সোহাগী শেষ পর্ব

0
1035

#সোহাগী
#অন্তিম পর্ব : ১৩
Lutful Mehijabin

কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ। সোহাগী কে ঘিরে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে সবাই। বিয়ের কনে বলে কথা! কতো মানুষের আনাগোনা, অথচ আমেনা সকাল থেকে একটি বারের জন্যও নাতির মুখ দর্শন করেনি! কিছুক্ষণ বাদে চিরকালের মতো নাতির বিদায় তবুও আমেনার হদিস নেই। রান্নার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত করেছেন সোহানা। উঠানে চারটা শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। আমেনার রান্না শেষ হয়েছে বেলা তিনটে নাগাদ। আসরের আযান পড়তেই রাশেদের চেনা জানা লোকগুলো ছুটে আসতে শুরু করেছে। অবশ্য এতে খরচ হলেও বিরক্ত হন নি সোহানা। সামান্য ডাল ভাতের আয়োজন! জন পঞ্চাশ মানুষের জন্য এই স্বল্প খরচ না করলে সবাই তাদের কী ভাববে! ভুঁইয়া বাড়ির আত্মীয় হয়ে কৃপণতা বড্ড বেমানান। সোহানা বুদ্ধি করে ভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন ভুঁইয়া বাড়ির লোকদের জন্য। কষানো লাল টকটকে মুরগির ঝোল, বাজার থেকে ক্রয় করে এনেছেন দু কেজি গরুর মাংস, টাটকা ইলিশ ভাজা, বাসন্তী চালের পোলাও এবং মিঠাই দিয়ে তৈরি পায়েশ। এসব খাবার গুলো নিজের হাতে তৈরি করেছেন সোহানা।

— সবাই খাইতে চলেন। বেডাগো বইঠক খাইয়া উইঠা পড়ছে। ঘরে কারো জন্যে খাওউন আনবেন পারুম না কইলাম।

সোহাগীর ভাই হঠাৎ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে উঠে! ছেলেটার মুখশ্রী চিকচিক করছে। বোনের বিয়েতে কাজে লেগে পড়েছে খোকন। কাজের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। গর্বে তার বুকটা ভরে উঠেছে। বন্ধুদের কাছে গর্ব করে বলছে, তার বোন ভুঁইয়া বাড়ির বউ হতে চলেছে! গ্রামের প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করাটা তাদের নিকট যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো আনন্দের।

খোকনের কথা শুনে একে একে সবাই চলে গেলো। মিনিট খানিকের মধ্যে পুরো জমজমাট ঘরটা নিরব হয়ে এলো। যাওয়ার আগে রুমা মেয়েটা পইপই করে বলে গেলো সোহাগী কে যেন সে বিছানা থেকে না নামে। সবাই চলে যেতেই প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো সোহাগী। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। আজ যদি তার আব্বার কাছে মোবাইল নামক যন্ত্রটা থাকতো তাহলে কতোই না ভালো হতো। মোবাইল ফোন সম্পর্কে পাঠ্যবই এ বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছে সোহাগী। গ্রামের দু একজন মানুষ কে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখলেও, তা ছুঁয়ে দেখার মতো ভাগ্য হয় তার। বিষয়টা মনে পড়তেই সোহাগীর বুকটা ভারী হয়ে এলো। মুহূর্তেই রফিক এবং তামিমের মুখশ্রী ভেসে উঠে তার চোখে! ওরা কী তার সাথে শেষ দেখা করতে এসেছে? পরক্ষণেই তার কথা মনে পড়লো সকালে সোহানা কৃত আচরণ। নিজের উপর ধিক্কার জানাতে লাগলো সে। এমন মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার!

রফিক এবং তামিমের প্রসঙ্গ মনের কোণে উঁকি দিতেই সোহাগীর স্মৃতিতে ভেসে উঠে তাদের একসাথে অতিবাহিত মুহূর্তগুলো। তৎক্ষণাৎ আঁখির কথা ও মনে পড়লো চুপিসারে! আজ একবার আঁখির মা কে দেখেছিলো সোহাগী। মেয়েটার সাথে কয়েক দিন যাবত তার দেখা সাক্ষাৎ হয় না। মেয়েটা কী তাকে ভুলে গিয়েছে। জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাগুলো ভাবতে লাগে সোহাগী। চৌকাতে বসলে জানালা দিয়ে একটা নারিকেল গাছ বরাবরই চোখে পড়ে সোহাগীর। উন্মুক্ত আকাশে গাছের পাতাগুলো হাওয়াতে দুলছে। আজ প্রকৃতি তার মতো উদাসীন! জানালা খুলে গাছটার দিকে তাকালে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সোহাগী।

এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে কেউ এসে জাপটে ধরলো সোহাগী কে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বললো,

— আফা তুমি পালায় যাও। বিয়া করুন লাগবো না। বিয়া করা সুখের না।

আঁখির কন্ঠস্বর শুনে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে সোহাগী ঠোঁটের কোণে। মিনমিন গলায় সে বলে,

— তুই একশো বছর বাঁচবি আঁখি বুড়ি।

নিজের থেকে আঁখি কে ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটার মুখ জোড়া দু হাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো সোহাগী। আঁখির চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লক্ষ করলো মেয়েটার চোখ জোড়া সজল! আপনজন হারানোর তীব্র আতঙ্ক তার চোখে স্পষ্ট। মেয়েটার শুষ্ক মুখ লক্ষ্য করে সোহাগী মলিন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

— কীরে, এতক্ষণ পর আমার কথা মনে পড়লো?

সোহাগীর কথার প্রত্যুত্তরে আঁখি ভাঙা গলায় বললো,

— কাকী তোমার কাছে আমারে আসবার দেই নাই। তাই আইবার পারি নাই। রফিক ভাই কইলো তুমি নাকি বিয়েতে রাজি না?

আঁখির কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো সোহাগী। সে যে এখন নিরুপায়। একমাত্র রাশেদের উপস্থিতি ব্যতীত তার পক্ষে বিয়ে না করে পালানোর কোনো উপায় নেই। সোহাগীর উত্তর না পেয়ে আশাহত হলো আঁখি। লহমায় উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,

— তুমি পালাই যাও আফা। তোমার কিছু হইলে আমি ম’ইরা যামু। পদ্ম বুরে হারাইছি। এখন তোমারে হারাইতে চাই না।

আঁখির মুখ থেকে পদ্ম নামটা শুনে কেঁপে উঠে সোহাগী। বছর খানিক পূর্বে আঁখির বড়ো বোন পদ্মর বিয়ে হয় একজন একুশ বছরের যুবকের সঙ্গে। পদ্মর বয়স তখন মাত্র বছর ষোলো। তার স্বামী শহরে ইট ভাটায় কাজ করতো। বিয়ের তিনমাস পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো। অবশ্য বিয়ের পর যখন প্রথমবার পদ্ম বাবার বাড়িতে আসে তখন আঁখির মায়ের পায়ে ধরে কেঁদেছিলো পদ্ম। বাবা মায়ের কাছে বাইনা ধরেছিলো যেন তাকে স্বামী নামক জন্তুর কাছে না পাঠাই। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো সে সংসার করতে পারবে না। তাকে নাকি রাতে ভীষণ অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে! হাত, পা, গলা, মুখ, ঠোঁট ইত্যাদি জায়গায় ক্ষত দেখেও কেউ তার কথা মেনে নেই নি। ক্ষত গুলো তার মা দেখেও দেখেনি। আঁখির মা ভেবেছিলেন নতুন বউ হিসেবে বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়! সেদিন বিদায়ের বেলায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায় পদ্ম। জ্ঞানহীন পদ্ম কে নিয়ে শশুড় বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় তার স্বামী। তার ঠিক দু মাস পর পদ্ম বাপের বাড়িতে এসে মায়ের কাছে টাকা ভিক্ষে চাই। যৌতুক চেয়েছে তার স্বামী! সে প্রথমে যৌতুক দিতে রাজি হতে পারে নি। সে ই তো জানে তার আব্বা কতো কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে। তার পাঁচ ভাই বোনের খরচ চালিয়ে মোটা অংকের যৌতুক দেওয়া তার বাবার পক্ষে অসম্ভব! বাবার কথা ভেবে দিন কয়েক মুখ বুঁজে সহ্য করে গিয়েছে পদ্ম। পৃথিবীতে হয়তো এমন পদ্মের অভাব নেই যারা স্বামীর যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পেরে একমাত্র বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিনিয়ত সহ্য করে আসছে সীমাহীন মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার! পদ্মর মা সেদিন বাধ্য হয়ে মেয়ে কে নিজের স্বল্প দামি গননা গাটি খুলে দিয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে। কিন্তু এতেও পদ্মর স্বামীর চাহিদা মিটে নি। যার ফলে শুরু হয় পদ্মর প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচার। এরপর কিছুদিন মেয়ের কোনো খোঁজ পান নি তারা। কিন্তু তার ঠিক দু সপ্তাহ পর কোনো এক ভর দুপুরে মাথায় পদ্মর সাদা কাপড় মোড়ানো লাশটা উঠোনে পড়ে থাকতে দেখেন তারা। নিজের সন্তানের মৃত্যু দেহ টা বাবা মায়ের কাছে কতোটা অসহ্যনীয় যন্ত্রণার হতে পারে তা হয়তো বলে বোঝানো মুশকিল। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর হলেও বেলা শেষে সন্তানের মৃত্যুতে আফসোস করবেই পিতা মাতা।

পদ্মর আঘাত প্রাপ্ত লা’শের কথা স্মরণ হতেই কেঁপে ওঠে সোহাগী। পদ্মর শরীর আঘাতে ফুলে গিয়েছিলো। সারা দেহ দেখেই বোঝা গিয়েছে যে মেয়েটা এ কয়দিন কতোটাই না শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।

— সোহা আফা, তুমি পালাই যাও। ওই বুইড়া বেডারে বিয়া করতে হইবো না।

সোহাগীর দু বাহু ধরে ঝাকাতেই বাস্তবে ফিরলো। আঁখি বারংবার একই কথা বলছে! সোহাগী ভারি নিশ্বাস ফেলে মিনমিন স্বরে বলে,

— তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন রে? চিন্তা করিস না আব্বা স্বপ্ন পূরণ করার আগ পর্যন্ত আমি ম’রবো না, ইনশাল্লাহ।

সোহাগীর কথার প্রত্যুত্তরে আঁখি ভীত কন্ঠে বললো,

— আ্যজ তো তোমার বাসর রাত হইবো আফা। তুমি জানো না আফা পদ্ম বু রে দুলাভাই বাসর রাইতরে মেলে মারছিলো। বু আমারে কইছে আঁখি নিজে বড়ো হইয়া যোগ্য ছেলে রে বিয়া করবি যে তোরে সম্মান করবো আর ভালোবাসবো। ছোট বেলায় বিয়া বইলে নাকি বাসর রাইতে মা’ইর খাইতে হয়। বু আরো কইছিলো আমি যদি মা’রই সহ্য করবার না পাইরা হাউমাউ কইরা কান্দি তাও কেউ আমারে বাঁচাইতেও আইবো না। বিয়ে করলেই শাশুড়ির আর স্বামীর মা’ইর খাইতে হয়। তুমি জানো আফা আমার পদ্ম বু রে বাসর রাতে দুলাভাই বেল্ট দিয়া পিটাইছে। বু আমার কাছে চুপিচাপি কইছে আর ফুপাই ফুপাই কাঁনছে। সোহা আফা আমি তোমারে হারাইতে পারুম না। রফিক ভাই, তামিম ভাই তোমার বাড়ির পাশ দিয়া ঘুরঘুর করতেছে কিন্তু কাকি ওগো ভেতরে ঢুকবার মানা করছে।

কথাগুলো তড়িঘড়ি করে শেষ করলো আঁখি। ইতোমধ্যে মেয়েটার কথাগুলো শুনে সোহাগীর আত্মা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। পদ্মর মতো কী তাকেও মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে। আজ রাতে তবে কী তার স্বামী ও তাকে বেল্ট দিয়ে পিটাবে? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটার উৎপত্তি ঘটলো সোহাগীর ছোট মস্তিষ্কে। আচ্ছা তার আব্বা কে সত্যি বুঝতে পারছে না যে তার সোহাগী কষ্টে আছে। সে কেনো তাকে উদ্ধার করতে আসছে না?

আঁখি সজল চোখে সোহাগীর হাত জোড়া শক্ত করে ধরেছিলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সময় যেন থমকে গিয়েছে। সোহাগী বাকরুদ্ধ! এমন সময় সোহাগীর ঘরে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন আমেনা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান! নানীর মুখশ্রী দৃশ্যমান হতেই স্বল্প মেঘ জমতে শুরু করলো সোহাগীর হৃদয়ে।

আমেনা ঘরে এসে হাঁপাতে লাগলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,

— আঁখি রে তুই ওহনে যা। জমাইরা প্রায় চইলা আইছে। যা দেখ গিয়ে তোর মা কী করে।

আমেনার আদেশ পেয়ে সোহাগীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আঁখি। ঘর ত্যাগ করার পূর্বে সোহাগী কে চোখের ভাষার কিছু বলে গেলো। আঁখি চলে যেতেই ঘরের শক্ত কাঠের দরজাটা খিল দিয়ে দেন আমেনা। অতঃপর সাত প্যাচ না ভেবেই দৌড়ে গিয়ে সোহাগী কে জড়িয়ে ধরেন। মুহূর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। ক্রন্দনের সহিত উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করেন,

— তুই আর কোনদিনই এই বাড়িতে পা রাখিস না সোনা। আর কোনদিনই তোরে যেন এ বাড়িতে বাড়িতে না দেহি। ওরা তরে বাঁচাতে দিব না। তোরে মা’ইরা হেলাবো।

আমেনার অদ্ভুত কথাগুলো শুনে চমকে উঠে সোহাগী। কে এবং কারা তাকে মা’রতে চাই! আমেনা কেন তাকে এমন কথা বললো তা বোধগম্য হলো না তার। ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে ম্লান কন্ঠে বলে উঠলো,

–নানী তুমি শান্ত হও। এমন উত্তেজিত হচ্ছো কেনো! কে আমাকে মারতে চাই?

— তোর মা।

আমেনার পরিষ্কার জবাব! সোহানা তাকে মে’রে ফেলতে চাই! স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সোহাগী। কেনো তার মা তাকে মে’রে ফেলতে চাই? মুহূর্তেই তার চোখ জোড়া আপনা আপনি বৃহৎ আকার ধারণ করে উঠে। কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

সোহাগী কে স্তম্ভ হতে দেখে কান্না বন্ধ করেন আমেনা। পরপর কয়েক টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সতর্ক হন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলান। না, ঘরে কেউ নেই। তিনি তো দরজা বন্ধ করে এসেছেন। অতঃপর ভীত কন্ঠে কয়েক দিন পূর্বে সোহাগীর সাথে ঘটে যাওয়া চরম ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা বর্ণনা করতে শুরু করেন। যা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সোহাগী।

— তোর মা তোরে মা’রতে চাই। কয়েক দিন আগে যখন সোহানা তোরে মারুনের লাইগা দাও লইয়া মাঝরাইতে ঘরে ঢুহে। আমি তোর পাশে শুইয়া ছিলাম তাও তোর মাইর হাত পা কাঁপে নাই। কিন্তু ওইদিন তোর মাই তোরে মারবার পারে নাই। মা তো তোর তাই তোর দিকে ঝুঁইকা কাইন্দা দিছিলো।

কথাগুলো বলা শেষ করে বার কয়েক নিশ্বাস ছেড়ে পুনরায় আমেনা বলতে শুরু করেন।

— মনে আছে ওইদিন রাইতে তুই কইছিলি আমারে, তোর গলায় কীসের যেন পানি পড়ছে। আমি তোরে ওই সময় কইছিলাম তোর গলায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। ওই পানি ফুটা কোন বৃষ্টির পানির ফুটা ছিলো না। ওই পানি ছিলো সোহানার চোখের পানি। ওইদিন ও তোরে মারবার পারে নাই। তুই বল মা হইয়া মাইয়ারে মারা যায়! আমি ভাবছিলাম সোহানা ভালো হইয়া গেছে। তাই সেদিন ওরে কিছু না বইলা বুঝাইছি। কিন্তু না, আমি ভুল ছিলাম। সোহানা হইলো আমার গর্ভের কালি। ওই তোরে বাঁচতে দিবো না। তুই আর আসিস না।

আমেনার কথাগুলো শেষ হওয়ার পূর্বেই তারা শুনতে পেলো বাইরের কোলাহল! কোনো ঝামেলা হয়েছে বোধহয়। মুহূর্তেই দরজায় কেউ এসে বারি মারলো। আমেনা চোখের জল মুছে দ্রুত দরজার খুলে দিলেন।

মলিন মুখে কয়েক জন মহিলা তৎক্ষণাৎ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। জামিলা ভেতরে ঢুকে সোহাগীর হাত ধরে মলিন স্বরে বলে উঠলো,

— আই সোহা বর আইসা পড়ছো। তোর ভাগ্য কী ভালা রে। বিয়াত্তা বেডারে তোর আর বিয়া করতে হইবো না।

জামিলার কথা শুনে আমেনা উত্তেজিত হয়ে বলেন,

— মানে! কী বলিতেছাস তুই?

— তুমি জানো না দাদি। সাংঘাতিক কান্ড ঘটছে। জানো, ওই আমিরুল বেডার নামে কি খবর রটছে! ওই বেডা নাকি শহরে জাইয়া ঝামেলায় পড়ছে। টিভি, রেডিও তে বেডার নামে কতো কী কওয়া শুরু করছে। তাই বর পালটায়া গেছে। এখহ সাফিদ ভুঁইয়ার লগে আমাগো সোহার বিয়া হইবো। আমার এহন হিংসা হইতেছে সোহারে। অবশ্য সাফিদ ভুঁইয়া নিজেগো সম্মান বাঁচাইতে বিয়া করতেছে।

কথাগুলো শুনে আমেনা আনন্দিত হলেন। সত্যিই তাদের উপর সৃষ্টিকর্তা অশেষ রহমত রয়েছে। সাফিদ ভুঁইয়ার মতো সৎ লোক কে গ্রামের কে না চিনে? পুলকিত তবে তা প্রকাশ করলেন না। সোহাগী পূর্বের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। বর পাল্টে কীই বা হবে! পরিশেষে বিয়ে তো তাকে করতেই হচ্ছে।
______________

তিন সিটের প্রাইভেট ক্যার শো শো করে ছুটে চলছে ভুঁইয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে। খানিক পূর্বে সাফিদ ভুঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সোহাগী। সাফিদ ভুঁইয়া যে তাদের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বিয়ে করেছে তা কারোই অজানা নয়। সোহাগী বিদায়ের সময় কারো সাথেই আর কথা বলেনি। সোহানা আনন্দের সহিত তাকে বিদায় দিয়েছেন। সাফিদ ভুঁইয়ারা কিছু খান নি। বিয়ের কাজকর্ম সেরে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তারা। বিদায়ের পথে রফিক এবং তামিমের অবস্থা দেখে সোহাগীর বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। উঠেনের এক কোণে গেটের আড়ালে লুকিয়ে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ফেলে রফিক। তামিম গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে গৌধুলির আলোতে দৌড়ে সরে যায়। যা লক্ষ্য করতেই দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সোহাগীর গাল বেয়ে। ইশ, তাদের কী আর কোনদিনই কথা হবে আগের মতো! আজ থেকে তাদের মাঝে পুরো দেয়াল তৈরি হলো।

আপন মনে ছুটে চলছিলো গাড়ির চাকা। তবে হঠাৎ মানুষ জনের ভিরের ফলে গাড়িটা থেমে গেলো। আশেপাশে মানুষ জনের কোলাহল! সোহাগীর ডান পাশে বসে রয়েছে আসমা। সেই তখন থেকে মহিলাটা ছেলের শোকে অঝরে কেঁদে চলছেন। এবং সোহাগীর বা পাশে বসে রয়েছে সাফিদ। ছেলেটার দিকে একপলকের জন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি সোহাগী। তার কাছে স্বামী মানে একরাশ পীড়িত বিষাদ! কোনো কিছুই ভালো লাগছে না তার।

— কী হয়েছে ড্রাইভার? এখানে ভির কেন?

হঠাৎ সাফিদের কন্ঠস্বর পেয়ে শীতল হলো সোহাগীর হৃদয়। গম্ভীর, ভারী শ্রুতি মধুর কন্ঠস্বর! সাফিদের প্রত্যুত্তরে ড্রাইভার বলে উঠেন,

— জানি না স্যার।

–ওকে, ওয়েট আমি গিয়ে দেখছি।

কথা শেষ করে গাড়ি থেকে নামার জন্য ডোর খুললো সাফিদ। গাড়ির ডোর খুলতেই সামনে একজন বয়স্ক লোক এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। লোকটার মুখ প্ররখ করতে সাফিদের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে যায়। সাফিদ গাড়ি থেকে নামার পূর্বে লোকটি কে বিনীত স্বরে জিজ্ঞেসা করে,

— ভাই, কী হয়েছে এখানে?

সাফিদের কথা শুনে লোকটা ভীত কন্ঠে যা বলে তা শোনার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিলো না। বিশেষ করে লোকের কথাগুলো সোহাগীর কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই উন্মাদ হয়ে উঠে সে।

— খু’ন হইছে ভাই। আমাগো রাশেদ মিয়ারে কেরা যেন মাইরা নদীর পাড়ে ফালাইয়া রাখছে। ওর লা’শ দিয়া বিছরি পচা গন্ধ কইতেছে। মনে হইতেছে কেউ যেন ওরে পাথর ছুইড়া ছুইড়া মারছে। মাথা ফাইটা ঘিলু আলাদা হইয়া পইড়া আছে।

লোকটার কথায় অতিরিক্ত আতঙ্ক স্পষ্ট! মুহূর্তেই চমকে উঠে সাফিদ। দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে মাটিতে পা রাখে। লোকটা পুনরায় বলে উঠে,

— ওইখানে জায়েন না ভাই। কী যে গন্ধ! উয়াক থু,, বমি পাইবো আপনার। খুব খারাপ লাগতেছে রাশেদের জন্যে। শুনছিলাম আইজ ওর মাইয়ার বিয়া আছিলো। আর এই দিনেই! আহারে। কেরা যে ওরে মা’রছে। খুনীর মনে মায়া দয়া নাই।

লোকটার কথাগুলো শেষ হওয়ার পরপরই হুমড়ি খেয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সোহাগী। লোকটা কী বলছে? তার আব্বা কী সত্যিই এই পৃথিবীতে আর নেই? হাত পা অবস হয়ে আসে সোহাগীর। তার হাত পা কাঁপতে থাকে বিরতিহীন! গাড়ি থেকে বেরিয়ে লোক সমাজ কে উপেক্ষা করে আশেপাশে না তাকিয়ে আলতা রাঙা পায়ে ছুটতে থাকে সোহাগী। সোহাগীর শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। মেয়েটার চুরির ঝনঝন ধ্বনি তার অশ্রুর সাথে পালা করে ঝনঝন শব্দে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। সোহাগীর হাঁটু অবস হয়ে এসেছে। বাবার সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে তার চোখের পাতায়। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে রাশেদ কোনদিনই আর বলবে না ‘সোহা মা কোথায় তুই’। তাহলে কে তাকে খাইয়ে দিবে আদুর করে, কে তাকে গল্প করতে করতে স্কুলে নিয়ে যাবে ভ্যানে করে, কেই বা তার হাজারো আবদার পূরণ করবে শূন্য পকেটে! সোহাগীর অনুভব হচ্ছে সে এই পৃথিবীতে নেই! তার আশেপাশে কেউ নেই। এ যেন এক অদ্ভুত মায়াজাল। সে একা বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ছুটছে।

সোহাগী কে দৌড় দিতে দেখে সাফিদ দ্রুত পা চালালো। ভির ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই তার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। গৌধুলির ঝাপসা আলোতে দৃশ্যমান হলো, চোখের সামনে পড়ে থাকা তার আব্বার নিথর দেহ। কেউ চরম ভয়ঙ্কর ভাবে লোকটার সারা শরীর আঘাত করেছে। রাশেদের মুখের বিবরণ বুঝা যাচ্ছে ঠিকই তবে সমস্ত শরীর জুড়ে পোকার দলের ভির জমেছে! আশেপাশের লোকগুলো কেউ হাত দিয়ে কেউ আবার লুঙ্গির কাপড় তুলে নাক চেপে ধরেছে। বাজে দুর্গন্ধ! কিন্তু মেয়েটার নাকে কোনো গন্ধের ছোঁয়া নেই। সোহাগীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে লোকজন নানান কথা বলতে শুরু করে।

সোহাগীর পৃথিবী থমকে গিয়েছে। মাথা শূন্য হয়ে পড়েছে। মিনিট খানিক সে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলো রাশেদের ক্ষত মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলে। তার আব্বা পরম শান্তিতে চোখ বুজে রয়েছে। আশেপাশের মানুষের হাহাকার সোহাগীর কান অবধি পোছালো না। হঠাৎ মেয়েটা ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে এলোমেলো পায়ে পা বাড়ালো রাশেদ কে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ এসে সোহাগীর হাত টেনে ধরলো। সোহাগী কিছু বুঝে ওঠার আগে মেয়েটা কে যত্ন সহকারে আগলে নিলো নিজ বাহু ডোরে। নিজের বুকের সাথে সোহাগীর মাথা চেপে ধরলো সাফিদ। সে নিজেও অবাকের চরম সীমান্তে! এলাকায় এমন নৃশংস মৃত্যু সত্যিই অপ্রত্যাশিত তার নিকট। রাগে সাফিদের চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠলো।

সাফিদের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সোহাগী। সে যে পৃথিবীতে একা হয়ে পড়েছে! সোহাগীর মাথা হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সাফিদ। কী বলে সান্তনা দেবে এই বাচ্চা মেয়েটা কে? তার যে কিছু বলার ভাষা নেই। তাও বিনীত গলায় বললো,

— নিজেকে শক্ত করো। পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। একদিন সবাই কে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। এই ধরণীতে কেউ কারো জন্য বাঁচে না। সবাই নিজের জন্য বাঁচে! একদিন তোমাকে ও চলে যেতে হবে তোমার আব্বার কাছে। একেই বলে ধরণীর নিয়ম।

(সমাপ্ত)

[সরি সরি অনেক গুলো সরি। এই মাঝ পথে এসে উপন্যাসটার ইতি টানার মোটেও অভিপ্রায় ছিলো না আমার। কিন্তু আমিও যে স্বার্থপর। নিজ স্বার্থে আমাকে পিছুপা হতে হলো। পরীক্ষার মধ্যে আমার পক্ষে রেগুলার গল্প দেওয়া অসম্ভব! নিশ্চয়ই অনেকগুলো প্রশ্ন জাগছে আপনাদের মনে। রিমার কী হলো, বেঁচে আছে কিনা তাও অজানা! প্রিয়া এবং জুবায়েরের ভবিষ্যৎ কি হবে? প্রিয়ার রহস্যময় হাসির পিছনে কী লুকিয়ে রয়েছে? আমিরুলের কী হলো, কেনো বিয়ে করতে এলো না? রাশেদের নৃশংস মৃত্যু কীভাবে হলো? কে বা কারা রাশেদ কে খুন করলো। এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দ্বিতীয় খন্ড নিয়ে হাজির হবো খুব শীঘ্রই।
বিরতিহীন ১৫ টা পরীক্ষা। পরীক্ষার পর আবার চলে আসবো। দোয়া করবেন। এই কয়েক দিন ইরেগুলার হয়েছি যা গ্রুপ এর রুলস এর বহির্ভূত। আমি ক্ষমা প্রার্থী। আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here