথা তৃতীয় আকাশ ছাড়া আর কেউ নেই। কিছু নেই। বুকের মধ্যটা অজানা ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। সমাজ সামাজিকতা, পরিবার সবকিছু কি মেয়েটার জন্য এত বড়ো হয়ে গেলো যে সে নিজের খুশিটুকুও বিসর্জন দিয়ে দিল? মেয়েরা কি এমনই হয়? নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও আপনজনদের সুখ কাড়বে না। ছেলেরা কেনো এত বড়ো ত্যাগ করতে পারেনা? শাহাদাত কেনো পারলো না নিজের মনের কথাটা একটু শুনতে? কেনো পারলো না একবার বাবা মায়ের সামনে দাড়িয়ে সাহস করে বলতে । ও নিজেও চায় কেয়া না যাক। ওর ঠিকানাটা ওই গ্রাম না হোক। এই গ্রামই হোক। কেনো পারলো না? হয়তো পরিবারের সম্মানের খাতিরে? হয়তো কোনো পিছুটান এ। পরিবারের সম্মান যে কতটা বাস্তব তিক্ত অনুভূতি, হয়তো এরা দুজনেই তা বুঝেছে। এমনই কত শত সম্পর্কের ইতি টেনে দেয় এই পারিবারিক সিদ্ধান্ত। পারিবারিক সম্মান, পিছুটান। সমাজ, সামাজিকতা। হয়তো কেয়ার চিন্তাও তাই ছিলো “দশটা সম্পর্কের মান রাখতে একটাকে নাহয় ভেঙে ফেলা হোক” । মন থেকে শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শাহাদাতের।
বিদায় সখি। ভালো থেকো। পারলে মাফ করে দিও। তোমার রেশমী চুড়ি গুলো দিতে পারলাম না।
সমাপ্ত