সূর্যশিশির পর্ব ৯

0
358

সূর্যশিশির
৯.
ফাইয়াজ কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় মানুষজনের ভিড় দেখে একপাশে বাইক থামালো। তার মাথায় হেলমেট। হেলমেট পরা অবস্থায় সে ভিড় ঠেলে ‘সুমনা হোটেলের’ সামনে এসে দাঁড়ায়। হীরা তখন হিংস্র রূপ ধারণ করেছে। সে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ছু’রি নিয়ে তেড়ে আসে রূপার দিকে। রূপা বারেক মিয়াকে সরিয়ে দুটো জগ তুলে নিলো হাতে। হীরা কাছে আসতেই জগ দিয়ে তার রেগে থাকা বিকৃত মুখ বরাবর আঘাত করে৷ ঠিক তখনই হীরার ছু’রিটি রূপার কাঁধে সৃষ্টি করে গভীর ক্ষত।

সঙ্গে সঙ্গে র’ক্তের স্রোত নামে। রূপা ব্যথায় আর্তনাদ করে দুই কদম পিছিয়ে গেল। চোখের পলকে দূর্ঘটনাটি ঘটে যায়, ফাইয়াজ প্রথমে বুঝে উঠতেই পারে না এখানে ঠিক কি হচ্ছে!

রূপার দেয়া আঘাতে হীরার নাক ফেটে র’ক্ত বেরিয়ে আসে। সে অনামিকা আঙুলে নাক ছুঁয়ে র’ক্তের স্পর্শ অনুভব করে। নিজ নাকের রক্তে রাঙা আঙুল দেখে হয়ে ওঠে আরো ক্ষুব্ধ।
পুনরায় বিশ্রী গালিগালাজ করে ছু’রি নিয়ে তেড়ে এলে ফাইয়াজ দ্রুত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

সাবধানতার সঙ্গে হীরার দুই হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে বললো, ‘দিনদুপুরে হাতে ছু’রি নিয়ে কীভাবে কাউকে আঘাত করতে পারো তুমি? হাত নামাও।’

হীরার চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। সে কিড়মিড় করে বললো, ‘শু’য়োরের বাচ্চা সর এখান থেকে।’

গালি শুনে ফাইয়াজের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল।
র’ক্তে শুরু হলো তীব্র মিছিল। সে নোংরা গালিগালাজ ঘৃণা করে। ফাইয়াজ কৌশলে হীরার হাত মুচড়ে ধরে ছু’রি ছিনিয়ে নিলো, ছুঁড়ে মারলো দূরে।

হীরা হাতাহাতি করে নিজেকে ছাড়িয়ে ফাইয়াজের শার্টের কলার ধরতে এলে ফাইয়াজ শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে তার গালে থাপ্পড় মারলো। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বললো, ‘ ইডিয়ট!’

দুলাল নিজের বিস্ময়তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না! বিস্ময়ের সাথে এবার মনে জেঁকে বসে ভীতি। এসব কি হচ্ছে? এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। সে পিছাতে পিছাতে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেল।

হীরা কিছুতেই থেমে যাওয়ার ছেলে নয়। সে তার হৃদয়ে অনুভব করছে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। বিধ্বস্ত হীরা দুই হাতে বেঞ্চি তুলে নেয় ফাইয়াজের উপর ছুঁড়ে মারার জন্য। ডাঙায় উঠা মাছের মতো ছটফট করছে সে। বারেক মিয়া এবার এগিয়ে এলেন। ফাইয়াজ ও বারেক দুজন একসাথে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

বাজার কমিটির চারজন সদস্য এসে প্রবেশ করে হোটেলে। দুজন দ্রুত হীরাকে চেপে ধরে। টেনে নিয়ে যায় বাইরে। পিছু পিছু দৌড়ে বেরিয়ে যায় দুলাল। হীরা শেকল পরা শেয়ালের মতো ছটফট করছে। বার বার বলছে , ‘দেখে নেব, সব কয়টাকে দেখে নেবো। পুঁতে দেবো মাটির সাথে। শু’য়োরের বাচ্চারা।’

বাকি দুজন সদস্যের মধ্যে একজনের নাম কামরান। তিনি বারেক মিয়াকে বললেন, ‘কী হইছে এখানে? এতো কিসের ঝামেলা হা?’
তার কর্কশ কণ্ঠ। যেন দোষ বারেক মিয়ার।

বারেক কিছু বলার আগে ফাইয়াজ বললো, ‘দিনদুপুরে একটা অসভ্য ছেলে ছুরি নিয়ে হাঙ্গামা করছিল আর আপনারা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে ধমক দিয়ে ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন করছেন?’

কামরান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। গম্ভীর সুরে বললেন, ‘কে আপনি?’

‘দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক।’

ফাইয়াজের দৃঢ়তা ও চোখমুখের ভঙ্গি দেখে কামরান আর কথা বাড়ালেন না। এ ধরনের লোকেরা নীতির কথা বলে বেশি! তিনি বারেক মিয়াকে বললেন, ‘সন্ধ্যায় বৈঠকখানায় আসবেন স্বাক্ষীসহ।’

রূপা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার এক হাত আহত স্থানে চেপে ধরা। রক্তপাত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বৈঠকখানায় যেতে হবে শুনে রূপা ভড়কে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বাজার কমিটির সদস্যদের সাথে হীরার ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। এরা বাজারের দায়িত্বে থাকলেও সবকটা স্বার্থপর। ন্যায়বিচারের থেকে ক্ষমতাকে বেশি মূল্যায়ন করে। অসহায়দের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়।

এখন যদি চক্রান্ত করে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়! তখন এতো বড় সংসার কীভাবে চলবে?
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকায় রূপা কুঁকড়ে ওঠে। ছলছল নয়নে বারেক মিয়ার দিকে চেয়ে থাকে। এই ভয়েই বারেক মিয়া কখনো প্রতিবাদ করেননি। নিশ্চয়ই এখন তিনি কামরান নামক মানুষটির হাতেপায়ে ধরবেন অথবা দরজা বন্ধ করে কাঁদবেন! মানুষটা তো এমনই।

কিন্তু রূপাকে অবাক করে দিয়ে বারেক জোর গলায় বললেন, ‘স্বাক্ষী প্রমাণসহ সন্ধ্যায় চলে আসবো। বেজন্মাটাকেও বলবেন যেন স্বাক্ষীসহ উপস্থিত থাকে।’

কামরান আশ্চর্য হয়ে গেলেন। গম্ভীরমুখে একবার ফাইয়াজ আরেকবার বারেককে দেখলেন। এই লোকটার উপস্থিতি কি বারেকের এতো সাহসের কারণ? নয়তো বারেক তো কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলে না! তিনি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে নিজ সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে যান। হীরার চিৎকার তখনো ভেসে আসছে। পাগলা কুকুরের মতো চেঁচাচ্ছে সে!

ফাইয়াজ শার্টের কলার ঠিক করে পিছনে ঘুরে তাকালো। রূপাকে একনজর দেখে বারেক মিয়াকে বললো, ‘মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। দ্রুত জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে। রক্তপাত হচ্ছে।’

কথা শেষ করেই বেরিয়ে পড়ে। ক্ষুধায় পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে।

বারেক গলার গামছা রূপার কাঁধে চেপে ধরে বললেন, ‘তোর রঞ্জন মামার দোকানে চলে যা। আমি জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে আসতেছি। যা।’
_
র’ক্ত শার্ট বেয়ে প্যান্ট অবধি চলে এসেছে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো চিৎকার করে কাঁদতো অথবা এতো র’ক্ত দেখে বেহুশ হয়ে যেত। রূপা দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করছে। সে ধীরে ধীরে রঞ্জন দত্তের ফার্মেসীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফাইয়াজ বাইক নিয়ে বাড়ির দিকে চলেই যাচ্ছিলো। রূপাকে এই তীব্র রোদের মাঝে আহত অবস্থায় একা হেঁটে যেতে দেখে বাইক ঘুরিয়ে নিলো। রূপা ফার্মেসী অবধি পৌঁছাতেই ফাইয়াজও পৌঁছে গেল। দুজনের চোখাচোখি হলেও কেউ কোনো কথা বললো না। ফাইয়াজ বাইকেই বসে রইলো।

রঞ্জন বই পড়ছিলেন। রূপাকে দেখে চট করে উঠে দাঁড়ান। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, ‘ কাঁধে কী হলোরে মা ? এতো রক্ত বেরোচ্ছে! এদিকে আয়।’

ফাইয়াজ পেছন থেকে বললো, ‘গুন্ডাপুন্ডাদের সাথে মারামারি করেছে। একটু ভালো করে দেখুন, ক্ষত হয়তো গভীর।’

রঞ্জন রূপাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে বসালেন। রূপার পরনের শার্টের বোতাম গলা অবধি লাগানো। সবসময় এভাবেই পরে। যতই গরম পড়ুক গলা অবধি বোতাম লাগিয়ে রাখবেই।

রঞ্জন ক্ষত পরিষ্কারের সরঞ্জাম নিয়ে শার্টের প্রথম বোতামটি খুলতে চাইলে রূপা আটকায়।
সে বোতাম খুলতে সংকোচবোধ করছে।

ফাইয়াজ হেলমেট খুলে চুলগুলো হাতে নাড়াচাড়া করে নিলো। চুল ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। বার বার বলার পরও যখন রূপা শার্টের প্রথম বোতামগুলো খুলছিল না তখন ফাইয়াজ বললো, ‘চিকিৎসায় এতো লজ্জা কীসের? আর দুই তিনটে বোতামই তো। এইতো আমারও খোলা। এতে আমার কি সর্বনাশটা হয়ে গেল?’

রূপা চোখ তুলে তাকায়। মনে মনে বুলি আওড়ায়, ‘আরে ব্যাঠা তুই সামনে থেকে চলে গেলেই তো আমি বোতাম খুলি। সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলছে?’

মুখে বললো, ‘লজ্জা না স্যার। অভ্যাস নেই তাই অস্বস্তি হচ্ছে।’

ফাইয়াজ বললো, ‘আংকেল এক কাজ করুন, শার্টের ওই অংশটা কেটে ফেলুন।’

রূপার মাথা ভনভন করছে। চোখ দুটি বার বার বুজে আসছে৷
ফাইয়াজের কথামতো রঞ্জন কেঁচি দিয়ে ক্ষত স্থান থেকে শার্টের একাংশ কেটে ফেলেন। এরপর ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘ক্ষত তো খুব গভীর! সেলাই লাগবে মনে হচ্ছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here