স্মৃতির পাতা, পর্ব:৩

0
2037

#স্মৃতির_পাতা (৩)
#ফারহানা_শিফা

বেলা হয়েছে আরো আগেই। কিন্তু বেচারা শাহাদাত এর ঘুম ভাঙলো সবেমাত্র। বাহিরে খুব লোকজনের হাসি ঠাট্টার আওয়াজে ওর ঘুমটা নাই হয়ে গেল।

অগোছালো চুল, ঘুম ঘুম ভাব, কাঁধে গামছা নিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ঘর থেকে নেমে উঠোনে আসলো শাহাদাত।

“ও ফুয়ারা , তোমার ছাওয়াল দেহি লাজ শরম রাখে নাই। ” বলে একদল মহিলারা হো হো করে হেসে উঠলো।
ব্যাপার কি?
শাহাদাত বুঝে ওঠার আগেই ওর মা বললো “তোমাগো তো আরো শরম নাই। আমার পোলার দিকে তাকাও ক্যান। ঘরের ব্যাটার দিকে গিয়া নজর দাও”
এতক্ষণে শাহাদাত তাদের কথা এড়িয়ে টিউবওয়েল এর দিকে গেলো। মুখ ধুতে হবে। কলের হাতলের সাথে রশি দিয়ে বাঁধা তুষ পোড়ার (কয়লা গুড়ো) বোতল থেকে তুষ পোড়া খানিকটা বাম হাতের তালুতে ঢেলে নিলো। আর ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে তুষ নিয়ে দাঁতে ঘষতে লাগলো।

হটাৎ কত্থেকে এক পরিচিত সুর কানে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে মহিলাদের দিকে তাকালো। আর রীতিমত অবাক হয়ে গেল। কেয়া একটা হাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর ওর মায়ের সাথে গল্প করছে। ও কোথা থেকে এলো? নাকি তখন ঘুম চোখে শাহাদাত খেয়াল করেনি?

এক পর্যায়ে কথা বলতে বলতে কেয়া আড়চোখে একবার শাহাদাত কে দেখলো। আর দ্রুত নিজের চোখ সরিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। শাহাদাত এর অর্থ বুঝতে পারলো না। সে দ্রুত দাঁত মেজে কোনমতে মুখ ধুতে শুরু করলো।

ওদিকে মহিলারা সব একে একে ফিরতে শুরু করেছে। শাহাদাত মুখ ধুয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কল পাড় থেকে নেমে এলো। ঠিক তখনই কেয়া ওর পাশ ঘেঁষে হেঁটে গেলো আর বলেও গেলো “কি, পর মহিলা গাঁ দেখাতে শরম করেনা? ” বলে সে হাড়ি হাতেই চলে গেলো।

শাহাদাত মুখ থেকে গামছা নামিয়ে সত্যিই নিজেকে শুধুমাত্র একটা লুঙ্গিতে গামছা গলায় আবিষ্কার করলো। উফফ, এজন্যই মহিলারা……. যাকগে। কিন্তু কথা হলো কেয়া পর্যন্ত ওকে লজ্জা দিয়ে গেলো? ভারী শরমের ব্যাপার।

এই রাগে শাহাদাত তেড়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাড়ালো “মা, ওরা কেনো এসেছিল?”

“আরে, এমনি আইছিল। ক্যান তোর আবার কি হইলো?”

“কিছুনা” বলে সে মুখ ফুলিয়ে একটা টুল এ বসে পড়লো। ওর মা হাসলো “আরে ওরা তো শয়তানি করসে। পাগল”

শাহাদাত মাথা নাড়লো “কেয়া কেনো এসেছিল? মানে কোনো কাজে?”

“আরে হো। ওর মার কাছ থিকা হাড়ি আনছিলাম গত সপ্তাহে। ঐটাই ফেরত নিতে আইছিল।”

শাহাদাত আর কিছু বলল না। মনে মনে ভাবতে লাগলো মেয়েটা কি কোনোভাবে কোনো বাহানায় এই বাড়িতে আসলো। নাকি সত্যিই হাড়ি নিতেই এসেছিল? একবার ব্যাপারটা দেখতে হবে।

_______________

খেয়ে দেয়ে শাহাদাত আজও গ্রাম ঘোরার উদেশ্যে বেরোলো। তবে একা। কাওকে না বলেই। হাটতে হাটতে ঠিক সেই সুপারি বাগানের ভেতর ঢুকে গেলো। কেনো? ও জানেনা। ব্যাস মন চাইলো একটু ঘুরে আসি। তাই হয়তো?

বাঁশ ঝাড়ের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত দিয়েই তাকিয়ে ছিল শাহাদাত। ঠিক তখনই পেছনে কেমন একটা শুকনো পাতা মরমরে আওয়াজ। সে বাকা ঠোঁটে হাসলো “জানতাম তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে” বলে ঘুরে তাকালো।

দূরে কেয়া আমতা আমতা ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে “জানতাম তুমি এইখানে আসবা” বলে কেয়া একপা একপা এগোতে লাগলো। শাহাদাত মৃদু হাসলো “সকালে ওভাবে বললে কেনো?”

“কোনভাবে?” যেনো সে জানেই না। শাহাদাত গিয়ে ওর মুখোমুখি দাড়ালো “যেভাবে বলেছিলে”
কেয়া ভাব নিলো “তো যেভাবে দাড়ায় আছিলা। ”

“কেনো তোমার শরম করে নাকি আমার দিকে তাকাতে?” শাহাদাত নরম সুরে বলল।
কেয়া কথা বলতে বলতে থেমে গেলো “হুম?”
শাহাদাত আরো মলিন সুরে বলল “কেমন দেখাচ্ছিল বলো তো?”
কেয়া এবার একটু লজ্জাই পেলো। ঘুরে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়াল “চলো আজকে উত্তর পাড়ায় যাই। ঐখানে তো রোজই যাইতাম আগে” বলে কেয়া চোখ লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা করলো।
শাহাদাত ও আর কথা বাড়ালো না।
হাটতে শুরু করলো।

কথায় বলে “গ্রামের মানুষ দশ গ্রাম চেনে”
কেয়াও তেমনি। কোন রাস্তা, কোন জঙ্গল, কোন দিক দিয়ে গেলে কোন পাড়ায় পৌঁছব, কোন পাড়ায় কার বাড়িতে কে থাকে সবই ও জানে। চঞ্চলা যে। তাই হয়তো।

“জানো তুমি যখন ছিলা না তখন এই আম গাছটার নিচে আইসা বইসা থাকতাম। আর পাশের পুকুরের দিকে তাকায় থাকতাম”

কেয়ার কথা মোতাবেক শাহাদাত তাকালো। রাস্তার পাশে একটা বড়ো মোটা আম গাছ। তার পেছন দিকে একটা শ্যাওলা জমা পুকুর। ঘাট বাঁধা নেই। হয়তো কেউ গোসল করতেও আসেনা। কেয়া বলতে লাগলো

“তোমার হয়তো মনে আছে। আমরা যেদিন কোনো কাজ কাম পাইতাম না। খেলতেও মন চাইতো না , এইখানে আইসা বইসা থাকতাম। তুমি গাছে উঠতা। আমি নিচে থাকতাম। বা দুইজনেই গাছে উঠতাম। তারপর লোকজন নিচ দিয়া গেলে তাগোরে ভয় ও দেখাইতাম” বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো কেয়া।

“মনে আছে একবার ময়না চাচী এইখান দিয়া যাইতাসিল , তুমি আর আমি এমন ভয় দেখাইছি , আল্লাহ উনি পরে শিকদার চাচারেই বিচার দিয়া বসে” বলে কেয়া থামলো।

শাহাদাত ওর দিকে তাকিয়ে ছিল “হয়তো তখন আমাকে তিনদিন ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল তাইনা?”

কেয়া বিস্মিত চোখে তাকালো “মনে পড়ছে?”

শাহাদাত আফসোসের সহিত শ্বাস টেনে নিয়ে বললো ” আব্বা এক রাইতে অনেক মারছিলো। হয়তো দুই দিন ঘর বন্দিও ছিলাম। এটুকু চোখের সামনে ভাসছে”

কেয়ার হাসিটা মিলিয়ে গেলো ” হুম। পাড়ার মধ্যে তোমার আমার বন্ধুত্ব ছিলো সবার হিংসার কারণ। আরে কেউ ত করো এতো ভালো বন্ধু ছিলনা। আমরা কত কত দুষ্টামি করতাম। কত জ্বালাইতাম মানুষেরে। হয়তো তারা অতিষ্ট হইয়া গেসিলো”

“বন্ধুত্ব!” শাহাদাত মনে মনে ভাবলো।

“তোমার সাথে কাটানো সব সব মুহুর্ত আমার মনে আছে। ওই রাতে চাচায় তোমারে অনেক মারছিলো। কিন্তু তুমি তো তুমিই। তুমি পরেরদিন লুকায়া আবার আমার কাছে আইসা গেছিলা। পরে তোমারে বিনু আপার কাছ থেইকা একটা মলম আইনা দিসিলাম। তোমার পিঠে কয়টা দাগ পড়ছিল জানো” কথাটা বলতে গিয়ে যেনো কেয়ার কণ্ঠ ভার হয়ে আসে।

শাহাদাত সে মুখ খানা পরম যত্নে লক্ষ্য করতে থাকে। কেয়া আবারো বলতে শুরু করলো “তুমি যেদিন গ্রাম ছাইরা গেছিলা ……..” কেয়ার মুখের বিষণ্ণতা যেনো আরো গভীর হলো।

“তারপর?” শাহাদাতের বুকটা কেমন যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো “বলো”.

কেয়া ফিক করে হেসে উঠলো “ঐযে বাবরা গাছটা। ঐটার পেছনে লুকাইয়া ভুত সাইজা আমারে ভয় দেখাইতাসিলা , আমি প্রথমে বুঝিনাই। পরে তোমারে অনেক মারছিলাম।” বলে কেয়া আগের কথাটা এড়িয়ে গেলো। শাহাদাত তাকিয়ে দেখলো ডানদিকে একটা খোলা মাঠের মতো অংশের মাঝ বরাবর একটা বাবরা গাছ। সাধারণত এই গাছগুলো একটু দেখতে ঝোপ ঝাড়ের মত খুব গুমুট ভাবে মাথা ঝুঁকিতে দাড়িয়ে থাকে তো….. তাই যেকোনো পরিবেশেই এই গাছকে দেখলে গা ছমছম করবে। গ্রাম বাংলার ভয়ানক দিকটা হয়তো এই “গাব গাছ, শ্যাওড়া গাছ, তেতুঁল গাছ, বাবরা গাছ, তাল গাছ” এগুলোই মিলিয়ে থাকে। আরেকটা ভৌতিক সৌন্দর্য।

তবে এ ক্ষেত্রে এই সৌন্দর্যটা হৃদয়ে তো দূরে থাক , চোখ নাক কান এমনকি অনুভূতিতে ও কেউ ধারণ করতে চাইবে না। অসম্ভব। ভাবতেই শাহাদাত এর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সে দ্রুত কেয়ার পাশে পাশে হাটতে শুরু করলো। কে জানে , ছোটো বেলায় এত সাহস কত্থেকে পেয়েছিলো সে।

“আচ্ছা শহর কেমন হয়?” কেয়া ওর দিকে তাকালো।

“যেমনটা হওয়ার” শাহাদাত এতো সোজা উত্তর দেবে এটা কেয়া আশা করেনি। “আরে ধুর। একটু ভালো কইরা কও। আমারও তো জানতে মন চায় কি সেই জিনিস যেইটা তোমার আমার থেকাও বেশি প্রিয় হইয়া গেলো?” বলে কেয়া ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।

শাহাদাত থেমে গেলো। প্রিয়! *এ কেমন কথা? ”

কেয়া বললো “হুম । আমি তো বহুত বকবক করি। জানোই তো। তুমিও কিছু কও”
শাহাদাত একটু চিন্তা করলো। কি? ওই জানে। তারপর মাথা নাড়লো “আশপাশে কোনো পুকুর নেই? ঐখানে চলো” কেয়া সায় ও দিল।

“আছে তো। চলো” বলে ওকে নিয়ে পাশের একটা খোলা জায়গায় কলা বাগানের পাশে মাঝারি আকারের একটা গর্ত যেটায় পানি জমে ছিল তার পাশে নিয়ে গেলো “এই জায়গাটা না আমার খুব প্রিয় জানো” বলে কেয়া ঘাসের উপর বসে পড়লো। শাহাদাত ও তাকিয়ে দেখলো আসলেই জায়গাটা একটা ছোট্ট স্বর্গ। পাশেই সারি সারি কলা গাছ। এইযে ছোট্ট শ্যাওলা পানির গর্ত, খালি মাঠে মত ছোটো জমি , দুরদুর কেউ নেই, সাথে দু চারটে লেবু গাছ ওর পাশে সটান হয়ে দাড়িয়ে আছে।

লেবু পাতার ঘ্রাণ যেনো ওকে আরো প্রকৃতির প্রেমে আবদ্ধ করে নিচ্ছে। লেবু পাতার ঘ্রাণটা কিন্তু খুবই তীব্র হয়। অনেকটা টক , তারপর ঝাঁঝালো, তারপর তিক্ত। এই তিনটে স্বাদ নিয়ে লেবু পাতার গঠন। ছিড়ে মুখে নিলেই বোঝা যায়। তবে এই স্বাদ দীর্ঘক্ষণ জিভে লেগে থাকেনা। মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায়। তেতুল পাতার মতো।

“জানো তুমি গ্রামে ছিলানা। তখন একদিন আমি এই রাস্তায় আসার সময় দেহি এই জায়গাটা। জমির মালিক ও ঢাকা থাকে। তাই এই জমিতে কি হয় না হয় করে দেহে না। আমি প্রায় প্রতিদিনই এইখানে আসতাম। আইসা কিছুক্ষন বইসা থাকতাম। কিছুক্ষন গান করতাম। মাঝে মধ্যে মন খারাপ হইলেও এইখানে আইতাম। ভাললাগত। এইখানে কিছুক্ষন নিরবে বইসা ওই লেবু গাছের দিকে তাকায় থাকার না একটা অন্য রকম মজা আছে জানো”

শাহাদাত কেয়ার পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ল ” নির্জনে একা ভয় করেনা?”

“ভয়? আরে না। আমার সাথে তো তুমি থাকতাই” বলে সে হাসলো।

“মানে?” শাহাদাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো ….

“উম্ মমম। মানে, আমি একা একা ভাবতাম তুমিও আমার সাথে আছো। আমরা একলগে বইসা গল্প করতাসি। একলগে এইখানে দেখা করি”

“একটু বেশিই কল্পনা করো তুমি” বলে শাহাদাত ঘাসের দিকে তাকালো। হাতের নিচে শুকনো ঘাস।যেনো মাটির পরিচ্ছদ।

“তোমার তো শহুরে অনেক মানুষ। কল্পনা করা লাগেনা। হাহ, আমার এইখানে তো আর কেউ নাই। ছিলনা। হয় ও নাই। তাই হয়তো কল্পনার সঙ্গেই নিজেরে জড়াইয়া নেই” খুব উদাসীন সুরে বলল কথাগুলো কেয়া।

শাহাদাত বুঝতে পারলো হয়তো ও একটু মনমরা হয়ে যাচ্ছে “আচ্ছা শোন।আমি শহুরে কি কি করেছি”

কেয়ার মনমরা ভাব কিছুটা দুর হলো “হুম কও”

_________

একে একে তিনটে ঘণ্টা পার করে গেলো। আসরের আজান দিয়েছে একটু আগেই। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে এসেছে সেই ধ্বনি। দুজনে খোশগল্পে মেতে উঠেছে

“কিন্তু বুঝলে, শহর ওতো ভালো জায়গা না। কেউ কারো দিকে তাকায় না। বাপ মার চিঠি পৌঁছায় না। টাকা ছাড়া থাকা যায়না”

কেয়া নিজের দুই হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে মৃদু হাসলো “কিন্তু অনেক বন্ধু পাওয়া যায় তাইনা?”

শাহাদাত নিশ্চুপ চাহনিতে তাকালো।

“তোমার তো ইশকুল কলেজের অনেক বন্ধু হইসে। মাইয়া ও পোলা ও। ওগোরে ও নিয়া আইতা। সবাই একলগে ঘুরতাম। ” কেমন একটা অভিমানী অভিমানী ভাব আছে মেয়ের কথাগুলোতে।

“তারা সবাই সহপাঠী। খুব ঘনিষ্ট বন্ধু না। আবার শত্রুও না” শাহাদাত কোনমতে বুঝ দিতে চাইলো। কিন্তু হায়, মেয়ে মানুষের মন। কি বুঝ দেবেন আপনি? কেয়া হাসলো “কি শাক দিয়া মাছ ঢাকতে চাও নাকি?”

শাহাদাত মাথা নাড়লো।
কেয়া হাসলো “আগামীকাল বিকালে আমাগো বাড়ি আইসো না” বলে সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

“কেনো?”

“উমমম, এমনি। উত্তরটা তো জানোই” কেয়া নিজের পরনের সুতি শাড়ি ঠিক করতে করতে উঠে দাড়ালো “চলো বাড়ি ফিরি। ” বলে হেঁটে সে লেবু গাছের কাছে গেলো। আর চার পাঁচটা কঁচি পাতা ছিড়ে হাতে নিলো “চলো” বলে নিজেই হাটতে শুরু করলো।

শাহাদাত সত্যিই হতাশ। মেয়েটা বড্ড হেয়ালী করে। খুব। কিন্তু শাহাদাত ও এক কথা দুবার জোর করেনা। হয়তো মুদ্রাদোষ তার। তাই হয়তো মেয়েটা প্রত্যেকবার পার পেয়ে যাচ্ছে। যাকগে। বাড়ি ফেরা যাক। বেলা কম হলোনা।

বাড়ি ফিরতে পথে অনেকের সাথেই দুজনের দেখা হলো। কথা হলো। যদিও লোক তাদের আড়চোখে দেখছে। কিন্তু তাতে দুজনের কিছুই যায় আসেনা।
যখন দুজনে শাহাদাত এর বাড়ির থেকে পাঁচ মিনিটের পথের দূরত্বে তখন কেয়া নিজের হাতের লেবু পাতাগুলো ওকে ধরিয়ে দিল “চাচীরে কইবা এই পাতা, তেতুল, লবণ পানি মিলাইয়া সরবত বানায় খাওয়াইতে। ভালো লাগবে। যাও বাড়ি চইলা যাও। সাবধান” বলে আর এক মুহুর্ত ও দেরি করলো না কেয়া। নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
পাছে শাহাদাত ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।

গ্রামের আরো একটা চমৎকার জিনিস। এই লেবু পাতার সরবত। অনেকে হয়তো খেয়েছেন? অনেকে শোনেননি হয়তো।
গ্রামে গঞ্জে মানুষ এই কাজটা করে। কিছু কচি লেবু পাতা ছিড়ে এনে একটা বাটিতে দুই চার কোয়া পাকা তেতুল, লবণ, মরিচ আর এই লেবুপাতা একসঙ্গে মাখিয়ে তাতে পানি দিয়ে সরবত বানিয়ে খেতো। সত্যিই খুব দারুন স্বাদের হয় এটা। টক ঝাল স্বাদের পানীয়। চেষ্টা করতে পারেন আপনিও।

যাকগে বাড়িতে ঢুকে শাহাদাত তাই করলো । মাকে বলে সরবত বানিয়ে খেলো। সুস্বাদু পানীয়। এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
কিন্তু আপাতত কাঠের জানালার ওপাশের নারিকেল গাছটার দিকে তাকিয়ে শাহাদাত চিন্তায় মগ্ন। কেয়া কেনো ওকে যেতে নিষেধ করলো? কাল যদি মা যায় নিশ্চই ওদেরকেও নিয়েই যাবে। তাহলে সমস্যা কোথায়? ওর অভিমান? হয়তো!

_________________

“কিরে শিউলি আর কতক্ষন লাগতো তোর। ঐহেনে কিয়ার মা বৈসে আছে। জলদি আয়”

হেমন্তের আরেক বিকেল। কড়া রোদে ধান সেদ্ধ করা শেষে ধান এর টিন ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে শাহাদাত আর ওর চাচাতো ভাই। শিউলি তখন ঘরে সাজগোজ করছে। কেনো কে জানে। তখনি ফুয়ারা বেগমের ডাক। শাহাদাতের মনে অজানা আশঙ্কা বাঁধলো। নিশ্চই মা ওকে সাথে নেবেন না। যদি নিতেন তাহলে আরো আগেই ওকে তৈরি থাকতে বলতেন। শাহাদাত হাতের কাজ শেষ করে মায়ের সামনে এসে দাড়ালো “কিগো মা, কোথায় যাও?”

“আরে কিয়ার বাড়ি। এমনিই দেরি হইয়া গেছে আর….”

“এইতো আইছি” বলে শিউলির আগমন। ফুয়ারা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে শাহাদাত তো আগে থেকেই বুদ্ধি করে রেখেছে। সেই মোতাবেক শিউলিকে চোখ টিপি দিলো। শিউলি ও বুঝে গেলো।

“মা , আমরা তো যাচ্ছি। ভাইজান রেও লইয়া চলো। চাচা আর শরীফ ভাই ওনারা তো মাঠে যাইবো। ভাইজান একা বাড়ি কি করবো?”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ফুয়ারা বেগম কেমন যেনো করলেন “ঐহানে মাইয়া মানুষ যায় ব্যাটা মানুষের কাম নাই” অনেকটা কড়া গলাতেই বললেন।

শিউলি ও চালু মক্কেল “হো তো ভাইজান রে কি দেখাইতে নিয়া যাইতাছি, হেরে দিয়া উঠান সাফ করামু। আজকে ওই বাড়ি অনেক কাজ। চলো তো ভাইজান চলো” বলে শিউলি একপ্রকার জোর করেই শাহাদাত এর হাত ধরে হাটতে শুরু করলো।
এদিকে ফুয়ারা বেগম যেনো কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। কথাটা মুখেই বেঁধে ফেললেন।
ওদিকে কেয়ার বাড়িতে যাবে বলে কতই না আনন্দ জমা হয়েছে শাহাদাত এর মনে। অথচ এর কোনো অর্থ নেই। শাহাদাত যথেষ্ট খুশি। কিন্তু কেনো ও জানেনা। তবে ভাব দুখানা সে মুখে প্রকাশ করলো না। ছোটো বোনটা যে এত কাজের। ও জানতোই না……..

____________

বাতাসে বাতাসে রঙের ছড়াছড়ি। যেনো কোনো রং খেলা প্রতিযোগিতা চলছে। উঠোনের পাশে খাটো একখানা মেহেদী গাছের পাতায় পাতায় লাল গোলাপী রঙের প্রলেপ লেগে গিয়েছে । মেয়েরা , মহিলারা, বাচ্চারা সকলেই হৈ হুল্লোর করে রং নিয়ে কে কার মুখে মাখাচ্ছে কে জানে। এতসবের মধ্যে উঠোনের মাঝে দাড়িয়ে থাকা কুড়ে ঘরের মাটির বারান্দায় একজনকে মাথা নুইয়ে বসে থাকতে দেখে শাহাদাত এর চোখ আটকে গেলো।

ইতোমধ্যে ফুয়ারা বেগম , শিউলি এরা অন্যসব মহিলাদের সাথে মিলে গিয়েছে। কিন্তু শাহাদাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যেনো ওর চোখ নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। আরো কিছুটা এগোতেই যেনো মেয়েটাকে আরো স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারলো শাহাদাত। তখনি কোত্থেকে এক খাবলা গোলাপী রং এসে শাহাদাত এর সাদা শার্ট এ আছড়ে পড়লো। উঠোনে রং খেলা মহিলারা থেমে গেলেন। কয়েকজন মহিলা কেমন কেমন করে তাকালো শাহাদাত এর দিকে। যেনো পুরুষ মানুষ কখনো দেখেনি। কয়েকজন তো হাসাহাসি ও করলো । কিন্তু শাহাদাত এর চোখ আটকে রইলো বারান্দায় বসে থাকা কেয়ার দিকেই।

চলবে………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here