স্মৃতির পাতা, পর্ব:১

0
2734

লুকিয়ে পালিয়ে কতই বা আসা যায় রোজ রোজ বলো তো? একে গ্রামগঞ্জ, তারউপর উঠোন ভর্তি লোক, তার উপর রাস্তার মানুষ, এবাড়ির সই ওবাড়ির সই সব সামলে শেষে কিনা নদীর ঘাটে এসেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে কেয়ার।

মাথার উপর খা খা রোদ, তবুও শাড়ির আঁচলটা উঠিয়ে কপাল পর্যন্ত টেনে রেখেছে আর দুর নদীর মাঝ বরাবর ভেসে আসা নৌকোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা।
আজই সকালে শুনলো পাড়ার শিকদার কাকার ছেলে নাকি শহর থেকে ফিরছে। সে নাকি আসবে, নদী পার হয়েই । আর এই গ্রামের পাশ দিয়ে বোয়ে চলা নদীর একমাত্র মাঝি কেঁয়ার মানিক চাচা।
আপন না হলেও সম্পর্কে চাচাই হন উনি।

সেই জন্যই তো দৃষ্টি একমাত্র তার নৌকোর দিকে আবদ্ধ।
হয়তো ওকেই নিয়ে আসছে!
ভাবতেই আনমনেই মুখে হাসি ফুটলো কেয়ার। কতবছর পর দেখা! সেই যে গিয়েছিল শহরে , কিসব পড়ালেখা করে চাকরির খোঁজে…… আজ পনেরো বছর পর ফিরছে এই তুচ্ছ গ্রামটায়।

তবে তাই বলে কেয়ার মনে আক্ষেপ নেই। অন্তত ফিরেছে তো।

ভাবতে ভাবতেই নৌকো এসে পাড়ে ভিড়েছে। সেই সাথে কেয়ার মনে হালকা বাতাসের দোল বয়ে যাচ্ছে।

বেশ ঢিলেঢালা প্যান্ট, সাদা শার্ট তাও আবার কলার অবধি বোতাম লাগানো , হাতে একটা বড়ো টিনের বাক্স সব মিলিয়ে এক শহুরে বাবু এই গ্রামের মাটিতে পা রাখলো যেনো।
কেয়া অপলক তাকিয়ে রইলো।
চেহারাটা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল তার মস্তিষ্ক!
আজ , আবারো , সেই মুখখানা। চোখ দিয়ে অস্রু মুখে হাসি, কোনোটাই যেনো কম নেই কেয়ার।

ছেলেটা সটান দাড়িয়ে বুক ফুলিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিল দু চারটে “বুঝলে চাচা, সেই যে গেলাম তাও আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, আজ কত বছর পর ফিরেছি বলো তো”?

ছেলের শুদ্ধ বাংলায় উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দে যেনো মানিক মিয়া উচ্ছসিত হচ্ছেন। হবে নাই বা কেন? গ্রামের সনামধন্য পরিবারের সন্তান, শহর থেকে ফিরেছে বলে কথা। মানুষ তো শুধু শহর বলে শুনেই এসেছে। দেখেছে তো এই বাপের ব্যাটাটাই । মানিক মিয়া হেসে উঠলো “হো বাবাজি ঠিক কইছো। তোমারে সেই যে ছোট্ট একটু দেখছিলাম , অহন তো অনেক বড়ো হইয়া গেছো!”

ছেলেটা মলিন হাসলো “সময় কি পড়ে রয় চাচা?”

ছেলের বাকভঙ্গিতে মানিক মিয়া সন্তুষ্ট “তা ঠিক। তো বাবা অহন যাও বাড়ি যাও। সবাই অপেক্ষা করতাছে হয়তো”

“হুম জ্বী। চাচা এইটা নিন” হাতে ১০ টাকার একটা নতুন নোট নিয়ে এগিয়ে দিল মানিক মিয়ার দিকে।
মানিক মিয়া হতাশ মুখে তাকালেন “বাবাজি, তোমার কি মনে হয় তোমার থিকা আমি টাকা লোমু?”

“আরে না না ভুল ভাবছেন। আপনি যে কষ্ট করেছেন এটা তারই প্রতিদান……. আপনার প্রাপ্য”

ছেলেটির কথায় মানিক মিয়ার ভারী অভিমান হলো “বাবা , যাও বাড়ি যাও। অন্য একদিন কথা হইবো। আমার অহন ওইপারে যাইতে হইবো আবার। যাও” বলতে বলতে নৌকতে উঠে বৈঠা চালাতে শুরু করে দিলেন মানিক মিয়া।
ছেলেটি আর পিছু ডাকলো না। ডাকলেও উনি শুনবেন না। যাক ব্যাপার না। টাকাটা নাহয় বাবাই দিয়ে দেবে। ভেবে বাক্স টা হাতে উঠিয়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে হেঁটে উপরে যেতে লাগলো ছেলেটা।

দুর থেকে এতক্ষণ কেয়া সব কিছু দেখলেও , এবার সে একপা একপা ছেলেটার দিকে এগোতে লাগলো।
ছেলেটার সেদিকে তেমন খেয়াল যায়নি। সে নিজের মতই হাঁটছে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো “শাহাদাত …….”

ছেলেটা থেমে গেলো।
আবারো একই ডাক।
এবারে সে একটু পেছন ঘুরে তাকালো ………
পাঁচ কদম দূরে এক যুবতী দাড়িয়ে। চেহারায় আলাদাই এক খুশির ছাপ।
শাহাদাত মাথা ঝুঁকিয়ে তাকালো “জ্বী কে?”
কেয়া মলিন মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো “কেমন আছো?”

শাহাদাত খানিক অবাক হলো “ভালো। তবে আমি কি… কোনোভাবে আপনাকে চিনি? না মানে গ্রামে তো অনেকদিন পর এলাম”

কেয়া যদিও একটু মন খারাপ করলো তবে তা বুঝতে দিলনা “আচ্ছা , তুমি না কইছিলা শহর থ থেইকা ফেরার পথে আমার…..”

কেয়ার মুখে কথার দাম দিলনা শাহাদাত “আসলে আমি একটু তাড়ায় আছি। যদি জলদি বলতেন। আপনি কে?”

কেয়া যেনো মুহূর্তেই পাথরের মত জমে গেলো। অন্তত এই মানুষটার কাছ থেকে এমন কথা সে আশা করেনি। মনের গহীনে একরাশ অভিমান নিয়ে সে ঘুরে দাড়ালো “কেয়াকুমারী” বলে সে হেঁটে বিপরীত পথ ধরে চলে যেতে লাগলো।
শাহাদাত ভীষণ অবাক। গ্রামের পথ বলতে শুধু নিজের বাড়ির পথটাই যা মনে আছে। আর তো ওর ছোটবেলার কোনো স্মৃতিই তেমন একটা মনে নেই। ওর দোষটা ও দেওয়া ঠিক না।

যুদ্ধের সময় সে ছোটো ছিল। বয়স হবে এগারো কি বারো। দেশ স্বাধীন এর পরপরই তার বাবা তাকে শহরে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার খাতিরে। আজ বহুবছর পর সে দেশে ফিরেছে। বলতে গেলে ছোটবেলার বহু স্মৃতিই তার মস্তিষ্ক নিজের মধ্য থেকে মুছে ফেলেছে।
যাকগে অতশত চিন্তা না করে শাহাদাত হাটতে লাগলো ফসলি জমির পাশে আইল রাস্তা দিয়ে।
পথিমধ্যে অনেকেই তার পরিচয় জানতে চাইলে , সগৌরবে সে নিজের বাবার পরিচয়টাই আগে ধরিয়ে দিল। ফলে গ্রামের কারো বুঝতে বাকি রইলো না এ হলো শিকদার বংশের জ্বলন্ত প্রদীপ শাহাদাত শিকদার।
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে সে নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছলো।

বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই যেনো উঠনভর্তি লোকজনের নজর কাড়লো এই অত্যন্ত সুগঠিত চেহারার ছেলেটা।
তখন উঠোনে বসে ছিল শাহাদাত এর বাবা, মা, চাচারা, চাচিরা, ছোটো ভাই বোন দুজন আর চাচাতো ভাইয়েরা। সব মিলিয়ে হাস্যোজ্বল বাড়ি। আর তাতেই শাহাদাতের আগমন।

বাড়ির আর কেউ না চিনলেও এতো যুগ পরেও নিজের বাবা মা তাকে ঠিকই চিনলো। ছেলেকে স্বশরীরে আজ এতদিন পর সামনে পেয়ে মা ফুয়ারা বেগম যেনো চেচিয়েই উঠলেন “বাজান! ওরে কে কোহানে আছিস, জলদি পানি আন। আমার বাপজান ফিরছে” বলেই উনি দৌড়ে গিয়ে নিজের ছেলেকে জড়িয়ে নিলেন।

শাহাদাত ও হাতের বাক্স মাটিতে রেখে মাকে বুকে আগলে নিলো । এই যৌবন বয়সে এসে ছেলেদের মধ্যে বহু পরিবর্তন আসে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সুঠাম দেহ, আর উচ্চতার তফাৎ। মায়ের থেকে বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছে শাহাদাত। এক কালে যার কোলে মুখ গুজত আজ তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে বেশ আনন্দই হচ্ছে “কি গো মা। কেমন আছো?”

ফুয়ারা বেগম কেঁদে উঠলেন। খুশির কান্না। শিকদার সাহেব এগিয়ে এলেন “বাজান। কেমন আছিস?”

সাথে বাকিরাও তড়িঘড়ি করে খাবার পানি আনলো। ছোটো বোন শিমুল একটা কাঠের চেয়ার এনে এগিয়ে দিল “ভাই জান”

সকলেই নানা প্রশ্ন, শাহাদাতের উত্তর, হাসি আড্ডায় বেলা কেটে গেলো। আজ এতগুলো বছর পর যেনো নিজের মাতৃভূমির বাতাস শাহাদাতকে জীবন্ত করে তুলছে। সে গোসলটা সেরে খাওয়া দাওয়া করে নিজের বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

শিকদার সাহেব এই গ্রামের জমিদার না হলেও কম ও নন। যুদ্ধে তার প্রশংসনীয় অবদান আর গ্রামের মানুষের যেকোনো বিপদ আপদে এগিয়ে আসা, দুইই যেনো তাকে সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে পরিণত করেছে।
অর্থের তেমন অভাব এবাড়িতে নেই। বলতে গেলে গোলা ভরা ফসল বারো মাসের বারো রকমের ফসল , পুকুরের মাছ, জমির ফল গাছগুলো, সব থেকে তাদের বাড়িতে যা উপার্জন হয় তা যথেষ্ট হবে আজীবন বসে বসে খাবার জন্য। এক কথায় ভাতের কষ্ট এবাড়িতে নেই।

উঠনটা শুকনো মাটিতে ঠনঠন করছে, একপাশে দুটো গোয়াল ঘর , চাচাদের গরু আছে কতকগুলো। আরেকপাশে তাদের টিনের ঘর। এই নব্বই এর দশকে টিনের ঘর মানেই বিরাট কিছু। যেখানে মানুষের বাড়ি বাড়ি ছই এর ঘর, সেখানে যাদের বাড়ি টিনের ঘর তারাই যেনো এক কথার বড়োলোক মানুষ। তার পাশেই দুই চাচার দুখানা টিনের ঘর। তার পাশেই অনেকগুলো আমগাছ।

বাড়ির ঠিক পেছনদিকে একটা পুকুর কাটা আছে। মূলত শৈল মাছে ভরপুর এই পুকুর। বাবার বড়ো শখের পুকুরখানা। মাছগুলোর যত্ন ও নেন তিনি খুব। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলো শাহাদাত। খুব ভালো লাগছে।

তবে মন চাচ্ছে আরেকটু দূরে হেঁটে আসতে। রীতিমত পুরো গ্রামটাই একবার চক্কর দিয়ে আসতে।
তাই কি করবে কি করবে? ছোটো বোন শিমুল কে ধরলো।

“শিমুল”
উঠোনে দাড়িয়ে ছিলো শিমুল। বয়স সতেরো হবে। ভাইয়ের ডাকে একমুখ হাসি মেখে উত্তর দিল “জ্বী ভাইজান”

শাহাদাত এগিয়ে গেলো “আচ্ছা আমাকে একটু গ্রাম ঘুরোতে নিয়ে যাবি? পথঘাট তো কিছুই চিনবো না। একবার গেলেই চিনে যাবো। ”

শিমুল মেয়েটা আবার স্বভাবতই চঞ্চল। ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হতে ওর কোনো দ্বিধা হলোনা “চলেন ভাইজান। আপনারে পুরো গিরাম একবার ঘুরায় আনি। এই পাড়া থিকা পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত” বলে সে হাটতে লাগলো।
শাহাদাত ও ওর পেছনে হাটতে শুরু করলো। পরনে নীল শার্ট , আর একটা লুঙ্গি। গ্রামীণ বেশভূষা যাকে বলা চলে। বোনটার সাথে খোশগল্প করতে করতেই গ্রামের বেশ কয়েক রাস্তা, বন জঙ্গল , অমুকের বাড়ি, অমুকের গোয়াল সবই একে একে দেখা হলো শাহাদাত এর।
অবশেষে দুই ভাই বোন এসে দাড়ালো নদীর পাড়ে। এক ঝাড় বাঁশ ঝাড়ের নিচে। নদীর স্রোতের ধাক্কায় বাতাস যেনো নিজের সর্বোচ্চ গতিতে ধাক্কা দিচ্ছে পাড়ের দিকে। যতদূর চোখ যায় শুধু নদীর অথৈ জল। কী যে মনোরম দৃশ্য।

শিমুল বাঁশপাতা আগার লম্বা কাঁচা ডগাগুলো বের করছিল মনের সুখে। ওদিকে শাহাদাত তাকিয়ে ছিল নদীর দিকে। হটাৎ তার চোখ গেলো তার বামদিকে । নদীর জলে লাফালাফি করা কিছু ছেলে মেয়ের দিকে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে । মনের সুখেই পানি নিয়ে খেলছে। খেলছে নদীর ঢেউএর সাথে।

কিন্তু বিষয়টা এটা ছিলনা। শাহাদাত এর চোখটা আটকে গিয়েছিল অন্যই এক দৃশ্যে।

চলবে……………

#স্মৃতির_পাতা (১)
#ফারহানা_শিফা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here