স্মৃতির পাতা, পর্ব:২

0
1994

#স্মৃতির_পাতা (২)
#ফারহানা_শিফা

খিলখিল হাসির শব্দটা, সেই দুর থেকেও ভেসে আসছিল শাহাদাত এর কানে। তবে চোখ যেথায় বেঁধে গিয়েছিল। সে ছিল অন্য কিছু।

সকালে যে মেয়েটা ওর নাম ধরে ডেকেছিল , ঠিক সেই মেয়েটা নিজেও বাচ্চাগুলোর সাথে নাইতে নেমেছে। দুর থেকে হলেও পরনের শাড়ি, আর শ্যামলা চেহারা দেখে চেনা যাচ্ছে এই মেয়ে সেইই। পরনের শাড়িটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে তার দেহ, মাথার ঘনো কালো চুলগুলো পিঠটাকে যেনো বহিরাবরণে আবৃত করে রেখেছে।মুখের চঞ্চল হাসি যেনো ওই পরিবেশটাকে আরো দুরন্ত করে তুলছে। শাহাদাত দুপা এগিয়ে গেলো।

কেয়া ততক্ষণে সঙ্গী সাথী ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়ে উঠে যেতে ব্যস্ত। এমনিও বিকেল হয়েছে আজ। বেশি ভিজলে সর্দি হতে পারে। পরে আরেক জ্বালা “এই তোরা, ওঠ ওঠ। বাড়ি যাইতে হইবো। বেশিক্ষণ গোসল করলে পরে মরবি”

হটাৎ এতো মুগ্ধকর দৃশ্যের বাহিরে কারো ডাকে শাহাদাত এর ধ্যান ভাঙলো “ভাই জান। কি দেহেন?”

শিমুল এগিয়ে গেলো “ওহ। ওরা তো হাকিম চাচার ছাওয়াল মাইয়ারা। আইছে কিয়া আপার লগে”

শাহাদাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো “কিয়া? কেয়া?”

শিমুল মাথা নাড়লো “হো, কিয়া আপা। রোজই ওগোরে নিয়া আহে”

শাহাদাত বোনটার দিকে তাকালো “কেয়া কে?”

শিমুল যেনো ভারী অবাক হলো “আরে ভাইজান” মলিন মুখে বলল “চেনেন নাই?”

শাহাদাত অবুঝের মতো মাথা নাড়লো “কে?”

শিমুল এবার বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল “আরে ভাইজান, কিয়া আপা। কিয়া। যার লগে আপনি ছোটবেলায় কত খেইলা বেড়াইতেন , সেই কিয়া আপা। মনে নাই? আমি কানতাম অথচ আপনারা আমারে খেলতে নিতেন না। কত যে গিরাম ঘুরঘুর কইরা বেরাইতেন আপনারা”

শাহাদাত বিস্ময়ের সহিত নিজের পেছনের দিকে তাকালো। ততক্ষণে কেয়া কাঁচা রাস্তায় উঠে গিয়েছে। দূরে তার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে।
শিমুল আবারো বললো “ভাইজান চলেন। অনেক দেরি হইয়া গেসে। বাকি নাহয় অন্য একদিন ঘুইরেন। আব্বা পড়ে বকবো” বলে সে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু শাহাদাত কিছুক্ষন স্তব্ধ দাড়িয়েই ছিলো। একসাথে খেলতো? কই ওর তো কিছুই মনে পড়ছে না।

___________

বেলাশেষে রাত্রির আগমন।
হেমন্তের এই ফুরফুরে সময়টায় চারিপাশে পাকা ধানের মো মো গন্ধ। বিশেষ করে কৃষক দের ঘরে। ঠিক যেমন শাহাদাত দের বাড়িতেও। একই গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে।

কাঠের বিছানায় বেশ আরামেই হাতপাখা নিয়ে শুয়ে ছিল শাহাদাত। ইলিশের তরকারি, আর নিজেদের ধানের ভাতে পেট টা যেনো তৃপ্ত আজ। বেশ ভালই কাটলো দিনটা। তবে একটা জায়গাতে গিয়েই শাহাদাত এর ঘুম হারাম।
কেয়া মেয়েটাকে নিয়ে।
ও কেনো যেনো কিছুতেই সেই পুরনো স্মৃতির পাতা থেকে মেয়েটার নামটা খুঁজেই পাচ্ছেনা। হয়তো পাতাগুলোয় ধুলো জমেছে। দীর্ঘদিন, সময়ের ব্যবধানে হয়তো পাতাগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে? হয়তো নামটা যে কালি দিয়ে লেখা হয়েছিল সেই কালি মুছে গিয়েছে। হয়তো কাগজটা মস্তিষ্কের অতি বুদ্ধিমান পোকে খেয়ে ফেলেছে? হয়তো?

ভাবতে পারেনা শাহাদাত। কি করলে সে কেয়াকে মনে করতে পারবে। কিভাবে ফিরে পাবে সেই স্মৃতিগুলো? ভাবতে ভাবতেই হাতপাখা আলগা হয়ে আসে তার। ক্লান্তি আর প্রশান্তির দুটোর সংমিশ্রণে ঘুমটাও যেনো ওকে জড়িয়ে ধরে।

_______________

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শাহাদাত আবিষ্কার করলো ফুয়ারা বেগম পায়েস রান্না করেছেন। নতুন ধানের চালের পায়েস। আহা কি গন্ধ। পুরো উঠোন যেনো এই ঘ্রানেই মোহিত হয়ে গিয়েছে।

ছেলেকে জোর করে ৩ পিরিচ পায়েস খাইয়েই ছাড়লেন ফুয়ারা বেগম। ছেলের ও তেমন আপত্তি হলোনা। বাবা গিয়েছে বাজারে। ইলিশ আনতে। কতকাল যে মায়ের হাতের সরষে ইলিশ খায়নি, শাহাদাত ভুলেই বসেছে সে স্বাদ। চাচা আর ভাইয়েরা মাঠে গিয়েছে ধান কাটতে। হয়তো ওদের সঙ্গ পাবেনা আজ শাহাদাত। মন তো এখনি চাচ্ছে একটু গ্রাম ঘুরে আসি। গতকাল শিমুল যে রাস্তাগুলো চিনিয়ে দিয়েছিল তা শাহাদাত এর মস্তিষ্ক খুব ভালো মতনই আগলে রেখেছে স্মৃতির পাতায়।
আজও নাহয় মুন্সী চাচার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে একটু মাঠের দিকে যাওয়া যাক?

ভাবতে ভাবতেই আনমনে হাটতে শুরু করলো শাহাদাত। গ্রামের কোন দৃশ্যটা আপনি নিজের অন্তরে ধারণ করবেন বলুন? কৃষকের মুখের হাসি, গোলা ভরা সোনালী ধান , ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব, সবুজ গাছ পালায় ছেয়ে থাকা শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, মাঠে মাঠে স্বর্ণের মত পাকা ধানের ছড়াছড়ি , আকাশের হলদে আভা। কোন সেই অমৃত চিত্রটা আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারে বলুন? আকাশের হলদে অাভাটা হয়তো ঋতুরাজ হেমন্তেরই পক্ষ থেকে আসা এক উপহার, যেনো মানুষ তার আগমনকে উপলব্ধি করতে পারে। বলতে পারে “ওহে হেমন্ত ! এবারেও কি চমৎকার সুসংবাদ হাতেই না তোমার আগমন হলো। ”

কৃষকের এমন স্বাগতম বাণীতে হয়তো হেমন্ত ও বলে উঠবে “আর থাকতে দিলে বা কই। এতো ডাকলে যে রামধনুর হলদে রঙকে টেনে নিয়ে এলাম। নাও, এবার হাসতে শুরু করো”
এভাবেই হয়তো কথোপকথন চলে।
তবে এই অতিমাত্রার সৌন্দর্য ধারণ ক্ষমতা হয়তো শাহাদাত এর নেই। এগুলো দেখলেই যেনো ওর মস্তিষ্কে আনন্দের জোয়ার ভেসে আসে, মন চায় চিৎকার করে প্রকৃতিকে ডাকি “ওহে সবুজ, আর কত বিস্ময় আর কত সৌন্দর্য নিজের মধ্যে গোপন করে রেখেছ? আর যে নিতে পারছিনা”
কে জানে এর উত্তরটা প্রকৃতি কিভাবে দেবে? ভাবতে ভাবতেই শাহাদাত হাজির মুন্সী চাচার উঠোনে। উনি সবেমাত্র খেয়ে উঠেছেন। একটু পর গরু গুলো নিয়ে যাবেন মাঠে। সেই প্রস্তুতি চলছে। চাচী শাহাদাতকে দেখে যেনো বিরাট খুশি হলেন “ওরে বাজান , আয় আয় বৈসে পড়। ঘরে আজ কিছু রান্দি নাই রে। তোর চাচা হাটে যাবে কাইলকে। আয়। পান্তা আর মরিচ মাখানো এই দিয়েই তোর আপ্যায়ন করবো” বলে মহিলা এগিয়ে গেলেন। উনি খুবই নরম মনের মানুষ। গ্রামের লোকজনদের খুবই আপন ভাবেন দুই বুড়ো বুড়ি। কেউ তাদের উঠোনে এলেই না খাইয়ে ফেরত পাঠান না তারা। তাদের আন্তরিকতা যেনো হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। শাহাদাত হেসে এগিয়ে গেলো।

“ওরে চাচী। খেতে আসিনি। তোমাদের নিতে এসেছি। ওঠো ওঠো , এইসব ছাড়ো বাড়ি চলো। মা পায়েস রান্না করেছে তোমাদের নিয়েই তবে ফিরবো”

বুড়ো হেসে উঠলেন “এই না হলি আমাগে ছাওয়াল (ছেলে) শহরে যাইয়েও মিষ্টি কথা ভোলে নাই”

শাহাদাত এগিয়ে গিয়ে বুড়োর হাতের পানের ডালা থেকে একটা পানের কোনা থেকে একটু ছিড়ে মুখে নিলো “বুড়ো শোনো। মেয়ে তো বিয়ে দিয়েই দিলে আমাকে তো খবর পাঠাও নি। তো এখন সেই শাস্তি পাবেনা?মিষ্টি কথায় ভুলো না আবার। ”

বুড়ো বুড়ি দুজনে হেসে উঠলো।
এক কথা দু কথায় বেশ কিছুক্ষণ পার করে শাহাদাত উঠে দাড়ালো । এই বাড়ির পেছন দিকে ঝোপের রাস্তা পেরিয়েই কাচা রাস্তা ধরে এগোলেই মাঠ। মাঠের আশপাশে দু চারখানা বাড়িঘর আছে বৈকি। শাহাদাত হাটতে হাটতে মাঠে এসে পৌঁছলো । এখান হতে শুধু মাঠ আর ফসল দুর দুর পর্যন্ত বিস্তৃত। দূরে কতক জন কৃষকের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। যাই সেদিকেই হাঁটা যাক।

ফাঁকা মাঠে হাঁটার মজাটা কোথায় জানেন? সাই সাই করে বাতাস এসে ধাক্কা দেয় , চারিদিকে শুকনো মাটির গন্ধ, পায়ে উড়ে আসা ধুলো, মাথার উপর আকাশ, আকাশে সূর্যের উত্তাপ। সব যেনো এক অন্নই প্রশান্তি নিয়ে আসে। এই না হলো গ্রাম বাংলা। কবি ঠিকই বলেন
“স্বার্থক জনম জন্মেছি এই দেশে”

খানিকটা এগোতেই শাহাদাতের চোখ আটকে গেলো এক মেয়ের উপর। আরেকটু এগোতেই স্পষ্ট হলো এই সেই মেয়েটা । কেয়া যার নাম। পাশেই তার বাবার বয়সি দুজন লোক মাটিতে বসে গামছা পেতে তারউপর থালায় ভাত খাচ্ছেন। তাদের দুজনের চোখ গেলো শাহাদাত এর উপর। যেনো কোনো আগন্তুকের আগমন। এক লোক বলে উঠলেন “শাহাদাত না?”

সাথে সাথে কেয়াও নজর তুলে তাকালো। হয়তো সে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি ছেলেটা যে তার পাশেই দাড়িয়ে আছে। শাহাদাত হেসে বললো “জ্বী চাচা”
লোকটা আসলে কেয়ার বাবা। আহমদ মিয়া। তার পাশেই তার ভাই মুহাম্মদ মিয়া। কেয়া এসেছিল মাঠে ভাত দিয়ে যেতে। কেয়া নিজের শাড়ির আঁচলটা মাথায় লেপ্টে নিলো। আর বসা থেকে দাড়িয়ে পড়লো। আহমদ মিয়া বললেন “আরে বাজান বসো বসো। কিয়া গামছা ডা দে বিছায়”

শাহাদাত মাথা নাড়লো “না না চাচা। খাওয়া শেষ করেন আমি আছি।” শাহাদাত যদিও তাদের চিনতে পারেনি। তবুও তা বুঝতে দিলনা। হেসেই কথা বলতে লাগলো। পাশে দাড়িয়ে কেঁয়াও তাদের কথা শুনছিল। কিন্তু গতকালকের শাহাদাত এর আচরণ ওর মোটেও পছন্দ হয়নি। একপ্রকার গাঢ় অভিমান নিয়েই সে মুখ ঘুরিয়ে দাড়িয়ে আছে। থাক। শহুরে গিয়ে যখন ওকে ভুলেই গিয়েছে, তখন আর কি বলবে কেয়া? এক্ষেত্রে দূরে থাকাটাই শ্রেয়।

আহমদ মিয়া হাসতে হাসতে বললেন “কি বাজান। ছোটো কালে তো আমার মাইয়ারে নিয়া এই মাঠ দিয়া দৌড়ায় বেড়াইতা, আইসা আমারে কতই না সাহায্য করিতা। মনে আছে তো ওইসব কথা?” মুহাম্মদ মিয়া হাসলেন “আরে ভাইজান মনে আছে। একবার আমাগো গরু লাগছিল ওর পেছনে। কি জোরেই না চিৎকার দিসিলো শাহাদাতে। পরেরদিন শিকদার ভাই বহুত ঝারসিল ওরে।”

এসব কথাবার্তার একটাও শাহাদাত এর মনে নেই। মনে আসছেনা। বিধায় সে কোনমতে মলিন মুখে তাকিয়ে আছে। আর তার চোখের কথাগুলো কেয়া খুব সহজেই পড়ে নিয়েছে। কেয়া ভালো মতনই জানে শাহাদাত কিছুই মনে করতে পারছেনা।
বেশ খানিকক্ষণ গল্প আড্ডার পর কেয়ার বাবা , চাচা উঠে দাড়ালেন “বাজান। এই রইদে খাড়ায় থাকবা কেমনে? তার চেয়ে ভালো বিকালে আইসো। এখন যাও বাড়ি যাও। ”

শাহাদাত ও চিন্তা করলো কথাটা ঠিকই বলেছেন উনি। এমনিও ওর মাঠ ঘোরা তো হয়েছেই। আর কি চাই? কেয়াও যাবার প্রস্তুতি নিলো। আহমদ মিয়া বললেন “কিয়া, বাজানরে আমাগো বাড়ি লইয়া যা। তোর মায়ে ওরে দেইখা খুশি হইবো”

কেয়া প্রতুত্তরে কিছুই বললোনা। মাথা নেড়ে হাটতে শুরু করলো। শাহাদাত ও বিদায় জানিয়ে কেয়ার পেছনে যেতে লাগলো। কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পরেও কেয়া চুপ করে আছে। এদিকে শাহাদাতের মনে বহু প্রশ্ন। বহু চিন্তা। উত্তরগুলো একমাত্র এই মেইয়েটাই দিতে পারবে। কিন্তু কথা বলা কি দিয়ে শুরু করবে শাহাদাত খুঁজে পাচ্ছেনা। অবশেষে বলেই বসলো “কেয়া”

দ্রুতপদে হাটতে থাকা মেয়েটার পা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। শাহাদাত ছিলো ঠিক ওর পেছনে “আসলে…..”

“জানি, তোমার কিছুই মনে নাই” বলে কেয়া আবারো হাটতে শুরু করলো। শাহাদাত অবাক। মেয়েটা কি মন পড়তে পারে?

“দেখো, আমি তো বহু বছর পর ফিরেছি। তাই হয়তো…..”

কেয়া হেসে উত্তর দিল “তাই হয়তো অপ্রয়োজনীয় জিনিস মন থেকা মুইছা দিসো….”

“ব্যাপারটা তেমন না। দেখো” বলে শাহাদাত কেঁয়াকে পেরিয়ে ওর সামনে মুখোমুখি দাড়ালো “এটুকু তো সাহায্য করতেই পারো। যেনো আমার সবকিছু মনে পড়ে যায়?”

কেয়া কী যেনো চিন্তা করলো। ওর মুখের ভঙ্গিমা দেখে শাহাদাত বুঝতে পারলনা ওর মনে কি চলছে। হটাৎ কেয়া ওর বাম হাতটা ধরে পাশের এক সরু পথে ঢুকে পরলো। সুপারি বাগান বলতে গেলে এটা। লম্বা লম্বা সারি বাঁধা সুপারি গাছ। মাঝে মাঝে আবার এক দুটো ছোটো ছোটো গাছ ও আছে। তারই এক পাশে আবার একটা বাঁশ ঝাড়। রোদের আলো এইখানে তেমন একটা আসেনা। কেয়া শাহাদাত এর হাত ছেড়ে বাঁশ ঝাড়ের নিচে গিয়ে হাতের গামছা বাঁধা থালা গুলো মাটিতে রেখে ঘুরে তাকালো। আজ ওর চুলগুলো খোঁপা করা। মাথার ঘোমটা ফেলে দেওয়ায় ওকে অন্য রকম লাগছে এখন।

“এইযে এই বাঁশ ঝাড়। মনে পড়ে কিছু?”

শাহাদাত ভ্রু কুঁচকে ঝাড়ের উপর থেকে নিচ অবধি চোখ বুলিয়ে নিলো। কেয়া জানে ওর কিছুই মনে নেই “এইখানে আমরা নিচের পাতাগুলো সরাইয়া মাটির হাড়ি পাতিল নিয়া খেলতাম। মনে নাই?”

শাহাদাত খুব অবাক হলো। পুরুষ জাত আবার হাড়ি পাতিল নিয়ে কিভাবে খেলে? কেঁয়া থাকার টপলা হাতে তুলে এগিয়ে গেলো “এইযে এই জোড়া লাগা সুপারি গাছটার নিচে বইসা তুমি কাঠাল পাতা বেচতা। আমি ঐখানে হাড়িতে মাটির গুড়ি ভইরা ভাত রান্না কইরা আন্তাম। মনে আছে ওই বাড়ির হাসু ও আমাগো লগে খেলতে আইতো। ” বলে মনের সুখে হাসতে হাসতে এগোতে লাগলো কেয়া। আর ওর পেছন পেছন বিস্ময়ের সহিত শাহাদাত ও এগোতে লাগলো।

একে একে একেকটা জায়গা দেখিয়ে দেখিয়ে কেয়া বলতে লাগলো “ঐযে দেখো। হাসুর বাড়ি। জানো ওর বাপের না এখন অসুখ হইসে। অনেক কষ্ট ওগো দিন যায়। বহুত খারাপ লাগে আমার। ”
শাহাদাত তাকিয়ে দেখলো পুরনো শন এর ঘর। ছোট্ট ঘরে হাসু, ওর বুড়ো মা বাবা থাকেন। কেয়া আরেকটু এগিয়ে গেলো “ওই দেখো ময়না চাচীর বাড়ি। মনে আছে একবার তুমি একটা পিঠা খাইতে খাইতে আইতাসিলা, আমি পেছনে ছিলাম তোমার। পিঠা ছিলো তোমার হাতে। এইটা দেইখা একটা কুকুর আমাগো ধাওয়া করসিল? মনে আছে কত জোরে দৌড় দিসিলা তুমি।” বলে কেয়া হাসতে লাগলো ।

শাহাদাত এর কিঞ্চিৎ মনে আসছে যে হ্যাঁ ও এক কুকুরের পাল্লায় পড়েছিল । কিন্তু ওর সাথে কোনো মেয়ে আদৌ ছিল কিনা, ওর খেয়াল নেই। কেয়া হেঁটে একটা ডোবার সামনে দাড়ালো “এই পচা ডোবায় কিন্তু আগে পাট জাক দিয়া রাখতো। আমরা রোজ এইখানে আসতাম তখন। হাসু ও থাকতো।আরে ঐদিকে আম গাছের আম যে কত চুরি করসি। আচ্ছা সামনে চলো। দেখো মফিজ চাচার মরিচ আর বেগুনের বাগান। মনে আছে আমরা এইখান থেকে মরিচ চুরি কইরা নিয়া বাজারে হাটের দিন গিয়া বিক্রি কইরা আসতাম। আর ওই টাকা দিয়া মালাই কিনা খাইতাম।”

এক পর্যায়ে কথা বলতে বলতে একটা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেলো কেয়া। ঘুরে তাকিয়ে বলল “এই ডান দিকের রাস্তা ধইরা আগায় যাও। রহমত চাচার বাড়ি পড়বো। তার উঠান দিয়া বের হইয়া ডান দিকের রাস্তা দিয়া হাইটা গেলেই তোমার বাড়ি। যাও” বলে কেয়া ঘুরে দাড়াতেই শাহাদাত বলে বসলো “কেনো তোমার বাড়িতে নেবে না আমায়?”

চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ মাঝে কেয়ার নিঃশব্দতা। শাহাদাত উত্তরের অপেক্ষায়।

“যারে মনেই রাখো নাই তার বাড়িতে গিয়া আর লজ্জা দিও না নিজেরে। এই বাড়ির রাস্তা তোমার উদেশ্য না” বলে অভিমানী মুখে কেয়া নিজের বাড়িতে ঢুকে গেলো।
শুধু সকালের আলো আর শাহাদাত এর বিস্ময় পড়ে রইলো জায়গাটায়।

_______________

বিকাল গড়াইয়া সন্ধ্যার উপক্রম। শিউলি মাত্রই ঘরে ফিরেছে। সারাদিন কোথায় কোথায় দিয়ে ঘুরে বেড়ায় কে জানে।

শিউলি ঘরে আসতেই শাহাদাত ডেকে উঠলো “শিউলি এদিকে আয় তো”

শিউলি কাছে যেতেই , শাহাদাত নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো “আমি কিছু প্রশ্ন করবো ঠিক ঠিক উত্তর দিবি?”

“জ্বী ভাইজান”

“কিচ্ছু লুকাবি না”

“জ্বী”

শাহাদাত এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলো “মা কি কেয়াদের বাড়িতে যায়?”

শিউলি হাসলো “আরে , পরশুদিন তো যাইবো।”

শাহাদাতের চোখজোড়া চকচক করে উঠলো “সত্যি! কখন?”

“উমমম, হয়তো বিকালে। সকালে তো …..”

“শিউলি” তখনি ফুয়ারা বেগমের ডাক পড়লো। শিউলি বাকি কথা শেষ করতে পারলো না। চলে গেলো মায়ের কাছে। এদিকে শাহাদাত কোন কারণে যে এত খুশি ও জানেনা। ওর মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছে। কোনোভাবে কেয়ার সাথে কথা বলতে হবে। মেয়টা কেমন যেনো খুব আপন আপন ভঙ্গিমায় ওর সাথে মেশে। যদিও লোকচক্ষুর আড়ালে ওদের কথা বলতে হবে, নয়ত মানুষ উল্টো পাল্টা ভাবতেই পারে। গ্রাম তো তাই। শহুরে অবশ্য ছেলে মেয়ের কথা বলা খুবই সাধারণ ব্যাপার। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এই বিষয়টা বুঝেছে শাহাদাত। সেখানে ওর অনেক সহপাঠী, সখি, বন্ধু আছে। তাই ওর কাছে এগুলো কোনো ব্যাপার না।

চলবে……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here