স্পন্দনের শুভ্রতা,পর্ব:১

0
3172

ওড়না ঠিক করতে করতে স্পন্দনের রুমের ভিতর চলে গেলো শুভ্রতা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভীষণ রেগে আছে। স্পন্দন একবার শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আবারো মনোযোগ দিল ল্যাপটপের দিকে। গোছানো বিছানা আবারো গোছাতে লাগল শুভ্রতা। আড় চোখে স্পন্দনের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। নাহ স্পন্দন তার দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না। রাগে দুঃখে তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। বিছানা গোছানোর পর আলমারি থেকে স্পন্দনের সমস্ত জামা কাপড় বের করে এলোমেলোভাবে বিছানায় ছড়িয়ে রাখলো। শব্দ শোনে বিরক্তি নিয়ে স্পন্দন তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতার সেদিকে কোনো হুস নেই সে আবার গোছাতে ব্যাস্ত আলমারি।

–” তোকে পাগলা কুকুরের কামড় দিয়েছে শুভ্রু?”

শুভ্রতা জবাব দিলো না। স্পন্দন হতাশ হয়ে জিজ্ঞাসা করলো আবারো,

–” হঠাৎ তোর কি হলো? গোছানো জিনিস এলোমেলো করে আবার গোছাতে শুরু করেছিস। অন্যদিন যদি বলি, শুভ্রু কাজটা করে দে, তো তখন তো মুখের উপর সোজাসাপ্টা বারণ করে দিস তখন ব্ল্যাকমেইল করে বাধ্য করি কাজ করার জন্য কিন্তু আজ না বলাতেই কাজ করছিস তাও অকাজ সমস্যা কি তোর?”

শুভ্রতা চোখের পানি আড়ালে ঢেকে মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

–” তোমার জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। আজ যেতে হবে পাত্রীর বাসায়।”

ভ্রু জোড়া কুঁচকে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল স্পন্দন,

–” তো? এইখানে সমস্যা কোথায়? ছেলে হয়ে জন্ম যেহেতু নিয়েছি বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। তাছাড়া বয়স তো আর কম হয়নি। এতদিনে বিয়ে করলে নার্সারি পড়ুয়া বাচ্চা কাচ্চা থাকতো আমার। বাই দা ওয়ে মেয়ে দেখতে কেমন জানিস কিছু?”

শুভ্রতা পারছে না চেঁচিয়ে কান্না করতে। স্পন্দনের কথা শোনে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে যাকে বলে ভয়ংকর কান্না তবুও নিজেকে সামলিয়ে বলল,

–” শুনেছি দেখতে ভালো। পড়াশোনা শেষ। বাবা মায়ের দুই নম্বর মেয়ে।”

–” দেখিসনি তুই? আমার হবু বউকে তোর দেখা উচিৎ ছিল শুভ্রু।”

শুভ্রতা এইবার চেঁচিয়ে উঠলো,

–” দেখবো না তোর বউ। একবার সামনে আসুক বঁটি চিনিস? ওইটা দিয়ে কেটে কুঁচি কুঁচি করে ফেলব। শুধু তোর বউ না তোকেও কুঁচি কুঁচি করবো।”

রাগ দেখিয়ে হনহন করে চলে গেলো শুভ্রতা। স্পন্দন শুভ্রতার যাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সে জানে কেন শুভ্রতা রেগে আছে। শুভ্রতাকে রাগাতে তার যে ভীষণ ভালো লাগে তবে একটা জিনিষে খটকা লাগছে তার। তাকে না জানিয়ে তো বিয়ের আলাপ এই বাড়িতে হবার কথা নয় তাহলে হঠাৎ কি হলো? তবে যাই কিছু হোক সেতো বিয়ে কিছুতেই করবে না। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে মনোযোগ দিলো আমারও ল্যাপটপে।

শুভ্রতা সম্পর্কে স্পন্দনের ছোট চাচার মেয়ে। যৌথ ফ্যামিলি থাকায় একত্রেই তাদের বসবাস। ছোট থেকেই শুভ্রতার পিছনে লেগে থাকতো স্পন্দন। কিছু দরকার হলেই তার মনে আগে যে নামটি আসবে তা হলো শুভ্রতা। শুভ্রতাও তাকে যে মনে মনে ভালোবাসে জানে সে কিন্তু সে চায় শুভ্রতা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে যখন দাঁড়াবে তখন সে নিজের মনের কথা বলবে। কিন্তু বেচারি শুভ্রতা এইসব মানতে নারাজ। পড়াশোনা তো তার বড় শত্রু।

ড্রয়িং রুমে বসে আছে শুভ্রতার মা, বাবা, স্পন্দনের মা, বাবা। শুভ্রতার ছোট ভাই শুভ আর ছোট বোন শুভ্রা। তারা বিয়ের আলোচনা করছে। তাদের সমাবেশে অংশ নিলো স্পন্দন। বাবার চোখের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–” আমার জন্য নাকি পাত্রী খুঁজছো তোমরা?”

শুভ্রতার মা বলল,

–” কেন তুই কি সন্ন্যাসী থাকবি? জানিস মেয়েটা কত সুন্দরী। আমার তো ইচ্ছা করছিল সাথে করে নিয়ে আসি। পুরোই রসগোল্লা।”

মায়ের কথা শোনে শুভ্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,

–” আমার আপু বেশি সুন্দর। আমার আপু রসগোল্লা, চমচম, ফুচকা, চটপটি, চকোলেট, আইস্ক্রীম হুহহ।”

শুভ্রতার মা গরম চোখে ছোট মেয়ের দিকে তাকালেন। শুভ্রা ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। স্পন্দনের বাবা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,

–” বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তোমার ভুলে গেছো?”

–” ভুলেনি আব্বু। আমার বিয়ের বয়স কখন হবে কিভাবে হবে তোমাদের সেই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বিয়ের সময় হলে আমিই তোমাদের বলবো। আমার যে লজ্জা সরম খুব কম জানা আছে তোমাদের। এখন আপাতত বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”

স্পন্দন উঠে চলে গেলো। এতক্ষণ সবাই মিলে বিয়ের প্ল্যান করছিল এখন সব শেষ। স্পন্দন সব শেষ করে দিয়েছে। স্পন্দনের বাবা রাগী চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রুমে চলে গেলেন। স্পন্দনের মাও ছুটলো পিছু পিছু। শুভ্রতার বাবা হেসে বললেন,

–” আমার কথাই ঠিক হলো তো? আগেই বলছিলাম স্পন্দনের বিয়ে নিয়ে ভেবো না। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। তোমরা কি ভাবছিলে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ে দেখবে পছন্দ হলে কিছু একটা বলে স্পন্দনকে রাজি করিয়ে দিবে। স্পন্দন যে কেমন তোমরা জানো না? ওর কথাতেই সে অটুট।”

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে শুভ্রতা। একটা মানুষকে সে ছোট থেকেই পছন্দ করে সেই মানুষটিকে অন্য কারো সে কখনই মানবে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছে তার। পিছন থেকে স্পন্দন এসে এক হাত পকেটে রেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো,

–” যেভাবে কান্না করছিস মনে হচ্ছে তোর বিয়ে? শোন তোর মত পেত্নীকে এই স্পন্দন কখনও বিয়ে করবে না।”

শুভ্রতা রাগ দেখিয়ে বলল,

–” বয়ে গেছে তোমাকে বিয়ে করতে আমি তো বয়ফ্রেন্ডের ছ্যাঁকা খেয়ে কান্না করছি। আজ আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”

স্পন্দন কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকালো। নীল আকাশের সাদা সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কতগুলো পাখি উড়ে যাচ্ছে তাদের খাবারের খুঁজে কিংবা নিজের বাসায়। গাছের ডালে বসে আছে দুটো পাখি সাথে চারটা বাচ্চা। নিজেদের ঠোঁট থেকে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে তারা। সুন্দর এই দৃশ্যটি স্পন্দনের মন কেড়ে নিলো। শুভ্রতা বেশ কিছুক্ষণ স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে থেকে সেও তাকালো স্পন্দনের দৃষ্টি অনুসরণ করে। তার চোখেও ধরা পড়লো সেই মিষ্টি, সুন্দর দৃশ্য। ছানাদের খাবার খাইয়ে দুই পাখি একত্রে এসে বসলো আলাদা একটি দিকে। একজন আরেকজনের গায়ে ঠোঁট দিয়ে বিলি কাটছে। শুভ্রতা ভীষণ লজ্জা পেয়ে স্পন্দনের দিকে তাকালো। নাহ এখনও স্পন্দন তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা লজ্জামাখা মুখ নিয়ে চলে যেতে নিলে স্পন্দন তার হাতটি ধরে কিছুটা গায়ের সাথে মিশিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

–” হঠাৎ লজ্জা কেন পাচ্ছিস? দুটো পাখির মাঝে কি আমাকে আর তোকে মনে করছিলি?”

–” অসভ্য লোক একটা। আমি কেন এমন ভাববো?”

–” আমি ভাবছিলাম। চারটা ছানার মতো আমাদেরও ক্রিকেট টিম হবে। আমিও তাদের জন্য খাবার আনবো। তারপরে আমরাওও….”

–” আমি কিন্তু কান্না করে দিবো বলে দিলাম। কেউ আসলে ভীষণ বকা দিবে ভাইয়া। প্লিজ ছাড়ো।”

স্পন্দন ছেড়ে দিল। শুভ্রতা কিছুতে দূর যেতেই স্পন্দন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

–” বিয়েটা ক্যানসেল শুভ্রু।”

শুভ্রতা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে স্পন্দনকে এই কারণে এসে জড়িয়ে ধরে দুই গালে দুটো চুমু দিতে কিন্তু নিজেকে সংযত করে শুধু বলল,

–” ওহহ। তো কেন হচ্ছে না বিয়েটা? তুমি তো রাজি ছিলে।”

–” হাসালি তুই। আমিও জানি তুইও জানিস আমাদের দুইজনের মনের বাঁধন যে একত্রে তবুও অভিনয় করে কি জানতে চাস? ভালোবাসার কথা। বলব যেদিন তুই আমার কথামত পড়াশোনা শেষ করে ভালো রেজাল্ট নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াবি সেদিন তোকে মনের সব কথাই বলব। এখন শুধু জেনে রাখ মাধুবিলতা। তুই এই স্পন্দনের শুভ্রতা।”

সমাপ্ত,

#স্পন্দনের_শুভ্রতা
#অনুগল্প
#ফারজানা_আফরোজ

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here