সোহাগী পর্ব ১২

0
419

#সোহাগী
#পর্ব :১২
Lutful Mehijabin

চৌকির উপর কাত হয়ে শুয়ে ছিলো সোহাগী। আজ একবার ও কাঁদে নি মেয়েটা। সেই সকাল থেকেই সে উদাসীন মনে ভেবে চলছে রাশেদের সাথে অতিবাহিত মধুর স্মৃতিগুলো। আব্বার আগমনের অপেক্ষায় তার ভেতরটা ছটফট করছে। ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো তবুও কেউ তার মুখে এক মুঠো ভাতের দানা তুলে দেই নি। এমনকি তার খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তার আদরের নানীও নিজ স্বার্থের কাছে হেরে গিয়েছে। সব মিলিয়ে সোহাগী তিক্ত বাস্তবতার অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। অনুভব করছে বাস্তবতা বড়োই কঠিন। পৃথিবীতে বাবা- মা ব্যতীত সবাই যেন বড্ড স্বার্থপর! তবে পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক বাবা-মাও নানান ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতি উদাসীন, নিজ স্বার্থে সন্তানকে অস্বীকার করতে মোটেও অনুতাপ হয় না। তারা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্বার্থপর! ঠিক যেমনটা সোহানার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এক ধ্যানে উন্মুক্ত আকাশে দৃষ্টি রেখে আকাশ কুসুম কল্পনা করে যাচ্ছে সোহাগী। হঠাৎ দরজা চাপানোর মৃদু শব্দ কর্ণপাত হতেই স্বল্প কেঁপে ওঠে সে। ঘরে কেউ এসেছে? সামান্য নড়েচড়ে বসলো সোহাগী। মানুষ জনের কোলাহল তার ভালো ঠেকছে না।

— সোহা,,

সোহানার কোমল কন্ঠস্বর শুনে সোহাগীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। আজ কতোকাল পর সোহানা তাকে এতো ভালোবাসার সহিত আদুরে গলায় ডেকেছে, তার কোনো হিসেব নেই!

— তুই এমনে উপড় হইয়া শুয়া আছিস কেন! তাড়াতাড়ি উঠ তো মা। যা গিয়ে কলপাড়ার থাইকা পরিষ্কার হইয়া আই তো। জমিলা, রুমা তোরা আই তো এখানে।

মায়ের আচরণে বেশ আনন্দিত হলো সোহাগীর ছোট হৃদয়। মন বললো, মা বুঝি তার বিষন্নতা সহ্য করতে না পেরে আমিরুলদের না করে দিয়েছে। হয়তো সোহানা তার উপর করুণা করেছে। এসব ভেবে মুহূর্তেও অপেক্ষা করলো না সোহাগী। মুখের উপর থাকা বালিশটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে বসলো। সোহানার দিকে একবার তাকিয়ে আশেপাশে লক্ষ্য না করেই ঝাপটে ধরলো সোহানা কে।

আচমকা সোহাগীর ছোঁয়া পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন সোহানা। তবে মেয়েটা অবশেষে তার কথা খুশী মনে মেনে নিলো। সোহাগী তার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে! কঠিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সোহানা কে। মেয়েটার চোখের জল সোহানার হৃদয় কতটুকু পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে তা বলা মুশকিল! তিনি মুচকি হেসে সোহাগীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। এক হাত সোহাগীর পিঠে অন্য হাত মাথায় রেখে বলে উঠলেন,

— এতো কান্দিস না। এখন কানলে তোর চোখ গর্তে চইলা যাইবো।

সোহানার কথার সারমর্ম বুঝে উঠতে পারলো না সোহাগী।

— ইশ! কান্দা বাদ দিয়ে উঠো তো মা। জমিলা, রুমা আর কতক্ষণ দাঁড়ায় থাকবো। একটু পর তো জামাই বাবাও চইলা আইবো।

সোহানার শেষোক্ত বাক্য কর্ণকুহুরে পৌঁছানো মাত্রই চমকে উঠে সোহাগী। তার মানে সে ভুল ভেবেছিলো! তৎক্ষণাৎ ঝড়ের বেগে সোহানা কে ছেড়ে দিয়ে, দূরে সরে এলো। বিছানা ত্যাগ করে শাড়ির আঁচল দু হাতের মুঠিতে চেপে ধরলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো তার। কিন্তু না, সজরে গলা ফাটিয়ে সে কাঁদতে পারলো না। শুধু মাত্র তার মূল্যহীন চোখের নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো যত্রতত্র! প্রতিবাদ স্বরে এক দমে বলে উঠলো,

— আমি মরে গেলেও বিয়া করবো না আম্মা। কতবার বলবো, আব্বা আসুক তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে। আমার আব্বা চাই না আমার বিয়ে হোক। আব্বা চাই আমি যেন পড়াশোনা করি। তুমি ওই বেডা দের নিষেধ করে দেও।

সোহাগীর কথাগুলো শেষ হওয়ার মাত্র সোহানা সজোরে এক থা’প্পড় মেরে বসলেন মেয়েটার কোমল গালে। সোহাগী কিছু বুঝে উঠার আগে তার চুলের মুঠো চেপে ধরেন। অতঃপর সোহানা দাঁত চেপে বলে উঠেন,

— কী বললি তুই বিয়ে করবি না তাই তো? আবার বল,,

চুলের গোড়ায় ব্যথায় অনুভব করলো সোহাগী। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। অথচ সোহানার প্রত্যুত্তরে নাছোড়বান্দা ন্যায় বলে উঠে,

— হ্যাঁ আম্মা, আমি বিয়ে করবো না। দরকার পড়লে পালিয়ে যাবো তবুও করবো না বিয়ে।

মুহূর্তেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠেন সোহানা। অদ্ভুত কান্ড করেন! সোহাগীর চুলের মুঠো ছেড়ে দূরে সরে আসেন। মিনিট দুইয়েক প্রাণ খুলে হাসলেন। এমন পরিস্থিতিতে সোহাগী কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই মুহূর্তে সোহানার হাসি বেমানান! সোহাগী কিছু বুঝে ওঠার আগে সোহানা ফির এগিয়ে এলেন মেয়েটার নিকটবর্তী।

— সত্যিই তো করবি না?

কথাটা ফিসফিসে বলে উঠেন সোহানা। বিস্ময়ের সাথে সোহাগী অস্পষ্ট গলায় উত্তর দেয়।

— না।

সোহাগীর উত্তর পেয়ে নিমিষেই সোহানার মুখশ্রী রুপ পরিবর্তন হলো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো পৈশাচিক হাসির রেখা। সোহাগীর কানের নিকট মুখ নিয়ে এলেন তিনি। অতঃপর ফিসফিসে কিছু বললেন। যা শুনে সোহাগীর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে সে বলে উঠলো,

— না আম্মা, এমনটা করো না। তুমি যা করবা আমি তাই করবো। আমাকে মাফ করে দেও আম্মা। আমি বিয়ে করবো তো।

কথাগুলো শুনে সোহানা মেয়েটার থুতনিতে স্পর্শ করলেন। মুচকি হেসে বলে উঠেন,

— এই তো ভালো মাইয়া! কথাটা মনে থাকে যেন। তুই যদি বিয়ে না করিস তাহলে,,,

সোহানার বাক্য সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই সোহাগী বলে উঠে,

— সত্যি মা আমি করবো বিয়ে। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করবো না। তুমি শুধু এমনটা করো না।

— ঠিক আছে। যা তবে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আই। জমিলা, রুমা সাজিয়ে দিবো। আর আমি ভাত পাঠাইতেছি তুই খাইয়া নিস। বাসর ঘরে তোর জামাই যদি দেহে মুখ কালা, চোখের নিচে কালি, ঠোঁট শুকনা তাইলে কী হইবো জানিস! আমারে খারাপ কইবো। কইবো পচা মা’ল ধরাইয়া দিছি। তাই খাইস কইলাম।

কথাগুলো শুনতেই কেঁপে উঠলো সোহাগী। তার মা এতো নিষ্ঠুর কেন? তার আব্বার অর্ধাঙ্গী এমন পাষাণভার বিষয়টা সত্যিই আশ্চর্য জনক তার কাছে। বর্তমানে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানবী বলে মনে হচ্ছে। বুক চিরে কান্না আসছে। তার আব্বা আসবে কবে ফিরে! কেন সে সোহানার গর্ভে জন্ম নিলো। সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে অন্য কোন নারীর গর্ভের সন্তান বানালো না। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে সোহাগীর।

তড়িঘড়ি করে সোহানা চলে গেলেন। চোখের পানি মুছে ফেললো সোহাগী। এখন আর কেঁদে কোন লাভ নেই! তাকে শক্তিশালী হতে হবে। এতটুকুতে ভেঙে পড়লে চলবে না। মুহূর্তেই হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়লো সে। দরজার দিকে চোখ দিয়ে দেখলো, কেউ নেই। জামিলা আর রুমা এসেছিলো কিন্তু চলে গিয়েছে। চোখ জোড়া বন্ধু করে সোহাগী বলে উঠলো,

— আল্লাহ আমার এতো বড়ো পরীক্ষায় ফেললে কেন? আমি যে আর পারছি না। আমার আব্বা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও। আমাকে শক্তি দেও। আমাকে প্রগাঢ় ক্ষমতা দেও যেন পৃথিবীর কোনো ঝড় আমাকে আঘাত করার ক্ষমতা না রাখে। আব্বা কে আমার কাছে ফিরিয়ে দেও আল্লাহ! আমি শুধু একবার আব্বা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই। তার কষ্ট, যন্ত্রণা সবকিছু আমাকে দিয়ে দেও। আমি আর কিছু চাই না। শুধু আব্বার মুখে বিজয়ের হাসি দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে তার গর্ব ভরা চলের জল দেখতে চাই। আমাকে শক্তি দেও আল্লাহ। বলো তো তুমি ব্যতীত আমার আর কে আছে? তুমি যদি তোমার বান্দর কথা না শুনো তবে তোমার বান্দা যে দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়বে।

_______________

চৌকির উপর সারি বেঁধে বসে রয়েছে কয়েক জন মহিলা। তাদের ঠোঁটে মুখে উপচে পড়া হাসির ধারা। সোহাগীর দিকে তাকিয়ে তারা মিটি মিটি হেসে চলছে অবিরাম! কয়েক জন বয়স্ক মহিলা গীত গেয়ে পরিবেশটা আরো আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টা করছে। তাদের ঠিক মধ্য খানে বসে রয়েছে সোহাগী। পরনে তার মোটা জামদানি শাড়ি! মেয়েটার সারা শরীর জুড়ে ভারী অলংকার! গলায় পরু হাড়, দু হাতে পুরু বালা, দু কানে ঝোলানো দুটো দুল, নাকে নথ, সিথি বরাবর ছোট টিকলি সব মিলিয়ে দারুণ দেখাচ্ছে মেয়েটা কে। তবে অলংকারের সাথে তার স্বাস্থ্য যেন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! খানিক পূর্বে ভুঁইয়া বাড়ির পক্ষ থেকে গয়না গাটি সহ যাবতীয় সবকিছুই দিয়ে গিয়েছে কয়েক জন যুবক। অলংকার দেখে সোহাগীদের বাড়িতে আগত প্রায় সকালেই সোহাগী কে ভাগ্যবান বলে গণ্য করছে। সত্যি তো ভাগ্যবান না হলে কী এতো দামী অলংকার পড়ার সৌভাগ্য হতে মেয়েটার!

— সোহানা তোমার মাইয়ার মুখখান কালা হইয়া রয়েছে কেন? ভয় পাইতেছে বুঝি?

মহিলা গুলোর মধ্যে থেকে একজন অর্ধ বয়স্ক মহিলা হঠাৎ কথাটা বলে উঠেন সোহানার উদ্দেশ্যে। মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো চারপাশে। জমিলা নামের মেয়েটা সোহাগীর খোপা করতে ব্যস্ত ছিলো। তৎক্ষণাৎ রসিকতার ছলে মেয়েটা বলে উঠলো,

— বিয়ে আগের দিন আমি ও ডরাইছিলাম। কিন্তু পরে,,

আর কিছু বলতে পারলো না জমিলা। নিমিষেই তার মুখখানা রঞ্জিত হয়ে উঠলো লাল আভায়। তার অবস্থান লক্ষ্য করে বৃদ্ধ মহিলা ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। তার গাল ভর্তি ছিলো একগাদা পানের রস। তিনি অতি দ্রুত রস ফেলে দিয়ে বলে উঠেন,

— হ হ আর শরম পাইতে হইবো না। সব মাইয়ারাই শশুড় বাড়ি যাওনের আগে কান্দে ভাসায়। কিন্তু পরের দিনই মাইগো দেমেগ বাইরা যাই। স্বামীর সোহাগী পাইয়া বাপের বাড়ির মানুষ গো ভুইলা যাই। আ্যজ সোহা কানতেছে তো কী হইছে। কাল দেখবা জামাইরে ছাড়া কিছু বুঝবো না। ও তোরা সোহারে ঢক কইরা সাজা যেন ওর রুপে জামাই বাবা পাগল হইয়া যায়।

বৃদ্ধ মহিলার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই পুনরায় ঘর ভর্তি থাকা মানুষগুলো অট্টহাসিটে ফেটে পড়লো। রুমা সোহাগীর পায়ে আলতা পড়ানো থামিয়ে হাসির সহিত বলে উঠে,

— পাগল তো হইবো। তয় শুনলাম বেডার নাকি আগে বিয়া হইছিলো। তা কাকি তোমরা সোহারে বিয়াত্তা বেডার লগে ক্যেন বিয়া দিতেছো। মানলাম ভুঁইয়া বাড়ির পোলা কিন্তু যাগো একটা বউ থাকে তারা নাকি দ্বিতীয় বউরে সহ্য করবার পারে না। আর ওই বেডার তো একখান ছাওয়াল ও আছে! ওই ছাওয়ালরে পাললে সোহাগী নিজের পোলাপান পালবো কখন? সৎ পোলাপান নিয়ে সংসার করা বহুত কষ্ট।

রুমার কথাগুলো শুনে ক্রোধে ফেটে পড়েন সোহানা। ইতোমধ্যে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে পড়েছে, সবাই চুপ কারো মুখে কোনো কথা নেই! লহমায় সোহানা ক্ষোভের সহ্য রুঢ় কন্ঠে রুমাকে বলে উঠেন,

— আমার মাইয়াডার কান ভাংগাস কেন ছেমড়ি? সৎ ছাওয়াল নিয়ে সংসার করলে কী হয়! মানলাম সৎ কোনদিন আপন হইবো তয় কী হয়েছে, আমার মাইয়া সব সামলায়ে নিবো। দেখিস আমার মাইয়া তগো চেয়ে সুখী হইবো। জামাইয়ের মহব্বত দিয়ে সুখ কিনা যাই না। জীবনে সবচেয়ে বড়ো সুখ হইলো টাহা। টাহা ছাড়া জীবন চলে না। যার যতো টাহা সে ততো সুখী। আমার মাইয়া রাজরানী হইবো। ভুঁইয়া বাড়ি রাজত্ব করবো। বুঝছোস?

সোহানার কথাগুলো শুনে সোহাগীর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কয়েক জন মহিলা সোহানার তালে তাল মিলালেন। ধন সম্পদ হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুখ! সত্যি কি সম্পদ মানুষ কে সুখ, আনন্দ, প্রশান্তি দিতে পারে? সংসারে শান্তি নিয়ে আসে!

(চলবে)
[পরীক্ষার চিন্তায় আমার অবস্থা শোচনীয়। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here