স্পন্দনের শুভ্রতা,পর্ব:৪

0
2581

–” এই শুভ্রতা তুই হঠাৎ শাড়ি কেন পড়লি? জানিস তোকে একদম বউয়ের মত লাগছে। এখন তোকে যদি আমার বাইকে ছড়িয়ে ফুপির বাসায় নিয়ে যাই পুরো রাস্তা ঘাটের মানুষ বলবে, দেখ ছেলেটা বউ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে। আমাকে বদনাম করার জন্য তুই শাড়ি পড়েছিস তাই না?”

শুভ্রতা যেন আকাশ থেকে টপকে মাটিতে পড়ল। কারণ, একটু আগেই স্পন্দন এসে বলে গেছে তাকে কালো শাড়ি পরতে কারণ আজ নাকি তার ফুপির বাসায় কাজিনরা কালো রঙের মেলা নিয়ে বসেছে। ছোট থেকে বড় সবাই আজ কালো রঙ শরীরে ধারণ করেছে কিংবা করবে । সেই হিসেবে আজ শুভ্রতাও স্পন্দনের কথা অনুসারে কালো শাড়ি পরেছে কিন্তু একি হলো? যখন সে স্পন্দনের রুমে এসে ডাকতে যাবে তখনই স্পন্দন রেগে গিয়ে তাকে যাচ্ছে তাই বলতে লাগলো।

–” আজব তো। একটু আগেই তো বলে আসলে, শুভ্রু তোকে যে কিছুদিন আগে কালো শাড়িটা কিনে দিয়েছিলাম সেটা আজ পরবি। তুমি তো দেখছি দু’মুখো সাপ কখন কি বলো বুঝা মুশকিল।”

স্পন্দন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

–” তখন কি জানতাম তোকে এত সুন্দর দেখাবে জানলে তো রুম থেকে বের হতেই দিতাম না।”

স্পন্দনের কথা বুঝতে না পেরে শুভ্রতা জিজ্ঞাসা করলো,

–” কি বললে তুমি?”

–” বোরকা আছে না ওইটা পরে বের হ।”

–” ফুপির বাসা তো সামনেই তাছাড়া তোমার সাথেই তো যাবো।”

–” এইজন্যই তো বোরকা পরে বের হবি। রাস্তায় যদি আমার গার্লফ্রেন্ড দেখে ফেলে তাহলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস? তবে হ্যাঁ বোরকা পরে গেলে ভাববে হয়তো বড় কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। সো তুই বোরকা পরে যাবি।”

রাজ্যর বিরক্তি ও রাগ নিয়ে শুভ্রতা নিজের রুমে চলে গেল। আধা ঘন্টা পর বের হয়ে আসতেই স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

–” চাচীর বোরকা কই? ওইটা পরে আয়।”

শুভ্রতা এইবার রাগে কষ্টে ফ্লোরে বসে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে লাগলো। কান্নার জন্য কি বলছে তাই বুঝা যাচ্ছে না। তবে স্পন্দনকে যে সে বকছে স্পন্দন ভালোই জানে। মৃদু হেসে বলল স্পন্দন,

–” যাবি না?”

–” তোমার সাথে যাবো না। তাছাড়া গিয়ে কি লাভ অর্ধেক আনন্দ তো শেষ। তিশা আপু ফোন দিয়ে বলেছে তারা অর্ধেক আনন্দ করে ফেলছে । শাহাদাত ভাইয়া সবার জন্য এত্ত এত্ত গিফট এনেছে,ট্রিট দিয়েছে, গান গেয়েছে, নেচেছে, অনেক্ষন আড্ডা দিয়ে নাকি এখন চলে গেছে। আজ নাকি ভাইয়াকে অনেক সুন্দর লাগছিল কালো পাঞ্জাবিতে একদম হিরো হিরো। আমি তো ভাইয়ার সাথে মিট করার জন্যই যেতে চাইছিলাম। এখন তো সেই চলে গেলো। তোমাকে ইচ্ছে করছে পঁচা ডিম ভাজি করে খাওয়ানোর জন্য।”

শুভ্রতার কথা শোনে স্পন্দন মনে মনে বেশ রেগে গেলো।

–” শাহাদাতকে দেখার জন্য শুভ্রতা যেতে চাইছিল? এইজন্যই এত সেজেছে সে। শাহাদাতকে না দেখেই হিরো বলছে কই একদিনও তো আমাকে বলেনি স্পন্দন ভাইয়া তুমি দেখতে একদম হিরোদের মত। ভালোই হয়েছে যেতে পারিস নাই। যদি ওই ছেলের আশেপাশে দেখতাম পা আর হাত কেটে তিন রাস্তার মোড়ে বসিয়ে রেখে আসতাম ফাজিল মেয়ে কোথাকার। আর তিশারে তো এক্ষুনি গিয়ে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে। শয়তান মহিলা সরি মেয়ে কত্ত বড় সাহস শুভ্রতার মাথায় শাহাদাত নামক বিলাতি বান্দরের নাম প্রবেশ করায়। আজ যদি ওর ওয়েফায়ের লাইন না কাটছি ওহ সরি বয়ফ্রেন্ডের নাম বাসায় না বলছি তাহলে আমার নামও স্পন্দন না। তিশা তোরে বিয়ে দিবো ওই বিলাতি বান্দরের সাথে ওয়েট আসতেছি।”

স্পন্দন মনে মনে ঝুড়ি ঝুড়ি বকা দিয়ে শুভ্রতাকে রেখেই চলে গেলো ফুপির বাড়ি। তিশা ওর ফুপির বড় মেয়ে। শাহাদাত হলো তিশার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শুভ্রতা এখনও ঠাঁই মেরে বসে কান্না করছে। হঠাৎ কান্না থামিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো স্পন্দন নেই। চোখের পানি মুছে এদিক ওদিক তাকালো নাহ কোথাও নেই। দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো দরজা খোলা। রাগে এখন তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। শেষমেষ কিনা তাকে নিয়েই গেলো না।

–” বজ্জাত, জল্লাদ, বাজে লোক একটা। আমাকে নিয়ে গেলো না শেষ পর্যন্ত। বুঝতে পারছি তোর আমাকে নেওয়ার ইচ্ছা মোটেও ছিল না। আমার সময় নষ্ট করার জন্য এইসব করছিস। যা ভাগ বদদোয়া দিলাম, তোর গার্লফ্রেন্ড যেন টাকলু হয়। তোরে যেন সারাদিন মাইরের উপরে রাখে। একশোটা ব্রেকআপ যেন হয় তোর। মেয়েদের হাতে প্রতিদিন হাজারটা থাপ্পড় যেন গালে পরে। বিয়ের পর তোর বউ হবে চুন্নি। যেকিনা সারাদিন তোর পকেট থেকে টাকা চুরি করবে। হতচ্ছাড়া।”

শুভ্রতা রাগে গজগজ করতে করতে বোরকা খুলে শাড়ি পরেই বের হয়ে গেলো। সে একাই যাবে ফুপির বাসায়।

এগারোটা ত্রিশ মিনিট,

সোনালী রঙের রোদ এসে মুখে পড়ছে শুভ্রতার। তবে রোদের কোনো তেজ নেই। ভালোই লাগছে তার। মৃদু বাতাস খোলা চুলগুলো হালকা টাচ্ করছে। নূপুরের শব্দে শুভ্রতা পায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আজ এই পথচলার সঙ্গী হিসেবে নুপুর তার পায়ে রয়েছে। রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ কিন্তু রিক্সার কোনো চিহ্ন নেই। মুখটা আঁধার রাতের অন্ধকারের মত হতে লাগলো তার। রাগের বশে রাস্তায় পরে থাকা একটা ছোট্ট পাথরকে পা দিয়ে লাত্থি মেরে কিছুটা দূরে সরালো। পাথরটা হয়তো লাত্থি খেয়ে শুভ্রতাকে অভিশাপ দিয়েছে তা-নাহলে এই রাস্তায় তার শাড়ির কুচি হয়তো খুলতো না। রাগে কষ্টে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। রাস্তা ফাঁকা বলে কোনমতে কুচি ঠিক করে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। লক্ষ্য একটাই যেভাবে হোক ফুপির বাসায় সে যাবেই। কোনমতে হাঁটছে সে হঠাৎ একটা বাইক এসে দাঁড়ালো তার সামনে। বাইকে থাকা লোকটিকে দেখে চোখটা সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরালো কারণ বাইকে চড়ে স্পন্দন এসেছে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। রাগের বশে চলে গিয়েও শুভ্রতাকে একা ফেলে এসেছে বলে আবার চলে আসে সে। আর রাস্তাতেই দেখা মিলে শুভ্রতার। শুভ্রতার শাড়ির হাবভাব দেখে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

–” উঠে বস।”

–” কে ভাই আপনি? রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই বাইকে উঠানোর ধান্দা তাই না। মানুষজন ডেকে গণপিটুনি খাওয়ায় ইচ্ছা না থাকলে বিদায় হোন।”

–” নাটক না করে উঠে বস। তোর বিলাতি বান্দর সরি শাহাদাত ভাই এখনও আছে। তোর জন্য ওয়েট করতেছে।”

–” মিথ্যা বললে বিয়ে হবে না।”

–” ওকে ফাইন তোর যেতে হবে না। আমি আবার চলে যাচ্ছি।”

শুভ্রতা ভাবলো তার পক্ষে এখন হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, শাড়ির যে অবস্থা মান সম্মান যেকোনো জায়গায় যেতে পারে তাই ছটপট করে উঠে পড়লো বাইকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো স্পন্দন। এই মেয়েকে কখনো সোজাভাবে কথা বললে রাজি হয়নি কিন্তু উল্টো কথা বললেই রাজি হয়ে যায়।

ফুপির বাসা থেকে অনেক দূরে চলে গেলো স্পন্দন। শুভ্রতা চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করলো,

–” কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

–” কাশফুল দেখতে যাবি? ছবি তোলে দিবো।”

–” সত্যিই?”

–” হুম।”

–” ওকে কিন্তু শাড়ি?”

–” সামনে রেস্টুরেন্ট আছে ঐখানে গিয়ে হালকা খাবার খাবো আর তুইও ওয়াসরুমে গিয়ে ঠিক হয়ে আছিস। আজ রাত আটটা পর্যন্ত ঘুরবো আমরা।”

স্পন্দনের কথা শোনে শুভ্রতার খুশি আর কোথায় থাকে। খুশিতে মনে হচ্ছে বাইক থেকে নেমে ডান্স করবে সে।

____________________________

পাহাড়ের চূড়ায় উঠলো দুজন। সাদা মেঘের ভেলার মত কাশফুল দুলছে। একবার ডানে আরেকবার বামে। যেন তারা স্পন্দন এবং শুভ্রতাকে স্বাগতম জানাচ্ছে তাদের সাথে মিট করেছে বলে। শুভ্রতা দৌঁড়ে কাশফুলের ভিতরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

—” স্পন্দননননন ভাইয়াআআআ এইদিকে আসো। আমি পোজ দিচ্ছি পিক তুলো ঝটপট। কালো শাড়িতে সাদা ফুলের রাজ্যতে ভালোই লাগবে আমাকে তাই না?”

–” কচু লাগবে তোকে। ফাজিল।”

শুভ্রতা ‘ডোন্ট কেয়ার ভাব’ নিয়ে বিভিন্ন পোজ দিতে লাগলো। অনেকগুলো ছবি তুললো শুভ্রতা। স্পন্দন মনে মনে বিরক্ত নিয়ে বলতে লাগলো,

–” শালী, একটা বার আমাকে ডাক। দু’জন ছবি তুলি একা একাই হাজারটা তুলে ফেলছে।”

স্পন্দন বুঝলো শুভ্রতা তাকে ছবি তোলার জন্য ডাকবে না তাই নিজেই শুভ্রতাকে ধমক দিয়ে বলল,

–” তুই একাই তুলবি সব? আমি তুলবো না?”

–” বারণ কে করেছে হুহ?”

শুভ্রতা কাশফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি কমলা রঙ ধারণ করা সূর্যের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝেই সূর্য রক্তিম হয়ে উঠবে। পাখিরা দ্রুত ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ পিছন থেকে কারো স্পর্শে চোখ বন্ধ করে মৃদু হেসে বলল,

–” কি হচ্ছে এইটা?”

শুভ্রতার কথায় পাত্তা না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হেসে বলল স্পন্দন,

–” তোকে এত সাজতে বারণ করেছি না আমি? আমার কথা অমান্য করে সেজেগুজে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলি তুই? ইচ্ছা করতেছে এক্ষুনি তোকে খুন করে ফেলি কিন্তু আমার বাচ্চাকাচ্চার কথা ভেবে পারছি না। চাই না আমার বাচ্চাগুলো মা হারা হয়ে যাক।”

স্পন্দনের কথায় ঠোঁট কামড়ে পিটপিট চোখে তাকালো শুভ্রতা। তার মাথায় স্পন্দনের কথাটা ঠিক ক্লিয়ার হলো না।

–” আমি মারা গেলে বাচ্চা কিভাবে হবে?”

শুভ্রতার একটি বাক্যতে হাসতে লাগলো স্পন্দন। যাকে বলে ভয়ানক হাসি। রাগ এবং অভিমান দুটোই শুভ্রতাকে গিড়ে ধরলো। সামান্য একটা বাক্যতে কেউ এত হাসতে পারে? অভিমানে কিছুটা দূরে সরে যেতে নিলেই খপ করে হাত ধরে ফেলল স্পন্দন। নেশাভরা কণ্ঠে বলতে লাগলো,

–” আমি প্রেমের আসক্তি চাই না, আমি চাই প্রেমের পূর্ণতা। কিন্তু বারবার কেন আসক্তি হই? আসক্তি নামক ঝামেলাটা দিনদিন আমার পিছনে দাওয়া করছে। এই যেমন তোর চোখ দেখে হঠাৎ করেই আসক্তি হয়ে পরি, তোর ঠোঁটজোড়া যেন আমার বারবার কাছে আহ্বান করে, তোর কণ্ঠ যেন বারবার আমাকে বলে বেড়ায়, তোর কালো লম্বা চুলগুলো আমার নেশা জাগিয়ে তুলে। এক কথায় আমার শরীরের প্রতিটি অংশ বলে বেড়ায়, শুভ্রতার প্রতি তুই বড্ড আসক্ত। আসক্ত কিন্তু ভালো নয়।”

শুভ্রতা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখল। এই মানুষটার প্রতিটি কথা ওর কাছে জাদুর মত লাগে। কারো কণ্ঠে এত জাদুময় হতে পারে হয়তো তার জানা নেই। হতে পারে মানুষটিকে সে ভীষণ ভালোবাসে সেই কারণেই মানুষটির সবকিছুই তার ভালো লাগে। এখন যদি পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটাও তার সামনে দাঁড়ায় তাহলেও সে চোখ বোজে এক বাক্যই বলবে, স্পন্দনের কাছ এই ছেলে কিছুই না। এই কারণেই হয়তো স্পন্দনেরও মনে হয়, শুভ্রতার মত সুন্দরী আর একটাও নেই। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বলে উঠলো স্পন্দন,

–” শুভ্রতার নামের পাশে স্পন্দন নাম ছাড়া অন্যান্য নাম দেখতে যেমনটা খারাপ দেখায় তেমনি স্পন্দন নামের পাশে শুভ্রতা নাম ছাড়া অন্য নাম মানায় না। আমাদের এই দুজনের গল্পটা ছোটগল্প হয়েই থাকুক। টেনেটুনে উপন্যাস করার কি প্রয়োজন। কিছু কিছু গল্প ছোটই মানায়। Love is an immeasurable force which has no length, no depth nor weight।”

সমাপ্ত

#স্পন্দনের_শুভ্রতা_৪
#ফারজানা_আফরোজ
#ছোটগল্প

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেকদিন পর লিখলাম। আশা করি ভালো লাগবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here